13/07/2025
র*ক্তে*র সম্পর্ক কবে কাগজে হেরে যায়, জানেন?
সেদিনই, যেদিন র*ক্তে*র উষ্ণতার চেয়ে
একটি কাগজের শীতলতার স্পর্শ বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
যেদিন এক ভাই, ভাইয়ের চোখে নয়,
তাকায় দলিলের নির্জীব অক্ষরের দিকে।
মুখের কথার দাম কমে যায়,
স্ট্যাম্প পেপারের দাম বাড়ে।
সেদিনই,
সম্পর্কের পবিত্র দেয়ালে প্রথম চিড় ধরে।
একসময় যে বাড়িতে হাসির আওয়াজে মুখর ছিল উঠোন,
সেখানে এখন শুধু হিসেব চলে।
কে কত টাকা দিল, কে কতটা জমি পাবে,
কার বিয়েতে কে কী উপহার দিয়েছিল!
এসব নিয়েই আলোচনা, এসব নিয়েই মনোমালিন্য।
একটানা এই হিসেব-নিকেশের ভিড়ে সম্পর্কগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে, ভেঙে যেতে থাকে ভিতরের সেই অদৃশ্য বাঁধন।
সবচেয়ে কষ্ট হয় তখন, যখন দেখতে হয়,
একসাথে বড় হওয়া ভাইবোন আজ কথা বলে না।
একই উঠোনে খেলা, একসাথে পড়া, একসাথে বড় হওয়া
সবকিছু মুছে যায় কাগজের দাগে।
যে দাদা যিনি একসময় বোনের জন্য ছায়া ছিলেন,
আজ তাকান না পর্যন্ত বোনের ঘরের দিকে।
যে বোন যিনি একসময় দাদাকে নিয়ে গর্ব করতেন,
আজ তাঁকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেন ঘৃণাতে।
এই দূরত্বের শুরুটা বোঝা যায় না,
কিন্তু ফাঁকটা ধীরে ধীরে এতটাই বড় হয়ে যায়,
যেখানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
ভালোবাসা, স্নেহ, বিশ্বাস
সবকিছু বদলে যায় সন্দেহ, অভিযোগ আর নির্লিপ্ততায়।
আর এই ভাঙন চূড়ান্ত রূপ পায় তখন,
যখন মা-বাবা আর থাকেন না।
তাঁরাই ছিলেন সেই অদৃশ্য বন্ধন,
যার জন্য সবাই একটু হলেও একসাথে থাকত।
তাঁরা চলে গেলে কেউ কাউকে আর ধরে রাখার চেষ্টা করে না।
তখন সম্পর্কের জায়গায় জায়গা নেয় স্বার্থ, মিথ্যে অর্থ!
নিজেরটা বুঝে নেওয়ার তাড়নায় হারিয়ে যায় সমস্ত মায়া।
সবচেয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন সেই মা, যিনি একসময় বলতেন,
“যার কষ্ট বেশি, আমি তার কাছে আগে ছুটে যাই।”
আজ তিনি চুপ করে একটা ঘরের কোণায় বসে থাকেন।
কারণ তার ভাগে ঘর পড়েনি, তার তিল তিল করে গোছানো সংসারে যেন পড়ে গিয়েছে এক অদৃশ্য সরলরেখা।
এই ভাগাভাগির খেলায় কেউ পায় ঘর, কেউ জমি।
আর কেউ পায় ‘ত্যাজ্য’ এই শব্দটা।
হয়তো সে এক দাদা, হয়তো সে এক বোন, যে কোনো ভুল করেনি,
তবুও সবার অলক্ষে কেউ বলে বসে,
“সম্পত্তিতে ওর আবার কী দরকার?”
এই কথাটা যেন তার অধিকারের দাবিটাকেই মুছে দেয়,
একটাও শব্দ না বলে, নিঃশব্দে।
সবকিছু পাওয়ার পরেও, জীবনের একটা সময় এসে প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসে,
“তারা কি সত্যিই সব পেলো?”
নাকি সবকিছু পেয়েও একেবারে খালি হয়ে গেলো?
জমি বাড়লেই বাড়ি হয় ঠিকই,
কিন্তু পরিবার না থাকলে সেটাকে ”ঘর” বলা যায় না।
সম্পত্তি হয়তো মানুষকে বাইরে থেকে ধনী করে তোলে,
কিন্তু ভিতরে জমে থাকা কষ্টটা কেউই দেখতে পায় না,
যা কোনো দলিলে লেখা থাকে না, জমে থাকে হৃদয়ের গভীরে!
আর সেই নিঃশব্দ যন্ত্রণার কপাট,
পৃথিবীর কোনো চাবিই আর খুলতে পারে না।
তারা সবাই কিছু না কিছু পেয়েছে।
জমি, ঘর, টাকা, দলিল! সবই ভাগ হয়ে গেছে এক এক করে।
শুধু ভাগ হয়নি সেই পুরোনো জানালাটা,
যেটা দিয়ে ঝগড়ার মাঝেও দুই ভাই একসাথে আকাশ দেখত।
ভাগ হয়নি সেই পুরোনো কম্বলের গন্ধ,
যেটার তলায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকত সবাই, শীতের রাতে।
ভাগ হয়নি সেই বিকেলের রোদ, যে রোদে ভাইবোনেরা পাটপাট করে পিঠ দিত উঠোনে শুয়ে।
ভাগ হয়নি সেই সন্ধের আলো,
যেখানে মা বলতেন, “এই সবাই পড়তে বোস এখনই।”
আজ তারা পারছে একে অপরকে দলিলের কলমে নিজেদের ছোট করতে,
পারছে কোর্ট-কাচারিতে নিজেদের অধিকারের লড়াই লড়তে,
কিন্তু পারেনি ছোট করতে সেই ছোটবেলার ভালোবাসাকে।
যেটা আজ আর নেই, চুপিচুপি হারিয়ে গেছে পুরোনো কাগজের ভাঁজে ভাঁজে।
তবু ভাবতে হয়,
এই জয় কি সত্যিই কোনো জয়?
জেতার পরেও যদি চোখে জল আসে,
তাহলে তো মন অনেক আগেই হেরে বসে আছে।
এত কিছু পেয়েও শেষে থেকে যায় শুধু একটা ফাঁকা বুক।
মানুষটাই যদি পাশে না থাকে,
তবে কিসের জমি? কিসের দলিল?
যার জন্য রেখে যাচ্ছে
সে-ই বা কি নিশ্চিতভাবে সেই মূল্য দেবে?
আর যদি দেয়ও,
কে বলতে পারে,
সে-ই হয়তো তাদের মতোই কোনোদিন সম্পর্কগুলো আবার টুকরো করে ফেলবে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মত?
জীবন তো আজ আছে, কাল নেই।
এক্স-রে রিপোর্টের একটামাত্র দাগেই পাল্টে যায় গোটা পৃথিবী।
কিন্তু সম্পর্ক?
সেগুলোই তো একমাত্র সম্পদ,
যা কোটি টাকার জমি দিয়েও কেনা যায় না।
সবাই কিছু না কিছু পেয়েই যায়।
কারও দখলে আসে বড় ঘর,
কারও নামে জমি রেজিস্ট্রি হয়,
কারও ভাঁজে ভাঁজে থাকে কাগজের গন্ধ মাখা কিছু দলিল।
আর কেউ কেউ থেকে যায় শুধু,
একটা পুরোনো ছবির কোণায়,
একটা মায়ের নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে,
একটা বিকেলবেলার গল্পে, যেটা আর কেউ মনে রাখে না।
তাদের নামে কিছু লেখা থাকে না,
তাদের ভাগে কোনো ঘর পড়ে না,
শুধু থেকে যায় নিঃশব্দে উচ্চারিত এক শব্দ, ‘অপ্রয়োজনীয়’।
কিন্তু আসল ক্ষতিটা হয় কোথায়?
না, জমি বা টাকায় নয়।
আসল ক্ষতি হয় সেইখানে,
যেখানে একসময় একসাথে খেলা, হাসি আর কাঁদা ভাগাভাগি করা মানুষগুলো, আজ চোখে চোখ রাখতে ভয় পায়।
যে উঠোনটা একসময় ছিল শৈশবের মঞ্চ,
সেই উঠোনই আজ ভাগ হয়ে গেছে কাগজে-কলমে।
কিন্তু সেই উঠোনের সোনাঝরা বিকেলগুলো,
তা তো আর কেউ ফেরত দিতে পারবে না।
সব কিছু পেয়েও শেষের দিকে গিয়ে অনেকেই নিঃশব্দে ভাবে,
“যাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম, তারা তো পাশে নেই।”
অর্থের লোভ, সম্পত্তির লোভ, বড়ই ভয়ংকর।
সে শুধু সম্পর্ক নয়, ভেঙে দেয় শিকড়টাকেও… যেখান থেকে সবার সেই প্রথম তাদের ‘ঘর’ শব্দটা জন্মেছি!
সংগৃহীত...