15/10/2025
আমার_হৃদয়ে_তুমি_আজীবন
#পর্ব_৩৮
ফিরে এলো চার মানব-মানবী। কিন্তু কেউ মনের সুখে, আর কেউ দগ্ধ হৃদয় নিয়ে। রাকিব আর লিজার জীবনে আজ সবচেয়ে খুশির দিন। এই দিনটার জন্যই তারা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে। আজ তারা একে অপরকে কোনো উপহার না দিলেও, করেছে মনের বিনিময়। যা সমস্ত দামি উপহারকে উপেক্ষা করে চলে যায়। কিন্তু আনন্দ, সুখ নেই দুটি হৃদয়ে। ভালোবাসায় সিক্ত হৃদয় আজ ভঙ্গুর, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। লিজা, রাকিব বকবক করে গেলেও চুপ করে আছে মায়া ও আদ্র! লিজা মায়ার সাথে নানান গল্পে মেতে আছে, কিন্তু মায়া হ্যাঁ হুঁ ছাড়া কিছুই বলছে না। অবশেষে রাত নয়টায় গাড়ি এসে পড়ল "সুখনীড়ে"। তারা আজ বাইরেই ডিনার করবে ভেবেছিল, কিন্তু মায়া রাজি হয়নি। এমন পরিস্থিতি, আদ্রকে প্রত্যাখ্যান, এত কিছুর পরে তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। মায়ার অবস্থা দেখে আদ্র একবারও জোর করেনি। সত্যি বলতে তার নিজেরই খেতে ইচ্ছা করছিল না। অবশেষে সবাই ঠিক করল বাড়ি ফিরেই খাবে। তাই তো লিজা রাকিবকেও জোর করে নিয়ে এসেছে।
আদ্ররা ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই আবিষ্কার করলো আরশাফুল শেখ, হুমায়রা আর সিতারাকে। আরশাফুল শেখ মূলত কলকাতাতে একটা কাজের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। কিন্তু মেয়ে ও ভাইঝি পিছে ধরায় বাধ্য হয়ে ওদেরকেও আনতে হয়েছে।
ওই তো ভাইয়ারা চলে এসেছে। সিতারার কথায় সবাই সেদিকেই তাকালো। হুমায়রাকে দেখে মায়ার বুকটা ধক করে উঠল। ভঙ্গুর হৃদয় ভস্ম হয়ে যাওয়ায় জোগাড়। এই মেয়েরটার ভাগ্যের উপর আজ তার হিংসা করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু চাইলেও সে হিংসা করতে পারছে না।খুব সহজেই সে আদ্র নামক মানবটিকে পেয়ে যাচ্ছে, পাবেনা শুধু সে। কপাল খুঁড়ে মাটিতে ঢুকে গেলেও পাবেনা। কারণ পরিবার যে বাধা। আর সে নিজের সুখের জন্য আদ্রের পরিবারকে যে কষ্ট দিতে পারবেনা। তাও যদি কোনোদিন আদ্রকে পেয়ে যায়, সারাজীবন শুকরিয়া আদায় করবে সৃষ্টিকর্তার।
রাকিব আর লিজা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, রাকিব চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো লিজাকে। তাতেই বুঝি লিজা স্বস্তি পেল।
আদ্র আর রাকিব এসে আরশাফুল শেখের সাথে কুশল বিনিময় করলো। আরশাফুল শেখ এখানে রাকিবকে দেখে খুশি হলেও, খুশি হতে পারেনি মায়াকে দেখে। এই মেয়ে কি সবসময় এখানেই পড়ে থাকে? নাকি এখনও বাড়িতেই যায়নি?
মায়া মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশাফুল শেখের তার দিকে ফিরে ভ্রু কুঁচকে থাকার কারণটা সে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারে। তাই আর কুশল বিনিময় করার সাহস হলোনা। হুমায়রা তাকিয়ে আছে আদ্রের দিকে, কিন্তু সে শুধু কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেই খালাস। কি হতো আরো কিছু জিজ্ঞাসা করলে? আমি তো উত্তর তৈরি করেই রেখেছি! কিন্তু প্রশ্নের অভাবে তা অচিরেই দেবে গেল।
সিতারা ফিসফিস করে হুমায়রার কানে কানে বলল,
এই হুমা আদ্র ভাইয়াকে বলে রাকিব ভাইয়াকে আজ এখানে থাকার জন্য রাজি করা না! আজ তো ভ্যালেন্টাইন ডে। আজ একসাথে কাটাতে পারতাম।
চুপ হয়ে যা তারা! তোর কি মনে হয় আদ্র ভাইয়া আমার কথা শুনবে? সন্দেহ করবেনা এমন বললে? আর তাছাড়া আদ্র ভাইয়াকে দেখেছিস কোনোদিন ভালো করে আমার সাথে কথা বলতে?
কথা বলেনি তো কি হয়েছে! তুই এবার চেষ্টা করবি কথা বলার। দেখ এক্সাম হয়ে গেলেই সবাই ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ের কথাটা বলবে। তার আগে তুই একটু সহজ হয়ে নে ভাইয়ার সাথে।
কিন্তু!
কোনো কিন্তু না! তুই আমার জন্য এটা করবিনা বল? আমি না তোর বোন কাম বন্ধু, তাহলে?
আচ্ছা আমি চেষ্টা করব। আর না পারলেও লিজা আপুকে বলে দেখি ম্যানেজ করতে পারি কিনা।
ওকে ডান। সিতারা তো খুব খুশি। সে ভাবতেই পারেনি আজ ফুপির বাড়িতে রাকিবকে পাবে! সিতারা ভেবেছিল আজ আশুরা আপুর শ্বশুরবাড়ি থাকবে। কিন্তু তার আব্বু নাকচ করে দেওয়ায় সে খুব কষ্টও পেয়েছিল, বোঝাতে চেয়েছিল বার বার আপুর ওখানে থাকার জন্য। কিন্তু তার আব্বু মানলে তো! কিন্তু এখন এখানে রাকিবকে দেখে মনে মনে সে তার আব্বুর প্রতি কৃতজ্ঞ হল।
আদ্র তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর কি খারাপ লাগছে?
না ড্যাড আমি ঠিক আছি। রুমে যাচ্ছি, ফ্রেশ হলে হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। বলেই আদ্র চলে গেল উপরে। আপাতত তার একা থাকা দরকার। আদ্র যেতেই রাকিবও তার পিছে পিছে চলে গেল। সে নিজেও খেয়াল করেছে আদ্রের এমন অবস্থা।
আদ্র রুমে গিয়েই দরজা লাগিয়ে দিতে যায়, কিন্তু তার আগেই রাকিব ঢুকে গেল রুমে।
তুই এখানে?
তো কোথায় যাব? আমি আসলে তো এখানেই থাকি। আদ্র দরজা লাগিয়ে দিল। চুপচাপ চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই রাকিব দাঁড়িয়ে গেল তার সামনে।
সামনে থেকে সর।
কি হয়েছে আদ্র! তোকে এমন কেন লাগছে? আর মায়া কি বলল? ওকে তো আজ প্রপোজ করবি বললি! তাহলে?
ও রাজি হয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে।
রাকিব বেশ অবাক হয়ে বলল,
তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। কেন আমাকে ফেরানো যায়না বুঝি?
কিন্তু মায়া!
কি বলল জানিস? বলল আমার জন্য নাকি জীবন দিয়ে দিতে পারবে কিন্তু ভালোবাসতে পারবেনা কখনও!
ভালো না বাসলে কি আর জীবন দেওয়া সহজ?
সেটা কে বোঝাবে ওকে? আমার জন্য নিজেকে ওই ফাহিমের হাতে সপে দিচ্ছিল। কিন্তু আজ কত নির্দ্বিধায় বলে দিল, আমাকে ভালোবাসে না। আমাকে কি ভালোবাসা যায়না রাকিব? আমি কি খুব খারাপ? আদ্রের গলা ধরে আসল।
রাকিব জড়িয়ে ধরলো তাকে। সেও তো কাউকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসার মর্যাদা খুব ভালো ভাবেই বোঝে। তোকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই আমার কাছে। তবে আমি যতটুকু চিনেছি,জেনেছি মায়াকে, মনে হয় ও তোকে ভালোবাসে! হয়ত কোনো কারণে সেটা স্বীকার করতে চাইছেনা।
আমার সাথে ওর কিসের এত লুকোচুরি! এই বলে, আমি নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।
লুকিয়েছিলিস তো তুইও। তখনও তো বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলিস। শোন আদ্র, হয়ত এমন কিছু আছে যেটার জন্য ও কষ্ট পাচ্ছে, দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তোকে। ভালোবাসার সত্যতা গোপন করছে।
সেটাই তো জানতে চাইছি। কিন্তু ও কি বলে জানিস! বলে কিনা সব কার্যের কারণ হয়না। আর সব কিছুর কারণ নাকি জানতে নেই। বড্ড পাকা পাকা কথা শিখেছে এই মেয়ে।
রাকিব হাসল।
তুই হাসছিস? আমার এই পরিস্থিতিতে তোর হাসি পাচ্ছে? বাহ।
আহা! রেগে যাচ্ছিস কেন? ও একবার না বলেছে বলেই কি হাল ছেড়ে দিবি নাকি? আমি হলে তো দিনরাত পিছুপিছু ঘুরতাম।
আদ্র বাঁকা হাসল, আদ্রিয়ান চৌধুরী কোনো মেয়ের পিছু পিছু ঘোরেনা।
মানে?
ডাইরেক্ট কোলে করে ঘোরানোর প্ল্যান করেছি।
কি বলিস ভাই? আমার একমাত্র বোনের দুইমাত্র ভাইয়ের সামনে এই লজ্জাজনক কথাটা বলতে তোর লজ্জা করল না?
না আমার লজ্জা সরম এমনিও কম। সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। ওই মেয়েকে আমি ঠিক হৃদয়ের খাঁচায় বন্দী করে রাখবো। দেখি কোথায় পালাতে পারে!
আর বারবার বলার পরেও যদি রাজি না হয়?
এই তুই আমার বন্ধু? নাকি শত্রু? ভালো কথা তোর মুখে আসেনা? যত্তসব!
রাকিব হেসে আবার জড়িয়ে ধরলো আদ্রকে। সে খুব ভালো করেই জানে আদ্র মায়া ছাড়া কতোটা অচল। সেই প্রথম দিন মায়াকে দেখার পর থেকেই শুরু হয়েছে মায়ার গল্পকথা। সময়ের সাথে সাথে ভালোবেসে ফেলেছে গভীর ভাবে। জড়িয়ে পড়েছে মায়ার সমস্ত ভালো, খারাপে। যাকে পাওয়ায় জন্য, যার ভালোর জন্য সে পৃথিবীর সাথে লড়াই করে যাবে। ছেড়ে দিতে পারবে দুনিয়া কিন্তু পারবেনা তাকে ছাড়তে।
আরশাফুল শেখের মায়াকে দেখে রাগ হলেও, তাও মুখে হাসি নিয়েই মায়াকে ডাকল,
আরে মায়া কেমন আছো?
ভালো আছি মামা! আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালো আছি। কিন্তু কেউ কেউ ঠিক ভালো থাকতে দিচ্ছে না।
মায়া বুঝল আরশাফুল শেখ কথাটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে। বুঝতে পেরে সে চুপ করে গেল। তবে আবরার চৌধুরী ঠিকই প্রশ্ন করে বসলেন,
কেউ ঠিক ভালো থাকতে দিচ্ছেনা মানে? কি বলতে চাইছো আরশাফুল? কে আবার তোমার ভালো না থাকার কারণ হলো?
আরে ওই নানান চাপের কথা বলছি আবরার। তুমি এত সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছ!
তাই বলো। আমি আবার কিনা কি ভাবলাম। মায়া আর লিজা হুমায়রা ও সিতারাকে নিজে চলে গেল গেস্ট রুমে। এখন গল্পের আসর বসবে সেখানে। মায়া ভেবেছিল আজ একটু একাকী কাটাবে, কিন্তু এদের উপস্থিতি হয়তো সেটা হতে দেবেনা।
গেস্ট রুমে গল্পের আসর সর্বোচ্চে। হুমায়রা তো কথার ফাঁকে ফাঁকে বারবার রাকিব আর আদ্রকে এই ঘরে ডেকে আনার কথা বলছে, যেটাই ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে লিজা। কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না। সে ভেবেছে রাকিবের জন্যই হয়ত হুমায়রা বারবার ওদের এখানে আসতে বলছে। কিন্তু মায়া তো ঠিকই জানে কারণটা হলো আদ্র। হুমায়রা চাইছে আদ্রের সাথে সময় কাটাতে। কিন্তু গল্পের মাঝে উঠে যেতেও পারছে না। এবার সিতারা লিজাকে প্রশ্ন করে বসল,
আচ্ছা লিজা আপু তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?
সিতারার কথায় কেন জানিনা রাগ হলো লিজার। অন্য সময় হলে হয়তো সত্যি কথাটায় আজ বলে দিত। কিন্তু এখন তো সেই পরিস্থিতিও নেই। সবার সামনে এখনই বলা যাবেনা। বিশেষ করে সিতারার সামনে।
না রে নেই। তোর কাছে ভালো কোনো ছেলের সন্ধান থাকলে বলিস। আমি প্রেম করবো। মায়া তখনই বেশি কিছু না ভেবে বলে উঠল,
ভালো ছেলে আমার হাতে কিন্তু আছে।
সিতারা আর হুমায়রা বেশ উৎসুক নিয়েই একসাথে বলে উঠল,
কোন ছেলে আপু? আমাদেরও বলো।
লিজা অবাক নয়নে চাইল মায়ার পানে। মায়া আপুর হাতে আবার কোন ছেলে আছে? সর্বনাশ!
কে আবার! আমার ভাইয়া! রাকিব এহসান!
রাকিবের কথা শুনে তিনজনেরই কাশি উঠে গেল। তিনজনেই মায়ার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন মায়া কাউকে খুন করে তার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। ওদের চাহনি দেখে মায়া খানিকটা ভড়কে গেল। হঠাৎ করেই বুঝতে পারল সে হয় ভালো কোনো কথা বলেনি। আসলে না ভেবেই বলেছে তো। বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কথা তার ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু ভাবেনি। এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে তার। না জানি কি ভাবছে এরা।
আদ্রের ব্যাপারে মায়ার উপর রাগ কিছুটা কমলেও, পুনরায় রাকিবের কথা শোনার পরে সেই রাগটা বেড়ে গেল। এই মেয়ে কি আমাদের দুই বোনের পছন্দের দিকে পড়ে আছে নাকি! অসহ্য! এই জন্যই এই মেয়েকে আমার ভালো লাগেনা। সিতারারও রাগ হল বেশ। রাকিবকে তো সে পছন্দ করে রেখেছে। বিয়ে করতে চাই তাকে। তাহলে এই মায়া আপু কোত্থেকে এসে বলছে যে, লিজা আপুর জন্য তার রাকিব ভাইয়াকে পছন্দ! মগের মুল্লুক নাকি। আমি রাকিব ভাইয়াকে কাউকে দেবনা। সে আমার, শুধু আমার হবে।
মায়ার কথা শুনে লিজার বুক থেকে যেন বড় একটা পাথর নেমে গেল। যাক মায়া আপু একবার যখন রাকিবের কথা বলেছে তখন মায়া আপুকে দিয়েই ভাইয়াকে রাজি করাবো। ভাইয়া রাজি হয়ে গেলে আম্মু আর ড্যাডকে খুব সহজেই রাজি করিয়ে নিতে পারবে। তখন মামারবাড়ীর সবাই যাই বলুক না কেন! বিয়ে তো আমি রাকিবকেই করবো। লিজা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বিড়বিড়ালো, এই সুযোগ আপুকে খুব তাড়াতাড়ি রাকিবের কথাটা বলে দেব। এইসব ভেবে লিজা বেশ খুশি হল। তবে কাউকে সেই খুশির রেশমাত্র বুঝতে দিলনা।
মায়া সবার চাহনীতে ভড়কে গেল, আমতা আমতা করে বলল,
আসলে আমি ওভাবে বলতে চাইনি কথাটা। কেউ কিছু মনে কোরোনা প্লীজ। হুমায়রা কিছু বলতে যাবে তার আগেই লিজা বলল,
আরে কিছু মনে করিনি আপু। অত প্যানিক কোরোনা। জাস্ট চিল। লিজার কথা শুনে মায়া বেশ স্বস্তি পেল। যাক লিজা কিছু মনে করেনি।
সিতারা এবার মায়াকে বলল,
আচ্ছা মায়া আপু আদ্র ভাইয়া তো এখন তোমার বন্ধু হয়ে গেছে। তা তোমরা কেমন বন্ধু এখন?
সিতারার কথা শুনে হুমায়রা বেশ খুশি হলো। যাক এই সুযোগে মায়ার মনোভাব কিছুটা হলেও বোঝা যাবে।
ভালোই বন্ধু। এই কদিনে ঠিক যেমন বন্ধু হওয়া উচিত তেমনটাই। এর থেকে বেশি কিছুনা।
মায়ার কথা শুনে বেশ খুশি হল সিতারা আর হুমায়রা। তারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে আগলে রেখে দেবে সব মেয়েদের থেকে। কিন্তু আদেও কি তা সম্ভব। মেয়েগুলো তো অনেক কিছুই জানেনা। জানলে না জানি কি ঝড় বয়ে যাবে।
এই ভাবেই গল্পে গল্পে কেটে গেল অনেকটা সময়। এদের সাথে কথা বলে মায়ার মনটাও কিছুটা হালকা হয়েছে। কিন্তু গভীরে যে ক্ষত-র সৃষ্টি হয়েছে ইহজগতে তা যাওয়ার নয়। সেই ক্ষত-র একমাত্র মলম আদ্র। যাকে না পেলে সারবেনা। কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে, আদ্র মরুভূমির মরীচিকার ন্যায়। যাকে দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায়না। কিন্তু আদ্র তো ছোঁয়ার অধিকার দিয়েছে। নিজের সবটাই দিতে চেয়েছে। কিন্তু মায়া তো পারলনা সেই অধিকারকে নিজের কাছে আগলে, ধরে রাখতে।
ডিনারের টেবিলে সবাই থাকলেও নেই আদ্র ও রাকিব। হুমায়রাকে আর আলাদা করে কাউকে রাজি করাতে হয়নি রাকিবকে এখানে থাকার জন্য। আদ্র নিজেই বলেছে এক রাকিব এখানে তার সাথে থাকবে। এই সুযোগে হুমায়রা আর সিতারা অনেক কিছুই প্ল্যান করে নিয়েছে, শুধু এক্সিকিউট করা বাকি।
মায়া রাবেয়া বেগমের সাথে হাতে হাতে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। রাবেয়া বেগম বারবার খেতে বললেও মায়া খেতে বসেনি। সে বলল, সেও নাকি সবাইকে খাবার পরিবেশন করবে। এতে নাকি তার ভালোই লাগছে। রাবেয়া বেগম বেশ খুশি হলেন মায়ার কথায়। কিন্তু পরমুহুর্তেই সেই খুশিতে ভাটা পড়ে গেল। মেনে নিলেন বাস্তবতাকে। মেনে নিলেন হুমায়রাকে। কিন্তু মন থেকে কি পারলেন মেনে নিতে? হয়তো না।
আবরার চৌধুরী বললেন,
আদ্র আর রাকিব কোথায় রাবেয়া? ওরা কি খাবেনা?
তোমার নবাব পুত্তুর ছেলে খাবেন না। ওনার নাকি অনেক কাজ। নিজে তো খাচ্ছে না সঙ্গে ওই ছেলেটাকেও না খাইয়ে রেখেছে। এসব ভালো লাগে বলো?
আহা! তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? হয়তো দুজন একটু গল্প করছে। এক কাজ করো কাউকে দিয়ে ওদের খাবারটা ঘরেই পাঠিয়ে দাও।
তোমার কি মনে হয়! আমি সেটা করিনি? তোমার ছেলে খাবেনা বলে দিয়েছে। তারপরও আমি কিছু বলতে গেছিলাম। কিন্তু কেমন রাগে গজগজ করতে লাগল। তাই তো বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম।
আবরার চৌধুরী বেশ ভাবুক হলেন, এই ছেলের আবার কি হলো? কারো সাথে কি আবার ঝগড়া করে আসল নাকি? একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। ঠিক হয়তো মারপিট করে চলে এসেছে। নইলে এমনি এমনি রাগ করার মতো ছেলে তার না। সে একদম মাটির মানুষ। শুধু রেগে গেলে তার মাথার ঠিক থাকেনা। নাহ্ এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেল না।
মায়া ভেবেছিল সবার খাওয়া হয়ে গেলে খেয়ে নেবে। কারণ নিজের কষ্ট, দুঃখ তো আর খাওয়ার উপরে দেখাতে পারবেনা। সেটা হলে রাবেয়া বেগমের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। এমনকি সে না খেলে আদ্র শুনলে নানান প্রশ্ন করতে পারে, সেই ভেবেই খাবে ভেবেছিল। কিন্তু এখন আদ্র খায়নি আর সে খেয়ে নেবে, এটা হতেই পারেনা।
ডিনার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল। মায়া খেল না। ভাবতে লাগলো কিভাবে আদ্রকে গিয়ে খাওয়ার কথাটা বলবে। অন্যসময় হলে ঠিকই খাবার নিয়ে ওর ঘরে চলে যেত। এমন নয় যে আদ্র প্রপোজ করেছে,আর সে রিজেক্ট করেছে বলে তার ঘরে যেতে পারছে না। বরং হুমায়রার সামনে এসব করে তাকে কষ্ট দিতে চাইছে না। যতই হোক মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। সে বোঝে, ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাউকে কল্পনা করলেও কতটা কষ্ট লাগে।
হুমায়রা এতক্ষণ আদ্র আর রাকিবের ঘরের দিকে বারবার উঁকি মারছিল। যেই দেখল আদ্র ছাদের দিকে যাচ্ছে, ওমনি হুমায়রা দৌঁড় দিল সেদিকে। এখনও বারোটা বাজেনি। চাইলেই ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করতে পারবে। আর সিতারা ছুটলো আদ্রের রুমে, আপাতত রাকিবের সাথে কিছুটা সময় কাটাবে সে। তাদের এই সাহসিকতার মাঝে তারা ভুলেই গেল বাড়িতে আরশাফুল শেখ আছেন।
আদ্র দাঁড়িয়ে আছে ছাদের রেলিং ঘেঁষে। দৃষ্টি তার শূন্যে, আকাশে। একটু আগেই আশুতোষ ফোন করেছিল তাকে। এবার তাকে সবার সামনে আসতেই হবে। বিজনেসে যোগ দিয়েছে যখন, তখন সমস্ত মিটিং সামনাসামনি অ্যাটেন্ড করতে হবে। তার উপর বিদেশি ডিল, অনেক টাকার ব্যাপার। কিন্তু মন থেকে ভয়টা কিছুতেই কাটাতে পারছে না। নিজের পরিচয়, পরিবার, মায়া আর তাদের সুরক্ষার চিন্তা। সব কিছুই যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।
এত রাতে এই অন্ধকারে কি করছো ভাইয়া! একটি মেয়েলি ডাকে পিছু ঘুরে তাকালো আদ্র।
তুই এখানে? এত রাতে? ঘুমাসনি?
না আসলে ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু তুমি এখানে সেটা তো জানতামই না।
জানলে কি করতিস? আসতিস না?
না না। সেটা কেন? অবশ্য তুমি থেকে ভালোই হয়েছে! একটু গল্প করা যাবে। তোমাকে তো আজকাল ঠিক করে পাওয়াই যায়না। আগে তাও ভিডিও কল করতে! এখন তো সেটাও করতে দেখিনা।
সময় পাইনা। অনেক কাজ।
শুনলাম নাকি বিজনেসে যোগ দিয়েছ?
হ্যাঁ। তোকে কে বলল?
বড়আব্বু আজ খাওয়ার টেবিলে ফুপাকে বলছিলেন! তাই তো শুনলাম।
আদ্রের ছোট্ট উত্তর ওহ। রুমে যা।
হুমায়রা তার ওড়নার একটা অংশ নিয়ে একবার আঙুল পেঁচাচ্ছে তো একবার খুলছে। কিন্তু চলে যাচ্ছে না।
কি হলো?
একটা প্রশ্ন করি ভাইয়া! যদি কিছু না মনে করো?
বল।
আচ্ছা কোনোদিন যদি শোনো ফুপি আর ফুপা মিলে তাদের পছন্দের কোনো মেয়ের সাথে তোমার বিয়ের ঠিক করেছে তাহলে তোমার রিয়েকশন কি হবে? তুমি কি রাজি হবে? নাকি বারণ করে দেবে তাদের?
আদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো হুমায়রার দিকে। এই মেয়েটার সাথে তার সখ্যতা খুবই কম। শুধু এর সাথেই নয়, সিতারার সাথেও তার তেমন সখ্যতা নেই। এমন নয় যে আদ্র ওদের পছন্দ করেনা বরং বয়সে ছোট হওয়ায়, আর তাছাড়া এত বছর বিদেশে ছিল সেই জন্যই হয়ত।
হঠাৎ এমন প্রশ্ন?
কেন জানতে পারিনা বুঝি? নাকি আমার সেই অধিকার নেই?
এখানে অধিকারের প্রশ্নই বা আসছে কেন? অবশ্যই জানতে পারিস।
তাহলে বলো, ওনাদের পছন্দ করা মেয়ে কি তোমার পছন্দ হবে?
ওনারা আমার আম্মু-ড্যাড। ওনারা যেটা করবেন অবশ্যই সেটা আমার ভালোর জন্যই করবেন। আর তার সাথে আমার পছন্দ, অপছন্দের দিকেও গুরুত্ব দেবেন। আমি ওনাদের যতটা না ভালোবাসি, ওনারা আমাকে তার থেকেও অনেক গুণ বেশি ভালোবাসেন। সুতরাং ওনারা যেটা করবেন আমার কথা ভেবে, আমাকে ভালোবেসে, আমার ভালোবাসার কথা ভেবেই করবেন।
তুমি কাউকে ভালোবাসো না? মানে কোনো মেয়েকে?
তুই এসব উদ্ভট প্রশ্ন করা কবে থেকে শুরু করলি?
বলো না ভাইয়া। আমারও তো জানতে ইচ্ছা করে।
বাসি। আদ্রের নিঃসঙ্কোচ উত্তর। আদ্রের কথায় ধক করে উঠল হুমায়রার বুক। আদ্র ভাইয়া একটা মেয়েকে ভালোবাসে? কে সে? মায়া আপু? হুমায়রার কান্না পেয়ে গেল। সঙ্গে পেল ভয়। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় জেঁকে ধরলো তাকে। নিঃশ্বাসের গতি ক্রমশ বাড়ছে, শীতল পরিবেশেও শরীরের তাপমাত্রাও যেন তিরতির করে বাড়ছে। আদ্রের বলা সামান্য একটা শব্দ তার সারা মনকে দ্বিখণ্ডিত করে তুলছে।
হুমায়রা তার কণ্ঠের খাদ নামিয়ে পুনরায় বলল,
কে সেই মেয়ে? যাকে তুমি ভালোবাসো?
আছে কেউ। আপাতত বলা যাবেনা। জানতে চেয়েছিলিস তাই মিথ্যে বললাম না। সঠিক সময় আসলে সবাই জানতে পারবে।
হুমায়রার চোখ ফেটে পানি আসার জোগাড়। ভালো লাগছে না তার কিছু। মনে হচ্ছে সব কিছু ভেঙে, চুড়ে শেষ করে দিতে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখল সে, আচ্ছা তাকে তুমি কতদিন ধরে ভালোবাসো?
আদ্র এবার অধৈর্য্য হল বেশ। এমনিতেও তার মন,মেজাজ ভালো নেই। তার উপর বাহ্যিক নানান দুশ্চিন্তা। সব মিলিয়ে তার মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার উপর এই মেয়ে একটার পরে একটা প্রশ্ন করেই চলেছে। তবুও যেহেতু হুমায়রাকে সে বোন হিসাবে ভালোবাসে তাই তার সাথে খারাপ ব্যবহার সে কখনই করবেনা। সেই জন্যই শান্ত স্বরেই জবাব দিল,
অনেকদিন আগে থেকেই ভালোবাসি।
অনেকদিন বলতে?
অনেকদিন বলতে অনেকদিন। আদ্রের অনেকদিন বলায় হুমায়রা এটা ভেবে সিওর হয়ে যায়, মেয়েটা আর যেই হোকনা কেন মায়া আপু নয়। কারণ মায়া আপুকে তো ভাইয়া দেশে আসার পর থেকে চেনে। সুতরাং বেশিদিন হয়নি। কিন্তু মায়া আপু যদি না হয় তাহলে মেয়েটা কে? হুমায়রার মাথায় নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
মেয়েটা কে ভাইয়া?
তোকে আমি আগেই বলেছি মেয়েটা সম্পর্কে সবাই পরে জানতে পারবি। তাও এত প্রশ্ন যখন করছিস তখন বলে রাখি মেয়েটাকে তুই চিনিস! ইনফ্যাক্ট খুব ভালো করেই চিনিস। আদ্র হাসল কথাটা বলার সময়। মায়ার কথা বলতে গেলেই তার ঠোঁটে সবসময় কিঞ্চিৎ হাসি বিদ্যমান হয়।
আদ্রের কথা শুনে কিছুমুহূর্তের জন্য থমকে গেল হুমায়রা। পরমুহূর্তে আনন্দে ফেটে পড়ল। সে ভেবেছে আদ্র ভাইয়া তার কথায় বলছে। কারণ তার চেনা, জানা মতে এমন কোনো মেয়ে নেই যে আদ্রের ক্লোজ। একমাত্র মায়া আপু ছিল। কিন্তু তার হওয়ার চান্স তো শূন্য শতাংশ। তাই এখন সেই আছে। বোকা হুমায়রা জানলোই না আদ্র তার কথা বলেনি। তার অবুঝ মন না জেনেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। শুধু আফসোস সত্যিটা জানতে, বুঝতে পারলো না। হুমায়রা খুব খুশি। আজকের দিনটা তার জন্য সত্যিই শুভ। সারাজীবন মনে রাখবে সে। বুকভরা আনন্দ, সুখ নিয়েই নীচে নেমে আসল সে। বেচারী হয়তো জানলোই না এই সুখ তার জন্য নয়, বরং এই সুখের মালকিন অন্যকেউ।
হুমায়রা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রুমে প্রবেশ করলো। আজকের সব ঘটনা তার বোনকে জানাবে সে। কিন্তু ঘরে এসে তার আনন্দে ভাটা পড়ে গেল অচিরেই। চোখ ফেটে পড়ল নোনা পানি। বোনের কান্নার প্রকোপে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। ছুটে গেল তার কাছে।
তারা এই তারা! কি হয়েছে তোর? কান্না করছিস কেন এভাবে? কিন্তু সিতারার কান্না থামার নাম নেই। সে কেঁদে চলেছে বিরামহীন।
কি হয়েছে বলবি তো? এভাবে কাঁদছিস কেন বোন আমার? কি হয়েছে আমাকে বলবি না?
সিতারা জড়িয়ে ধরলো হুমায়রাকে। হুমু! হুমু রে! রাকিব.. রাকিব ভাইয়া আমাকে...
রাকিব ভাইয়া! কি করেছে তোর সাথে রাকিব ভাইয়া? হুমায়রা চমকে গেল রাকিবের কথা শুনে। মনে হানা দিতে লাগল নানান চিন্তা ভাবনা। কিন্তু না। রাকিব ভাইয়া তো এমন ছেলে না। কিন্তু সিতারার কান্নার কারণটা এখনও পরিষ্কার না তার কাছে।
কি হয়েছে না বললে আমি বুঝব কি করে তারা। কি হয়েছে বল আমায়।
রাকিব ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে না হুমু। সে অন্য কেউকে ভালোবাসে। বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সিতারা।
কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
তুই ছাদে যাওয়ার পরে আমি রাকিব ভাইয়ার ঘরে গিয়েছিলাম।
ভাইয়া আসবো?
একি সিতারা! এত রাতে তুমি এই ঘরে?
সিতারা একটু নার্ভাস। কি বলবে বুঝতে পারল না। তাও সাহস জুগিয়ে বলল,
আসলে আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। তাই আর কি!
ওহ। ঠিক আছে, যা বলার কাল সকালে বোলো। আমি তো আছিই এখানে। এখন ঘরে যাও। আমি চাইছিনা এই রাতে এক ঘরে কেউ আমাদের দেখুক। বিশেষ করে তোমার আব্বু। উনি তো সুযোগ খোঁজেন লোককে অপমান করার। আমাকে যা ইচ্ছা বলুক। কিন্তু আমি চাইনা তোমাকে জড়িয়ে আমাকে কোনো কথা শোনাক। যেটা আমার পছন্দ হবেনা।
বেশ লজ্জিত বোধ করলো সিতারা। সে জানে তার আব্বু অমন। কিন্তু যেটা করেন, ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্যই করেন। তাই বলে এভাবে কথা শোনাবেন। সিতারা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মোট কথা যেটা বলতে এসেছে সেটা বলেই ফিরবে সে।
কি হলো! দাঁড়িয়ে আছো যে?
আসলে আমি যেটা বলতে এসেছি সেটা বলাটা খুব জরুরী তাই....
ঠিক আছে বলো, তবে জলদি।
সিতারা কিছুক্ষন আমতা আমতা করল, অতঃপর চোখ বন্ধ করেই বলে উঠল,
আমি আপনাকে ভালোবাসি রাকিব ভাইয়া। যদি আপনি অনুমতি দেন, আপনার সাথে আমি আমার ইহকাল, পরকাল দুটোই কাটাতে চাই।
রাকিব হা হয়ে তাকিয়ে আছে সিতারার দিকে। সে ভাবেইনি, সিতারা এমন একটা কথা এই ভাবে, এখানে, কিছু না ভেবেই বলে দেবে। লিজা বলেছিল তাকে যে, সিতারা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু রাকিব ভেবেছিল সিতারা মেয়েটা ভীতু। হুমায়রাকে তার মনের কথা জানালেও বাকিদের বা তাকে জানানোর সাহস সে কোনদিনও পাবেনা। কিন্তু এই মেয়ে তো রাকিবের ভাবনার থেকেও একশো কাঠি উপরে। কত নির্দ্বিধায় বলে দিল ভালোবাসার কথা।
রাকিব এবার বেশ রেগে গেল, কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলল নিজের। এই মেয়ে তোমার সাহস হয় কি করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই সব কথা বলার? হাউ ডেয়ার ইউ?
কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল সিতারা। রাকিবকে সে এভাবে কখনও কারো সাথে চিৎকার করতে দেখেনি। তাই স্বাভাবিক ভাবে সেটা নিতে পারছে না।
আমি আপনাকে ভালোবাসি ভাইয়া। সত্যি বলছি।
বাহ! যার আব্বু কিনা মেয়েদেরকে নিজের কাছে বন্দী করে রাখতে চাই। ওনার মেয়ে হয়ে তোমার, আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে লজ্জা করেনা?
ভালোবাসায় লজ্জা কিসের! আমি আপনাকে ভালোবাসি। অন্যায় তো করিনি।
অন্যায় করেছো! আমাকে ভালোবাসে অন্যায় করেছো। শোনো সিতারা আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আর না কোনোদিন বাসবো। আমি কিন্তু আমার ভাইয়াকে তোমার আব্বুর করা অপমানের কথা ভুলিনি। কি দোষ ছিল তার? শুধুই তো ভালোবেসেছিল তোমার আপুকে। তার মানে এটা নয় যে, আমি অপমানের ভয়ে তোমাকে ভালোবাসছিনা! আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আর বিয়ে করলে তাকেই করবো। তাই ভুলে যাও আমাকে। আর প্লীজ দয়া করে এখান থেকে চলে যাও। তোমার আব্বু আছে এখানে। আমার সাথে এতরাতে দেখলে আর রক্ষা থাকবেনা। সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। তাই প্লীজ। রাগে, দুঃখে, অপমানে বেড়িয়ে গেল সিতারা। সে কখনও ভাবেনি রাকিব ভাইয়া তার সাথে এমন একটা ব্যবহার করবেন। হ্যাঁ এটা ঠিক তার আব্বু এসব প্রেম, ভালোবাসা পছন্দ করেননা। কিন্তু তাই বলে কি সে নিজের ভালোবাসার কথা বলতেও পারবেনা? নাকি কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা?
সিতারা যেতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল রাকিব। সে কখনই সিতারার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করতে চাইনি। কিন্তু হঠাৎ করেই সে কি করে ফেলল সেটা সে নিজেও বুঝতে পারল না।
কি বলছিস কি তারা? রাকিব ভাইয়া তোর সাথে এমন ব্যবহার করেছে? তোকে অপমান করেছে?
হুঁ! উনি আমাকে ভালোবাসেন না হুমু! উনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন। বাসেন না ভালো। আমাকে বললেন ভুলে যেতে। কিন্তু ভুলে যাওয়া কি অতই সহজ। এতবছর ধরে আমি নিজের মনের মধ্যে যে ভালোবাসা ওনার জন্য গচ্ছিত রেখেছি, আজ জানলাম তার ভাগীদার অন্য কেউ। আমি নই। আমি নই। হুমায়রা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বোনকে। বোনের কষ্টে তারও বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। প্রকাশ করতে পারছেনা সে।
চলবে....