
30/06/2025
"প্রায় নিভে যাওয়া এক দীপ্তির গল্প"-পুরানো গল্প নতুন করে লেখাঃ
সে ছিল শ্রেণিকক্ষের কোণায় নীরবে বসে থাকা এক বিষণ্ন মুখ। কেউ তাকে খুব একটা খেয়াল করত না। কারণ তার উপস্থিতি ছিল নিস্তব্ধতার মতো একেবারে নীরব, নিস্পৃহ আর নিস্প্রভ।
কিন্তু সময়ের পাতায় এক দিন এমন কিছু ঘটে যা বদলে দেয় তার সমস্ত অনাগত জীবন।
পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসে এক সকালে শিক্ষিকা মিস থমসন মৃদু হেসে বললেন- আমি তোমাদের সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসি।
শব্দগুলো শুধু বাতাসে ভাসে। কিন্তু তা পুরোপুরি সত্য ছিল না। এই “সবাই”থেকে বাদ পড়েছিলো একটিমাত্র নাম "টেডি"।
কারণ- টেডি ছিলো অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন, ক্লান্ত মুখে ক্লাসে বসে থাকা এক কিশোর। তার দৃষ্টিতে ছিল না কোনো কৌতূহল, মনোযোগে ছিল না কোনো তৃষ্ণা। পরীক্ষার খাতায় বারবার ব্যর্থতাই ছিলো টেডির একমাত্র পরিচয়।
মিস থমসনের কাছে সে যেন ছিল কেবল নামমাত্র উপস্থিতি। এমনও দিন গেছে যেদিন টেডির খাতায় “ব্যর্থ” শব্দটি জোড়ালো লাল কালিতে লিখে দিতে পারলেই তার তৃপ্তি হতো।
তবে সময় থেমে থাকে না।
একদিন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ফাইলগুলো পর্যালোচনার সময় হঠাৎই মিস থমসনের হাতে পড়ে টেডির ফাইল।
প্রথম শ্রেণি: টেডি উজ্জ্বল, পরিপাটি ও মেধাবী একজন ছাত্র। পড়াশোনায় আগ্রহী এবং সহপাঠীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়।
দ্বিতীয় শ্রেণি: টেডির মা অসুস্থ। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। টেডি কিছুটা উদাস এবং মনমরা হয়ে গেছে।
তৃতীয় শ্রেণি: টেডির মা গতকাল ক্যান্সার হাসপাতালে মারা গেছেন। সে একা। তার বাবা অনেক আগেই চলে গেছেন। যিনি আর ফিরে আসেননি।
চতুর্থ শ্রেণি: টেডি দিন দিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। কারো সাথে কথা বলে না। কোনো কিছুতেই আগ্রহ দেখায় না। সে এক গভীর শূন্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে।
এইসব শব্দ যেন মিস থমসনের হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে তোলে । তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বুক ভরে উঠে নিদারুন অপরাধবোধ। সেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন শুধু শিক্ষক হিসেবে নয়। একজন মানুষ হিসেবেও কোথাও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
বড়দিনের সকালে প্রতিটি শিশু যখন মিস থমসনের জন্য চকচকে মোড়কে ঢাকা উপহার নিয়ে আসে। তখন টেডি এগিয়ে এলো একটি পুরনো কাগজে মোড়ানো ছোট ব্যাগ নিয়ে। সেখানে ছিল একটি পুরনো হার যার কিছু পাথর খসে পড়েছে। আর ছিল প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া পারফিউমের ছোট একটি পুরানো শিশি।
শ্রেণিকক্ষে হাসির রোল উঠে।
কিন্তু মিস থমসন হাসি থামিয়ে গলায় পরে নিলেন খসে যাওয়া পাথরের সেই হার। আর নিজের গায়ে মাখলেন অতি পুরানো পারফিউম।
টেডি ক্লাস শেষে মিস থমসনকে ফিসফিস করে বলে- আজ আপনার গায়ের গন্ধটা ঠিক যেন আমার মায়ের মতো।
সেই মুহূর্তে মিস থমসন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ভালোবাসা আর অনুশোচনার জোয়ারে তিনি টেডিকে জড়িয়ে ধরলেন।
সেদিন থেকেই বদলে গেল দুজন।
টেডির চোখে ফিরে এলো হারিয়ে যাওয়া আলো। সে আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসলো। প্রতিটি পরীক্ষায় সে যেন নিজের অস্তিত্বের নতুন পরিচয় দেয়া শুরু করলো।
আর মিস থমসন?
তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন—হয়ে উঠলেন একজন পথপ্রদর্শক, একজন মমতাময়ী মা।
দিন, মাস বদলালো। বছর শেষ হয়ে এলো।
ক্লাসের শেষ দিনে টেডি একটি ছোট চিরকুটে লিখলো: আপনি আমার দেখা সবচেয়ে ভালো শিক্ষিকা।
উত্তরে মিস থমসন লিখলেন: কারণ হলে তুমি। তুমিই আমাকে শেখালে কীভাবে একজন প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায়। একজন মমতাময়ী মা হওয়া যায়।
এরপর কেটে যায় অনেক বছর।
টেডি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক , কলেজ সব পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যায় দূর শহরে।
আর মিস থমসন?
বয়সের ভারে চুলে সাদা রেখা পড়ে। চোখে পড়ে বয়সের ছাপ। পুরোনো ছাত্ররা কদাচিৎ চিঠি পাঠায়। জীবনের ছায়া আর আলোয় ঘেরা এক নিস্তরঙ্গ দিনযাপন তার।
একদিন হঠাৎ ওয়াশিংটন মেডিকেল কলেজ থেকে তাঁর নামে আসে একটি সিল করা খাম।
ভেতরে লেখা:
আমরা আনন্দের সাথে স্নাতক অনুষ্ঠানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি—টেডি স্টোডার্ডের পক্ষ থেকে।
মিস থমসন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। গলায় পরে আসেন সেই পুরনো হার যেটা একদিন ক্লাসে উপহারের মতো পেয়েছিলেন। শরীরে মেখে নেন সেই পুরানো শিশিতে লেগে থাকা অতি পুরানো সেই পারফিউম।
স্নাতক মঞ্চে দাঁড়িয়ে টেডি বলে ওঠে-
আমি আজ যা হয়েছি তার পেছনে একজনেরই অবদান। আমার সেই শিক্ষিকা যিনি একদিন আমার মধ্যে আলো খুঁজে পেয়েছিলেন। যখন সবাই শুধু দেখছিলো আমার মাঝে ব্যর্থতা আর অন্ধকার।
মিস থমসন এবার গর্ব, ভালোবাসায় আর আনন্দে টেডিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।
নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন - কে এই টেডি।
তিনি আজ ডা. টেডি স্টোডার্ড। বিশ্বের খ্যাতনামা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। স্টোডার্ড ক্যান্সার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা।
আর অবাক করা ব্যাপার তিনি এই হাসপাতালের ৫০% মালিকানা দান করেছেন এমন এক মানুষের নামে। তিনি আর কেউ নন। তিনি মিস থমসন। যিনি এক নিভে যাওয়া সলতেকে দীপ্তিমান করে তোলেছিলেন তার পরিচর্যা, স্নেহ ,বিশ্বাস আর ভালোবাসায়।
প্রতিটি টেডির পেছনে থাকে এমন একজন যিনি দেখতে পান ব্যর্থতার আড়ালে থাকা সম্ভাবনার দীপ্তি। আর প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া শিশুর গল্পে থাকে এমন এক প্রতিকূল অবস্থা যা তার প্রতিভাকে বিকশিত হতে দেয় না। হারিয়ে যাওয়া ফুলকলির মতো ফুটার আগেই সে ঝরে যায়।
কারণ কোনো শিশুই ব্যর্থ হয়ে জন্মায় না। পরিবেশ, পরিচর্যা আর নিয়তিই শুধু তাকে ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখায়।
আরিফ মাহমুদ