17/09/2025
গল্প: সুখের চাবিকাঠি
রাশেদ প্রতিদিন ভোরে উঠে বের হয়, হাতে একটা পুরোনো ব্যাগ। শহরের এক প্রাইভেট অফিসে তার চাকরি, মাসে বেতন আঠারো- বিশ হাজার। এই টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালানো যেন পাহাড় ঠেলবার মতো কঠিন।
স্ত্রী নীলা ভোরে উঠেই বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানায়। পাঁচ বছরের মিষ্টি, চার বছরের রাফি—তাদের ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া নিয়েই সংসারে যেন অন্যরকম আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দকে সবসময় ঢেকে রাখে টাকার হিসাব।
প্রায়ই রাতে খাওয়ার টেবিলে নীলা মুখ গোমড়া করে বলে—
“এইভাবে কতদিন সংসার চলবে রাশেদ? বাজারে জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিন বাড়ছে, তুমি ভাবছো কিছু?”
রাশেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে—
“আমি কি চাই না সংসারে সুখ আনতে? দিনরাত খেটে মরছি, কিন্তু বেতন তো আর বাড়ছে না!”
এদিকে সংসারের ভেতরে ছোটখাটো রোগবালাই লেগেই থাকে। কখনো বাচ্চাদের জ্বর, কখনো নীলার অসুস্থতা। আর রাশেদের নিজের শরীরও প্রতিদিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড়, মাথা ব্যথা, মাঝে মাঝে মাথা ঘোরা—তবুও ডাক্তার দেখানোর মতো সাহস হয় না। মাস শেষে সংসারের হিসাব মেলাতে গিয়ে চিকিৎসা সবসময় পিছিয়ে যায়।
একদিন মাসের শুরুতে রাশেদ বেতন পেল। সিদ্ধান্ত নিল এবার আর ফাঁকি দেওয়া যাবে না, অন্তত একবার ডাক্তার দেখাবে। কিন্তু রাতে ঘরে ঢুকতেই নীলা হাত বাড়িয়ে বলল—
“শোনো, বাজারে চাল শেষ, বাচ্চাদের দুধও নেই। দু’টো-একটা মাছ তো আনতে হবে। এতদিন ধরে ওরা শুধু ডাল-ভাত খাচ্ছে।”
রাশেদ থমকে গেল। পকেটে ভাঁজ করা টাকা শক্ত করে ধরল। একপাশে ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছে, অন্যপাশে পরিবারের চাহিদা। শেষমেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“ঠিক আছে, তুমি খরচ কেটে নাও।”
ডাক্তারের খরচের জন্য রাখা টাকাটা সংসারের পেছনে চলে গেল।
এভাবেই মাসের পর মাস কেটে গেল। রাশেদের অসুখ বেড়েই চলল, কিন্তু চিকিৎসা হলো না। শরীর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগল।
একদিন ভোরে রাশেদ অফিসে যাওয়ার আগে বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল—
“তোদের জন্যই সব করি আমি… একদিন যদি না থাকি, বুঝবি কি আমার কষ্টটা?”
সেদিন অফিসে গিয়েই রাশেদ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে গেল, কিন্তু ডাক্তার মাথা নাড়ল—
“অনেক দেরি হয়ে গেছে। আগে এলে হয়তো বাঁচানো যেত।”
নীলা দৌড়ে এলো হাসপাতালে। রাশেদের নিথর শরীরের পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মনে পড়তে লাগল প্রতিটি মুহূর্ত—তার অপূর্ণ চিকিৎসা, সংসারের টানাপোড়েন, আর নিজের কথার টোপে পড়ে রাশেদের ত্যাগ।
হাসপাতালের নিস্তব্ধ পরিবেশে নীলা শুধু একটাই কথা বলছিল—
“আমাদের জন্য তুমি নিজের জীবন দিলা… আমরা তো বুঝতেই পারলাম না।”
---
শিক্ষা
এই গল্প শুধু একটা পরিবারের নয়, হাজারো মধ্যবিত্ত সংসারের প্রতিচ্ছবি। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ভালোবাসে, কিন্তু অভাব-অনটন সবকিছু গ্রাস করে ফেলে। সুখের চাবিকাঠি হয়তো টাকা নয়, কিন্তু টাকার অভাবে ভালোবাসার মাঝেও কান্নার রেখা ফুটে ওঠে।