19/08/2025
#দিবারাত্রি
আজকের এমন খুশির দিনেও রাত্রি কোনো ভাবে নিজেকে খুশি রাখতে পারছে না।তবুও একটা চাপা খুশি নিয়ে সবার সাথে কথা বলছে সে। সে বুঝতে পারছে না কীভাবে নিবে তার পরিবার এই সারপ্রাইজটা।সে জানে সবার এই খুশির মূহুর্তটা কিছুক্ষণ পর বিষাদে রূপান্তরিত হবে।
ঠিক তখনই প্রধান ফটক দিয়ে একটি গাড়ি এসে থামলো, রাত্রির বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, এই মুহূর্তের জন্যই সে তিন বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু যখন গাড়ি থেকে ড. ফয়েজ এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনাফকে দেখল, তার চাপা আনন্দ এক নিমেষে বিষাদে পরিণত হলো। আনাফের পাশে দিবানীকে দেখে তার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয়টা যেন সত্য হয়ে উঠল।
আনাফ দিবানীর হাত ধরে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত শান্ত হাসি। যেন তিন বছরের শূন্যতা, কষ্ট বা কোনো স্মৃতিই তাকে স্পর্শ করেনি। সে যেন তার অতীত ভুলে নতুন এক জীবন শুরু করেছে। আনাফ যখন সবার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টিতে কোনো পুরোনো সম্পর্কের উষ্ণতা ছিল না, ছিল কেবল এক অপরিচিত নীরবতা। সে তাদের দিকে এগিয়ে এলো, কিন্তু তার চলাফেরা বা দৃষ্টিতে সেই পুরনো আনাফের কোনো চিহ্ন নেই। তার এই নতুন আচরণে রাত্রির মন এক অজানা যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল।
আনাফ তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে কোনো আবেগ নেই, কেবল এক স্বাভাবিক সৌজন্যতা। সে বলল, "তোমরা সবাই ভালো আছো?" তার কণ্ঠে কোনো আবেগ ছিল না, যেন সে কেবল একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন করছে। তার দৃষ্টি যখন রাত্রির ওপর পড়ল, তখন রাত্রির মনে হলো সে তার প্রিয় মানুষটিকে দেখছে না, দেখছে এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকে। তার চোখ জোড়া পরিচিত, কিন্তু সেখানে তার জন্য কোনো চিন্হিত স্থান নেই। যে ভালোবাসাকে সে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে করত, সেই ভালোবাসার মানুষটি আজ তার চোখের সামনে অন্য কাউকে আপন করে নিয়েছে। এই কষ্টটা হয়তো মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। তার মনে হলো, আনাফের ফিরে আসাটা তার জন্য সুখ নয়, বরং এক নতুন যন্ত্রণার শুরু।
আনাফ ধীরে ধীরে ঘরের মাঝখানে এগিয়ে এলো। তার চোখ সবার দিকে ঘুরছে, মুখে সেই পুরোনো হাসি, কিন্তু চোখে নেই তিন বছরের বিচ্ছেদ ও ফিরে আসার কোনো আবেগ। সে যেন এক অচেনা মানুষ, যে পুরোনো কোনো বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। প্রথমে সে রাত্রির বাবার কাছে গেল, তাকে জড়িয়ে ধরে বলল।
আনাফ :- কেমন আছেন আঙ্কেল??
রাশেদ :- এতক্ষণ যতটুকু ভালো ছিলাম। এখন তোকে দেখে আরো বেশি ভালো আছি....তুই কেমন আছিস??
আনাফ :- আমিও ভালো আছি। আপনাদের সবাইকে দেখে খুব ভালো লাগতেছে।
তার কথায় কোনো রহস্য বা বেদনা ছিল না, ছিল কেবল স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও সে একইভাবে কথা বলল, যেন তারা কেউ হারিয়ে যায়নি, বরং এইমাত্র দেখা হয়েছে। সবার চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দ মিশে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল।
এরপর আনাফের চোখ পড়ল রাত্রির ওপর। সে রাত্রির দিকে এগিয়ে গেল, তার কাঁধে হাত রাখল এবং এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
আনাফ :-কিরে, তুই কাঁদছিস কেন? তোকে আমি কোনোদিন একা রেখে যাব, এটা তুই ভাবলি কী করে পাগলি?"
আনাফের এই কথাগুলো যেন রাত্রির বুকে তীরের মতো বিঁধল। 'তুই এখনো কাঁদছিস?' এই কথাগুলোর মধ্যে সেই তিন বছরের তীব্র অপেক্ষা, কান্না আর কষ্টকে যেন এক মুহূর্তে মুছে দেওয়া হলো। আনাফ তাকে দেখছে, চিনতে পারছে, কিন্তু তার চোখে নেই সেই ভালোবাসার গভীরতা, নেই সেই তীব্র টান যা একসময় তাদের সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল। সে যেন তাকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে নয়, বরং কেবলই একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখছে। রাত্রির চোখে জল জমে এলো, সে কোনো কথা বলতে পারল না। তার ভেতরটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
এরপরেই আনাফ দিবানীকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
আনাফ :- দিবানী, এরাই আমার পরিবার। আর রাত্রির কথা তো জানো সে আমার বেস্টফ্রেন্ড।
আনাফের এই কথায় যেন সবাই আরও বেশি অবাক হয়ে গেল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। রাত্রির চোখে জমে থাকা নীরব অশ্রু জানান দিচ্ছিল, তাদের দীর্ঘ ভালোবাসার গল্পটা হয়তো এখন কেবলই এক অজানা স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
আনাফের কথায় সবার মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। রাত্রির বাবা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আনাফের দিকে তার চোখ, কিন্তু দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর শূন্যতা। যে ছেলেকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন, যে তার মেয়ের জীবনের সর্বস্ব ছিল, সেই ছেলেটি আজ এমনভাবে কথা বলছে যেন তাদের সম্পর্কের গভীরতা কেবলই এক বন্ধুত্বের। রাশেদ সাহেবের মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না, কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস তার বুক থেকে বেরিয়ে এলো। সোমা, এই দৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারলেন না। তার চোখে জল ভরে এলো। তিনি ধীরে ধীরে আনাফের কাছে এগিয়ে গেলেন। আনাফ তাকে দেখল, হাসিমুখে বলল,
আনাফ :- আন্টি, কেমন আছো? তোমাকে দেখতে কিন্তু আগের মতোই তরুণী লাগছে।
সোমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি আনাফের হাত ধরে বললেন,
সোমা :- আনাফ, বাবা... কী বলছিস এসব? তুই কোথায় ছিলি তিন বছর? আমরা ভেবেছিলাম তোকে হারিয়ে ফেলেছি।
আনাফ হাসল আর বললো।
আনাফ :- কোথায় আবার? আমি তো এখানেই ছিলাম। তোমরা সবাই কি আমার সাথে মজা করছ?
আনাফের এই কথায় সোমার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাদের প্রিয় আনাফ ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সে আর আগের মতো নেই। তার স্মৃতি থেকে তাদের সম্পর্কের গভীরতাটুকু মুছে গেছে। তিনি তার ছেলের মতো প্রিয় মানুষটিকে তিন বছর পর ফিরে পেয়েও যেন তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছেন।
রাশেদ সাহেব এবার এগিয়ে এলেন। তিনি সোমার কাঁধে হাত রাখলেন, যেন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তিনি আনাফের দিকে তাকালেন, তারপর দিবানীর দিকে তাকালেন। তার চোখে একরাশ প্রশ্ন, যা তিনি মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না। এই মুহূর্তে এই পরিবারের কাছে আনন্দ নয়, বরং চাপা কষ্ট আর একরাশ রহস্যের জন্ম হয়েছিল।
এদিকে রাত আনাফকে এতবছর পর দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে,, নিজের ভাইয়ের মতো ভাইকে ফিরে পেয়ে অনেকটা আবেগী হয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাত। অনেকক্ষণ আনাফকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। আনাফ কিছুটা অবাক হলেও তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত হাসি। সে তার হাত দুটি রাতের পিঠে রেখে আলতোভাবে চাপড়ে বলল,
আনাফ :- "আরে, কাঁদছিস কেন আপুনি ? আমি তো ফিরে এসেছি। এখন তো তোর খুশি হওয়ার কথা।
তার কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু তার কথায় কোনো গভীরতা ছিল না, ছিল কেবল এক অসম্পূর্ণ সান্ত্বনা।
এই দৃশ্য দেখে রাত্রির বুকের ভেতরের যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেল। তার প্রিয় মানুষটি তার বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, কিন্তু তার হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিরাট শূন্যতা। রাত্রি বুঝতে পারছিল, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে তার বোনের বিয়ের ছোট আয়োজনটা নষ্ট হয়ে যাবে। সে আর দেরি করল না। নিজের কষ্টকে বুকের গভীরে চেপে রেখে সে দ্রুত পায়ে তাদের কাছে এগিয়ে এলো।
আনাফের পাশ থেকে রাত্রির উপস্থিতি টের পেয়ে রাত তার দিকে তাকাল। রাত্রির চোখে তখন কোনো জল ছিল না, ছিল এক দৃঢ়তা। সে খুব শান্তভাবে রাতের কাঁধে হাত রেখে বলল,
রাত্রি :-"আপুনি , শান্ত হও। দেখো, সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।"
তার কণ্ঠস্বর কোমল হলেও তাতে ছিল এক ধরনের কর্তৃত্ব, যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
Will Continue.... 🥰🥰