
19/05/2025
দুবাইয়ের সোনালী রাজপ্রাসাদে জন্ম হয়েছিল রাজকন্যা আলিয়ার। জন্মেই তার কপালে ছিল রাজসিংহাসনের ছায়া, কিন্তু জীবন তাকে যে পথে হাঁটাবে, তা ছিল সিংহাসনের পথ নয়—তা ছিল কাঁটার পথ। সে ছিল কেবল সুলতান মাকতুমের কন্যা নয়, বরং ছিল এক নিঃসঙ্গ আত্মা, যাকে একসময় ভালোবাসা দিয়েছিল আশ্রয়, আবার সে ভালোবাসাই কেড়ে নিয়েছিল তার সবটুকু।
আলিয়া ছোট থেকেই ছিল অন্যরকম। রাজদরবারের আড়ম্বর তার চোখে কখনও ভালো লাগেনি। তার মন পড়ে থাকত প্রাসাদের বাইরের মানুষের জীবনে, বিশেষ করে মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলা বেদুইনদের সংসারযাত্রায়। সে গোপনে তাদের মাঝে যেত, খাবার বিলি করত, আর তাদের গান শুনত। একদিন সেখানেই তার দেখা হয় কাসিমের সঙ্গে—এক তরুণ বেদুইন, যার চোখে ছিল মরুর সাহস, আর কণ্ঠে ছিল প্রাচীন আরবের কবিতার ছোঁয়া।
কাসিম ছিল এক সাধারণ উটচালক, অথচ তার চিন্তাভাবনা ছিল স্বপ্নপথিকের। প্রথম দেখাতেই আলিয়া বুঝেছিল, এই মানুষটি তাকে বোঝে—প্রাসাদের দেয়ালের বাইরেও যে একটি জীবন আছে, সে জীবন কাসিম জানে। গোপনে তাদের ভালোবাসা গড়ে ওঠে। অনেক সন্ধ্যা তারা কাটাত মরুভূমির নিচু টিলার পাশে বসে, যেখানে কেবল দু’জনেই জানত একে অন্যের চোখের ভাষা।
কিন্তু ভালোবাসা একে অপরকে বাঁধলেও সমাজ বাঁধন মানে না। সুলতান যখন জানতে পারেন, রাজকন্যা এক উটচালকের প্রেমে পড়েছে, তখন রাজদরবারে ঝড় ওঠে। আলিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়, আর কাসিমকে প্রাসাদ থেকে নির্বাসিত করে মরুভূমির নিষিদ্ধ অঞ্চলে পাঠানো হয়।
এই মুহূর্ত ছিল আলিয়ার জীবনের মোড়ফেরানো সময়। সে পারত কাঁদতে, ভেঙে পড়তে, কিন্তু সে বেছে নিল অন্য পথ। সে ভেবেছিল—যদি ভালোবাসা হারায়, তবে অন্তত নিজের স্বপ্নকে হারাতে দেবে না। বন্দিত্বের মধ্যেই সে শুরু করে পড়াশোনা, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি। ধীরে ধীরে সে প্রাসাদের ভিতরে নিজের শক্তি গড়ে তোলে। অভিজাতদের মধ্যে যাদের মন ছিল নরম, তাদের সঙ্গে গড়ে তোলে এক অদৃশ্য জোট।
দশ বছর পর, সুলতান বার্ধক্যে ক্লান্ত। দেশের শাসন অগোছালো। সেই সময় আলিয়া ঘোষণা করে, সে প্রাসাদ ছেড়ে মরুতে যাবে এবং নতুন নগরী গড়ে তুলবে—আল-আমাল, যার অর্থ “আশা”।
মরুভূমির নিষিদ্ধ অঞ্চলে পৌঁছে, যেখানে কাসিমকে একসময় নির্বাসিত করা হয়েছিল, সেখানেই আলিয়া শুরু করে নতুন শহরের কাজ। অবিশ্বাস্য হলেও, একসময় সেই অঞ্চলে কূপ খননের পর জল বেরিয়ে আসে। পুরোনো বেদুইনরা তাকে সাহায্য করে। একসময়, বছরখানেকের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি ছোট্ট অথচ সুশৃঙ্খল বসতি—নাম তার আল-আমাল।
এখানে কেউ কারও বংশ দেখে না, দেখে মেধা, শ্রম আর মন। আর একদিন সেই বস্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আলিয়া দেখে, বালির ধুলোর মধ্যে দিয়ে এক চেনা মানুষ এগিয়ে আসছে—কাসিম। এত বছরেও তার চোখে সেই একই আগুন, শুধু চুল কিছুটা পেকে গেছে।
তারা কথা বলেনি প্রথমে। কেবল হাতে হাত রাখে। আলিয়া কেবল বলেছিল, “আমি রাজ্য চাইনি, কেবল একটুকরো আকাশ চেয়েছিলাম—তুমি ছিলে সেই আকাশ।”
আজ আল-আমাল শুধু একটি শহর নয়—এটি এক প্রতীকের নাম। ভালোবাসা হারিয়েও কেউ হারে না, যদি তার ভিতরে থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস। আলিয়ার জীবন তার প্রমাণ। সে ছিল না কেবল একটি রাজকন্যা, সে ছিল মরুর বুকে জন্ম নেওয়া এক আলোকরেখা, যে শিখিয়েছে—ভালোবাসা হারাতে পারে, জীবনও পিছলে যেতে পারে, কিন্তু মন যদি না ভাঙে, কিছুই শেষ হয় না।