02/08/2024
অন্যরকম কোটা আন্দোলন
আমি একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাত্রে ঘুরাঘুরির অভ্যাস থাকায় প্রায়শই বাইরে বের হই। শ্যামলী স্কয়ারের উত্তর পাশে নূর মসজিদের গলির মুখে রাত্রে একটা অল্প বয়সী মেয়ে দাড়িয়ে থাকতো কাস্টমারের আশায়। একরাত্রে আমি বাড়ি ফেরার পথে গলিতে ঢুকতে গিয়ে দেখি একজন ব্যক্তি তার সাথে ধস্তাধস্তি জবরদস্তি করছে। গাড়ি থেকে নেমে আমি আর ড্রাইভার পাশে গিয়ে দাড়াতেই সে ছেড়ে দিয়ে আঙ্গুল উচিয়ে শাসাতে শাসাতে চলে গেল। আমি পাচশত টাকার একটা নোট হাতে গুজে দিয়ে বললাম আজকের মতো বাড়ি চলে যাও। সে মাথা নিচু করে হেটে চলে গেলো।
এরপর মাঝে মাঝেই রাত্রে দেখা হতো, সে দাঁড়িয়ে আর আমি অফিস থেকে ফিরছি অথবা অলস ভাবে হেটে যাচ্ছি, যেমনই হোক সে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমাকে ইশারায় সন্মান জানাতো তারপর আমি চোখের আড়াল হওয়া অবধি তাকিয়ে থাকতো মাথা নিচু করে। লুকিং গ্লাসে আমি কয়েকদিন দেখার পর একদিন গাড়ি থামিয়ে বললাম গাড়িতে ওঠো। গাড়িতে উঠে জিগ্যেস করলাম,
" তোমার বয়স কত?"
"বয়স জানি নে স্যার।"
স্যার, সম্মোধন শুনে অভ্যস্ত হলেও ইজি হওয়ার জন্য বললাম, আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে পারো। তারপর সরাসরি প্রশ্ন করলাম "যদি আমি তোমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিই তাহলে কি এই পেশা ছেড়ে দিবে?"
সে চুপ করে রইলো। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম ছাড়ার উপায় নেই। অভিজ্ঞতা বলতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি পঙ্গু, হিজরা, পতিতা, ধর্ষিতাদের পুনর্বাসনেরও কাজ করি টুকটাক।
আমি বললাম খুলে বলো কি বাধা। সার কথা, গ্রামের বাড়ি তার চাঁদপুর হাজিগঞ্জ। স্থানীয় আওয়ামীলীগের এমপির ভাই তাকে চাকুরী দেবার কথা বলে ঢাকায় এনে ধর্ষণ করে বাড়ির জমির কাগজপত্র কেড়ে নিয়েছে ওর মাকে ব্ল্যাকমেইল করে। বাবা না থাকায় প্রতিবাদ করার মতোও কোন অবস্থা নেই এমপির ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এখন উক্ত ব্যক্তি মেয়েকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করাচ্ছে, এবং মেয়ে বুঝতে পেরেছে যে সে বাজে ভাবে ফেসে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কত টাকা দাবি করে সে কাগজের জন্য? "পাচ লাখ" বলেই কান্না করে দিলো মেয়েটি। আমি বললাম জানি না কতটুকু পারব তবে চেষ্টা করে দেখি তোমার মুক্তি সম্ভব কি না।
অত:পর, ওকে আর ওর জীবিত একমাত্র আত্নীয় মাকে সেফ জোনে রেখে আমি আমাদের পুনর্বাসন গ্রুপের সাইবার টিমকে জানালাম। তারা ফিশিং লিংক দিয়ে এমপির ভাইয়ের ৩ টা মোবাইল ও এমপির মোবাইল হ্যাক করে ফেলে। এমপির প্রকাশ্য ও গোপন মিলিয়ে একাধিক স্ত্রী/ এসকর্টের ভিডিও পাওয়া গেলো। এবং তার ১ম স্ত্রী, যাকে উইকিপিডিয়ায় একমাত্র স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে তারও ভিডিও পাওয়া গেলো (!) এক যুবকের সঙ্গে!! তারমানে এমপি সাব স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়ে অবগত ছিলেন?!!!
ভাইয়ের ৩ টা ফোন!! ৩ টা ফোন মিলিয়ে জান লিখে কন্টাকে সেভ করা মেয়ের সংখ্যা ৭ টা, ভিন্ন ভিন্ন বানানে। কল লিস্ট অনুযায়ী বোঝা গেলো সে মোটামুটি ২ জনের সাথে লেট নাইট টক করে। সেই দুই মেয়ের ফোন ট্র্যাপ করে জানা গেলো তারা ইডেনের ছাত্রলীগের কর্মী(!) হোয়াট দ্য হেল!
এমপি, এমপির ভাই আর তার দুই "জান" এর ফোন থেকে ভিডিওই উদ্ধার হলো এক ডজন! ফোন তো নয় যেন গ্রীক পুরান। সেখানে জাহেলিয়াতের কি নেই!! ক্যাম সেক্স, মাস্টারবেশন, শেয়ারিং, বাইসেক্সুয়ালিটি, ফ্যান্টাসি, পলিপার্টনার সেক্স থেকে শুরু করে বিদেশি মদ আর সবজি ( গাজা) সেবন সবকিছু ফটো ও ভিডিও মজুদ করে রাখা। আসলেই অনেক উন্নয়ন(!) করেছে বাংলাদেশের ছাত্রীলীগের নেতাকর্মীরা, যেটা তারা সারাদিন বলে, উন্নয়ন উন্নয়ন। কুকর্ম করিস ভালো কথা, কিন্তু ভিডিও করার কি দরকার?
যাইহোক, কেচো খুড়তে কেউটে। সাইবার টিম রিভার্স ভয়েস চেঞ্জার ব্যবহার করে এমপির ভাইকে ফোন করে জমির দলিল চাইলো এবং ভবিষ্যতে এই মেয়ের সাথে যোগাযোগ বা কারা তার সাথে আছে এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করলেই লিংক ভাইরাল হবে তার সাথে তার একাধিক নিবেদিত কর্মীর, তার ভাইয়ের সাথে এসকর্টের, ভাবির সাথে অন্য ছাত্রলীগ কর্মীর ব্লা ব্লা ব্লা।
দলিল উদ্ধারের সাথে সাথে জমি বিক্রয় করে দিয়ে সেই টাকা ওর নামে একাউন্ট করে রেখে দিলাম এবং চাঁদপুরের সাথে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করা হল।
এখন মাকে মহিলা মাদ্রাসায় রান্নার কাজ দিয়েছি, বেতন ও পায়, মেয়ে পড়াশোনাও করে সেখানে। বিয়ের কথা বললেই বলে সে পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না। তাই কখনো বিয়ে করবে না।
কোটা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার দরুন বাসায় যাই নি ৩ দিন। রিমোট এরিয়ায় থেকে ছাত্রদের সাথে আছি সর্বক্ষণ। নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় শুধু ফোনে ফোনে প্রচার হয়েছে মাদ্রাসায় যে আমার গুলি লেগেছে। কিন্তু কেমন অবস্থায় আছি তা জানার কোন উপায় মাধ্যম ছিল না ওর কাছে। মাদ্রাসায় ফোন এলাউড না সঙ্গত কারণে। আমার মিসেস ও আন্দোলনের কারণে মাদ্রাসায় যায় নি ৩ দিনে পুনর্বাসন বা অন্য খিদমত বিষয়ক কাজে।
শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় আছি। এমতাবস্থায় দূর থেকে বোরকা পরিহিতা একটা মেয়েকে দেখে মনে হল আমার শিক্ষার্থী। কিন্তু, ঠিক কে তা নিশ্চয়ন করতে পারলাম না। কয়েক সেকেন্ড পরে দেখি আরে এতো আমার সেই ছোটবোন। আমার দিকে তাকিয়ে কাদছে। "তুই এখানে কখন এলি?"
"ভাইয়া, আপনের কি গুলি লাগছে?"
"ভাবি কই?"
"বাবু কেমন আছে?"
"কোথায় গুলি লাকছে ভাইয়া?"
আমি কনুই উচু করে দেখালাম। নন মাহরাম হওয়ায় আমাকে ছোয়ার অনুমতি নেই তার, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তার ব্যাকুলতা আমার আঘাত আমার ক্ষত সে দেখবেই।
"গুলি কনুই ছুয়ে বেড়িয়ে গেছে রে। কিছু হয় নি আমার" সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হল মোহাব্বত। সে আমার মোহব্বতে কাদছে। আমার সন্তান, স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য কাদছে, তার কয়েক গজ দূরেই সেনাবাহিনী বন্দুক তাক করে আছে, উচু ছাদে স্নাইপারের লেন্সে আছি আমরা, উপরে ইউনাইটেড ন্যাশনস এর হেলিকপ্টার উড়ছে, কিন্তু সে কাদছে তার ভাই, ভাবি, ভাতিজার জন্য।
"আমি সুস্থ আছি তুই মাদ্রাসায় ফিরে যা। গলির ভেতর দিয়ে যেতে পারবি? " সে মাথা নেড়ে অপারগতা জানালো" আমি ভাবলাম যেতে পারবে না। আমি বললাম,
"কাউকে দিয়ে এগিয়ে দিই?"
"ভাইয়া, আমি কালকেও আইলাম। আপনাকে খুইজ্যা পাই নাই তয় হ্যা গো আন্দোলন আমার ভালা লাকছে। আমি আন্দোলন করমু। ভাইয়া আমি বিয়া করমু। এই ছাত্রগোর লাহান চরিত্রর কাউরে আইনা দ্যান"
আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম। আসলেই তো। এই আন্দোলনের সাথে আমার যে শিক্ষার্থীরা আছে তারা যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান। সচ্চরিত্র। তারা নির্ভিক। নারীকে তারা সন্মান করে। জালিম পুলিশের মতো নয় যারা মেয়েদের সাথে শক্তি প্রদর্শন করে। নির্লজ্জ প্রধানমন্ত্রীর মতোও নয়, যে নারী হয়ে হুকুম দেয় অন্য নারীর শ্লীলতাহানির।
আমি ওকে নিয়ে গেলাম। আমার মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে। আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না যারা মাঠে আসেন নাই, চোখের সামনে মৃত্যু দেখছি তবুও আমাদের মধ্যে কোন ভয় কাজ করছে না। যেন আমরা কোন উৎসব করছি, যেন কোন ফেস্টিভাল, যেন কোন মৌসুম ফসলের।
রাত্রে ফিরে আসার সময় হাটছি আর ও আমাকে প্রশ্ন করছে,
"ভাইয়া,এই সাংবাদিক মিছা কথা কয় ক্যান?"
"কি বলেছে?"
"কয়, ছাত্ররা গুলি করছে। ছাত্ররা ট্যাংক পাইলো কই? হেলিকপ্টার পাইলো কই? কি দিয়া গুলি করল ছাত্ররা? সেই গুলি করার ভিডিও কই? আবার কয় হেলিকপ্টার দিয়া র্যাব পানি দিছে, পানি দিছস তো বালতি কই হেলিকপ্টারে? বন্দুক দিয়া পানি দেস তোরা?"
আসলেই তো, যেটা আমার এই নিরক্ষর বোন বুঝে সেটা সাংবাদিক কেন বুঝে না(!)?
" তুই আমাকে দেখতে আসছিলি, কিন্তু দেখার পর চলে গেলি না ক্যান রে?"
" জীবনে তো বহুত পাপ করছি ভাইজান, আজকে ইকটু নেক কাজে শরীক হইলাম। "
বুঝ আসার পর থেকে পতিতাবৃত্তি করা আমার এই বোনটা বুঝল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য নেক(!) কিন্তু দুই বারে ২১ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকেও হাসিনা বুঝল না!!
ওর বাপ মুজিব বাকশাল বাহিনী দিয়ে নাকি যত মানুষ মারছিলো তাদের সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়া মানুষের চেয়েও বেশি! এজন্যই বলে বাপ কা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া!
এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, এই আন্দোলন 'নেক' আন্দোলন, এই আন্দোলন আমার নিরক্ষর বোনের আন্দোলন।