25/03/2024
‘আমার যখন তিন নাম্বার মাইয়াটা হইলো, আমি ওরে দুধ দিতাম না। ও কানত, আমি দরজার দাঁড়ায় ওর কান্দন দ্যাখতাম। আমি চাইতাম, দুধ না পাইয়া অই মইরা যাক।’
আমিনা খালার কথা শুনে আমি শিউরে উঠি। তিনি আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘এই যে তোমার তিন নাম্বার মাইয়া হইলো, তুমি অখুশি হও নাই তো? আমার মাইয়াটা সেদিন মরে নাই, পরে মরছিল। বিয়ার পর বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়া মইরা গেল। খুব ভালা ছিল।
আমি পোলার জন্য পাগল আছিলাম। আল্লায় আমারে তিন মাইয়ার পর পোলা দিছিল। সেই পোলার জন্য গ্রাম ছাড়ছি, নেশা কইরা সবখানে সে ধারদেনা করছে।
পোলায় আমাক মারতে আসে। পাওনাদারদের ডরে আমি গ্রাম ছাড়ি। এখন মানষের বাড়ি কাজ-কাম কইরা খাই।’
আমিনা খালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাতিমার কাঁথা কাপড় ধুতে বাথরুমে চলে যায়। আমি সদ্য হওয়া তৃতীয়া কন্যা ফাতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
কন্যা শিশুদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কত মায়া আর সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। আর সেই কন্যা সন্তান পিতা-মাতার কাছে বোঝার মতো মনে হয়! এই দোষ কী শুধুই পিতা-মাতার! না, এই দোষ এই সমাজের!
একজন মেয়েকে বড় করতে বাবা-মায়ের যে কী পরিমাণ এফোর্ট দিতে হয়, তা শুধু মেয়ের পিতা-মাতাই জানে।
আমি বিকেলে ভার্সিটি থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম। সন্ধ্যেয় বড় আর মেঝো কন্যাকে মাদরাসায় রাখতে যেতাম। বড় মেয়ে আফসোস করে বলত, ‘আম্মু, আমি ছেলে হলে তোমার এত কষ্ট হতো না। আমি মারইয়ামকে সাথে নিয়ে একাই যেতে পারতাম!’
কন্যাদের আগলে রাখো, নিরাপত্তা দিয়ে বড় করো, তারপর ভালো দেখে বিয়ে দাও। বিয়ে দিতে কত মেয়ের বাপকে আমি ঋণগ্রস্ত হতে দেখেছি। পাত্রপক্ষের হাজার মানুষকে গলা অব্দি খাওয়াও। মেয়েকে সাজিয়ে দেবার কথা বলে ফার্নিচার, গয়না, মোটরসাইকেল যা পায় তারা হাতিয়ে নেয়।
মেয়ে বিয়ে দিয়েও শান্তি নাই। ইফতারি পাঠাও, কুরবানির গরু-ছাগল পাঠাও। বাচ্চা হলে অপারেশনের টাকা দাও, আকিকার ছাগল দাও। পারলে মেয়ের বাপের কলিজাটা ছিঁড়ে খাও।
কেন মানুষ কন্যা সন্তান চাইবে? জাহেলি যুগের মতো কন্যা সন্তানকে হত্যা করা ছাড়া তো উপায় নাই! কিছুদিন আগে, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে সন্তানের লিঙ্গ জানানো হাইকোর্ট থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কেন এমন আইন করা হলো, ভাবুন তো?
আমাকে এ পর্যন্ত যতজন জিজ্ঞেস করেছে, কয় সন্তান? আমি উত্তরে বলেছি, ‘তিন কন্যা, আলহামদুলিল্লাহ!’
বলার পর অনেকেই বলেছে, ‘আহা, এতগুলা মেয়ে। একটা ছেলেও নাই!’ আবার কেউ সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, ‘হোক মেয়ে, এখন তো মেয়েরাই ছেলে! মেয়ে কামাই করে খাওয়াবে!’
ইতিবাচক মন্তব্য খুব কমই পেয়েছি। এই সমাজ কন্যা শিশুদের জন্য নয়। এই নোংরা সমাজটা পরিবর্তনের দায়িত্ব আমাদের, যাতে বাবা-মাকে কন্যা জন্মানোর পর মুখ কালো করতে না হয়।
__________________
| আহা, এতগুলা মেয়ে! |
উম্মে বুশরা সুমনা