29/07/2025
#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭৬ [খ]
বাড়িতে আসার পর একদিনও বাইরে বের হয়নি, বলতে গেলে কোথাও যায়ইনি আরসালান। যেই অনুভব করল তার আকর্ষণ কেড়ে নেওয়া ফুলটিকে এ বাড়ির বাতাসে আর অনুভব করতে পারছে না; অস্থির হয়ে উঠা সে মকবুলের ঘাড় চেপে ধরে জানতে পেরেছিল, সে তার বাড়িতে ফিরে গেছে। মাথাটা এলোমেলো হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। গায়ে শার্টটা চাপিয়ে কেমিকে নিয়ে বেরুবে, গ্যারেজে এসেই দেখল সে, তার রুবিকনের ব্যাটারি খুলে ভুলভাবে কানেক্ট করে সার্কিট ড্যামেজ করে, ম্যানুয়াল গিয়ারে ক্লাচ পুড়িয়ে, কমপ্রেসড এয়ার ইনটেকে পানি ঢুকিয়ে, এবিএস সেন্সরে কাট করে ইনজান শেখের রুবিকন জীপটাকে অকেজো করে দিয়েছে ইহসান শেখ। বাইক চুরমার করে দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবেই যে কাজটা করেছে কাউকে আর বুঝিয়ে দিতে হলো না৷ ক্রোধে উন্মত্ত ছোটো ছেলেকে দেখে আজিজ শেখ পড়লেন মহাবিপাকে। কয়েক মাস আগে ছেলের আবদার মেটাতে বিশেষভাবে কাস্টোমাইজ করে চড়ামূল্যে টেক্স দিয়ে বিদেশ থেকে গাড়িটি আনিয়েছিলেন তিনি। যেটা এই মুহূর্তে ধ্বংসাবশেষ হয়ে গ্যারেজের এক কোণে পড়ে আছে। ইট মারলে পাটকেল খেতেই হয় এই প্রবাদটাই শুনতে হলো ইনজান শেখকে। এরপর রিহ্যাবে পাঠানোর দু'দিনের মাথায় যখন সে ওখানকার স্টাফদের জখম করে চলে এলো, ইহসান ওর ভালোমন্দের ব্যাপারে ভাবা বন্ধ করে দিলো চিরতরের মতো। পশুকে যেমন মাংস খাওয়া থেকে বিরত রাখা যায় না, তেমনি আরসালান শেখকেও বিরত রাখা গেল না তার স্বভাবগত প্রবৃত্তি থেকে। কিছু কিছু বিষয়ে নির্লিপ্ততা অবলম্বন করে সে ফিরে গেল তার ধ্বংসাত্মক জীবনেই। ইহসানের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ হলো ঠিক সেদিন থেকেই।
নিদ্রাপুরীতে পরিণত হওয়া শেখ বাড়ির দোতলাতে স্ট্যারী নাইট অঙ্কিত ঘরটা থেকে চতুর শেয়ালের মতো বেরিয়ে এলো আরসালান। ডান পাশের ঘরটার সামনে এসে নিশ্চুপতা অবলম্বন করে দরজাটা খুলে নগ্ন পায়ে ভেতরে ঢুকতেই খা খা শূন্য একটা ঘর পেয়ে ভ্রু দুটো অস্বাভাবিক ক্রোধে কুঁচকে গেল আরসালানের। তীক্ষ্ণ চোখে ঘুরেফিরে ঘর, বারান্দাটা দেখে নিয়ে ধীর কদমে এগিয়ে গিয়ে সাদার উপর নীল রঙের বড়ো বড়ো ছাপাওয়ালা বিছানাটায় হাত-পা মেলে শুয়ে পড়ল সে। হাত বাড়িয়ে বুকের কাছে বালিশ টেনে নিয়ে নাক ঠেকাল সেখানটাতে। একটাতে অচেনা, তেল চিটচিটে গন্ধ পেলেও অন্যটাতে স্বল্প পরিচিত তবুও কামুকতা তুলে দেওয়ার মতো ঘ্রাণ; তার নাসারন্ধ্র ঠিকই চিনে নিলো। বালিশটাকে দু'হাতে পিষে নিজের বুকের নিচে রাখল সে। মুখ গুঁজে রইল অনেকটা সময়। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল এলিজা রেহমানের পেলব মুখটা।
চট করে চোখদুটো খুলে পকেট থেকে আধা ছেঁড়া স্কেচটা বের করে আঙুল বুলাল সে মেয়েলি অবয়বটার উপর। মেয়েটার ঠোঁট-মুখ এতোটা নিঁখুত, গাল কপালের ঐ দাগটা কিছুতেই এই মুখটাকে ম্লান করে দিতে পারে না। আরসালান ইনজান শেখ পরণের শার্টের দুটো বোতাম খুলে বুকের ভেতর ছবিটাকে রেখে দিয়ে বালিশে নাক চেপে নিদ্রায় ডুবে গেল নিত্যদিনকার মতো।
°
ইজহান শেখ, মানুষটা একরোখা, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। নিজের ভালোটা ছাড়া অন্য কার কী ছেঁড়া গেল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা বরাবরই নেই ওর। এটা সবাই জানে। তবু বেশ কয়েকদিন যাবৎ একটা ব্যাপারে তার মাথাব্যথা হচ্ছে। তার কারণ ইস্মিতার আইবুড়ো ভাই আকাশ। যার বিয়ের বয়স সাগরের ঢেউয়ের মতো উচ্ছলতা প্রকাশ করছে, কিন্তু সে এখনো কোনো ঘরে বাঁধা পড়েনি। ইজহানের মাথাব্যথার কারণ অবশ্য আকাশের সেলিবেসি জীবন নয়। বরং সমস্যা হল ইস্মিতার মুখখানা। সেদিনের ঐ ঘটনার পর থেকেই একটা ভার চাপা পড়েছে সেখানে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখার যে নিঃশব্দ সংগ্রাম চালাচ্ছে, তা ইজহানের চোখ এড়ায়নি। সে তাই শঙ্কিত। অতীতে ইস্মিতাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার অদৃশ্য চেষ্টায় আকাশ ছিল প্রতিপক্ষ। তাকে ইজহান কথার খোঁচায়, বাঁকা ঠাট্টায়, এমনকি প্রান্তসীমা ছুঁয়ে যাওয়া ধাক্কাধাক্কিতে পর্যদস্ত করার চেষ্টা করেছে মুখোমুখি হলেই। করেছে আকাশ নিজেও। দু'জনেই, সমান তালে। কিন্তু ইচ্ছেকৃত মারধর করা বা থুতু ছোড়ার মতো অপমানজনক কাজও তারা কেউই করেনি। শত রাগের পরেও না। তাদের দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু তার সীমা ছিল। সবসময়ই আকাশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে নিতো। সেই আকাশের গায়ে আরসালান থুতু দিয়েছে, টব ফেলেছে, পা মচকে ফেলেছে। বরাবরের মতোই আকাশ নিজেকে সামলে নিয়েছে। কুকুরের কামড়ে নিজেও কুকুর হয়ে যায়নি। একটা প্রতুত্তরও করেনি। সেই দৃশ্যটা ইজহানের ভেতরে এখন ঢেউ তোলে। শত কথা মিথ্যে হলেও এটা মিথ্যে নয় যে, আকাশ সুপুরুষ এবং উদার মনা একজন ব্যক্তি। যার ধৈর্যটাও চোখে লেগে থাকার মতো। বিভিন্ন সাংগঠনিক কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুণই হয়তো সে এই স্বভাবটা আয়ত্তে নিতে পেরেছে। তবে সকলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ ভাবে চলার চেষ্টা করলেও আবার ঘাড়ত্যাড়া ব্যক্তির সাথে ঘাড়ত্যাড়ামি সে নিজেও করে। যেমন মচকানো পা নিয়েই সে শেখ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল সেদিন। কারো উদ্বিগ্নতা, বারণ কানেই তুলেনি। ইজহান তার গাড়িতে করে পৌঁছে দিতে চাওয়ায় আকাশ ‘থ্যাংকস’ বলে রিকশা নিয়ে নিজেই চলে গেছিল। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ইজহান স্পষ্ট দেখেছিল আকাশের চোখে জমে থাকা অপমান আর ক্রুদ্ধ আগুন।
এদিকে স্বাভাবিক থাকার ভান করে সব কাজকর্ম করলেও ইজহান বেশ বুঝতে পারে ইস্মিতার মনে জমা কালো মেঘের ঘনঘটা। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে কেমন বাঁধছিল তার। তবে সে তো এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে আপোষ করার ব্যক্তি নয়, তাই অফিসের ফাইলে নজর বুলানোর ভান করে সে গলা খাকারি দিয়ে আজ প্রশ্নটা করেই ফেলে, “ইস্মিতার ভাইজানের পা’য়ের অবস্থা এখন কেমন? তাকে কি একবার বাড়িতে আসতে বলা যায়?”
কাঁথা ভাঁজ করতে থাকা ইস্মিতার হাত থেমে যায়। ধীর চোখে তাকায় ইজহানের দিকে, তারপর কাঠ হাসি মুখে বলে, “ধন্যবাদ আপনার উদ্বেগের জন্য। কিন্তু আমার ভাই শেখ বাড়িতে আর কোনোদিন পা রাখবে না।”
শব্দগুলো কোমলভাবে বলা হলেও ভেতরে বিষাদের এক সমুদ্র লুকিয়ে আছে। ইজহান বুঝতে পারে।
আন্দাজ করা স্বত্তেও সে জিজ্ঞেস করল, “পা রাখবে না মানে? কেন?”
“যেখানে সম্মান নেই, সেখানে না আসাই তো আত্মসম্মানের।”
ইজহানের মুখ থমথমে হয়ে গেল, “আমার আম্মাজানকেও দেখতে আসবে না?”
”জি, তাকেও দেখতে আসবে না।”
ইজহান থমকে যায়, “কিন্তু কেন?”
পৃথিবীর কোনো বোনই চায় না, তার ভাই অপমানিত হোক, কষ্ট পাক। কিন্তু ইস্মিতা নিজের চোখে দেখেছে আকাশের সেই অপমান। থুতু গায়ে এসে পড়েছিল। সামনাসামনি, নির্লজ্জভাবে। আর সেই অপমানের ঘাতক ইনজান শেখ। যাকে সেও ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিল, সৃজার মতোই। তাঁর পাগলামি, অস্থিরতা সব মেনে নিয়ে যতটা সম্ভব খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছিল। ভেবেছিল, সম্পর্ক মানে কিছু দেওয়া-নেওয়ার বাইরেও কিছু। কিন্তু সেই মানুষটাই আকাশের সঙ্গে এমন আচরণ করল? একটা অদৃশ্য জেদের বশে পশুর মতো ব্যবহার? ইস্মিতা ভুলতে পারছে না ব্যাপারটা। পারবেও না কখনো। তার বুকের ভেতরটা ঠান্ডা, জড় হয়ে জমে গেছে। লজ্জা, ক্ষোভ, হতাশায় মিশে একরকম অর্ধমৃত। এই ঘটনার পর সে আর আকাশের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। নিজেকে তার ভাইয়ের স্থানে ভাবলেই ভেতরটা অস্থিরতায় ছেয়ে যাচ্ছে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নীরব বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে তারপর কাঠগলায় ইস্মি জবাব দিলো, “সেসব জেনে আপনার আদৌ কোনো লাভ আছে? নেই। আপনি বরং নিজের কাজে মন দিন। হিসাবপত্র দেখুন, ফাইল সাইন করুন। লাভ হবে।”
ইজহান ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে ইস্মিতার দিকে তাকাল। মেয়েটা আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। ইজহানের বুকে ধাক্কা লাগল একটা। স্তব্ধ মুখে বলল, “আমি জানতে চাইলে সমস্যা?”
“হ্যাঁ।”
“কীসের সমস্যা?”
“জেনে আপনার তেমন কোনো লাভ হবে না।”
“আমি লাভের জন্য জানতে চাইছি?”
ইস্মি থম ধরা কণ্ঠে অস্পষ্ট জবাব দিলো, “উহুম।”
ইজহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, “পরিষ্কার কথা বলো। আমি সবকিছু নিজের লাভের জন্য করি?”
“দয়া করে কথা প্যাঁচিয়ে এটাকে ঝগড়ার দিকে টেনে নিয়ে যাবেন না। আপনার মেয়ে ভয় পাবে। আমার জন্য না হলেও মেয়ের জন্য একটু কনসিডার করুন। আমি ঝগড়া করতে পারদর্শী না, চাইও না।”
এই কথাটা ইজহানের গায়ে ঘুষির মতো লাগল।
সে সবকিছু নিজের লাভের জন্য করে? হ্যাঁ করে। কিন্তু পাগলের মতো ভালোও তো বাসে। ইস্মিতা কি কখনোই অনুভব করতে পারে না তাকে? ইজহান হাতের ফাইলগুলো ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। এরপর কিছু না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ, চোখে ক্লান্তি, বুকের ভিতর পুড়ে যাচ্ছে এমন অসহনীয় অনুভূতি। সেরাতে আকাশের সাথে যা হয়েছে তা মোটেও উচিৎ হয়নি, অন্যায় হয়েছে। সংকোচ হলেও সেটা চেপে রেখে নিজ থেকে ফোন করে ওর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার কাছে আকাশের পুরোনো কন্ট্র্যাক্ট নাম্বার যেটা আছে, সেটা এই মুহূর্তে বন্ধ। নতুন নম্বর আছে ইস্মিতার কাছে। সে ভেবেছিল, একটা সুযোগ করে চেয়ে নেবে নাম্বারটা। কিন্তু ইস্মিতা তার উপরও ভীষণ অভিমান করেছে। অথচ সেই রাতেই সে মন থেকে আকাশকে সরি বলেছে। শুনে আকাশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল, “দাম্ভিক ইজহান শেখ আমাকে সরি বলছে? সরিটুকু না বলে আমার বোন আর ভাগ্নিকে দিয়ে দিন, নরক থেকে নিয়ে যাই!”
এতো বড়ো কথাটা বলার পর প্রতুত্তরে ইজহান শেখ কিছু বলেছে? না৷ কারণ তার বাড়িটা আসলেই একটা নরক আর সে সত্যিই অনুতপ্ত। ইজহান মেজাজ খারাপ করে মিজুকে ফোন দিলো। রিসিভ হতেই হড়বড় করে বলল, “বউ ভীষণ অভিমান করেছে। ওর অভিমান ভাঙাব কীভাবে?”
মিজু আমতাআমতা করতে করতে বলল, “আমি কীভাবে জানব স্যার? ম্যাডামরে জিজ্ঞাসা করেন।”
“আরে! বউ যদি বলতোই তাহলে তোর কাছে মারা খেতে ফোন দিয়েছি আমি? নূন্যতম কমনসেন্স নেই তোর? আমি তো ভাবতেই পারছি না তোর মতো একটা গাধা, মূর্খকে আমি এখনো কাজে রেখেছি।”
মিজুর ইচ্ছে করল মুখের উপর বলে দিতে যে, আপনার মতো আধপাগলের সাথে কাজ করার চেয়ে সারাজীবন বেকার থাকা ভালো। অন্তত রাতে বউকে আদর করার সময় কেউ বাগড়া দিয়ে বলবে না, ‘আম্মাজান ঘুমাচ্ছে, বউটাও। আমি ওদেরকে পাহারা দিচ্ছি। একা একা বোরিং লাগছে। আয় তোর সঙ্গে নতুন ডিলটা নিয়ে ডিসকাস করি।’ বউকে বুকে জড়িয়ে নতুন ডিল নিয়ে ডিসকাস করতে কার ভালো লাগে? মিজুর তো ইচ্ছে করে স্যারের মাথাটাই ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু সে অপারগ! তবে সুযোগ যদি হয়, একবার না একবার স্যারকে সে নাকানিচুবানি খাওয়াবেই খাওয়াবে। মনে মনে শেখদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিজু বলল, “মিষ্টি মিষ্টি কথা বইলা দেখেন স্যার। বাবু সোনা ডাকেন, তাইলে যদি রাগ ভাঙে।”
“বাবুসোনা ডাকতে হবে?”
মিজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কেন আপনি আগে ডাকেন নাই স্যার?”
ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “না তো।”
মিজু আচমকা ঠাট্টার স্বরে বলেই ফেলল, “কী বিবাহিত জীবন কাটাইলেন স্যার, যদি বউরে আদর কইরা বাবুসোনাই না ডাকেন? ফুল, চকলেট দেন না, ঘুরতে নিয়া যান না, আদর কইরা ডাকেনও না। শাসনের উপরে রাখেন শুধু। আপনার বিবাহিত জীবনের ৬০% ই তো লস।”
“৬০℅ লস?”
“জি স্যার। এইসব আহ্লাদীপনা না দেখাইলে মেয়েমানুষরে বশে রাখা যায় না। আর যদিও যায়, তাইলে ওই ম্যাডামের মতোই হইয়া যায়। নিজের মনে কী চলে তা খুইলা বলতে পারে না। ভিতরে ভিতরে কষ্ট৷ আফসোস, অভিমানের পাহাড় নিয়া একদিন হার্ট-অ্যাটার্ক করে দুনিয়া ত্যাগ করে।”
মিজুর কথাগুলো শুনে ইজহান চিন্তিত হয়ে পড়ল। ফিরে গেল ঘরে। ইস্মি তখন মেঝে থেকে তার ছুঁড়ে ফেলা কাগজপত্র তুলছে। ইজহান ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে ওকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল, “রেগে কেন?”
ইস্মি শরীর মুচড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “রেগে নেই।”
“তাহলে এতো কঠিন কথা শোনানো হলো কেন?”
“মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। দুঃখিত।”
আহারে! বউটা নির্দোষ হওয়া স্বত্তেও তার সঙ্গে সহজ নয় বলে নিজে থেকে ক্ষমা চাইছে। সে যদি বন্ধুর মতো মিশতো তাহলে এতোটা জটিল হতো না সম্পর্কটা। ইজহান ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে চট করে ওকে সামনের দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে মুখটা দু'হাতে আগলে তৃষ্ণার্তের ন্যায় ওষ্ঠে অধর মিলিয়ে দিয়ে শুষে নিতে চাইল ওর সব রাগাভিমান। ইস্মি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো না। জানে, ছাড়বে না।
ইজহান নিজের বোধ হারাল না। ঠোঁট ছেড়ে ওর কপালে চুমু বসিয়ে ইস্মিকে বুকে টেনে নিয়ে গভীর গলায় বলল, “আকাশ সাহেবের সঙ্গে যা হয়েছে তা উচিৎ হয়নি। আরসালান একদমই ঠিক করেনি, অন্যায় করেছে। আমি ওর হয়ে মন থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আর কখনো ওমন ভুল হবে না। আমি হতে দেব না। আমার ইস্মিতাকে যেমন এ বাড়ির কেউ অসম্মান করতে পারবে না, তার বাপ-ভাইকেও না। তাদের সবার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আমি ইজহান শেখ, আজ থেকে নিজে নিলাম। আমি ভীষণই অনুতপ্ত ইস্মিতা। তোমার কাছে, তোমার ভাইয়ের কাছেও।”
বলে নোটবুক থেকে আকাশের ফোন নাম্বার জোগাড় করে ইস্মির সামনেই ওকে ফোন দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমা চেয়ে নিলো। সিরাজ সাহেবের সাথেও কথা বলল নিজে থেকেই৷ এটাও বলল যে, সে তার তিন বাচ্চা আর ইস্মিতাকে নিয়ে আজ রাতে তাদের বাড়িতে যাবে। শ্বশুরমশাই যাতে বেগুন ভাজা, ডিম ভুনা আর আচার করে রাখে। সে খিচুড়ি দিয়ে খাবে। দই হলেও ভালো হয়। টনা-মনা আর তার মায়ের জন্যও যাতে বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। একচুল কমতি হলেও সে নিন্দা করতে ছাড়বে না। এদিকে আধপাগল জামাইয়ের মুখ থেকে এসব শুনে ফোনের ওপাশে হতভম্ব সিরাজ সাহেব। তিনি সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ জপলেন। ফোন রেখে একপাশে ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে চোখের ইস্মির চোখের কার্নিশ বেয়ে পড়া অশ্রুকণা দু'হাতে মুছে দিয়ে ইজহান আবারও বলল, “ইস্মিতা জানে, সে রেগে থাকলে আমার দিন ভালো যায় না।”
ইস্মি হাসলো। পায়ের পাতা উঁচু করে ওর কণ্ঠমণিতে চুমু বসিয়ে দিয়ে বলল, “পাগল। এভাবে কেউ শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে? হুমকি দেয়?”
“তোমাকে ওরা কম ভালোবাসে তাইতো হুমকি দেই।”
ইস্মি নাক কুঁচকাল, “মোটেও না।”
“মোটেও হ্যাঁ৷”
“সব ভালোবাসা যেন আপনিই আমাকে ভালোবাসেন?”
“সেটা তুমি বুঝো না সোনা?”
ইস্মি লজ্জা পেয়ে গেল হঠাৎ, “ইশ! কথার কী ছিঁড়ি।”
“কী ছিঁড়ি বাবু?”
ইস্মি নাক কুঁচকাল, “আমি বাবু? আমার নিজেরই একটা বাবু আছে। আমাকে বলছে বাবু! যত্তসব ঢং। বুড়ো বয়সে ভিমরতি।”
ইজহান গভীর চোখে দেখল ইস্মির গাল লাল হয়ে গেছে। লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা। তার মানে ঔষধ একটুখানি কাজ করেছে। তবে বুড়ো বলায় সে ইস্মিকে সাবধানী কণ্ঠে বলল, “তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ আমার বয়স পঁচিশ।”
“পঁচিশ না ছাই।”
তাচ্ছিল্য গায়ে না মেখেই ইজহান গম্ভীর স্বরে বলল,
“অফিসের আব্দুল চাচাই তো বলল, আমার বয়স নাকি তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে একটুও বাড়েনি।” একজন তো চিরকুটে লিখল, “এভারগ্রীন ইজহান শেখ।”
ইস্মি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “চিরকুট পাঠিয়ে বলল? প্রেরকের নাম কী?”
“মে বি জেরিন।”
ঠোঁট উল্টে দোটানায় ভুগে বলল ইজহান। যেন সে নিশ্চিত নয়। ইস্মির মাথার একটা কুবুদ্ধি খেলে গেল হঠাৎ। বাস্তবতা জানা থাকা স্বত্তেও মেকি রাগ দেখিয়ে ইজহানের গালে আঁচড় কেটে সরে গিয়ে মেয়ের নিকটে অভিযোগ ছুঁড়ল, “তোমার মাম্মাকে বাড়িতে রেখে পাপা অফিসে গিয়ে পরকীয়া করে বেড়ায়, মা।।এজন্যই তো তাকে পড়াশোনা করতে দেয় না, বাড়ি থেকে বেরও হতে দেয় না। যদি সত্যটা সামনে চলে আসে তাহলে তো জানে, আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব। নিজের মতো বাঁচব। আমাকে যাতে খোঁড়া করে রাখা যায় সেজন্যই তার এতসব চালবাজি। আজ বুঝেছি আমার জায়গাটা কোথায়!”
খোশমেজাজে থাকা ইজহানের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তড়াক করে ইস্মিকে সাফাই দেয়ার মতো করে বলল, “বিলিভ মি, জেরিন নামক কোনো মেয়ে আমার অফিসে নেই। সে বাবার অফিসের এমপ্লয়৷ একটা মিটিংয়েই তার সাথে দেখা। আমার কাছ থেকে পেন নিয়েছিল। দেওয়ার সময় আমার মুখে বিরক্তি ভাবও ছিল। আমি কোনো উস্কানি দিইনি। তারপরেও সে মিটিং শেষ করে এই চিরকুটটা দিয়েছিল। অনেক আগের কথা। আমার তো এর চেহারাও মনে নেই৷ আম্মাজানের সামনে আমার মাথা নিচু করে দিও না ইস্মিতা...”
মুখখানা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল ইজহানের। ইস্মি ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। ইজহান ভাবল বউ হয়তো তার আরো রেগে গেছে সে কলম দিয়েছে বলে, তাই ইস্মিতাকে বোঝানোর জন্য ইহসানকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো। শত হলেও তার বউ ভেড়ার কথা মানে৷ এদিকে ইহসান ওর কান্ডকীর্তিতে বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে বলল, “বউদের মনে একবার সন্দেহ ঢুকলে সহজে বের হতে চায় না। এরচেয়ে জিজ্ঞেস কর ওর কী প্রমাণ লাগবে, কী চায়?
যা চায় তা-ই করতে দিবি। তাহলে অন্তত তোর প্রতি একটু সুনজর থাকবে।”
ইজহান গলা খাকারি দিয়ে ইস্মিকে জিজ্ঞেস করল সে কী চায়, কীভাবে প্রমাণ দিলে বিশ্বাস করবে জেরিন বলে কারো সাথে তার কোনো কাহিনী নেই। শুনে সুযোগ বুঝে ইস্মি বলেও ফেলল, সে আর অন্ধ জগতের বাসিন্দা হয়ে খোঁড়া থাকতে চায় না। স্বাভাবিকভাবে সংসার সামলে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায়।
বউয়ের এতো বড়ো চাওয়ার কথা শুনে ইজহান শেখের মাথা ঘুরে উঠল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে থমকে দাঁড়িয়ে রইল সে। ইহসান হাসি চেপে বলল, “কলিজা চায়নি, পড়তে চেয়েছে। মেনে নিলেই জীবন সুন্দর।”
কলিজা চাইলে তাও দিয়ে দিতো ইজহান শেখ,
কিন্তু বাইরে গিয়ে ছেলেপুলেদের সঙ্গে ঢ্যাংঢ্যাং করে পড়াশোনা? স্বপ্নেও আঁৎকে উঠে সে।
[ইজহান, ইজহান করছিলেন, দিলাম ওকে।]
________
[আপনাদের বোরিং লাগবে পর্বগুলো, ভালো করে লিখতে পারছি না। আমার অপারতার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে...