23/06/2025
বাছুরের টিকা ব্যবস্থাপনা ও গরুর কয়েকটি প্রাণঘাতী রোগ: সম্পূর্ণ নির্দেশিকা!
গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন গবাদিপশু-পাখির নানা ধরনের রোগবালাই হয়ে থাকে, যা খামারিদের দুশ্চিন্তার কারণ। তবে সময়মতো সঠিক টিকা প্রদান এবং রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকলে অনেক রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে বাছুরের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ প্রকাশের আগেই টিকা দিয়ে দিলে তাদের রোগমুক্ত রাখা যায়।
প্রথমেই, বাছুরের টিকা ব্যবস্থাপনা জানার আগে গরু ও অন্যান্য গবাদিপশুর কিছু প্রাণঘাতী রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. তড়কা রোগ (উবামড়কি/গলি/ধড়কা/তীরাজ্বর):
এটি একটি অত্যন্ত মারাত্মক রোগ যা দ্রুত প্রাণহানির কারণ হয়।
কারণ: গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়। বর্ষাকালের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। গরু, ছাগল, মহিষ এবং ভেড়ার এই রোগ হতে পারে।
লক্ষণ:
দেহের লোম খাড়া হয়ে যায়।
দেহের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে।
শরীরে কাঁপুনি ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ও গভীর হয়।
নাক, মুখ ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
পাতলা ও কালো পায়খানা হয়।
ঘাড়ের পিছনে চামড়ার নিচে তরল পদার্থ জমে ফুলে ওঠে।
ক্ষুধামন্দা, পেট ফাঁপা এবং পেটের ব্যথা হয়।
লক্ষণ প্রকাশের ১-৩ দিনের মধ্যেই পশু ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।
মৃত্যুর পরপরই পেট দ্রুত ফুলে ওঠে এবং রক্ত জমাট বাঁধে না।
প্রতিরোধ:
পশুর বয়স ৬ মাস হলে প্রথমবার তড়কা রোগের টিকা দিতে হবে। এরপর প্রতি বছর একবার করে এই টিকা দিতে হবে।
আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা রাখতে হবে।
পশুর মল, রক্ত এবং মৃতদেহ ভালোভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, জীবাণুমুক্ত এবং শুষ্ক স্থানে পশুকে লালন-পালন করতে হবে।
চিকিৎসা:
পেনিসিলিন, বাইপেন ভেট, জেনাসিন ভেট বা এম্পিসিন ভেট ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও, স্ট্রেপটোমাইসিন বা এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন ব্যবহার করা যেতে পারে। (তবে যেকোনো ঔষধ প্রয়োগের আগে ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।)
২. খুরারোগ (বাতা, জ্বারা, তাপা, এসো, খুরাপাকা):
এটি জোড়া খুরবিশিষ্ট পশুর একটি পরিচিত ভাইরাসঘটিত রোগ।
কারণ: পিকরনা নামক ভাইরাস দ্বারা এই রোগ হয়। গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদিতে এর সংক্রমণ দেখা যায়। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এই রোগ বেশি ছড়ায়।
লক্ষণ:
মুখে, জিহ্বায় এবং খুরে ফোস্কা পড়ে।
ফোস্কা ফেটে ঘা হয়।
নাক ও মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
পশু খুঁড়িয়ে হাঁটে।
পশু শক্ত কিছু খেতে পারে না।
ওলানের বাঁটে ক্ষত হয়, দুর্গন্ধ বের হয় এবং কষ ঝরে।
ধীরে ধীরে পায়ের খুর খসে পড়তে পারে।
পশু দুর্বল হয়ে পড়ে।
দেহের তাপমাত্রা বাড়ে।
গাভীর দুধ কমে যায়।
প্রতিরোধ: তড়কা রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও টিকা প্রদান জরুরি।
চিকিৎসা:
হালকা গরম পানির সাথে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ক্ষতস্থানে দিনে ২-৩ বার ধুয়ে দিতে হবে।
সোহাগা (বোরাক্স) বা বরিক পাউডার মধু বা গ্লিসারিনের সাথে মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে।
পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন (যেমন: প্রোনেপেন, এসপিভেট, ডায়াডেট, সুমিডভেট, জেনসিনভেট) দিতে হবে।
জ্বর কমানোর জন্য ডিক্লোডেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
নারকেল তেল ও তারপিন তেল ৪:১ অনুপাতে মিশিয়ে ক্ষতে লাগানো যেতে পারে।
পশুকে নরম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
সতর্কতা:
কাদামাটি বা পানিতে পশুকে রাখা যাবে না।
ক্ষতস্থান ঘষা যাবে না।
৩. বাদলা রোগ (কালো, জহরত, সুজওরা, কৃষজঙ্গ রোগ):
এটি মূলত তরুণ গবাদিপশুর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।
কারণ: গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই রোগ হয়। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সে এর সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। দেহের ক্ষত বা মলের মাধ্যমেও এটি সংক্রমিত হতে পারে।
লক্ষণ:
পশুর দেহের মাংসপেশি ফুলে যায় এবং গায়ের চামড়া খসখসে হয়।
ফোলা স্থানে গরম অনুভূত হয় এবং হাত দিলে চটচট শব্দ হয়।
ফোলা স্থানে পচন ধরে এবং পশু মারাও যেতে পারে।
দেহের তাপমাত্রা ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত বাড়ে।
কখনো পশুর পেট ফাঁপে এবং পশু খোঁড়াতে থাকে।
খাওয়া ও জাবর কাটা বন্ধ হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
দেহের পশম খাড়া হয় এবং পশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
আক্রান্ত স্থানে কাটলে গাঢ় লাল, দুর্গন্ধযুক্ত ফেনা বের হয়।
প্রতিরোধ: তড়কা রোগের প্রতিরোধ পদ্ধতির মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চিকিৎসা:
পশুর শিরা বা ত্বকের নিচে প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ হাজার ইউনিট পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে হবে।
অথবা, ৩-৫ মিলিগ্রাম টেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন দিতে হবে।
বিকল্প হিসেবে বাইপেনভেট, এম্পিসিনভেট বা এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে। (চিকিৎসকের পরামর্শ আবশ্যক।)
৪. ওলান ফোলা/প্রদাহ রোগ (ওলান পাকা, ঠুনকো ইত্যাদি):
দুগ্ধবতী গাভীর একটি সাধারণ কিন্তু মারাত্মক সমস্যা।
কারণ: ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে এই রোগ হয়। অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতসেঁতে বাসস্থান, ময়লা হাতে দুধ দোহানো এবং ওলানে আঘাত প্রভৃতি কারণে রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়।
লক্ষণ:
ওলান লাল হয়ে ফুলে যায়।
ওলান শক্ত ও গরম হয় এবং ওলানে ব্যথা হয়।
দুধ ছানার মতো ছাকা ছাকা হয়।
দুধের সাথে রক্ত বের হতে পারে।
ওলান ও বাঁট নষ্ট হয়ে গাভীর দুধ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিরোধ:
পশুকে শুকনো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে লালন-পালন করতে হবে।
ওলান সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে।
দুধ দোহনের আগে হাত জীবাণুনাশক দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
ওলান গরম হলে ঠান্ডা সেক এবং ঠান্ডা হলে গরম সেক দিতে হবে।
চিকিৎসা:
আক্রান্ত পশুকে জেনাসিনভেট, এম্পিসিন ভেট, ক্লোফেনাক ভেট বা এন্টিহিস্টাভেট ইনজেকশন দিতে হবে।
সরিষার তেল ও কর্পূর তেল মিশিয়ে ওলানে মালিশ করা যেতে পারে। (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ ব্যবহার করবেন না।)
৫. ডায়রিয়া/পাতলা পায়খানা/উদরাময় রোগ:
এটি বাছুর ও বয়স্ক গরু উভয়েরই একটি সাধারণ রোগ।
কারণ: ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া জাতীয় জীবাণু দ্বারা এই রোগ হয়। বর্ষার সময় দূষিত খড়, পচা লতাপাতা, পচা পানি বা পচা খাদ্য খেয়ে এর সংক্রমণ ঘটে।
লক্ষণ:
ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়।
মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
মলের সাথে রক্ত বের হতে পারে।
পেটের ডান দিকে চাপ দিলে পশু ব্যথা পায়।
প্রতিরোধ:
পশুকে পরিষ্কার ও টাটকা খাদ্য খাওয়াতে হবে।
বাছুর জন্মের পরই ২% আয়োডিন দিয়ে নাভি মুছে দিতে হবে।
জন্মের পর ২ ঘণ্টার মধ্যে শাল দুধ (কলোস্ট্রাম) বাছুরে কে খাওয়াতে হবে।
জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে।
চিকিৎসা:
স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
সালফা প্লাস ট্যাবলেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রয়োজনে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। (চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।)
৬. নিউমোনিয়া:
শ্বাসতন্ত্রের এই রোগটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে।
কারণ: বিভিন্ন জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, রিকেটশিয়া, ভাইরাস) ছাড়াও অ্যালার্জেন, আঘাত, ক্লান্তি, ঠান্ডা লাগা, বৃষ্টিতে ভেজা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং আর্দ্র আবহাওয়া ইত্যাদি কারণে এই রোগ হয়।
লক্ষণ:
আক্রান্ত পশুতে প্রথমে অল্প জ্বর ও কাশি দেখা যায়, পরে ঘন ঘন কাশি দেয়।
নাক ও মুখ দিয়ে সাদা সর্দি বের হয়।
দ্রুত ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শব্দ হয়।
প্রতিরোধ:
বৃষ্টি, ঠান্ডা, আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে পশু রাখা যাবে না।
শুকনো ও গরম স্থানে রাখতে হবে।
চিকিৎসা:
পশুকে জেনাসিনভেট, ওটেট্রাভেট বা কোট্রিমভেট ইনজেকশন দিতে হবে। (চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত নয়।)
বাছুরের বয়স অনুযায়ী যেসব টিকা দিতে হয়:
গরুর বাছুরকে সময়মতো টিকা প্রদান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের সুস্থ জীবন নিশ্চিত করে এবং খামারকে রোগমুক্ত রাখে। নিচে বাছুরের বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টিকার একটি তালিকা দেওয়া হলো:
৪৫ দিন: ক্ষুরারোগ
৪ মাস: ক্ষুরারোগ (বুস্টার ডোজ)
৬ মাস: বাদলা
৬ মাস ২১ দিন: তড়কা
৭ মাস ১৪ দিন: গলাফুলা
৮ মাস ৭ দিন: প্লেগ
১০ মাস: ক্ষুরারোগ (বুস্টার ডোজ)
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
গরুর মধ্যে যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ দেখলে দ্রুত উপজেলা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
#বাছুরেরটিকা #গরুরোগ #খামারি #পশুপালন #প্রাণিস্বাস্থ্য #টিকাকরণ #তড়কা #খুরা #বাদলা #ওলানপ্রদাহ #ডায়রিয়া #নিউমোনিয়া