07/09/2025
আজকে অস্ট্রেলিয়াতে ফাদার'স ডে! সেজন্যই কিনা জানিনা মনে হচ্ছিলো আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখি! আব্বু বেঁচে থাকতে কখনো লিখিনি। উইশও করিনি। এমনকি তার বার্থডেও বেশীরভাগ সময় মনে থাকতো না। আব্বু বেঁচে থাকতে সে যতটা আমাদের সাথে দূরত্ব মেইনটেইন করেছে বা বাবা হিসেবে যতটা অ-বাবাসুলভ আচরণ করেছে, আমরা দুবোনই আসলে ততটাই শীতল কঠিন হয়ে গেছি 'বাবা' শব্দটার ব্যাপারে।
তারমানে যে আব্বুর সাথে আমাদের একদমই যোগাযোগ ছিলো না, তা না! যোগাযোগ, হৃদ্যতা সবই ছিলো অনেকটা স্কুল,কলেজের হাড়িয়ে যাওয়া সেই বন্ধুর মতো! যার সাথে অনেক অনেকদিন পর যখন দেখা হয়, তখন নতুন উচ্ছাসে, মন ভালো করা আড্ডা, গল্পগুজব হয়। আর যখন বিদায় নেয়ার সময় হয় তখন দু'পক্ষই খুব স্বাভাবিকভাবেই জানি যে আবার কবে দেখা বা যোগাযোগ হবে তার ঠিক নেই! বাবা সন্তানের মাঝে চিড়ায়ত দেয়া, নেয়া, মানসিক, অর্থনৈতিক কোন বাধ্যবাধকতা বা প্রত্যাশা ছিলোনা বলে, সেখানে দাবীদাওয়া বা সম্পর্কের অধিকারবোধের অনুভূতিও ছিলো না বললেই চলে!
আব্বুর সাথে আমার ছোটবেলায় একসাথে থাকার স্মৃতি খুব একটা মনে পড়েনা! শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া। একদমিই যখন ছোট ছিলাম মানে চার/পাঁচ বছর বয়স। তখন 'হিসু চাপলে' আব্বু থাকলে নিশ্চিন্তে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারতাম আমার টয়লেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য! যত গভীর রাতই হোক না কেন, ঘুম ভাঙানোর জন্য আব্বু কখনোই ঝাড়ি দিতোনা। আর দ্বিতীয় স্মৃতি হচ্ছে, আব্বুর সাথে ঘুমানো। ২০২০ এর জানুয়ারীতে আব্বুর মারা যাওয়ার আগে শেষবার যখন ডিসেম্বরে দেখা হলো, তখনও আমি আর এরিশা একসাথে আব্বুর সাথে ঘুমিয়েছিলাম। আর সকালে বাড়ির পুকুর থেকে ধরা ফ্রেশ মাছভাজা অন্য সবার সাথে আব্বু নিজেও খাচ্ছিলো আর আমাকে কাঁটা বেছে বেছে দিচ্ছিলো খাওয়ার জন্য! এরপর আমি জানুয়ারীতে অস্ট্রেলিয়া চলে আসার আগে, মেজোচাচাকে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে, সকাল সাতটা/আটটার দিকে গাড়ি নিয়ে আমার বাসার নিচে এসে ফোন দিয়েছিলো চাচার সাথে দেখা করানোর জন্য। আব্বুকে দেখে হাগ দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো অনেক। কিন্তু জেদ করে দেইনি। কারন আমাকে দেখে আব্বু কেমন লজ্জা মেশানো ভঙ্গীতে হাত মেলানোর মতো করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো! রাগ হচ্ছিলো সে কেন নিজে থেকে হাগ দিলোনা! ভেবেছিলাম যাওয়ার আগে সে নিজে থেকে ফোন না দিলে, আমিও ফোন করে বিদায় নেবোনা। কিন্তু ফোন দিয়েছিলো আব্বু। ফোন পেয়ে সেই চিড়াচরিত খোঁচা দিয়েছিলাম 'আমার যাওয়ার তারিখ তোমার মনে আছে'! আর আব্বুও কন্ঠে হালকা মনোক্ষুন্নতা এনে বলেছিলো 'কি যে বলোনা! মনে কেন থাকবে না'! এর ঠিক সাতদিন পর, অস্ট্রেলিয়ায়, সকালে কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, তখন খবর পাই 'আব্বু মারা গেছে'!
আমি অসম্ভব কঠিন মনের মানুষ! হয়তো এইজন্য খবরটা শুনে কান্না পায়নি! কাঁদতে যে চাচ্ছিলাম না, তা না। কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। সব অনুভূতি কেমন দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে ছিলো! আর মনে হচ্ছিলো আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। যতই চেষ্টা করি কিছুতেই লাংস সম্পুর্ন অক্সিজেন পাচ্ছে না! আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম নিজের মাঝে আব্বুকে দেখার জন্য। দেখি নাক, ঠোঁট, থুতনি ঠিক তার মতো। আব্বুর সাথে আমার মুখের যে সাদৃশ্য, জিনের যে বৈশিষ্ট সারাজীবন বিরক্তি উদ্রেক করেছে, যে মিল না থাকলেই সবচেয়ে বেশী খুশি হতাম, সে মারা যাওয়ার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই মিলকেই সবার আগে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। মনে মনে ভাবছিলাম এখনতো সে বেঁচে থাকবে শুধুমাত্র এই মিলগুলোর মাঝেই।
তবে আব্বু মারা যাওয়ার পর কষ্টের চাইতেও বেশি যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের 'conflicting emotions' এর সাথে। আগে ভাবতাম আব্বু মারা গেলেও আমার কিছু যাবে আসবে না। যার সাথে যোগাযোগই তেমন ছিলো না। তার মৃত্যুতে আর কিইবা যাবে আসবে। কিন্তু যায় আসছে তো! খুব অদ্ভুত ভাবেই অনেক কিছু যায় আসছে! আমি তার মৃত্যুতে কষ্ট পেতে চাইছি না! কিন্তু পাচ্ছি তো! কেন! নিজের কাছেই নিজের অনুভূতি অস্বীকার করতে পারি না! কার কাছে গেলে এই দূর্বোধ্য জট খুলবে তাও জানিনা! যে মানুষটার ব্যাপারে আমার এতো রাগ, অভিমান, অভিযোগ, সেই অনুভূতিগুলোকে এখন আমি কোথায় রাখি! এই মানুষটা মারা যাওয়ার সাথে সাথে কেন মনে হচ্ছে, সেই আসলে জিতে গেছে! আর আমি ভীষনভাবে হেরে গেছি! কেন মনে হচ্ছে দূরে বসে সে আমাকে দেখে হাসছে। তার সেই চিরাচরিত ঠোঁট চাপা হাসি! আম্মু বলে আব্বুর মতোই নাকি আমার হাসি! এখন সেই হাসিতেও আমি খুঁজি তাকে। আমি আসলেই আব্বুকে খুঁজি এখন নিজের মাঝে!
যদিও সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু এখন সহজ হয়ে গেছে। Conflicting Emotions কেও অনেকটাই আয়ত্তে এনে ফেলতে পেরেছি। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝেই মনে হয় আমি আব্বুকে মিস করি। কথার খোঁচায় ঘায়েল করার জন্য হলেওতো কাউকে লাগে! হঠাৎ হঠাৎ আব্বুকে স্বপ্নেও দেখি। কোনোটা মনে থাকে। কোনোটা থাকেনা। লাস্ট যখন আব্বুকে দেখেছিলাম, মনে হচ্ছিলো সে ভালো আছে। নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, আনন্দে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো!
তারপর থেকে আমারও ভাবতে ভালো লাগে যে মৃত্যু মানেই হয়তো খুব ভয়ংকর কিছুনা। মৃত্যু মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া না। আব্বু এই ভুবনে ইতি টেনে, অন্য ভুবনে আবার শুরু করেছে। হয়তো সেই অদেখা ভুবনের জীবনটা, এই মানব জীবনের চাইতেও বেশি আনন্দের!
হ্যাপী ফাদার'স ডে, আব্বু!💖
©মুনলীন