14/08/2025
আমার জন্ম ৯০ দশকে। আমি চারপাশে মানুষের অভাব দেখে বড় হয়েছি। মানুষ সে সময় ভাতের মাড়টুকোও ফেলতো না। সেই মাড় দিয়েই গ্লাসে ভাত মিশিয়ে খেতো। চাল ভেজে গুঁড়ো করে ছাতু খাওয়া তখন সবার ঘরে ঘরে সাধারণ ব্যাপার ছিল। রেস্টুরেন্ট বলতে কিছু ছিলোই না তখন। ছিলো ভাতের হোটেল। সেখানে মিষ্টি জিলাপি এগুলোও বিক্রি করতো। আলাদা করে মিষ্টির দোকান বলতে তেমন একটা কিছু ছিল না। একটা শহরে বড়জোর দুই চারটি মিষ্টির দোকান ছিল কেবল। মানুষ পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে এই ব্যাপারটাই ছিল না তখন।
একান্নবর্তী পরিবারের চল ছিল। একই বাড়িতে সবার বসবাস। জীবন জীবিকা ছিল খুবই সাধারণ। সামান্য লবন তেল শেষ হয়ে গেলেও একে অন্যের ঘর থেকে ধার করে আনতে যেত। মা চাচিরা বোতল একটা ধরিয়ে দিয়ে বলতো, "অমুকের মাকে গিয়ে বল একটু তেল দিতে। সন্ধ্যার সময় দিয়ে দিব।" বিলাসিতা বলতে তেমন কিছু ছিলো না। বিনোদন বলতে কেবল ই বিটিভি আর বেতার। আর মাঝেমধ্যে টিভির এন্টেনা ঘুরিয়ে ঘারিয়ে ভারতীয় ডিডি ন্যাশনাল অথবা দুরদর্শণ চ্যানেল দেখার প্রানান্তকর চেষ্টা ছাড়া মানুষের জীবনে আর তেমন বলার মতো কোন মিডিয়াকেন্দ্রিক বিনোদন ছিল না।
তবে মানুষ শান্তিতে ছিল। তখন অন্যায় অপরাধ চুরি ডাকাতি এগুলো ছিলো না, তাও নয়। তবে সেটা লিমিটের মধ্যেই ছিল। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিল না।কোথাও একটা খু* হলে সেটা বিশাল একটা ব্যাপার ছিল। পত্রপত্রিকায় বড় করে হেডলাইন হতো। আর এখন খু* তো পরের বিষয়, চমকপ্রদ খু* র ঘটনা না হলে পত্রিকায় আসেই না।
মানুষের সাথে মানুষের সরাসরি interaction টা ছিল বেশী। খেলার মাঠে, হাটে বাজারে, চায়ের দোকানে, মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে, নানান রকম গ্রামিন মেলা উৎসব পুজো পার্বনে সবারই আসা যাওয়া ছিলো। উঠা বসা ছিল। যে কারণে একে অন্যের প্রতি আন্তরিকতা, সহানুভূতি, দায়িত্বশীলতা এগুলো ছিল। সেই সময় খুব কম বাসা বাড়ীতেই পাচিল কিংবা বেড়া ছিলো। অধিকাংশ বাড়ী ঘর ই ছিল উন্মুক্ত। এলাকার সবাই সবার বাড়ীতে যাতায়াত করত। পারস্পরিক একটা বন্ধন ছিল সবার মাঝে। মানুষ অপরাধ করতে ভয় পেত। পুলিশের দুর্নীতি ঘুষ এগুলো তখনও ছিল কিন্তু এতটা মহামারী আকারে ছিল না। মানুষ পুলিশের নাম শুনলে ভয় পেত। দুইজন কনস্টেবল থ্রি নট থ্রি রাইফেল কাঁধে আর একজন এস আই, কোমড়ে একটা বুলেট বিহীন পিস্তল, এরা একটা গ্রামে ঢুকলে সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে যেতো।
খাল বিল নদী নালা এমনকি রাস্তাঘাটের পাশে জলাশয় থেকেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাজার থেকে অনেক মানুষের মাছ কিনে খাওয়ারও এত দরকার পড়তো না।পোল্ট্রি মুরগী কি জিনিস তা আমরা জানতাম ই না। সবাই ঘরে ঘরে দেশি হাঁস মুরগী পালতো। সেগুলো বাজারে নিয়ে আসতো। আমরা খাবারের ক্যামিকেল বলতে কিছুর নাম ই শুনি নি তখন। যা খেতাম একদম পিউর। ন্যাচারাল।
বাচ্চারা একা একা স্কুলে যেত। দল বেঁধে যেত। কোন ভয় ডর কিছুই ছিল না। গার্ডিয়ান কেবল স্কুলে ভর্তি করানোর সময় একবার সাথে যেত। অনেকের তাও যেত না। সবাই হেলে দুলে খেলে বড় হতো।
মোট কথা তখন মানুষের অভাব ছিলো কিন্তু সবাই শান্তিতে ছিলো। আমাদের অশান্তি শুরু হলো তখনই যখন আমাদের অভাবকে আমরা অসম্মানের চোখে দেখা শুরু করলাম। শহরে শহরে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এলো। বিনোদনের সকল মাধ্যম হাতের মুঠোয়। ফেসবুক এলো। দুনিয়ার সবার সাথে যখন মানুষ কানেক্টেড হলো। তখন অন্যেরটা দেখে দেখে তাদের মধ্যে নিত্য নতুন অভাব আর হতাশা তৈরী হতে লাগলো। আমাদের নিজেদের যে একটা আলাদা জাতিগত সত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্বাস তার সবকিছু ধ্বংশ, চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেল। এখন আর নিজের বলতে কিছু নেই। আমরা পুরো দুনিয়া ঘুরছি। পুরো দুনিয়ার আবর্জনা নিজেদের গেলানোর চেষ্টায় আছি। যে কারণে এখন পেটে ভাত থাকলেও মনে শান্তি নাই। কারণ আমরা নিজেরা সুখী হবার চেয়ে সুখী হবার প্রতিযোগিতা করতে এখন বেশি ভালোবাসি।