
08/08/2025
ইন্ডিয়ার পরাশক্তি হওয়ার দিবাস্বপ্ন
এই শতাব্দীর শুরুতে আমিরিকা যখন বিশ্বব্যাপী তার গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন শুরু করেছিল, তখন সেই ছকে ইন্ডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। আমিরিকার গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান রোধ এবং সেক্যুলার লিবারেল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। এ বিষয়ে জর্জ বুশ, ডিক চেনি থেকে শুরু করে টনি ব্লেয়ার এবং পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের অনেকেই বিভিন্ন সময় বক্তব্য প্রদান করেছে। আর তাদের স্ট্র্যাটেজী বাস্তবায়নে যে কাল্পনিক শত্রু দাঁড় করিয়েছিল, তারই নাম দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদ বা জংগীবাদ।
মধ্যপ্রাচ্যে আমিরিকা নিজেই সশরীরে উপস্থিত হলেও অন্যান্য স্থানে তার লোকাল গুন্ডা দিয়ে এ উদ্দেশ্য পূরণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্ডিয়াকে শক্তিশালীকরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। যার ধারাবাহিকতায়,
# জর্জ ডব্লিউ বুশ ইন্ডিয়ার বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্পে সহায়তা করে।
# ওবামা প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
# ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম শাসনামলে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করে এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে, যা ইতিপূর্বে শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সরবরাহ করা হত।
# জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পরে সর্বাধুনিক ফাইটার জেট ইঞ্জিন প্রযুক্তির সরবরাহ করে। একইসাথে, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগীতা জোরদার করে।
এ সবগুলো পদক্ষেপ মূলত জর্জ বুশের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি যেখানে সে ইন্ডিয়াকে একবিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব পরাশক্তি হতে সহায়তার কথা বলেছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো আমিরিকা ইন্ডিয়াকে সাহায্য করতে চাইল?
আমিরিকা এবং ইন্ডিয়ার কর্মকর্তাগণ কিছু অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে ঐক্যমতে পৌঁছেছিল। সেই অভিন্ন স্বার্থগুলো হচ্ছে
১. রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ঠেকানো
২. উদীয়মান চায়নাকে দমন করা
৩. উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যাবস্থা টিকিয়ে রাখা
আমিরিকা এই উপসংহারে পৌঁছেছিল যে, শক্তিশালী ইন্ডিয়া এ অঞ্চলে আমিরিকাকে শক্তিশালী করবে।
ইণ্ডিয়া কেন আমিরিকার কাংক্ষিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি?
এর কারণ, ইন্ডিয়ার আপাত বৈশ্বিক দর্শন। ইন্ডিয়া মনে করে, একটি এককেন্দ্রিক বিশ্বের চেয়ে বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব তার জন্য সুবিধাজনক। বিশ্বে আমিরিকাই যদি একমাত্র হর্তাকর্তা হয়, তাহলে সে কোন এক সময় ইন্ডিয়ার স্বার্থকে বিপন্ন করবে। তাই ইন্ডিয়া চেয়েছে আমিরিকার পাশাপাশি আরও শক্তিশালী রাষ্ট্র থাকুক, যাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে সে প্রয়োজনে আমিরিকার সাথে দর কষাকষি করতে পারবে। ইন্ডিয়ার এই মনোভাবের তাত্ত্বিক নির্দেশনা পাওয়া যায়, নেহেরু ডক্ট্রিনে।
নেহেরু বলেছিলেন, "ইন্ডিয়া কোন পরাশক্তির পাইটু (camp follower) হবেনা।" ২০০৪ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ী বলেছিল,
"India does not believe that unipolarity is a state of equilibrium in today's world"
কারণ, ইন্ডিয়ার ধারণা, এতে করে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে তার জন্য নাক গলানো কঠিন হবে। তাই সে একমেরু বিশ্বের পরিবর্তে বহুমেরু বিশ্ব চায়। এজন্যই, আমিরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও সে
১. জলবায়ু ইস্যুতে আমিরিকার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে
২. ইরান এবং রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে
৩. ডলারের পরিবর্তে রুপি দিয়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছে (বাংলাদেশের সাথেও যার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল)
৪. বাণিজ্য সুবিধা, তথ্য অধিকার, ই কমার্স নীতি, বৈশ্বিক সরকারব্যাবস্থার স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ে আমিরিকার নীতিকে পাশ কাটিয়ে গেছে
৫. চায়নার সাথে একটা স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রেখে এ অঞ্চলে আমিরিকার প্রবেশ কঠিন করে তুলেছে।
৬. BRICS এবং Sanghai Cooperation এ সংযুক্ত হয়েছে
এসবেরই উদ্দেশ্য ছিল, আমিরিকার প্রভাবকে ক্ষুন্ন করা।
কিন্তু, কেন ইন্ডিয়া এই কাজ করল?
ইন্ডিয়া বুঝতে পেরেছিল, চায়নার উত্থান ঠেকাতে, তাকে আমিরিকার প্রয়োজন। সুতরাং, যতদিন চায়নার উত্থানের বিষয়টাতে সে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে, ততদিন আমিরিকার কাছে তার কদর থাকবে। চায়নাকে যদি পুরোপুরিভাবে দমন করা হয়, তবে আমিরিকার কাছে ইন্ডিয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে এবং ইন্ডিয়াও দর কষাকষি করার অবস্থান হারাবে। এই চিন্তা থেকেই ইন্ডিয়া আমিরিকান বিরোধী কিছু কার্যকলাপ হাতে নিয়েছিল।
কিন্তু ইন্ডিয়া কি সফল হয়েছে?
প্রথমত, আসি ইসলামী সন্ত্রাসবাদ (তাদের ভাষায়) দমনে। বর্তমানে ইন্ডিয়া ইসলামের উত্থানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছে। একদিকে আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান, অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক যুদ্ধে লজ্জাজনক পরিণতি, বাংলাদেশসহ আশপাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় চরম ভারতবিরোধী মনোভাবের উত্থান, ইন্ডিয়াকে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে। ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলন তো বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় দালালকেই অপসারিত করেছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলা এবং পাকিস্তানের কাছে একাধিক জঙ্গী বিমান হারানো, ইন্ডিয়ার নিরাপত্তা ব্যাবস্থার নাজুকতা ফুটিয়ে তুলেছে। ঘরে বাইরে ইন্ডিয়া হয়ে উঠেছে হাসির পাত্র। চায়নার সাথে সীমান্তে হরহামেশাই জওয়ানদের অপমানিত হওয়া এবং প্রাণ হারানো, ইন্ডিয়াকে বলিউড যোদ্ধা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। আফগানিস্তানের সাথে আপাত বন্ধুত্ব থাকলেও, ইন্ডিয়া এবং আফগানিস্তান উভয়ই জানে, আজ হোক বা কাল, ইসলামিক ইস্যুতে উভয় রাষ্ট্রের মাঝেই শত্রুতা আসন্ন। আর, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ তো উঠতে বসতেই মুরগির কল্লা ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়।
দ্বিতীয়ত, ১৯৮০ সালে একই আকৃতির অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও, চায়নার অর্থনীতির আকার বর্তমানে ইন্ডিয়ার চেয়ে ৫ গুণ। ৯০ এর পর ইন্ডিয়ার জিডিপি যেখানে ৬.৫% হারে এগিয়েছে, সেখানে চায়নার অর্থনীতি এগিয়েছে ৯% হারে। ১৯৭৯-২০২৩ পর্যন্ত চায়নার জিডিপি যেখানে ১৫ বার ডাবল ডিজিট ছাড়িয়েছে সেখানে ইন্ডিয়া একবারও ডাবল ডিজিটে পৌঁছাতে পারেনি।
সামরিক দিক দিয়েও ইন্ডিয়া যে চায়না থেকে যোজন দূরত্বে পিছিয়ে, তা সাম্প্রতিক পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। চীনের সহায়তায় নির্মিত যুদ্ধবিমান দিয়ে ইন্ডিয়ার একাধিক রাফায়েল বিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী।
তাই, ইন্ডিয়াকে ব্যাবহার করে চায়নাকে কাউন্টার করার আমিরিকান নীতি ব্যার্থ হয়েছে দুইটা কারণে,
১. ইন্ডিয়ার অযোগ্যতা
২. ইন্ডিয়ার অনীহা
তৃতীয়ত, সমাজতন্ত্রের পতনের পর, আমিরিকার আশা ছিল, বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ইন্ডিয়াকে উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করাবে। কিন্তু, ৯০ এর পর হিন্দুত্ববাদের উত্থান, এবং বিজেপির রাজনীতিতে তার চর্চা বর্তমানে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, আমিরিকার সেই আশায়ও গুড়েবালি। সংখ্যালঘু নির্যাতন ইন্ডিয়ায় বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে, ফলে উদার গণতন্ত্রের আদর্শ প্রচারে যে ইন্টেলেকচুয়াল ভিত্তি থাকা দরকার, ইণ্ডিয়া তা হারিয়েছে।
গত নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে কোয়ালিশন সরকার গড়তে বাধ্য হয়েছে। ইন্ডিয়ার এক তৃতীয়াংশ রাজ্য বিরোধীরা শাসন করছে।
পরাশক্তি হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে দুইটি উপাদান, "নিকট প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক" এবং "দূরবর্তী দেশগুলোয় প্রভাব বিস্তার" - এ দুইটি উপাদানের কোনটিই বর্তমান ইন্ডিয়ার মধ্যে নেই। উপরন্তু, ইন্ডিয়ার এসব কর্মকান্ডে বিরক্ত আমিরিকা বুঝতে পেরেছে যে, তাকে দিয়ে আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ইসলামী সন্ত্রাসবাদ আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে
চায়না আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে
এবং
উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যাবস্থার মডেল ভূলুন্ঠিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই।
এসকল কিছুর দরুণ, ইণ্ডিয়ার প্রতি আমিরিকার নীতি বদলে যেতে পারে, যার একটা নজির ট্রাম্পের শুল্ক আরোপে দেখা গেছে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কি?
ইউনুস সরকারের সময় গত ১১ মাসে ৩৪ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে BSF... এগুলো কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের নমনীয়তা কখনই শত্রুকে নমনীয় করবেনা।
আমাদের প্রথমে ইন্ডিয়া আর আমিরিকার সম্পর্ক বুঝতে হবে। আমিরিকা, ইন্ডিয়ার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সুতরাং আমাদেরকে আমিরিকা এবং ইন্ডিয়া উভয়কে একসাথে কাউন্টার দেয়ার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ,
১. ভারী শিল্প যেমন যুদ্ধাস্ত্র বানানোর উদ্দেশ্যে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করবে এবং শত্রুর সমীহ আদায় করে ছাড়বে
২. প্রয়োজনে চায়নার কাছ হতে প্রযুক্তি সহায়তা নিতে হবে। কোনমতেই ইণ্ডিয়া কিংবা আমিরিকা হতে কোন অস্ত্র কেনা যাবেনা
৩. ইন্ডিয়া এবং আমিরিকার সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যৌথ এবং দ্বিপাক্ষিক মহড়া বন্ধ করতে হবে
৪. উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মডেলের বিপরীতে ইসলামী শারীয়াহ ব্যাবস্থার রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হবে। Secular World Order এর বিপরীতে Divine World Order এর ন্যারেটিভ সামনে আনতে হবে।
আশা করা যায়, এধরনের নীতিমালার বাস্তবসম্মত প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে উদিত হবে।