30/07/2025
মুহাম্মাদ ই/ব/নে আ/ব্দু/ল ওয়াহাব আন-নজদীর
(1703–1792) চিন্তাধারা, তাঁর আন্দোলন,
মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার অভিযোগ, খিয়ানত এবং সমালোচিত ভুল ও ত্রুটি তুলে ধরছি—ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মূলধারার আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রভাবসহ:
🌿 পটভূমি
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ছিলেন নজদের (আজকের সৌদি আরবের এক অঞ্চল) একজন আলেম। তিনি তাওহিদের নামে এমন এক কঠোর সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, যা পরে ওহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। এটি সৌদ পরিবার (আল সউদ) এর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করে।
⚔️ মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার অভিযোগ
১️⃣ তিনি তাঁর মতের বাইরে থাকা প্রায় সকল মুসলিমকে (যেমন আশআরী, মাতুরিদী, সুফি, শিয়া) মুশরিক বা বিদআতপ্রিয় আখ্যা দেন। ২️⃣ কবর যিয়ারত, ওলী-আওলিয়ার প্রতি সম্মান, মিলাদ, তাওয়াসসুল ইত্যাদিকে সরাসরি শিরক বলেন। ৩️⃣ এর মাধ্যমে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা উম্মাহর ঐক্য, প্রেম, সহনশীলতা ও সংস্কৃতির মধ্যে তীব্র বিভক্তি সৃষ্টি হয়। ৪️⃣ ওহাবি আন্দোলন সমর্থন না করলে যুদ্ধ করা জায়েজ বলতেন — যার কারণে হাজারো নির্দোষ মুসলমান নিহত হন (উদাহরণ: কারবালা, তায়েফ, মক্কা-মদীনা আক্রমণ ইত্যাদি)।
🏴☠️ খিয়ানতের অভিযোগ
• ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নিজে সরাসরি বিদেশি শক্তির এজেন্ট ছিলেন এমন প্রমাণ নেই, তবে:তাঁর আন্দোলনকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা সমর্থন করেছে বলে ঐতিহাসিক দলিল আছে।ব্রিটিশরা অটোমান খিলাফতের বিরুদ্ধে সৌদ পরিবারকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে, যাতে হিজাজ (মক্কা-মদীনা) অটোমানদের হাতছাড়া হয়।
• ফলে মুসলিমদের প্রধান কেন্দ্র বিভক্ত হয়, যা পশ্চিমা শক্তির স্বার্থেই উপকারী হয়েছিল।
•
🧩 মূল ভুল ও ত্রুটি
✅ উম্মাহর মূলধারাকে কুফর/শিরক বলা:
• কুরআন-সুন্নাহ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কঠোরতা ও অতিবাদী সিদ্ধান্ত। ✅ ইজমা ও ঐতিহ্য অস্বীকার:
• উলামায়ে উম্মাহর বহু শতাব্দীর ইজমা ও ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে নতুন ব্যাখ্যা চালু করেন। ✅ সশস্ত্র জিহাদের অজুহাত:
• মুসলিমদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছেন, অথচ শত্রু ছিল তৎকালীন ঔপনিবেশিক শক্তি। ✅ রুহানিয়াত ও তাসাউফের প্রতি বিদ্বেষ:
• ইলম ও আধ্যাত্মিকতার ভারসাম্য নষ্ট করেন। ✅ শরিয়াহর দোহাই দিয়ে সৌদ পরিবারকে একনায়ক শাসনের বৈধতা দেন:
• যা ইসলামে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলার শিক্ষা বিরোধী।
•
📜 ইতিহাসে প্রমাণিত কিছু ঘটনা
• ১৮০১ সালে কারবালায় হামলা করে হাজারো নির্দোষ মানুষ হত্যা ও ইমাম হুসাইনের মাজার ভেঙে ফেলা।
• তায়েফ আক্রমণে বহু মুসলিম শহরবাসীকে হত্যা।
• মক্কা-মদীনায় ইমাম ও সাধারণ মুসলিমদের উপর চরম জুলুম।
• পরে ব্রিটিশদের মদতে অটোমান খিলাফত ভেঙে সৌদি রাজতন্ত্র কায়েম।
•
📚 উলামায়ে হক ও ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে
• মিসরের আযহার, ভারত উপমহাদেশের দেওবন্দ, বেরেলভী, সিরিয়ার উলামা, মরক্কো, তুরস্ক—সবাই এক বাক্যে বলেন:ওহাবি মতবাদের চরমপন্থা উম্মাহকে একতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।ইসলামের নামে ইসলামের মূল সৌন্দর্য, সহনশীলতা ও ঐতিহ্যবাহী ইজমা ধ্বংস করেছে।
• আল্লামা আহমদ যরকানী, শায়খুস সুদান, ইমাম ইবনে আবেদিন (র.) সহ বহু উলামা তাঁদের কিতাবে এই ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
•
⚖️ সারমর্ম
ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ইসলামের নামে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত চরমপন্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতালোভী শক্তির সঙ্গে আঁতাত, উম্মাহর ঐতিহ্য অস্বীকার — সব মিলিয়ে মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করেছে এবং পশ্চিমাদের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছিল। এখনো এই বিভক্তি, ঘৃণা, সহনশীলতার অভাব মুসলিম জাহানকে ক্ষত-বিক্ষত করে রেখেছে।
🌿 ১) মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার দিক — ঐতিহাসিক দলিল ও উক্তি
✅ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব তাঁর কিতাব কিতাব আত-তাওহিদ-এ স্পষ্ট লিখেছেন:
«مَن تَعلَّق بشيء فقد أشرك» অর্থ: “যে কোনো কিছুর মাধ্যমে তাওয়াসসুল বা সাহায্য চায়, সে শিরক করল।” 👉 মূলধারার আলেমরা বলেন, এভাবে সহস্রাব্দ ধরে চলে আসা ওলী-আওলিয়ার মাধ্যমে দোয়া করার রেওয়াজকে শিরক বলা মুসলিমদের বড় অংশকে কাফের আখ্যা দেয়, যা উম্মাহর বিভক্তির মূল কারণ হয়।
✅ শায়খ ইবনে আবেদিন আল-শামী (রহ.) তাঁর রাদ্দ আলাল-ওয়াহাবিয়া কিতাবে বলেন:
“এরা (ওহাবিরা) মুসলমানদেরকে মুশরিক ও কাফের বলে; অথচ তারা ঈমান ও তাওহিদের প্রকৃত অর্থ না জেনেই এই ফতোয়া দেয়।” 📚 (ইবনে আবেদিন, রাদ্দ আলাল-ওয়াহাবিয়া, পৃষ্ঠা ৩)
⚔️ ২) খিয়ানত ও উপনিবেশবাদীদের মদদ — দলিল
✅ ব্রিটিশ অফিসার হ্যাম্পার (Hamper) এবং ক্যাপ্টেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (1914) এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে, ব্রিটিশরা নজদ এবং সৌদ পরিবারকে সহায়তা করেছে অটোমান খিলাফতের বিরুদ্ধে। 📚 The Secret History of the British Conquest of Arabia, Mark Curtis 📚 Confessions of a British Spy (এটি বিতর্কিত হলেও প্রাচীন দলিল হিসেবে বহু ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন)
✅ ১৮০১ সালে ওহাবি বাহিনী কারবালা আক্রমণ করে। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বহু মুসলমান নিহত হয় এবং ইমাম হুসাইন (র.)-এর রওজা ভেঙে দেয়। 📚 Najd and the Emergence of the Saudi State, Alexei Vassiliev, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৩৫
🏴☠️ ৩) ভুল ও চরমপন্থা — দলিলসহ
✅ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব তাঁর চিঠিতে লিখেছেন:
“আমরা ওহাবিরা, যারা আমার দাওয়াহ মেনে চলে না, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করি।” 📚 উক্ত চিঠি উদ্ধৃত — ইবনে ঘান্নাম, تاريخ نجد (তারিখ নজদ), পৃষ্ঠা ২৭৯
✅ আল্লামা আহমদ যরকানী বলেন:
“তাদের দাওয়াতের মূল ভিত্তি হলো: যে তাদের বিরোধিতা করে, সে মুশরিক।” 📚 الدرر السنية في الرد على الوهابية (আল-দুররুস সানিয়া ফি রাদ্দ আলাল-ওয়াহাবিয়া)
🕌 ৪) তাসাউফ ও ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংস — দলিল
✅ ওলী-আওলিয়াদের মাজার ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন এবং এটি বাস্তবায়ন করা হয় মক্কা-মদীনায়। 📚 Encyclopaedia of Islam (Brill), “Wahhabism” এন্ট্রি
✅ শায়খুল আজহার মুহাম্মাদ আলী আবদুর রাসুল (রহ.) বলেন:
“ওহাবিয়াত হচ্ছে এমন ফিতনা, যা ইসলামের গভীর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ধ্বংস করে মানুষকে দাস বানিয়েছে।” 📚 فتنة الوهابية (ফিতনাতুল ওহাবিয়া)
⚖️ ৫) উলামায়ে হকের ঐকমত্য ও সমালোচনা
✅ ইমাম ইবনে জাইন আল-আবিদিন (রহ.) বলেন:
“ওহাবিরা শুধুমাত্র মুসলিমদের বিভক্ত করেছে এবং শত্রুদের হাতে শক্তি তুলে দিয়েছে।” 📚 রিসালাতুন ফি রাদ্দ আলাল-ওয়াহাবিয়া
✅ দেওবন্দ, বরেলভী, মরক্কো, মিসর, সিরিয়া—সবই এক বাক্যে বলেন:
• উম্মাহকে “তাওহিদের নামে” টুকরো করেছে।
• ব্রিটিশদের সহায়তায় মুসলিম কেন্দ্রগুলো দখল করেছে।
• মূলধারার ফিকহ ও তাসাউফ ধ্বংস করেছে।
•
📌 সারসংক্ষেপ (দলিলসহ)
বিষয় ঐতিহাসিক দলিল উম্মাহকে বিভক্তি ইবনে আবেদিন, রাদ্দ আলাল-ওয়াহাবিয়া মুসলিম হত্যা কারবালা আক্রমণ, Najd and the Emergence of the Saudi State ব্রিটিশ মদদ Secret History…, Confessions of a British Spy চরম ফতোয়া কিতাব আত-তাওহিদ, ইবনে ঘান্নাম তাসাউফ বিরোধিতা Encyclopaedia of Islam, শায়খুল আজহার
✅ এইভাবে, দলিলসমেত প্রমাণিত হয় যে ইবনে আব্দুল ওয়াহাব ও তাঁর আন্দোলন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও হৃদ্যতা নষ্ট করেছে, শত্রুদের শক্তি দিয়েছে, এবং ইসলামের সহনশীলতা ও রুহানিয়াত ধ্বংস করেছে।🌿📜