14/07/2025
জামাত, চরমোনাই ও খেলাফত মজলিশের মতো দলগুলা এতদিন ইসলামী রাষ্ট্র ও আল্লাহর আইনের কথা বইলা আসছে। হেযবুত তওহীদও বলতেছে তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই। আপাতদৃষ্টিতে দুইটা জিনিস একই বিষয় মনে হইতে পারে, কিন্তু আসলে একই না।
দেখেন বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলা কিন্তু প্রচণ্ডভাবে ইসলাম সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় আপ্লুত। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তারা এটা মাইনা নিছে যে, এই যুগে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। তাই তারা পশ্চিমাদের তৈরি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সিস্টেমটাকেই যথাসম্ভব “ইসলামাইজ” করার কৌশল বাইছা নিছে। মানে তারা যখন সফল হবে, খুব বেশি কিছুতে পরিবর্তন তারা আনবে না। পুরান ইঞ্জিনেই নতুন রঙ লাগাবে আর কি। তারপর সেটার নাম দিবে ইসলামী রাষ্ট্র।
প্রমাণ দেখতে চান? কিছুদিন আগে বাংলাদেশের বড় একটা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদককে নিউ ইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হইছিল- আপনারা কোন মডেলের রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণ করতে চান? তিনি বলছেন তুরস্ক মডেলের কথা। আচ্ছা বলেন তো- তুরস্ক কি ইসলামী রাষ্ট্র?
শুধু একটা নমুনা দিই। ইসলামের আকিদা হইল পুরা মুসলিম উম্মাহ হবে একজাতি, তাদের নেতা হবেন একজন। ইসলামী ব্যবস্থায় মো’মেনদের মধ্যে হরেক রকম রাজনৈতিক দল খোলার কোনো অনুমতিই নাই। তাইলে যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে সেখানে কি বহুদলীয় গণতন্ত্র চলতে পারে? সেখানে কি সরকারি দল-বিরোধী দল থাকতে পারে? পারে না। ঐ অপশন ইসলামে টোটালই নাই। তাইলে তুরস্ক কীভাবে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা হয়?
আসলে জামাত বা চরমোনাই বা খেলাফত মজলিশের মতো দলগুলা যদি কোনোদিন ক্ষমতায় যায়ও- তারা প্রচলিত দলাদলির ব্যবস্থাই বহাল রাখবে। রাখতে বাধ্য। কেননা এই দলাদলির ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই তো তাদের ক্ষমতায় যাওয়া। এদের তথাকথিত ঐ ইসলামী রাষ্ট্রে যেহেতু প্রধান প্রধান বিষয়গুলো আগের মতোই থাকবে, সেগুলো ইসলামাইজ করার সামর্থ্য তাদের হবে না, সেজন্য তাদের ফোকাসটা গিয়া পড়বে গৌণ বিষয়গুলাতে। যেমন- সবাইকে বাধ্যতামূলক নামাজ পড়ানো, বাধ্যতামূলক দাড়ি রাখানো, রাস্তাঘাটে মোরাল পুলিশিং, ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেওয়া, নারীদেরকে বাধ্যতামূলক নিকাব পরানো, ঘরের বাইরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা সীমিত করা ইত্যাদি। আসলে ইসলামী রাষ্ট্র বলতে তারা এগুলাই বোঝে।
পক্ষান্তরে হেযবুত তওহীদ একদমই কারো ব্যক্তিগত দাড়ি টুপি জোব্বা পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়া বাড়াবাড়ির পক্ষে না। হেযবুত তওহীদ মূলত চায় প্রচলিত হানাহানির ব্যবস্থা বাদ দিয়া আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে কায়েম করতে। সেই ব্যবস্থার ভিত্তি হবে আল্লাহর হুকুম। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ নিষেধ, হুকুম-আহকামকে মানদণ্ড বা মূলনীতি হেসেবে মাঝখানে রেখে রাষ্ট্রের বাকি স্ট্রাকচার দাঁড় করানো হবে।
হ্যাঁ, যে বিষয়ে আল্লাহর কোনো হুকুম নাই, ঐ বিষয়ে প্রচলিত সিস্টেম যদি যৌক্তিক হয়, তাহলে সেটা বহাল থাকতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে আল্লাহর কোনো হুকুম আছে, সে বিষয়ে অন্য কারো কোনো কথা চলবে না। ইভেন জাতির যিনি ইমাম হবেন, তার কথাও চলবে না।
এখানেই প্রচলিত রাষ্ট্রের সঙ্গে তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রের মূল ফারাকটা বোঝা যায়। প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে বলে “সার্বভৌমত্ব” থাকবে জনগণের হাতে, তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্র সেখানে বলে “সার্বভৌমত্ব” থাকবে আল্লাহর হাতে। প্রশ্ন আসতে পারে, তাইলে রাষ্ট্র পরিচালনায় বা নেতা নির্বাচনে জনগণের কি কোনোই অংশগ্রহণ থাকবে না? ভাই, অবশ্যই জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে।
এখন যেভাবে জনগণের ভোটে জননেতারা ইলেক্টেড হন, সেভাবেই জনগণ ভোট দিয়ে তাদের নেতাদেরকে নির্বাচিত করতে পারবে, কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু কথাটা হচ্ছে ঐ জায়গায় যে, উক্ত নেতারা ইলেক্টেড হয়ে কী করবে? তাদের কাজ কী হবে?
এখন জনগণ ভোট দিয়া যাদেরকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে, তারা সংসদে বইসা আইন বানায়। এখানেই মূল সমস্যা। এটা সরাসরি আল্লাহর সাথে শিরক। কেননা মানুষ কখনই আইনপ্রণেতা হইতে পারে না। আইনপ্রণেতা হইতেছেন একমাত্র আল্লাহ। তাঁর হুকুমে ও তাঁর বেঁধে দেওয়া আইনেই তো চলতেছে সমস্ত বিশ্বজগত। তাইলে পৃথিবীর আইনপ্রণেতা আবার মানুষ হয় কেমনে? মানুষকে তিনি পৃথিবীতে পাঠাইছেন খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর দেয়া হুকুম বিধান আইন দিয়া পৃথিবীকে পরিচালনা করবে। সে নিজেই যদি হুকুম বিধান রচনা শুরু করে তাইলে তো সে প্রতিনিধিত্ব করল না, বরং বিদ্রোহ করল।
সুতরাং মো’মেনরা যাদেরকে ভোট দিয়া নেতা বানাবে, তাদের কাজ হবে- আল্লাহর হুকুম কীভাবে কার্যকর করা যায় সেটা নিয়া গবেষণা করা, অনুসন্ধান করা ও চূড়ান্ত করা। তারা হবেন আমির। তারা জনগণের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হবেন ও আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। আর সেই মোতাবেক নির্বাহী বিভাগ কার্যনির্বাহ করবে।
যেহেতু রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ (ইলাহ) হবেন আল্লাহ- কাজেই একজন ব্যক্তি যতবড় আমিরই হোন, যত ভোট পেয়েই নির্বাচিত হোন, আল্লাহর হুকুম পরিপন্থী কোনো আইন, কোনো নীতি, কোনো আদেশ, কোনো নিষেধ, কোনো রায়, কোনো সিদ্ধান্ত তার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আল্লাহর হুকুম হলো অনৈক্য-দলাদলি নিষিদ্ধ, সুদ নিষিদ্ধ, ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা নিষিদ্ধ ইত্যাদি। কাজেই দলাদলি করার বা সুদের লেনদেন করার বা দ্বীন বিক্রি করে খাওয়ার বা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কোনো সুযোগই রাষ্ট্রে থাকতে পারবে না। ঐ রাস্তাগুলাই আইন পাস কইরা চিরতরে বন্ধ করে দিবেন আমিরগণ।
প্রশ্ন হইল- এটা সম্ভব কিনা? একটা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন কইরা অন্য আরেকটা ব্যবস্থা কার্যকর করা তো সোজা কথা না। এটা আদৌ বাস্তবসম্মত চিন্তা কিনা?
আসলে একদিক থেকে দেখলে এই চিন্তা অযৌক্তিক কারণ আমাদের জাতি তো আল্লাহকে হুকুমদাতা-বিধানদাতা (ইলাহ) হিসেবে মানে না। যেহেতু মানে না কাজেই এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব না। কিন্তু আরেকদিক থেকে আশার কথা হইল- এই জাতির কাছে তো এত সুস্পষ্টভাবে তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রস্তাব কেউ দেয়ও নাই। কেউ তো তাদেরকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে স্পষ্টভাবে ডাকেও নাই। আল্লাহ চাইলে তারা শুনতেও তো পারে। মাইনা নিতেও তো পারে। সারাজীবন তো ইসলাম নিয়া করা হইছে রাজনীতি। তাই ভোটের বাক্স ভরানোর জন্য যা বলার দরকার তাই বলছে ধর্মভিত্তিক দলগুলা। সকালে বলছে এক কথা, বিকালে আরেক কথা। এসব দেখে জনগণ ঠিকই বুঝতে পারছে এরা আসলে ইসলাম কায়েম করতে দাঁড়ায় নাই, ধাপ্পাবাজি করতে দাঁড়াইছে।
কিন্তু প্রকৃত ইসলামের ডাক, তওহীদের ডাক, বিপ্লবের ডাক, ঈমানের ডাক যদি এই জাতির কাছে পৌছে দেয়া যায়, তারা কি গ্রহণ করবে না? জীবনের সর্বাঙ্গনে একমাত্র আল্লাহকে হুকুমদাতা বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিবে না? আল্লাহর হুকুমে যারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েতেছে, হজ্ব করতেছে, তারা কি চাইবে না আল্লাহর হুকুমে তাদের রাষ্ট্র চলুক? আমার মনে হয় চাইবে। অবশ্যই চাইবে।
যদি নাও চায়- সেটা আমরা তাদের মুখ থেকেই শুনতে চাই এবং আল্লাহকে সাক্ষী রাইখা বলতে চাই- “হে আল্লাহ! আমরা এই জাতির কাছে তোমার সার্বভৌমত্বের ডাক নিয়া গেছিলাম, আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি সেখানে ছিল না। কিন্তু এরা সিদ্ধান্ত নিছে তোমাকে হুকুমদাতা হিসেবে মানবে না।”
এই বইলা আমরা আল্লাহর ফয়সালার জন্য অপেক্ষা করতে চাই।
কাজেই আমরা যবো। সারা দেশের রাস্তায় রাস্তায়, দোকানে দোকানে, বাড়িতে বাড়িতে যাবো। আমরা নামাজীদের কাছে জানতে চাইব- আল্লাহ কি শুধু নামাজের হুকুম দিছেন? আমরা হাজ্বীদের কাছে জানতে চাইব আল্লাহ কি শুধু হজ্বের হুকুম দিছেন? আমরা রোজাদারের কাছে জানতে চাইব আল্লাহ কি শুধু রোজার বিধানই দিছেন? আল্লাহ তো রাষ্ট্র পরিচালনার বিধানও দিছেন, অর্থনীতির বিধানও দিছেন, সামরিক নীতির বিধানও দিছেন, আইন কানুন দণ্ডবিধিও দিছেন, সেটা কেন প্রত্যাখ্যান করলেন? আপনারা কি আল্লাহর কিছু হুকুম বিশ্বাস করেন আর কিছু হুকুম অবিশ্বাস করেন? এই আংশিক ঈমান কি আপনাদেরকে জান্নাতে নিবে?
তারপর তাদেরকে বলব- ভায়েরা, বোনেরা, আসেন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধ হই তওহীদের ভিত্তিতে। তারপর তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে আওয়াজ উঠাই। এক রেনেসাঁর জন্ম দিই, জাগরণের সূত্রপাত করি। এই জাগরণ কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়। এই জাগরণ হোক আল্লাহর হুকুম মানার লক্ষ্যে, আল্লাহর দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করার লক্ষ্যে।