
24/06/2025
গল্প :- #কোমলময়ী_আজালিয়া
লেখিকা :- #আরভিন_জুহায়না
পর্ব ১
হলরুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
চারপাশে নিঃশব্দের এক চাপা উত্তেজনা।
সেই মুহূর্তেই সদর দরজার ভারী কাঠের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো একদল পুরুষ। তাদের সবার আগে আছে শ্যাম বর্ণের রোহান।
তার মুখ কঠিন, চোখে চাপা আগুন।
তার সঙ্গে তার দুই চাচা—রিজওয়ান ইফতিয়ার খান ও ইফাদ করিম খান , এবং ইফতিয়ারের পুত্র আবিদ, ইফাদের দুই পুত্র নোমান হাসান।
এক মুহূর্তে মেয়েটির দৃষ্টি আটকে গেল রোহানের চোখে।
দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এক অদৃশ্য যুদ্ধে।
— "তুমি জানো না, তুমি কী করেছো!"
রোহানের গলা নীরব অথচ ভয়ানক দৃঢ়।
মেয়েটি চুপ।
তার চোখে ভয় নেই, আছে ক্লান্তি আর ঘৃণা।
— "এইভাবে এক অপরিচিত ছেলের সাথে বিয়ে করা যায়? সেটা যদি গুন্ডা হয়, তাও?"
রিজওয়ান চাচার মুখে তীব্র অভিমানের ছায়া।
— "কার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সেটা আমার সিদ্ধান্ত।
আপনাদের সঙ্গে আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব রাখার কোনো সম্পর্ক নেই।"
মেয়েটির কণ্ঠে এখন এক অদ্ভুত জড়তা—একটা যেন অনেকবার বলা হয়ে যাওয়া সংলাপ।
— "চুপ! মুখে এত ভাষা? তুমি এই বাড়ির মেয়েই তো, না অন্য কোথাও থেকে কিনে আনা?"
করিম চাচার মুখ থেকে ছিটকে পড়লো তীব্র অপমান।
চারপাশে কাটা ঘাসের মতো নীরবতা।
কারো মুখে প্রতিবাদ নেই।
সবার চোখ মেয়েটির দিকে, যেন সে কোনো অপরাধী।
রোহান বাড়ির দুজন ভৃত্যকে ডাকলো,
— "তাকে ওখানে নিয়ে যাও।"
রোহান মাথা ঘুরিয়ে বলে দিলো, চোখে এক বিন্দু কৃপাও নেই।
সবার দয়া না হলেও আবিদের কেন জানি মেয়েটার জন্য খারাপ লাগলো।
রোহানের আদেশে ভৃত্যরা এগিয়ে এসে মেয়েটিকে ঘিরে ধরে। মেয়েটি কিছুই বলেনা। শুধু একবার দীর্ঘদৃষ্টিতে চারপাশ দেখে নিলো। সব অচেনা মুখ। এই মানুষগুলোর মাঝে একটিও চোখ নেই, যেখানে তার জন্য সহানুভূতি আছে।
হলরুম পেরিয়ে তাকে একটি অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
ঘরটি পুরোনো, তবে খুব বড় রাজকীয় ধরণের। মেয়েটা চারদিকে নজর বুলালো দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি বিড়বিড় করে বললো "আমাকে জাস্ট একবার এই বাড়ি থেকে বের হতে দাও, আই প্রমিস ধ্বংস লীলা রচনা করবো আমি"
🍂🍂
দুই ঘন্টা হয়ে গেছে মেয়েটাকে বন্দি করা হয়েছে সারাদিন কিচ্ছুটি খাওয়া হয় নি। তবুও মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে না খাওয়ার অভাবে কষ্ট তো হচ্ছে সেই মানুষটার জন্য যার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে।
হঠাৎ দরজায় ধীরে ধীরে শব্দ হলো।
একটা চাবি ঘুরে খুলে গেল দরজা।
ভিতরে প্রবেশ করলেন একজন মানুষ—
সুফিয়া বেগম।
তার চোখে নেই কোনো অভিযোগ।
চলাফেরায় নেই রাগ কিংবা ভয়।
তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসে পড়লেন মেয়েটার পাশে।
দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—
— "তোর চোখে আমি যে কষ্টটা দেখি, সেটা কেউ বোঝে না রে মা।
এই বাড়িতে রক্ত আছে, কিন্তু হৃদয় নেই।"
মেয়েটা চুপচাপ শুনে যায়।
একটু পর নিজের গলা ভেঙে বলে—
— "আমি কারো চোখে মানুষ নই দাদিমা। আমি একটা ভুল, আমি এক কলঙ্ক।"
সুফিয়া বেগম তার হাত ধরলেন, গলা কাঁপছে, কিন্তু শান্ত।
— "তুই একটা কলঙ্ক না মা। তুই একটা অসম্ভব সুন্দর, অসম্ভব সাহসী মেয়ে।
যারা তোকে বোঝে না, তারা তোদের কোনোদিন বুঝবেও না।
কিন্তু তুই নিজের ভিতরে বিশ্বাস রাখিস।
কারণ এই লড়াইটা তোর একার, আর এই যুদ্ধ একদিন গল্প হয়ে থাকবে,
যে গল্পে সবাই জানবে—‘কোমলময়ী’ মানে শুধু নরম নয়,
তা কাঁটার মধ্যেও ফুল ফোটায়।”
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
কেবল একটা দৃশ্য থেকে গেল—
এক বৃদ্ধা নারীর কাঁপা হাত, আর এক তরুণীর নিরব চোখ—যার ভেতরে কেবলই আগুন।
বাহির থেকে উঁকি দিয়ে তাদের সব কথোপকথনই শুনলো রাইতা। তবে ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হলোনা, ভেতরে গেলে যদি আপুটার অস্বস্তি হয়? কিন্তু হাতে তো খাবারের থালা ফুপিমনি পাঠিয়েছে আড়ালে। খাবারটা না দিলে খাবে কি? সারাদিন তো কিচ্ছু খায়নি।
— "তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?"
হঠাৎ কারোর আওয়াজে চমকে উঠলো রাইতা। আমতা আমতা করে বললো,
— "না মানে আপু আ আসলে...."
— "ভেতরে এসো"
শান্ত স্বরে বললো মেয়েটি। রাইতা অনুমতি পেয়ে সাথে সাথে ঘরে ঢুকে গেছে। দরজাটা লাগিয়ে মেয়েটার সামনে এসে বসলো। হাতে থাকা প্লেটটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— "ফুপিমনি পাঠিয়েছে তোমার জন্য"
— "উনি আবার কে?"
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মেয়েটা। এবাড়িতে কেউ তার প্রতি সদয় হয়েছে ভাবতেই অবাক লাগে।
— "আমার ছোট মেয়ে আয়েশা"
সুফিয়া বেগম জবাব দিলেন। মেয়েটা খাবারের প্লেটের দিকে তাকালো পোলাও আর রোস্ট আছে দেখতে ভালো কিন্তু সে তো রোস্ট খায়না, ফ্রাই খায়। কিন্তু এই মুহূর্তে খুব দুর্বল লাগছে শরীর। কিছু না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে তখন এখান থেকে মুক্তি পাবে কি করে!
খাবারের দিকে তাকিয়ে আকাশকুসুম ভাবতে দেখে রাইতা প্রশ্ন করে,
— "কি ভাবছো এতো?"
— "কিছুনা"
মেয়েটা রাইতার হাত থেকে প্লেটটা নিবে ঐ সময়ই রাইতা জিজ্ঞেস করে,
— "তোমার নাম কি?"
মেয়েটা রাইতার দিকে তাকালো। শান্ত কণ্ঠে বললো,
— "রাইয়া, রাইয়া জেইন"
রাইতা কিছু বললো না। আর মেয়েটাও তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। মেয়েটার খাওয়ার ভঙ্গিতেও কেমন একটা রাজকীয় ভাব উপচে পরছে।
রাইতা মনে মনে বললো "এ কি আমি কোনো রানী কে দেখছি?"
বোকা রাইতা হয়তো জানে না যে সে আসলেই একটা রানী কে দেখছে। উঁহু কোনো রাজ্যের কিংবা দেশের রানী নয় বরং কারোর হৃদয়ের রানী!
চলবে 🌷
[ পড়ে গঠনমূলক কমেন্ট করবেন ]