14/04/2025
বঙ্গাব্দ: বাঙালির নিজের সময়ের গল্প | বাংলা সনের ইতিহাস
সময়! সময় শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় কিছু সংখ্যার নাম নয়, ঘড়ির কাঁটা নয়- সময় মানে ইতিহাস। সময় মানে পরিচয়।
আর বাঙালির নিজস্ব সেই সময়ের নাম—বঙ্গাব্দ।
আজ আমরা জানব সেই সময়ের জন্মকথা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষকের জীবন, রাজনীতির হিসেব, আর বাঙালির উৎসবের আবেগ।
ইতিহাসের পটভূমি: ১৫৬০ দশকের ভারতবর্ষ।
মুঘল সম্রাট আকবর সিংহাসনে। তাঁর সাম্রাজ্যে রাজস্ব আদায় হয় হিজরি সন অনুযায়ী, যা চলে চাঁদের গতিতে। কিন্তু কৃষিকাজ নির্ভর করে সূর্যের আলো ও ঋতুর গতিপথের উপর। ফলে কৃষকরা পড়েন বিপদে-- খাজনা প্রদান অত্যাসন্ন হলেও তাদের ফসল পড়ে থাকে মাঠ-প্রান্তরে।
প্রজাদের মতো সম্রাট নিজও নিরুপায়। সমস্যার সমাধানে নিরুপায় হয়ে ডাকা হয় রাজজ্যোতিষী আমির ফতুল্লা শিরাজীকে; যিনি সৌরপঞ্জিকার ভিত্তিতে তৈরি করেন নতুন বর্ষপঞ্জি- যার নামকরণ করা হয় ‘তারিখ-ই-ইলাহী’।
বঙ্গাব্দের জন্ম ও রূপান্তর:
এই তারিখ-ই-ইলাহী পরবর্তীতে বাংলার কৃষিজ অর্থনীতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে ফসলি সনের পরিচিতি পায়। আর কালের পরিক্রমায় ফসলী সন রুপান্তরের মাধ্যমে বাংলার মাটিতে হয়ে ওঠে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন।
সন গননার কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছিল ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু সূচনা ধরা হয় ১৫৫৬ সালকে। এর পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গাব্দের সাথে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের ইতিহাস।
মাস ও কাঠামো:
বঙ্গাব্দে আছে ১২টি মাস—
বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। প্রথম ৬টি মাস ৩১ দিন করে, আর পরের ৬টি মাস ৩০ দিন। লিপইয়ার হলে ফাল্গুন হয় ৩১ দিনের।
এই সময়রেখা সূর্য-নির্ভর হওয়ায় ঋতুর সঙ্গে একদম মিল রেখে চলে। আর এটাই বাংলা সনের সৌন্দর্য—প্রকৃতির ছন্দে বাঁধা সময়।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও আধুনিকতা: পহেলা বৈশাখ মানে বাঙালির প্রাণের উৎসব। এদিন বাঙালি সাজে নতুন করে—চারুকলার শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা, আর ঐতিহ্যবাহী খাবার।
বাংলা সনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যবসার হিসাব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক উৎসব।
বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল ও পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ।
একটি দিন, যেখানে বাঙালি আত্মপরিচয়ের উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
আজও বহু কৃষক খাজনার হিসাব রাখেন বঙ্গাব্দ ধরে।
বিয়ে, জন্ম, পূজা—সবই হয় বাংলা তারিখে নির্ভর করে।
এই সন বেঁচে আছে আমাদের উৎসবের ছায়ায়, হৃদয়ের গভীরে।
উপসংহার: বঙ্গাব্দ কেবল সময়ের গতি নয় এটি বাঙালির নিজস্ব একটি স্বাক্ষর। একটি সন, যা আমাদের মাটি, ফসল আর উৎসবের গন্ধ মিশিয়ে তৈরি।
শুভ নববর্ষ, শুভ হোক আগামীর পথচলা।
゚