09/06/2025
#অপ্রিয়কথা
সেদিন একটা র্যাংকিং চোখে পড়লো-২০২৪ এ কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশী বই পড়েছে। র্যাংকিং এ প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় হয়েছে যথাক্রমে USA, India আর UK! র্যাংকিং এর তথ্য অনুযায়ী আমেরিকাতে একজন মানুষ বছরে ১৭ টা বই পড়ে, ভারতে ১৬ আর ইউকেতে ১৫ টা! আর সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান কততে জানেন? ৯৭ তম! অর্থাৎ একজন বাংলাদেশি বছরে ২.৭৫ টা বই পড়ে! বাংলাদেশের পরে আর যে পাঁচটা দেশ আছে তারা হলো-UAE, Saudi Arabia, Pakistan, Brunei & Afghanistan!
সত্যি কথা হচ্ছে, তালিকাটা দেখে আমি একদমই অবাক হয়নি! এভারেজে বাংলাদেশি মানুষদের আই-কিউ যে খুবই কম সেটা নতুন করে বলার কিছু নাই! সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটলে সেটা আরও প্রকট ভাবে বোঝা যায়। আর সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে ব্যাপারটা বোঝা যায় দেশের লোকজনের সাথে কথাবার্তা চালাতে গেলে! এ ক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষিত অশিক্ষিতর ভেতর খুব বেশী পার্থক্য নেই!
আমাদের দেশে বেশীরভাগ মানুষ স্কুলের পড়াশোনার বাইরে বই পড়াকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনা! ছোটবেলায় আমার পরিবার আমাকে গল্পের বই পড়তে কখনো বাঁধা দেয়নি! সেটা তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ, সুনীল, সমরেশ যেই হোক না কেন! কিন্তু সে সময় আমার বয়সী অন্য অনেকের বাড়িতেই দেখেছি গল্পের বই পড়া একদম বাড়ন! হুমায়ুন আহমেদ একটু আধটু পড়তে পারলেও, তসলিমা নাসরিনের বই এরতো প্রশ্নই উঠেনা! বিশেষ করে বেশীরভাগ ফ্যামিলির পুরুষদের দেখতাম মেয়েদেরকে তসলিমা নাসরিন এর বই পরতে দেখলেই ক্ষেপে যেতো!
অর্থাৎ যা মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে, যা নিজেদের চেনা পৃথিবীর বাইরের দৃশ্যপট তুলে ধরতে পারে, যে সত্য অসুন্দর কিন্তু চারপাশে ঘটছে, তা চোখ কান ঢেকে রেখে জানতে না চাওয়াতেই বেশীরভাগ বাংলাদেশিরা অভ্যস্ত! তো এসব মানুষরা নিজেদের অতি পরিচিত, নন-থ্রেটেনিং গন্ডির বাইরে গল্প করার মতো, সচেতন থাকার মতো নলেজ বা deep thinking এর ক্ষমতা আসলে কিভাবে পাবে! কই থেকে পাবে!
আসলে পুরো বাংলাদেশেটাই হচ্ছে ভীষন ছোট্ট একটা কুয়ার মতো। যার ভেতর আটকে থাকা বেশীরভাগ মানুষজনেরই বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোন ধারনা নেই! ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এদের হাতের মুঠোয় থাকলেও নিজেদের চেনা গন্ডির বাইরের পৃথিবীকে গ্রহণ করার মতো বুদ্ধি, সহনশীলতা বা সচেতনতা কোনটাই নেই! কারন সেইরকম চিন্তার পরিবেশ না তারা পরিবারে পায়, না সামাজিকভাবে এনকারেজ করা হয়! আর ধর্মীয়দিক থেকেও লজিক্যাল ভাবনাচিন্তাকে প্রমোট করার প্রশ্নই আসেনা! সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তা কিন্তু না! বরং বলা যায় আরও অবনতি হয়েছে! যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের মানুষজন হাল ফ্যাশনের জামাকাপড়, মেইকআপ, টেকনোলজি চিনলেও, মেধা, মননে, ব্যাক্তিত্বে ধাড়ালো হয়ে উঠতে পারেনি। এখন ঘরে ঘরে গোল্ডেন এ প্লাস স্টুডেন্ট, কোরান শরীফ মুখস্থ করা হাফেজ, চিন্তা ভাবনা, পোষাক পরিচ্ছদে ধর্ম মেইনটেইন করা, আধুনিক ছেলেমেয়ে অনেক পাওয়া যাবে! কিন্তু ক্রিটিক্যাল থিংকিং করা ইয়াং জেনারেশন এর সংখ্যা যে ভয়াবহ রকম কম, সেটা দেশের ওভারঅল চিত্র দেখলেই বোঝা যায়!
আশি, নব্বই দশকের রক্ষণশীল বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ এর মতো লেখকেরা তাদের লেখা দিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাতে পারলেও, এখন কেন বইমেলায় এমন লেখক পাওয়া যায়না! কেন কারও লেখা পড়ে নিজেকে জানার, পৃথিবীকে জানার কৌতুহল উদ্রেক হয়না! কেন মোশতাক, সাবরিনাদের অশালীন রিলস দেখে, লোকজন শুধুমাত্র 'মজা নিতে' এখন বইমেলায় যায়! এখনকার বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের দৈন্য দশার প্রমান সিমিন লুবাবা'র মতো শিশু কিশোররা! যে কিনা অল্প বয়সেই বুঝে গেছে বাংলাদেশে পপুলারিটি পেতে হলে হিজাব মাথায় 'ইসলামের কথা' বললেই হবে! ঠিক মতো কথা বলতে না পারলেও, হাজব্যান্ডের বানানো সি-গ্রেডের মুভিতে নায়িকা হয়ে, সেলিব্রিটি হওয়ার স্বপ্ন ফুলফিল করে, রমজান মাসে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে, ক্যামেরার সামনে বলে ফেললেই হয় 'ছেলে বড় হচ্ছে, তার মা নায়িকা হলে ভালো দেখায় না'! অথচ নায়িকা হওয়া যে 'এতো খারাপ' একটা ব্যাপার, সে কথা কেনো তাদের ছেলের মা হওয়ার আগে মনে থাকে না, কে জানে!
বাংলাদেশের মতো গন্ডমূর্খদের দেশ বলেই পিনাকী ভট্টাচার্য ইসলাম বন্দনা করে, বাংলাদেশী মুসলিমদদের 'গুড়ু' হতে পেরেছেন। অথচ সেই একিই মুসলিম নতুন ছাপা হওয়া টাকায় মন্দিরের ছবি থাকলে, সেটা পকেটে রেখে নামাজ হবে কিনা, এই ভাবনায় অস্থির!
যেহেতু গড়পরতা বাংলাদেশিরা স্কুল আর কোরান শরীফের বাইরে অন্য কোন বই পড়তে আগ্রহী না, এইজন্য তারা না নিজেরা কোন যুক্তি দিতে পারে না অন্যের যুক্তি বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ বোঝাতে গেলে তাদের মুর্খ ফ্র্যাজাইল ইগো খুব অপমানিত হয়! অথবা তা ধর্ম অবমাননা মনে হয়! তখন গালাগালি বা খুনোখুনী করা ছাড়া এদের অন্য উপায় থাকেনা। এদের সব ইনফরমেশন সোর্স হয় ফেইক অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর না হয় কোন আলেম হুজুর! যেখানে তাদের ব্রেইন ব্যাবহারের কোনও প্রয়োজনও পরে না! তো এই লেভেলের আইকিউ নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশ্বের কোন দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায় সেই উত্তর আতিপাতি করে খোঁজে আমার এ অবুঝ মন!
©মুনলীন