23/08/2025
১৫_বছর_বয়সী_মা
পর্ব- (৫২)
{রহস্যের শেষপ্রান্তে}
“প্রি- নেটাল প্যাটারনিটি টেস্ট করতে এতোদিন লাগে? তুমি কি বুঝতে পারছোনা বাচ্চাটার বাবাকে কনফার্ম করাটা কতবেশি আর্জেন্ট? আমি তোমাকে সবকিছু রাশ মুডে করতে বলেছিলাম। তবুও কেনো এতো টাইম লাগছে?”
আলভী থামলো তারপর আবারও বলতে লাগলো,
“আমি তোমাকে যথেষ্ট টাইম দিয়েছি। কালকের মধ্যে সব রেডি রাখবে নইলে আগের এসিস্ট্যান্ট লাবিবের মতো তোমাকে বাদ দিতে বাধ্য হবো।”
কথাটা শুনে অলি দুপা পিছিয়ে গেলো। ঘুরে এসে ধপ করে বিছানার উপর বসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সিলিংয়ের দিকে। কিছুক্ষণ সেভাবে বসে থেকে উঠে গিয়ে বেডসাইড থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো তারপর ইউটিউবে সার্চ করলো,
—প্রি- নেটাল প্যাটারনিটি টেস্ট মানে কি?
সার্চের রেজাল্ট দেখে সে অবাক হলোনা। যা ধারণা করেছিলো সেটাই, অলির মনে হতে লাগলো তার হৃৎপিন্ডটা কেউ চেপে ধরে টেনে বের করে আনতে চাইছে। সে ছটফট করতে লাগলো কিন্তু রুম সাউন্ডপ্রুফ হওয়াতে তার গোঙানির শব্দ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি টের পেলোনা। সে হয়তো তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। অলি টেবিলের উপর রাখা পানিটুকু খেয়ে ধীরপায়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে মনে মনে আওড়ালো,
“সে একজন ডাক্তার। হতে পারে অন্য কারো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। হ্যাঁ সেটাই হবে, আমি একটু বেশি বেশিই ভাবছি।”
অলি ওড়না দিয়েই হাত মুখ মুছতে মুছতে রুমে ফিরে এলো। আলভী খাটের উপর বসে ফোন চাপছে। অলিকে দেখেই সে উঠে দাড়ালো,
“একা একাই চলে এলে?”
অলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো,
“তোমাকে কতোবার বলেছি একা একা সিড়ি দিয়ে চলাফেরা করবেনা।”
“চিন্তা করবেন না আমি তো ঠিক আছি।”
“হুম কিন্তু এই অবস্থায় আর কখনো একা একা সিড়ি পার হবেনা বুঝলে?”
অলি মাথা নেড়ে খাটের দিকে এগিয়ে যেতে নেয় কিন্তু কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
“আপনি আলোকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেন তাইনা?”
অলির এহেন প্রশ্নে আলভী কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। অলি মৃদু হেসে বলল,
“চিন্তা করেন সেই জন্যই তো আমার এতো খেয়াল রাখেন। শত হলেও আলো তো আপনারই অংশ।”
অলির কথাটা শুনে আলভীর চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেলো। এর আগে অলি কক্ষনো এভাবে বলেনি তাকে।
“তুমি হঠাৎ এভাবে বলছো কেনো?”
“কিভাবে বললাম? জানেন আমি অনেক বেশি এক্সাইটেড ওর মুখ দেখার জন্য। ওর নরম ছোট্ট তুলতুলে হাতটা ধরার জন্য। আপনিও অনেক এক্সাইটেড তাইনা? বাচ্চারা তো দু বছর থেকেই আধো আধো কথা বলতে শুরু করে। আচ্ছা যখন আলো আপনাকে বাবা বলে ডাকবে তখন আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন? আহ আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে। যেদিন ও আমাকে প্রথম মা বলে ডাকবে আমি হয়তো খুশিতে পাগলই হয়ে যাবো।”
আলভী স্তব্ধ হয়ে অলির দিকে তাকিয়ে আছে। সে কখনো এসব নিয়ে ভাবেনি। সত্যিই কি বেবিটা তাকে বাবা বলে ডাকবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই আলভী হকচকিয়ে গেলো। এ কেমন অদ্ভুত ভাবনা? বেবিটা তার হলে বাবা বলে না ডেকে কি আলভী তাসনীম মির্জা বলে ডাকবে? কথাটা মনে হতেই তার গলা শুকিয়ে এলো, অলি যদি একবার জানতে পারে সে বেবিটাকে নিয়ে এসব ভাবে তাহলে নিশ্চিত তাকে বাবা ডাক শোনার আগেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। আলভীর চেহারা দেখে অলির সন্দেহ আরও নিগূঢ় হলো। মূলত আলভীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই সে এসব বলেছে, অলি এগিয়ে এসে আলভীর বাহু জড়িয়ে ধরলো,
“আচ্ছা আপনি আপনার ছেলেকে পেয়ে আমাকে কম কম ভালোবাসবেন নাতো?”
আলভী বিরবির করে আওড়ালো,
“আমার ছেলে?”
“কি হলো বলুন,”
আলভী মেকি হেসে বলতে লাগলো, “না বউজান আমি তখন আরও বেশি ভালোবাসবো তোমায়। ওকে ভালোবাসার জন্য তো তুমি আছোই তাইনা? কিন্তু তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমি ছাড়া আর কে আছে?”
অলির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আলভী সবসময় বাচ্চাটাকে ইগনোর করে যেন বাচ্চাটাকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। আলভী অলিকে ছাড়িয়ে সামনে আনলো তারপর তার মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে ঠোঁটে চুমু খেতে চাইলো কিন্তু অলি দুপা পিছিয়ে গেলো। আলভী অবাক চোখে অলির দিকে তাকিয়ে রইলো। সেদিনের পর থেকে অলি কখনোই তাকে বাধা দেয়নি তাহলে হঠাৎ কি হলো?
“হানিবি কি হলো?”
অলি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বেডের উপর বসলো,
“আসলে আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা।”
কথাটা শুনে আলভী ব্যতিব্যস্ত হয়ে অলির সামনে এসে বসলো,
“কি হয়েছে হানিবি? তোমার কোথাও ব্যাথা হচ্ছে?”
অলি নিশ্চুপ, আলভী আরও চিন্তায় পড়ে গেলো। সে অলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
“হানিবি, বলো কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো। প্লিজ কষ্ট চেপে রেখোনা। তোমার কিছু হয়ে গেলে কিন্তু আমিও ম*রে যাবো। এটা সবসময় মনে রেখো।”
অলির চোখের কোণে পানি জমেছে। সে আলভীর হাতটা নিজের বুকের বা পাশে রেখে বললো,
“আমার এখানে কষ্ট হচ্ছে, আপনি না হার্টের ডাক্তার আমার হার্ট টাকে পরিবর্তন করে দেবেন?”
আলভী হতবিহ্বল হয়ে অলির মুখের দিকে তাকালো। অলি ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে ফলস্বরূপ নাকের পাটা টাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
“কি হয়েছে? তোমার মন খারাপ?”
অলি আলভীর চোখে চোখ রাখে আলভীর চোখজোড়া অনুভূতিশূন্য। সে আলভীর হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“আমার হার্ট অনেক দূর্বল। একটুতেই ভেঙ্গে যেতে চায়। এতো দূর্বল হার্ট নিয়ে এতো এতো কঠিন পরিস্থিতি সামলানো আমার পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। আপনি কোনোভাবে আমার হার্ট রিপ্লেস করে দিন না।”
আলভী বুঝতে পারলো কোনো একটা অজানা কারণে অলির মন মেজাজ ভালো নেই, তাই সে আলতো হাতে অলিকে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরলো।
“হার্ট রিপ্লেস করতে হবে কেনো? তোমার তো এমনিতেই দুটো হার্ট, এই যে এখন যেই হৃৎযন্ত্রের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছো সেটাও যে তোমার। সকল কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আছি তো আমি। তুমি শুধু আমার বুকের সাথে মিশে থাকো।”
অলি সত্যিই আলভীর বুকের সাথে মিশে রইলো। আর কোনো কথা বললোনা।
রাত দুটো।
চারদিকে নিস্তব্ধতা, ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ ব্যাতিত অন্য কোনো গুঞ্জন নেই। জানালার আধখোলা পর্দার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকেছে পূর্ণিমার আলো, রূপালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো রুমে। বিছানার হলুদ রঙের চাদরে সেই আলো যেন মৃদু ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আলভী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে অলিকে শক্ত করে জড়িয়ে আছে, আলভীর তপ্ত নিশ্বাস অলির ঘাড়ের ভাজে আছড়ে পড়ছে। অন্যদিন হলে অলিও হয়তো ঘুমে নিমজ্জিত থাকতো। কিন্তু আজকে তার চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছেনা। কিছু একটা বুকের ভেতর খচখচ করছে।
যতক্ষণ না সে সব রহস্যের খোলাসা করতে পারবে ততক্ষণ তার চোখে আর ঘুম নামবে না। সে এসেছিলো আলভীকে ইয়াদের ব্যাপারে জানাতে। ইয়াদকে তার সন্দেহ হচ্ছে। যদিও আলভীর মতে এখন তারা বিপদমুক্ত, একে তো রিফাত বেচে নেই আরেক হলো রূপসার বিষ দাঁত আলভী উপড়ে ফেলেছে। তাই আলভী হয়তো রিল্যাক্স মুডে আছে। কিন্তু অলির কেনো এমন মনে হচ্ছে যে খুব শীঘ্রই খারাপ কিছু হতে চলেছে? সে এইট্টি পার্সেন্ট সিওর যে সেদিন রিফাতের পার্টনার লোকটা ইয়াদই ছিলো। ইয়াদ আলভীর কাজিন না হলে সে একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর হয়ে যেতো।
অলি ভেবেছিলো ইয়াদের বিষয়ে আলভীকে জানিয়ে তারা দুজন মিলে এই রহস্য উন্মোচন করবে। কিন্তু…অলির তো এখন আলভীকে নিয়েও ভয় হচ্ছে। লোকটার মনে ঠিক কি চলছে সে বুঝে উঠতে পারছেনা। অলি আলভীকে বিশ্বাস করলেও আলভী যে আলোকে প্রোটেক্ট করবে সেই বিষয়ে ভরসা করতে পারছেনা। মূলত আলভীর কেয়ারলেস বিহেভিয়ারের জন্যই অলি ভয়ে আছে। অলি নিজের পেটের উপর হাত রেখে মনে মনেই বলল,
“তোর মা থাকতে কেউ তোকে ছুতেও পারবেনা। আমি তোকে রক্ষা করবো আলো।”
আলভী নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। অলি বুঝতে পারলো আলভী সহজে উঠবেনা। অলি আলভীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো তারপর খাট থেকে নেমে আলভীর পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে আলভীর ফোনটা হাতে নিলো। সে কখনোই আলভীর ফোন ধরেনা। আলভী অনেক সময়েই অলির ফোন ধরে কিন্তু অলি আলভীর ফোনের পাসওয়ার্ডটাও জানেনা। অলি আবারও নিজের স্থানে এসে ধীরেসুস্থে আলতো করে আলভীর হাতের আঙুলটা নিয়ে গেল ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সরে।
“টিক্” শব্দে স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই অলির বুকের ভেতর কাঁপন বয়ে গেল। তার ভালো লাগছেনা এভাবে আলভীর পারমিশন ছাড়া তার ফোনে হাত দিতে কিন্তু তাকে আগে আলভীকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে হবে। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়ে যায় তাহলে ধ্বংস নিশ্চিত। অলি ধ্বংস হতে ভয় পায়না কিন্তু আলোকে সে জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবে। অন্তত সে বেচে থাকতে আলোকে অশুভ কিছু স্পর্শ করতে পারবেনা।
অলি ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো। সেখানে থাকা চেয়ারে বসে সে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো। হাত অস্বাভাবিকভাবে কাপছে মনে হচ্ছে সে চোর ধরতে নয় নিজেই চুরি করতে এসেছে। হোয়াটসঅ্যাপের সবার উপরে রয়েছে রাজিবের নম্বর। অলি জানে রাজিব হচ্ছে আলভীর নতুন ফিজিশিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট। লাবিবকে আলভী পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলো অলির ছবি তার কাছে সেন্ড করে ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য। এটা অবশ্য আলভীই অলিকে বলেছে। অলি স্ক্রোল করে একেবারে প্রথম থেকে মেসেজ গুলো পড়তে শুরু করলো।
—USA এর ল্যাবে স্যাম্পল পাঠিয়ে দেয়া ডান স্যার।
—সবকিছু রাশ মুডে করবে পেশেন্টের অল্রেডি ৩৭ সপ্তাহ চলছে তার ডেলিভারির আগেই যেন রিপোর্ট পেয়ে যাই।
—স্যার কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো?
—হুম?
—পেশেন্ট কি আপনার আত্মীয় হয়? না মানে এতো টাকা খরচ করে সবচেয়ে ভালো ল্যাবে পাঠাতে বললেন তার উপর এসব তো আমাদের কাজের মধ্যেও পড়েনা।
—মাইন্ড ইওর বিজনেস আর ভবিষ্যতে কখনো এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেনা। শুধু যেটুকু বলবো সেটুকুই করবে।
—ওকে স্যার স্যরি। আর করবোনা।
এরপর আর রাজিবের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেনি আলভী। শুধু আজকেই এই বিষয়ে আরেকটা ম্যাসেজ দিয়ে বলেছে,
—কালকের মধ্যে রিপোর্ট না পেলে তোমাকে আর কাজে আসতে হবেনা।
অলি আশ্চর্য হয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো। আলভী এসব করেছে সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা। সে ফোনটা রেখে দেয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতেই আলভীর হোয়াটসঅ্যাপে দিহানের ম্যাসেজ আসে। অলি আবারও চেয়ারে বসে পড়লো তার এবার ভীষণ ভয় করছে। সে আর কিছু দেখতে চায়না, সাহসে কুলাচ্ছেনা। তবুও সে কম্পিত হস্তে দিহানের ম্যাসেজ ওপেন করলো।
—কিরে কালকে দেশের বাইরে যেতে হবে বলে আমার ঘুম আসছেনা কিন্তু তুই এতো রাতে অনলাইনে কি করিস হুম?
অলি আগের ম্যাসেজগুলো দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু আলভী হয়তো দিহানের আগের ম্যাসেজ গুলো ডিলেট করে ফেলেছে। অলি জানে এই দিহান আলভীর ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে তাই এর থেকেই পুরো ঘটনাটা বের করতে হবে। অলি এবার বুদ্ধি খাটিয়ে আলভী সেজে দিহানকে ম্যাসেজ পাঠালো,
—এখনো রিপোর্ট হাতে পেলাম না তাই চিন্তা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ যেতেই দিহান রিপ্লাই দেয়,
—বাচ্চাটার বাবা তুই-ই হবি। শুধু শুধু চিন্তা করিসনা।
অলি এবার কান্না করে দিলো। তার মানে আলভী এতদিন যাবত বাচ্চাটাকে সন্দেহ করতো? অলি চোখ জোড়া মুছে নিজেকে সামলে নিলো। ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। অলি সময় নিয়ে টাইপ করলো,
—আমার মনে হয়না যে বাচ্চাটার বাবা আমি।
দিহান আর রিপ্লাই দিলোনা। অলি বুঝতে পারলোনা কিছুই। সে উঠে গিয়ে ব্যালকনির রেলিঙে হাত রাখলো। চোখের পানিও যেন এবার অভিমান করলো তার সাথে, বুক ফেটে যাচ্ছে তবে চোখ দিয়ে আর পানি বের হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ যেতেই চেয়ারের উপরে রাখা ফোনটায় টুং করে শব্দ হলো। অলি এগিয়ে গিয়ে দেখলো দিহান অনেক বড় একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। হয়তো এটা লিখতেই এতোটা সময় লেগেছে,
—দেখ লাস্ট বারের মতো বলছি এসব নিয়ে ভাবিস না। রিফাত সেদিন ভাবীর সাথে খারাপ কিছু করলে কি ভাবী সেটা তোকে বলতোনা? মানলাম ভাবী হয়তো তোর থেকে লুকিয়েছে কিন্তু ভাবীর সাথে রিফাত কিছু করে থাকলেও সেই জন্য তুই-ই দায়ী। তোর সাথে শত্রুতা করেই রিফাত তেমনটা করেছিলো। আর তুই যে বেবিটাকে দত্তক দিয়ে দিতে চাইছিস। একবার ভেবে দেখেছিস ভবিষ্যতে এই কথাটা ভাবী জানলে সে কতোটা কষ্ট পাবে? ভাবী যখন জানবে তার মৃত বাচ্চা হয়েছে তখন তুই কিন্তু ভাবীকে সামলাতে পারবিনা এভি। প্লিজ এবার এসব বন্ধ কর। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুই শুধু নিউজটা ধামাচাপা দিতে এসব করছিস কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে তোর মনে এই বিষয়ে আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো।
অলি পুরো ম্যাসেজটা পড়লো কিন্তু তার একটুও খারাপ লাগলোনা। অলি হয়তো বুঝতেই পারলোনা যে সে খারাপ লাগা অনুভব করার ক্ষমতা ইতোমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছে। সে নিষ্পলক চোখে ম্যাসেজগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে রিপ্লাই দিলো,
—হ্যাঁ নিউজ টার জন্যই আমি এমনটা করেছি।
অলি জানেনা যে দিহান কোন নিউজের কথা বলছে তবে তাকে জানতে হবে সবটা তাই এভাবে বলেছে।
—তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে মাঝরাতে? নাকি ইয়ার্কি করছিস? নিউজের চ্যাপ্টারটা তো একদিনেই ক্লোজড করে দিয়েছিলি সেই জন্য NIPP টেস্ট করার কোনো প্রয়োজনই ছিলোনা। তাছাড়া লাবিবকেও তো তুই নিউজটা ছড়ানোর জন্য নিজের হাতে মে*রে ফেললি।
লাবিবকে আলভী মে*রে ফেলেছে শুনে অলির হয়তো আঁতকে ওঠার কথা ছিলো কিন্তু তার মাঝে কোনো ভাবাবেগ হলোনা সে আবার রিপ্লাই দিলো,
—আমার এখন মনে হচ্ছে নিউজটা হয়তো সঠিক ছিলো।
এদিকে আলভীর উদ্ভট ম্যাসেজগুলো দেখে দিহানের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে রেগেমেগে ম্যাসেজ দিলো,
—ওই সম্বন্ধী, তুই কি ড্রিংকস করেছিস? নিউজে বলা হচ্ছিলো ভাবী একজন ক্যারেক্টরলেস গার্ল সে একদিন তোকে ড্রিংক করিয়ে তোর সাথে ইন্টিমেট হয়েছিলো তারপর তোকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলো। তার উপর অন্য একজনের বাচ্চা তোর বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। আর তুই বলছিস তোর মনে হচ্ছে নিউজটা সঠিক ছিলো?
অলি এবার আর রিপ্লাই দিলোনা। সে সব জেনে গেছে আর বুঝেও গেছে। সে ম্যাসেজগুলো ডিলেট করে ফোনটা আগের জায়গাতে রেখে দিলো। তাকিয়ে দেখলো আলভী এখনো ঘুমে মগ্ন, সে সেদিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো। অলির মনে হচ্ছে আকাশের বুকে থাকা চাঁদটাও যেন তার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে। সে হাত দিয়ে নিজের পেট আড়াল করে নিলো, বিরবির করে বলতে লাগলো,
“আলো শুধু আমার ছেলে। আর কারো নয়, একমাত্র আমিই প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করেছি যে ও আমার ছেলে, আমার প্রাণ। ও কারো নয়। ছিহ, আমার ভাবতেও ঘেন্না লাগছে যে উনি তোকে রিফাতের বাচ্চাও ভেবে নিয়েছিলো। ওনার মনে হচ্ছে যে সেদিন শুধু উনিই আমাকে রে/প করেননি। রিফাতও করেছিলো?”
অলির শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। কান্নাগুলো গলার ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। সে কাদতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। অলি ঘন্টাখানেক একভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। এখন রাত্রী সাড়ে তিনটা, অলি নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটাই নিয়ে নিলো এই এক ঘন্টায়। সে এবার রুমে ঢুকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো আলভীর দিকে। আলভীর পাশে শুয়ে দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে চোখমুখে একে দিতে লাগলো অজস্র চুমু, অলির ঠোঁটের স্পর্শে ঘুমের ঘোরেই অলিকে নিজের কাছে টেনে নিলো আলভী। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“আরও আদর করো হানিবি। ভালো লাগছে খুব।”
আলভীর মাতাল কন্ঠে অলি দিশেহারা হয়ে গেলো। সে লেপ্টে রইলো আলভীর বুকের সাথে তারপর আনমনেই গেয়ে উঠলো,
“এমন একটা রাত দেও আল্লাহ দুনিয়ায় উপর
এক নজরে দেখবো তারে কয়েক’শো বছর।”
অলির মুখ থেকে নির্গত গানের বাক্যটা যেন আলভীর সমস্ত সত্তা জাগিয়ে তুললো, সে ফট করে চোখ মেলে তাকায়। গানের সুরেই বলে,
“বাবুই পাখির মতো দুজন বানাইবো ঘড়
আমারে ছেড়ে যাইওনা আসলে কঠিন ঝড়”
অলি মাথা তুলে আলভীর দিকে তাকালো তারপর ম্লান হেসে গানের সুরে বলল,
“যতনে রাখিও তোমারে দিলাম আমার মন।”
চলবে,