
02/07/2025
“সন্ধ্যার ছায়া”
সন্ধ্যা নেমেছে গ্রামটায়। বাতাসে এক ধরনের অজানা শূন্যতা। পাখিরা ডেকে উঠে বাসায় ফিরছে, গরুগুলোও ফিরে এসেছে খোঁয়াড়ে। কিন্তু ঝুমুর এখনও পথ চেয়ে বসে আছে উঠোনে, হাতে তার বই, চোখে একরাশ আতঙ্ক।
ঝুমুর একটা গ্রামের মেয়ে। সবে দশম শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখায় ভালো, স্বপ্ন দেখে শহরে গিয়ে কলেজে পড়বে। কিন্তু সেই স্বপ্নে বারবার ছায়ার মতো ঢেকে যায় সন্ধ্যার অন্ধকার।
তার বাবা একজন দিনমজুর, সারাদিন মাঠে কাজ করেন। মা গৃহস্থালির কাজ সামলান। সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকা এক ধরনের “নিষিদ্ধ” ব্যাপার যেন। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য।
ঝুমুরের সমস্যা শুরু সন্ধ্যার পর। পাশের বাড়ির রহিম চাচা — একজন বয়স্ক লোক, যিনি মাঝে মাঝেই অজুহাতে তাদের বাড়িতে আসে। ঝুমুরের দিকে তার দৃষ্টির ভাষা ঝুমুর বুঝে ফেলে ছোটবেলাতেই। সন্ধ্যা নামলেই সে দরজা বন্ধ করে পড়তে বসে। কিন্তু শান্তি পায় না। ছাদে পায়ের আওয়াজ, দরজায় হালকা ঠোকাঠুকি – সব যেন তার বুক কাঁপিয়ে তোলে।
একদিন সে সাহস করে মাকে বলেছিল, “মা, রহিম চাচা মাঝে মাঝেই অদ্ভুতভাবে তাকায়।” মা তাকে থামিয়ে বলেছিল, “ছেলেমানুষ এসব বলে না, কুলক্ষণ করিস না।”
ঝুমুর চুপ করে যায়। সেদিন সে বুঝে যায়, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু শুধুই কোন অপরিচিত মানুষ নয়, সমাজের চেপে ধরা চুপ করিয়ে দেয়া রীতিও।
একদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রহিম চাচা আবার আসে। বাবা তখনও বাড়ি ফেরেনি। মা রান্না ঘরে। ঝুমুর একা ঘরে। দরজার ছিটকিনি দেয়া, তবু হৃদয়ে ভয় ঢেউ তোলে।
তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় – আর না।
মোবাইলটা নিয়ে একটা ভিডিও রেকর্ড শুরু করে রাখে। দরজা খুলে বলে, “চাচা, কিছু দরকার?” রহিম ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে — তখনই ঝুমুর বলে, “আপনি আর এক পা এগুলেই আমি পুলিশে ফোন করব, আর ভিডিওটা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেব।”
রহিম থমকে যায়। কণ্ঠ শক্ত করে ঝুমুর বলে, “আমি ভয় পাই না আর। এই অন্ধকার আমার নয়, আপনার লজ্জা লুকায়। আমি আলো চাই, আমার মতো মেয়েদের জন্য।”
সেই রাতটা কেটে যায় নতুন ভোরের আশায়। পরদিন ঝুমুর তার মাকে আবার বলে, এবার মা তাকে বোঝে। বাবা থানায় যায় অভিযোগ করতে।
ঝুমুর আজ স্কুলে যায়, সন্ধ্যায় কোচিংও করে। নিজের জন্য, অন্য মেয়েদের জন্য — কারণ, সে জানে, অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একটুখানি আলোই যথেষ্ট।
সন্ধ্যা শুধু সূর্য ডোবার সময় নয়, বহু মেয়ের মনে ভয়, দুঃশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তার নাম। কিন্তু যদি কেউ একবার সাহস করে দাঁড়ায়, তবে আলো ফিরতেই বাধ্য।