13/05/2025
টেকনাফের আঁধার থেকে ডুলহাজরার আলো
১৩ই মে, ২০১৮: প্রথম দিন
"খারদুংলা বাইসাইকেল এক্সপেডিশন"-এর স্বপ্নীল যাত্রা শুরু হলো আজ, তবে শুরুটা যেন এক রহস্যময় আঁধারে মোড়া। টেকনাফের রাতের আকাশ বিদ্যুতের অভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ সময়ই ছিল নীরব, নিস্তব্ধ। ভোরের আলো ফোটার আগেই, যখন প্রকৃতি আলস্য ভাঙছে, ঠিক ৫:৩০-এ আমার ঘুম ভাঙলো। শরীরে তখন অভিযানের উত্তেজনা, তাই দ্রুত হাতে সাইকেলের ব্রেকগুলো পরীক্ষা করে নিলাম। সকাল ৬:২০-এর মধ্যেই ইমরানকে সাথে নিয়ে টেকনাফের সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত জিরো পয়েন্টের দিকে রওনা হলাম।
অথচ নিয়তির খেলায় বাদ সাধলো দু'দিন আগের কালবৈশাখী। শাহপরীর দ্বীপের পথে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি রেখে যাওয়া ধ্বংসলীলার চিহ্ন স্পষ্ট। তাই বেশি দূর আর এগোনো হলো না। সাবরাংয়ের জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বন্ধু ইমরানের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এবার মেরিন ড্রাইভের মসৃণ পথ আমার সঙ্গী, গন্তব্য তখনও বহুদূর। আকাশ জুড়ে তখন মেঘের লুকোচুরি, আর হঠাৎ করেই শুরু হলো দমকা হাওয়া। বাতাসের সেই অপ্রত্যাশিত সহায়তা যেন পালতোলা নৌকার মতো গতি এনে দিলো আমার সাইকেলে—স্পিড ছুঁলো ২৫-৩০ কিমি/ঘণ্টা। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল কখন বদলায় কে জানে! আচমকাই পিছন থেকে ধেয়ে এলো এক পশলা বৃষ্টি। আশেপাশে দাঁড়ানোর মতো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে প্রাণপণে প্যাডেল চাপতে লাগলাম। তবুও শেষ রক্ষা হলো না, হাল্কা ভিজে গেলাম। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়লাম—যেন সামনেও বৃষ্টি ধেয়ে আসছে, আর পিছনেও তার তাড়া! ভাগ্যিস কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় এক ছোট্ট দোকান খুঁজে পেলাম। ব্যাগ থেকে তাড়াহুড়ো করে প্লাস্টিকের টার্প বের করে যখন সাইকেল ঢাকতে যাচ্ছি, তখন বুঝলাম একা এই বাতাসের সাথে পাল্লা দেওয়া কঠিন। দেবদূতের মতো একজন জেলে ভাই এগিয়ে এসে সাহায্য করলেন। বৃষ্টি আর বাতাসের সেই যুগলবন্দী যেন মেরিন ড্রাইভের পরিচিত সৌন্দর্যকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো।
বৃষ্টি থামতেই আবার শুরু হলো আমার পথচলা। শরীর তখন ক্লান্ত, কিন্তু গন্তব্যের হাতছানি উপেক্ষা করার সাধ্য নেই। একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেল, আর এখন যেন আকাশ থেকে আগুনের হলকা নামছে! শাপলাপুরে পথের ধারে এক দোকান থেকে হাফ লিটার জুস পান করে শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেলাম। কিন্তু প্রকৃতির মতিগতি বোঝা দায়—কিছুদূর না যেতেই ফের আকাশের রং বদলালো। প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে চললো সেই দমকা বাতাস। ইচ্ছে করছিল একটু দাঁড়াই, মেরিন ড্রাইভের পাশে বসে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের খেলা দেখি, কিন্তু বৃষ্টির ভয়ে সাহস হলো না। সোনাপাড়া মোড়ের কাছে চোখে পড়লো এক ছোট্ট ছেলেকে, রাস্তার পাশে ডাব বিক্রি করছে। চলন্ত অবস্থাতেই হাঁক দিলাম—"দাম কত?" ছেলেটির সরল উত্তর—"মামা, আপনার জন্য ৩০!" বিশ্বাস হতে চায় না, কক্সবাজারে এত সস্তা ডাব! আর সাইজ? মাশাল্লাহ, বেশ ভালোই। ডাবের মিষ্টি জলে গলা ভেজালাম, আর সেই সাথে দেড় ঘণ্টা ধরে চললো বিশুদ্ধ বাতাসের সাথে আমার নীরব কথোপকথন। ছেলেটির সাথে জমে উঠলো এক অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্ব, যেন বহুদিনের চেনা কেউ। আড্ডার ফাঁকে সে দুটো পাকা আমও দিলো, তবে লবণ না থাকায় সেদিন আর খাওয়া হলো না, এমনকি আমের কথা ভুলেও গেলাম।
হিমছড়ির আঁকাবাঁকা পথ পেরোনোর পরই যেন আকাশ ভেঙে নামলো বৃষ্টি। ভিজতে ভিজতেই চালালাম, মেরিন ড্রাইভ যেখানে শেষ হলো, সেখানেই চোখে পড়লো এক সাধারণ হোটেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মামা যেন আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন। মনে পড়লো, আগের দিন কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে তার কাছে এক গ্লাস জল চেয়েছিলাম। মানুষটা মনে রেখেছে! আমার ক্লান্ত সাইকেলটিকে হোটেলের ভেতরে টেনে নিয়ে ভেজা শরীরেই দুপুরের খাবারের জন্য বসলাম। সেই সাধারণ খাবারের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে—গরুর মাংস ষাট টাকা, পোয়া মাছ চল্লিশ, আলু ভর্তা দশ, ডাল দশ, পুঁই শাক বিশ আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা সেই ভাতের দাম মাত্র পঁচিশ টাকা। এতক্ষণ ধরে শরীরে জমানো ক্যালোরির চেয়েও বেশি হয়তো খেলাম, তবে সেই তৃপ্তি ছিল অমূল্য।
পেটের পূজা শেষে আবার পথ ধরলাম—লক্ষ্য কক্সবাজারের জিরো পয়েন্ট, তারপর ডুলহাজরা সাফারি পার্ক। কিন্তু জিরো পয়েন্ট যেন এক গোলকধাঁধা! শহরের অলিগলি চষে ফেললাম, ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল। অবশেষে এক হোটেলের সামনে আবিষ্কার করলাম সেই কাঙ্ক্ষিত জিরো পয়েন্ট। আমার এই জিরো পয়েন্টের খোঁজ যেন উৎসুক মানুষের মনে কৌতূহলের ঢেউ তুললো।
হাইওয়েতে ওঠার পর বাতাসের প্রবল ধাক্কা যেন প্রতিটি প্যাডেল ঘোরাকেই কঠিন করে তুলছিল। ঈদগাঁও পৌঁছাতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, তখন মনে হলো আজকের মতো বিশ্রাম প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সাইক্লিস্ট তমাল ভাইয়ের বাড়ি আজ রাতের আশ্রয়স্থল। বিকেল থেকেই তমাল ভাইয়ের বাবার উদ্বিগ্ন ফোন আসতে শুরু করেছিল, সন্ধ্যা যত বাড়লো, ফোনের মাত্রাও তত বাড়লো। কটখালী বাজারে দাঁড়িয়ে যখন সাইকেলের সামনের আলো ঠিক করছিলাম, তখন প্রায় সাতটা বাজে। ওখান থেকে আরও চার কিলোমিটার পথ বাকি... স্থানীয়দের সাবধানবাণী—সামনে নাকি 'ডাকাত পড়ে', তাই ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা চলে যেতে হবে। তখনই বুঝলাম কেন সেই স্নেহময় আংকেল এতবার ফোন করছিলেন—এতো ভালোবাসা!
শুনেছিলাম, সাফারি পার্কের আশেপাশে একসময় ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটতো। বুকের ভেতর চাপা ভয় নিয়ে লাইট জ্বালিয়ে প্যাডেল চাপা শুরু করলাম। কিছুদিন আগে সুন্দরবনের ডাকাতদের নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম, তখন থেকেই কেমন যেন একটা অদম্য কৌতূহল জেগেছিল—তাদের দেখার। কিন্তু আগ্রহের সাথে ভয়ও তো ছিল! ডাকাত আর দেখা হলো না সেদিন, তাই সাবধানে, সামনের আলো বন্ধ করে, নিঃশব্দে চালানোর চেষ্টা করছিলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, এর মধ্যে সেই অচেনা বাড়ি খুঁজে পাবো কিভাবে, তাও বুঝতে পারছিলাম না। শেষ চার কিলোমিটার পথ যেন আর শেষ হতে চাইছিল না। অবশেষে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহময় আংকেল তার হাতের টর্চলাইটের আলো দিয়ে আমাকে ইশারা দিলেন। যাক, ডাকাতের খপ্পরে পড়িনি! এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।
সত্যি বলতে, চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার কিছুই আমি বুঝি না। সেই আন্তরিক আংকেল যখন তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন, তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে তার চোখের স্নেহ আর মুখের উদ্বেগের ভাষা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। পেটে তখন রাজ্যের ক্ষুধা, কিছু বলার আগেই তিনি নিজের হাতে কলা আর রুটি এগিয়ে দিলেন। তাদের ছোট্ট সংসারে বিদ্যুতের ছোঁয়া নেই। রাতের অন্ধকারে, নাস্তা শেষ করে যখন তাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, তখন কোন পথে হেঁটেছি, কোন দিক দিয়ে গিয়েছি কিছুই ঠাহর করতে পারিনি। বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো যেন এক ঘন জঙ্গলের মাঝে এসে পড়েছি।
ঘরের ভেতরে ঢুকেই আন্টির হাতের তৈরি অমৃতের মতো শরবত পান করে ভেজা জামাকাপড় বদলালাম। তারপর আন্টি আর আঙ্কেলের সাথে বসেই শুরু হলো আমার এই পাগলাটে ভ্রমণ নিয়ে গল্পের আসর। তাদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালোই লাগছিল। অনেকক্ষণ ধরে চলা সেই গল্পের শেষে, আঙ্কেলের সাথে বসেই রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষ করে যখন আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে গেলাম, তখন আংকেল হাতে ধরিয়ে দিলেন তার লেখা একটি ছোট্ট বই। এরপর শুরু হলো তার জীবনের গল্প—এক করুণ অথচ অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনী। কতবার যে ট্রেনিং নিয়েও দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাননি, সেই আক্ষেপ আজও তার চোখে স্পষ্ট। বইটি আকারে ছোট হলেও প্রতিটি পাতায় ছিল দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, নিজের জীবন সংগ্রামের কথা আর যুদ্ধের রক্তঝরা ইতিহাস। বইটি তিনি আমাকে উপহার দিলেন—যেন এক অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন। এখন আমি ডুলহাজরা সাফারি পার্কের পাশেই এক বিদ্যুৎহীন গ্রামের কোনো এক বাড়িতে। প্রকৃতির নীরবতা আর সরল মানুষের উষ্ণতা—জীবন সত্যিই সুন্দর।
ইন্টাগ্রাম আইডি ফলো করুন:
https://www.instagram.com/1971miles.bd