12/12/2024
নিশিতা প্রথম এক মাস বিশ্বাস করতে পারলো না আমাদের বিয়ে হয়েছে। অমন ফাজিল একটা মেয়ে, বিয়ের পরদিন ভোরে চোখ খুলে পাশে আমায় কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাতে দেখে চিৎকার। ভাবী দৌড়ে এলেন। দরজায় জোরদার ঠক ঠক।
‘কী হলো? কী হলো?’
আমি লজ্জায় শেষ। নিশিতা জিহ্বায় কামড় দিলো। দু’হাতে কান ধরে মুখটা অমন লাজুক করে তুলল, আমি তখনই ক্ষমা করে দিলাম তাকে। মাথায় বালিশ চেপে শুয়ে পড়লাম তারপর। ভাবখানা অমন- চিৎকার তোমার ছিল, সামলাবেও তুমি। নিশিতা মাথার বালিশ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। আমি শক্ত করে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে রইলাম। সে ফিসফিস করল, ‘কী বলবো ভাবীকে?’
‘তুমি জানো।’
‘একটা বুদ্ধি তো দাও।’
‘পারবো না। আমার বুদ্ধি কম।’
নিশিতাকে প্রথমবার দেখে আমি বেকুব হয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সরল নিষ্পাপ মেয়েটি একই কলেজের একই ডিপার্টমেন্টের একই ক্লাসের একই বেঞ্চিতে আমার পাশে বসে। কি সৌভাগ্য আমার। চতুর্থ পিরিয়ডের পর টের পেলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সরল নিষ্পাপ মানুষটি আমি নিজে। একমাত্র চূড়ান্ত হাবা না হলে নিশিতাকে সহজ সরল ভাবা কারোর পক্ষে সম্ভব না। চতুর্থ পিরিয়ডের পর নিশিতা সৌমিকের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসলো। কারণ সৌমিক ক্লাসের সবার জন্য চুইংগাম এনেছে। সবাই হুড়মুড় করে কেড়ে নিয়েছে সব। কয়েকজন চার-পাঁচটে করেও নিয়েছে। আমিও একটা পেয়েছি। কিন্তু নিশিতার জন্য নেই। একটা চুইংগামই তো। দু’টাকা দাম। আমি হা করে তাকিয়ে দেখলাম, নিশিতাকে কয়েকজন বান্ধবী টেনে ধরে রাখছে, সে ওদের ঝাড়া দিয়ে সৌমিককে মারতে যাচ্ছে। পাশাপাশি পুঙ্খানুপূঙ্খ বর্ণনা করে যাচ্ছে কিভাবে চুইংগাম চিবিয়ে নরম করে সৌমিকের শরীরের বিশেষ ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেবে তার। কি ভয়ংকর! কি ভয়ংকর!
সৌমিক পালালো চতুর্থ পিরিয়ডের পর। পঞ্চম পিরিয়ডে যখন নিশিতা চুইংগাম চিবুতে চিবুতে আমার পাশে এসে বসলো, আমি ভয়ে আর তাকালাম না ওদিক। সৌমিকের রাগ কখন আমার উপর এসে না পড়ে। নিশিতা নিজ থেকেই আমায় সাধলো, ‘চুইংগাম খাবে?’
‘না।’
‘নাও।’
আমি চট করে হাত পেতে নিলাম। হয়তো দ্বিতীয়বার মানা করলে, না থাক। নিশিতা আমায় বলল, ‘তোমায় আগে দেখিনি।’
‘আমি নতুন।’
‘নাম কী?’
‘আসাদ।’
‘আমি নিশিতা। তুমি আমায় আমার পুরো নাম ধরে ডাকবে। আমার সব বন্ধুরা আমায় নিশি ডাকে। কিন্তু নিশি আমার পছন্দ না। নিশি হচ্ছে একটা ভুতের নাম। রাতে এর ওর নাম ধরে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। যাকে ডেকে নিয়ে যায়, সে আর ফেরত আসে না। বুঝেছো?’
আমি মাথা ওপর নিচ করলাম। নিশিতা আমায় আরেকটা চুইংগাম সাধলো। আমি হাত পেতে নিলাম। মানা করলে যদি ডেকে নিয়ে যায়। ষষ্ঠ পিরিয়ডের পর নিশিতা আমায় টেনে নিয়ে তার আর সব বন্ধু বান্ধবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সবচেয়ে হর্নি বান্ধবীকে চোখ টিপে ইশারাও করে দিলো, আমার সাথে যেন উল্টাপাল্টা কিছু না করে। কেন? আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সপ্তম পিরিয়ডের পর আমি নিশিতাকে ভালোবেসে ফেললাম। এক আকস্মিক নাটকীয় ভালোবাসা। আমি লক্ষ্য করলাম, পাশের বেঞ্চিতে অস্থির বসে থাকা এক চঞ্চলা হাওয়া, মুখের সাথে সাথে চোখ দিয়েও কথা বলা যার, এদিক ওদিক তাকানো, পলক ফেলা টুপ টুপ, নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজে আনমনে কোনো একটা গানের সূর মনে করে মাথা দুলানো- আমায় পেয়ে বসলো খুব। আমি সেদিন জানলাম, অমন আলোর গতিতেও মানুষের প্রেম হয়। আদৌ প্রেম? আমি তো বলতে পারবো না কোনোদিন তাকে। বলার প্রয়োজনও হয়নি। আমি তাকে বলিনি, সে আমায় বলেনি অথচ পুরো কলেজ মাত্র দুই সপ্তাহের ভেতর জানলো আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। সিনিয়র ছেলেপেলে আমায় নিয়ে হাসলো। একজন বলল, পুরো কলেজে যদি এই একটা মেয়েও থাকে, পুরো কলেজ বাদ দে, পুরো দেশে যদি এই একটাই মেয়ে অবশিষ্ট থাকে, তাও আমি তার প্রেমে পড়তাম না। তুই কি ভোদাই?
আমি বোধহয় ভোদাই। কারণ আমার চারপাশ অসম্ভব নির্জন, আমি থাকি একটা বদ্ধ রুমে, আমার পছন্দ নিরবতা, আমি মধ্যাকর্ষণের টানবিহীন কোনো এক নদীর মধ্যিখানের চূড়ান্ত স্থির জল। অথচ আমি ভালোবাসলাম অস্থির ফড়িং কোনো। এক দণ্ড বিশ্রাম নেই যার কোথাও সারাদিন। যার তার সাথে যখন তখন ঝগড়া। হৈ-হুল্লোড়। মাতামাতি। গালাগালি। মারামারি। যখন কলেজে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আলাপ আলোচনা তুঙ্গে, তখন একদিন নিশিতা এসে আমায় বলল, ‘তুমি কি মজা পাচ্ছো?’
‘কী নিয়ে মজা?’
‘এই যে তোমার আমার সম্পর্ক নিয়ে একটা গুজব ছড়ালো।’
আমার বুকটা অতদিনে বেলুন হয়েছিল ফুলে, নিশিতা একটা আলপিন এনে ঠুস করে ফুটিয়ে দিলো তা। আমি চুপসে যাওয়া স্বরে বললাম, ‘আমি পাত্তা দিই না।’
‘কেন পাত্তা দাও না?’
‘এমনিই।’
‘আমাদের সম্পর্ক, আমার প্রেমে পড়া তোমার কাছে পাত্তা না দেওয়ার মতোন কোনো ঘটনা?’
নিশিতার গলার স্বরেও রাগ, চোখেও। আমার বুকটা ফুলতে আরম্ভ করল আবার। আমি আনন্দে থতমত খেলাম। বললাম, ‘না না না। তা বলছি না। মানে, আমি বলতে চাচ্ছি..’
‘আমি একটা ভোদাই।’
নিশিতা স্বীকার করল সে ভোদাই। শুধু স্বীকার করল না, সে ভোদাই কারণ আমার প্রেমে পড়েছে সে। আমি প্রেমে পড়ার মতোন কোনো ছেলে না। পাত্রপক্ষের দশটা ছবির ভেতর কনে এক দেখায় যার ছবি প্রথম বাদ দেবে, ওটা আমার ছবি। ভোদাই না হলে কোনো মেয়ে আমার প্রেমে পড়বে না। নিশিতা আমার কানে ফিসফিস করল, ‘প্রেম করেছো কোনোদিন?’
‘ছোটবেলায় করেছিলাম।’
‘বড়ো হওয়ার পর করোনি?’
‘না।’
‘আমি ছোটবেলায়ও করিনি। আমি জানিও না প্রেম কিভাবে করতে হয়। আমার ঐ হর্নি বান্ধবী ছয়টা প্রেম করে ফেলেছে ইতোমধ্যে।’
আমি চুপ করে রইলাম। দুইজন অনভ্যস্ত প্রেমিক প্রেমিকা আমরা, কোনোরকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রেমে পড়েছি একে অপরের। স্বীকার করছি না একদম। কলেজের শ্যাওলা পড়া ঐ বিল্ডিং-এর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ইতিউতি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলা আমরা দুইজন কোনোদিন ভাবিনি, চার বৎসর পর এমন একটা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আমাদের বিয়ে হবে আয়োজন করে। কলেজের সমস্ত বন্ধু বান্ধব উপস্থিত থাকবে। মজা করবে। হৈ-হুল্লোড়ে ভরে যাবে বাড়ি। সৌমিকের আনা গিফট নিয়ে বিয়ে বাড়িতেই এক প্রস্থ মারামারি হবে ফের। নিশিতা গিফট ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করবে, ‘প্লাস্টিকের থালা! তুই আমাকে বিয়েতে প্লাস্টিকের থালা দিচ্ছিস? এই থালা দিয়ে আমরা কী করবো? ভিক্ষা?’
সৌমিক এক কাপড়ে পালাবে বাড়ির ভেতর। বিয়েতে শিক্ষক শিক্ষিকারাও আসবেন। কয়েকজন গল্প জুড়ে দিবেন, ‘কত দেখেছি ওদের একসাথে। আমাদের কলেজের প্রথম প্রেমিক প্রেমিকা ওরা। প্রেম যে কত শুদ্ধ হয়, ওদের না দেখলে বিশ্বাস হতো না। কি সুন্দর দু’টো ছেলেমেয়ে এত বৎসর প্রেম করে সংসার শুরু করলো। দেখেন। কি মায়া মায়া।’
কলেজে আমরা সবসময় পাশাপাশি বসতাম। আমার পাশের জায়গা খালি থাকলেও কেউ এসে ওখানে বসতো না। ওর পাশের জায়গা খালি থাকলেও একই অবস্থা। কলেজের প্রতিটি কীট পতঙ্গ জানতো আমাদের কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একটা ক্লাসে নিশিতা পেছনের বেঞ্চিতে বসেছিল কোনো একটা বন্ধুর সাথে জরুরি আলাপের জন্য। আমি একলা বসে। শিক্ষক এসে আমার দিকে তাকালেন। পেছনে তাকালেন। এবং কোনোদিনও পাঠ্যপুস্তকের বাইরে একটা অপ্রাসঙ্গিক শব্দও না করা ঐ শিক্ষক আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের ঝগড়া হয়েছে?’
চার বৎসরে আমাদের মধ্যে তুমুল কোনো ঝগড়া হয়নি। মনোমালিন্য হয়েছে বেশ। প্রথমবার হলো যখন সৌমিকের সাথে আবার মারপিট করল সে। সম্ভবত সেকেন্ড ইয়ার। আমি জানি না, কেন ওর ওপর এত রাগ। সৌমিক নিতান্তই চমৎকার একটা ছেলে। আমার ধারণা, হাত চুলকালেই নিশিতা সৌমিককে খুঁজে মারার জন্য৷ তেমন কোনো কারণ ছাড়াই। এক দুপুরে সৌমিক দৌড়ে কমন রুমের পাশে এলো। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একজন বন্ধুর সঙ্গে। আমার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ফিসফিস করল, ‘আমায় বাঁচা।’
‘কী হয়েছে?’
‘ডাইনিটা আসতেছে ভাই। ওর হাতে ইটের টুকরা। ছোটখাটো হলে ভয় পেতাম না। বড়ো ইটের টুকরা। মাথায় লাগলে অক্কা পাবো।’
আমি ভাবলাম তিলকে তাল বলছে সৌমিক। নিশিতাকে দেখার পর মনে হলো তালকে তিল বলেছে সৌমিক। ক্যাম্পাসে আনিয়ে রাখা ইটের স্তুপ থেকে আকারে প্রায় অর্ধেক একটা ইট হাতে ছুটে এলো নিশিতা। কেন? কারণ জানার পর আমি অবাক হলাম না। নিশিতার সাথে পরিচয়ের পর আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল। সৌমিক টিফিন পিরিয়ডে সিঙ্গাড়া এনেছিল কয়েকটা। বন্ধু বান্ধব সবাই খেয়েছে। নিশিতা ওয়াশরুমে ছিল। এসে দেখল সবার খাওয়া শেষ। প্যাকেটে সিঙ্গাড়া নেই। তাই মারপিট। চুইংগাম, সিঙ্গাড়া! মানুষ তুচ্ছ খাদ্যের জন্য বন্ধুর মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে, নিশিতা চোখে আঙুল গুঁতিয়ে জানালো আমায়। ইটের টুকরো উঁচু করে বলল, ‘সরো।’
আমি সরলাম না। নিশিতা ইটের টুকরা ছুঁড়ে মারলো সত্যি সত্যি। আমি হতভম্ব। কস্মিনকালেও ভাবিনি নিশিতা ছুঁড়ে মারবে ওটা। কি রাগ! চট করে বসে পড়ায় সৌমিকের হাতে গিয়ে লাগলো। ব্যান্ডেজ করা লাগলো পুরো হাত। এক সপ্তাহ হাত ঝুলিয়ে হাঁটলো হতভাগা। আমি নিশিতার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। প্রথম একদিন টের পেল না। আমরা একই বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসলেও মাঝখানে দুই বিগত দূরত্ব থাকে এমনিতেও। দ্বিতীয় দিন নিশিতা বেঞ্চিতে এইদিক খসকে খসকে এসে দূরত্ব এক বিগত কমিয়ে আনলো। ফিসফিস করল, ‘তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো?’
আমি চুপ।
‘কথা বলবা না?’
আমি চুপ।
‘আচ্ছা। মাফ চাই।’
আমি চুপ।
‘এখন যদি কথা না বলো, আজকে ইটের টুকরো দিয়ে সৌমিকের মাথা থেঁতলে দেবো।’
আমি আঁতকে উঠে কথা বললাম। ব্ল্যাকমেইল যদি কোনো শিল্প হয়, নিশিতা ঐ শিল্পের ভিঞ্চি। একবার ব্যবহারেই দারুণ ফলাফল তাকে অনুপ্রেরণা দিলো খুব। পরবর্তীতে আমাদের সবরকম মনোমালিন্যে সৌমিক চলে আসতো মাঝখানে। নিশিতা আনতো ওকে। উদাহরণ দিই। বৃষ্টিতে জোর করে ভিজে গায়ে জ্বর আনার জন্য আমি রাগ করে নিশিতার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি একদিন। পরদিন সে আমার কানে ফিসফিস করল, ‘এখন যদি কথা না বলো, ইচ্ছা করে ঝগড়া লাগিয়ে সৌমিকের হাড়গোড় ভেঙে দেবো আমি। খোদার কসম।’
আমাদের বিয়ের সমস্ত আয়োজন সৌমিকের হাতে ছিল। দুপুরের দিকে খাওয়ার টেবিলে পেলাম তাকে। মুরগীর রানের গোশত কামড়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, সবকিছু ফিটিং করে দিলাম। আমি বাঁচলাম। এখন তুই কেমনে বাঁচবি তুই জানিস। নিশিতাকে ইঙ্গিত করা হলো। আমি মনে মনে হাসলাম। হতভাগা কোনোদিন জানতেও পারবে না, কতবার বাঁচিয়েছি আমি তাকে।
‘ভাবীকে কী বলবো?’
আমি বালিশ মাথায় চেপে শুয়ে রইলাম। নিশিতা স্বরুপে ফিরে গেলো তার। বালিশের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল, ‘যদি বুদ্ধি না দাও, আমি ভাবীকে বলবো তুমি আমার বুকে কামড়ে দিয়েছো।’
আমি তড়াক করে উঠে বসলাম। কারণ আমি জানি, নিশিতা এই কথা খুব হেসে হেসে ভাবীকে বলে দিতে পারবে। কোনোরকম সভ্যতা, ভদ্রতা, লজ্জা কিংবা নম্রতার বালাই না করে। আমায় তড়াক করে উঠতে দেখে নিশিতা খিলখিল করে হাসলো। আমি উঠে দরজা খুললাম। ভাবী ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘নিশি চিৎকার করল যে?’
‘তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়েছে।’
‘ও। আচ্ছা, দরজা বন্ধ করে দাও। আর তেলাপোকা দেখে আস্তে চিৎকার করতে বলো ওকে। সাউন্ডপ্রুফ রুম না। বাসায় মেহমান।’
আমার ইচ্ছে করল একটা গর্ত খুঁড়ি, আর তাতে ধুপ করে ঝাঁপ দিয়ে নিজেই নিজেকে মাটি চাপা দিয়ে দিই। ভাবী নিশিতার চিৎকারের পেছনে আমার দাঁড় করানো চিরকাল ধরে বহমান ঐতিহাসিক যৌক্তিক কারণ পাত্তা না দিয়ে যা ভাবার ভেবে উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। আমি দরজার হুক আটকে ফিরে এলাম বিছানায়। নিশিতা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়ালো কয়েকপাক। তারপর উপুড় হয়ে ইশারা করল আমায়, ‘পিঠ চুলকে দাও।’
‘আমি?’
‘তো কি ভাবীকে ডাকবো পিঠ চুলকে দেওয়ার জন্য?’
আমি শুয়ে পড়লাম। সারা রাত্তির জেগে ভোর ভোর চোখ খোলা রাখার চেয়ে মাটি কাটা বেশী সহজ কর্ম। আমার ঘুম দরকার। নিশিতা খিলখিল করে বলল, ‘চুলকাবা নাকি ইয়েস ইয়েস বলে জোরে চিৎকার করবো?’
আমি আঁতকে উঠলাম। তারপর পাশ ফিরে নিশিতার পিঠ চুলকালাম। নিশিতা একটু পরই আমার দিকে ফিরল। আমার চোখজোড়া নিভু নিভু, নাকের ডগায় ঘুম, গালে হাত রেখে আদুরে স্বরে বলল, ‘আমার চঞ্চলতা নিয়েছো তুমি, নির্জনতা নিতে পারবে?’
‘তোমারও বুঝি নির্জনতা আছে?’
‘আছে বৈকি।’
‘অথচ গত চার বৎসর ধরেও আমি হদিস পাইনি তার।’
নিশিতা হাসলো। সারা রাত্তির জেগে থাকার পরও এই মেয়ের চোখে ঘুম নেই একফোঁটা। কি আশ্চর্য সুন্দর। কি উথাল পাথাল স্নিগ্ধতা। রোজ দেখি। চার চারটে বৎসর। কোনোদিন মনে হয়নি এই মেয়েটিকে ঠিক গতকালের মতোন লাগছে আজ। প্রতিদিন অন্যরকম। প্রতি মুহূর্ত আলাদা। প্রতিটি ক্ষণ নতুন। নিশিতা আমার কাছে আসলো খুব। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের খুব কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করল, ‘চার বৎসর আগে সতেরবার সুইসাইড এটেম্প নিয়েছিলাম আমি। একদিন গলায় দড়ি বেঁধে লটকেও গিয়েছিলাম। যখন শ্বাস আটকে আসলো, চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসলো, জিহ্বা বের হয়ে আসলো প্রায়, আব্বু দরজা ভেঙে আমায় বাঁচালেন।’
আমার ঘুম কেটে গেল আচমকা। বাইরে সূর্য উঁকি দিচ্ছে ধীরে। জানালার ফাঁক গলে ফিনকি মেরে ঢুকছে নরম আলো। নড়ে উঠতে দেখে নিশিতা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল শরীর আমার। ফিসফিস করল পুনরায়, ‘আমার ওপর রাগ হচ্ছে তোমার?’
আমি তাকিয়ে রইলাম শুধু।
‘রাগ কোরো না। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি আমার একটা বন্ধুকে রাগ করে পরিত্যক্ত একটা কুয়ায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম বহু বৎসর আগে। বন্ধুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল পরদিন। কাত হয়ে দুই হাঁটু গুঁজে শুয়ে থাকা একটা লাশ। আমি সতেরবার নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করেছি ঐ কুয়া থেকে। সবকিছু জানার পর তুমি আমায় ভালোবাসবে আসাদ?’
আমি দু’হাতের বাঁধন শক্ত করলাম। ঠোঁট জোড়া নির্বাক, তবে আমার চোখ জোড়া কথা বলল। ছলছল ভাষা। হাতজোড়া কথা বলল। আঙুলগুলো এঁটে বসলো শরীরে আরও। নিশিতা আমার ঠোঁটে আলতো একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘কেউ জানে না, আমি একটা কুয়ায় পড়ে আছি আসাদ। আমার উঠা দরকার। হোক অন্দর খানিক অন্ধকার, তুমি আমায় একটু ভালোবেসো। ওতে কোনো ক্ষতি নেই। সূর্য তার সবটুকুন রোদ দেবী খুনী সবার জন্যই বরাদ্দ রাখে।’
🧿সমাপ্ত
⛔‘কুয়া’
🖊️Shakhawat Hossen