03/06/2025
#নেমপ্লেট #গল্প ( শেষ অংশ)অরিত্রা যেতেই মোহনা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।লিভিং রুম খুঁটে খুঁটে দেখতে শুরু করে।একটু ঘুরে তাকাতে রুমের একদিকের ঝকঝকে হালকা কমলা রঙের দেওয়ালে অরিত্রার আপাত সুখী বিবাহিত জীবনের কিছু মুহূর্ত ফ্রেমবন্দিরত অবস্থায় চোখ পড়ে।সবই একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একসঙ্গে বাইরে বেড়ানোর দৃশ্য।তারমধ্যে একটি ছবিতে কৌস্তভ অরিত্রার গালে চুম্বনরত।মোহনা চোখ সরিয়ে নেয়।সোফায় গিয়ে বসে।ইতিমধ্যে অরিত্রা চা ও স্ন্যাক্স নিয়ে আসে।দুই বান্ধবী ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেয়।মোহনা কিছু বলার পূর্বেই অরিত্রা মোহনাকে জিজ্ঞাসা করে, "আমার জীবনের গল্প অনেক শুনলি। এবার বল তো তুই বিয়ে করিসনি কেন ?"
মোহনা উচ্ছসিত হয়ে বলে,"কে বলেছে আমি বিয়ে করিনি!"
অরিত্রা ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে বলে "মানে !"
মোহনা তারপর ম্লান হেসে বলে,"আমি ডিভোর্সী রে।"
অরিত্রা কৌতূহল সহকারে বলে," তুই এসব কি বলছিস ?"
মোহনা তার হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে বলে "হ্যাঁ রে।তোর অনিকেতকে মনে আছে?"
"অনিকেত মানে কলেজের অনিকেতদা ! মনে আবার থাকবে না।কলেজে তোর পেছনে ঘুর ঘুর করে বেড়াত ।"
"হ্যাঁ সেই অনিকেত ! কলেজ ছাড়ার পর যখন ইউনিভার্সিটি ভর্তি হলাম। অনিকেতও আমার পিছু পিছু সেখানে গিয়ে ভর্তি হল।এরপর ওকে আর না করতে পারিনি।টানা প্রেমের জোয়ারে ভেসে বেরিয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস অফ্ করে প্রায়ই শহরের অলিগলি ঘুরে দিন কাটে।এরইমধ্যে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির চেষ্টা করলাম দুজনে।অবশেষে আমার স্কুলে হল । ও নেট পরীক্ষা দিয়ে কলেজের চাকরির ইন্টাভিউ দিল।"একটানা কথাগুলি বলতে বলতে মোহনা টেবিল থেকে জলের গ্লাস হাতে নেয়। কথার মাঝে অরিত্রাকে বলে "দ্বারা একটু জল খেয়ে নিই।"
অরিত্রা বলে "ঠিক আছে।"
জল খেয়ে সে পুনরায় বলতে শুরু করে,"আমি যে বছর স্কুলে চাকরি পেলাম,তারপর দুবছর পর ও কলেজে অধ্যাপনার চাকরিটা পেল।"
অরিত্রা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে "বাহ্ দারুণ ব্যাপার তো !"
মোহনা বলে ওঠে "আগে পুরোটা শোন।"
অরিত্রা উচ্ছ্বাস সংযত করে বলে "বল।শুনছি।"
মোহনা বলতে শুরু করে,"আমাদের দুজনের কাস্ট আলাদা হওয়ায় দুই বাড়িতে প্রথমে আপত্তি উঠলেও পরে আমাদের চাপে মেনে নেয়। দিনক্ষণ দেখে তারপর কলাতলায়।বিয়ে করার পর আবেগে ভাসলাম।খাওয়া দাওয়া বেড়ানো সবই চলল টানা এক দু বছর।"
অরিত্রা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,"তাহলে এমন কি ঘটল যে সম্পর্কটা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ালো!"
মোহনা একটু মৃদু হেসে পুনরায় বলতে শুরু করে," "তুই জানিস আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।আধুনিক মানসিকতার মেয়ে।"
অরিত্রা বলে,"হ্যাঁ জানতাম তো।"
মোহনা বলে,"সেখানে কিনা আমাকে নিয়মের বেড়াজালে অহেতুক বন্দী করার চেষ্টা !টিপিক্যাল কনজারভেটিভ ব্রাহ্মণ ফ্যামিলি।বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু না বললেও একবছর কাটতে না কাটতেই শুরু হল বৌমা যখন তখন বাড়ির বাইরে বেরোবে না,বৌমা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে,বৌমা তুমি কোন বাড়ির বউ ভুলে যেয়ো না..আমি জাস্ট নিতে পারছিলাম না।নিজের ছেলের বেলা সব ছাড় !"
অরিত্রা বলে ওঠে,"অনিকেতদা কিছু বলত না মাসিমা মেসোমশাইকে !"
মোহনা এবার একটু গলার জোর বাড়িয়ে বলে "ওখানেই তো সমস্যার শুরু ।বিয়ের আগে ছিল গদগদ প্রেমিক।আর বিয়ের পর বুঝলাম আস্ত একটা হিপোক্রেট ।জেনেশুনে ওরকম ও ওর ঐ গোঁড়া মানসিকতাসম্পন্ন ফ্যামিলিতে নিয়ে গেল।কথায় কথায় বলতে শুরু করল মোহনা তুমি এখন বাড়ির বউ।তুমি চাকরি করলেও আমার বাবা মায়ের একটা এক্সপেক্টেশন আছে ।তারা যেভাবে তোমাকে চাইছে মানিয়ে নাও।অনিকেতের কথা শুনে মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু সব সীমা অতিক্রম করল যখন বিয়ের চারবছর পরও আমাদের কোনো বেবি হল না।জানিস কিছুতেই কনসিভ করতে পারছিলাম না।আমাকে কলকাতার বড় বড় গাইনোকোলজিস্ট এর কাছে ট্রিটমেন্টের জন্য নিয়ে গেল।কত রকম টেস্ট চলল !আলটিমেটলি রেজাল্ট এল আমার সব রিপোর্ট নরম্যাল।"
অরিত্র উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে বসে, "তাহলে কি সমস্যা অনিকেতদার ছিল !" রাখী দে দত্ত
মোহনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে,"একদম।ওর সমস্যা ছিল।বাবা হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ।আমার রিপোর্ট নরম্যাল হওয়ায় আমার সন্দেহ হয়েছিল।আমি জোর করে ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই তারপর বিষয়টা বুঝতে পারি। এই ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আসতেই অনিকেত আমার সঙ্গে কেমন খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল।তার সঙ্গে ওর মা - বাবা।আমাকে প্রায় শাসানির সুরে বলে কিনা,দেখো বৌমা আমাদের ভদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার। পাড়ায় সম্মান আছে।অনিকেতের সমস্যার ব্যাপারটা রাষ্ট্র করলে ওর মানসম্মান ধূলায় মিশে যাবে,তাই তোমাকে কেউ বাচ্চা নেওয়ার বিষয় কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ বুজে থাকবে।"
অরিত্রা সবটা শুনে অবাক।কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে "তুই তারপর কি করলি ?"
মোহনা বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোহনাকে বলে,"আমি কি দমে যাওয়ার পাত্রী।বলে বসি আমি মুখ বুজে থাকব কেন!"অনিকেতের মা আমার কথা শুনেই তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলেন, "কেমন মেয়ে তুমি !নিজের স্বামীর জন্য এটুকু পারবে না ।এই না তোমাদের ভালোবাসার বিয়ে।"
এসব কথা শুনে আমিও সটান বলে দিই,"সমস্যাটা আমার থাকলে তোমাদের ছেলে চুপ থাকত বা তোমরা বিষয়টা মেনে নিতে!" অনিকেতের মা বলে,"সে পুরুষমানুষ সে কেন দোষ নেবে।"আমিও তখন রেগে গিয়ে অনিকেতের মাকে বলি "ও আচ্ছা বুঝেছি! যত দায় বাড়ির বউমাদের!সে যতই শিক্ষিতা চাকুরিরতা হোক না কেন!আসলে মেয়েমানুষ তো.."
অরিত্রা যত শুনছে ততই তার চোখ বড় হয়েছে।সে পুনরায় মোহনাকে বলে "তারপর কি করলি ?"
মোহনা জানায়,"সেখানে তখন অনিকেতও উপস্থিত ছিল।আমি জোর গলায় অনিকেতকে জিজ্ঞাসা করলাম। তুমিও একই কথা বলবে তো !
অনিকেত কোনো উত্তর দেয়নি।তারপর আমিও সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করিনি।" এরপর চুপ করে যায় মোহনা। অরিত্রা সোফা ছেড়ে উঠে মোহনার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।মোহনার কাঁধে দুইহাত রাখে।মোহনা পেছনদিকে মাথা ঘুরিয়ে অরিত্রাকে বলে,"জানিস তো অরিত্রা মফঃস্বল শহরের আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিতা বিবাহিতা মেয়েদের মানসিক দ্বন্দ্ব অনেক বেশি।মন থেকে না পারে তারা সমাজ সংসারের গতানুগতিক আচার নিয়মকানুন মানতে ,না পারে তারা সম্পূর্ণ এড়াতে।একরকম দোআঁশলা জীবন !অথচ কি আশ্চর্য সুখী থাকার অভিনয় তারা দিব্যি করে যেতে পারে !আমি সেই সুখী থাকার অভিনয় করতে পারিনি। অনিকেতের সঙ্গে কথা বলে মিউচুয়াল ডিভোর্সের জন্য অ্যাপ্লাই করি। চাকুরীরতা সন্তানহীনা।খোরপোষের বিষয় নেই। ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।"
মোহনার কথা শুনে অরিত্রা ম্লান গলায় বলে, "অনিকেতদা এত ভালোবাসত তোকে ! এত সহজে তোকে ডিভোর্স দিতে রাজি হয়ে গেল!"
মোহনা তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,"রাজি হবে না আবার ! বাবা মায়ের দুগ্ধ পোষ্য শিশু দুধের দাঁত না পড়তেই আমাকে জীবনসঙ্গী বানিয়েছিল।"
অরিত্রা মোহনাকে জিজ্ঞাসা করে "তুই আর ছাদনাতলায় গেলি না !"
মোহনা উচ্চ স্বরে হেসে বলে,"ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।দাম্পত্যের নামে দিনের পর দিন গুমরে মরেছি অনিকেত ও তার ফ্যামিলির জন্য।জীবনের সবচাইতে জঘন্য সিদ্ধান্ত ছিল।একবার যখন মুক্তি পেয়েছি দ্বিতীয়বার সে ভুল করি !জীবনে ভালো থাকার অধিকার সকলের রয়েছে।তার সঙ্গে আর কোনো আপোষ নয় অরিত্রা।নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি নিজের কাছেই থাকুক।মা না হলে নারীজীবন বৃথা ,ওই কনসেপ্টে আমি একদম বিশ্বাসী নই।একজন টিচার হিসেবে স্কুলের কত ছেলেমেয়েকে সন্তান রূপে পেয়েছি।ওদের আদর - স্নেহে ভরিয়ে দিই।এতেই এখন মনের আনন্দ খুঁজে পাই।"
অরিত্রা মোহনার কাঁধ থেকে হাত দুটি সরায়।ধীর পায়ে এগিয়ে সোফায় নিজের জায়গাতে গিয়ে বসে।তারপর চিন্তান্বিত কণ্ঠে বলে,"তবু শেষ বয়সে একা থাকবি !"
মোহনা আবার স্বমহিমায় বলতে শুরু করে,"দেখ অরিত্রা আমাদের সোসাইটিতে আজও ডিভোর্স নিয়ে ছুতমার্গ রয়েছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারে একছাদের নীচে কোনো বিবাহিতা মেয়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে না পেরে দমবন্ধ হয়ে মরলেও কেউ একা জীবন কাটানোর কথা কল্পনা করতে পারে না।কারণ একটাই লোকে কি বলব !আর তুই আমাকে জানিস আমি কোনোদিনই সমাজের একপেশে নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা বিশেষ করিনি।" রাখী দে দত্ত
অরিত্রা বলে,"তোকে খুব ভালো করেই জানি!"
মোহনা বেশ জোরালো গলায় বলে,"শোন অরিত্রা আমাদের মেয়েদের নিজস্ব একটা আইডেন্টিটি থাকা ভীষণ দরকার এবং স্বাধীনতাও দরকার যা আমার এখন আছে।তাই বলে আমি আমার নীতিবোধ ও মূল্যবোধের সীমানা লঙ্ঘন করি না।আর কি চাই জীবনে !শেষজীবনে কাউকে প্রয়োজন নেই।বরং তোর জন্য একটু করুণা হচ্ছে !একজন স্বাধীনচেতা এডুকেটেড মেয়ে সে কিনা গোটা জীবনটা কিচেনে তেলমশলার হিসাব নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে !"
মোহনার কথা শুনে অরিত্রা এবার আমতা আমতা করে বলে,"ঠিক তা নয় মোহনা।আমি যে গুছিয়ে সংসার করতে ভালোবাসি।"
মোহনা অরিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"কম্প্রোমাইজ করে ?"
মাথা নীচু করে অরিত্রা। অরিত্রাকে চুপ করে থাকতে দেখে মোহনা বলে,"তোকে আজ আর জ্বালাবো না।তোর কাঁচের ঘরে আমি ঢিল মারতে চায় না।এবার উঠব। কৌস্তভদা ও ডোডোর সঙ্গে অন্য একদিন এসে দেখা করব।"
মোহনা তার নীরবতা ভেঙে বলে,"আরেকটু সময় থেকে যা।"
মোহনা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"নারে অনেক্ষণ সময় নিলাম।এখন থেকে কলেজ স্ট্রিট যাবো।কিছু বই কিনব।তারপর সোজা বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরব।আজ আসি রে।"
মোহনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় অরিত্রা।তারপর বলে, "আবার আসিস ।"
মোহনা হেসে বলে,"চেষ্টা করব।"
মোহনা চলে যেতেই অরিত্র সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এরমধ্যে ডোডো স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসে। ডোডোকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অরিত্রাও এসময় বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয়।আজ তার ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ পর বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
অরিত্রা চিন্তিত তার আইডেন্টিটি নিয়ে।মোহনার ভাবনা কি সত্যি ! মোহনা কি আদৌ ভালো আছে !নাকি তার সুখে ভরা সংসার দেখে মোহনার মনে আক্ষেপ তৈরি হয়েছে ! মোহনার ডিভোর্স নিয়ে আলোচনা করার সময় ওর চোখের কোণ মুহূর্তের জন্য হলেও সজল হয়ে উঠেছিল। অরিত্রার দৃষ্টি এড়ায়নি।পরক্ষণে অরিত্রা চিন্তা করে তার মতো শিক্ষিতা মেয়ের এহেন সুখী সংসারী জীবন ডিভোর্সী মোহনা মেনে নিতে পারছে না! অরিত্রার সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! সে আসলে কে !অম্লান বসুর মেয়ে !কৌস্তভ রায়ের স্ত্রী ! ডোডোর মা ! সত্যিই তো কৌস্তভ তার নাম বাড়ির নেমপ্লেটে রাখার প্রয়োজন অনুভব করেনি!মানসিক দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ ঘনীভূত হচ্ছে অরিত্রার মনে।(পত্রিকায় প্রকাশিত)©® রাখী দে দত্ত
***ছবি AI
----------
Rakhi Dey Dutta
গল্পের প্রথম অংশের লিংক👇 https://www.facebook.com/share/p/1ANgZdm79Q/