
12/07/2025
"নানা কাঁধে ভর করে যে শৈশবটা পার করেছি"
আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান মানুষটির নাম মুনসুর আলী সিকদার। তিনি কোনো চাকরি করেন না, করেননি বহু বছর ধরে। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সেই অবসর সময়েই আমি পেয়েছি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল উপহার—ভালোবাসা, ত্যাগ আর আদরের ছায়া।
আমি ছোটবেলা থেকেই নানাবাড়িতে বড় হয়েছি। মা–বাবা ব্যস্ত ছিলেন, আর হয়তো জীবনের হিসেব-নিকেশের মাঝে আমি একটু আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমার জন্য ছিল নানার খোলা দরজা, খোলা মন আর সীমাহীন মমতা। আমি হেফজ মাদ্রাসায় পড়তাম। দূরে থাকতাম, কষ্ট হতো, মন পড়ে থাকত নানা নানির আদর-ভরা ঘরে।
দু-একদিন পরপরই নানা চলে আসতেন—কখনো হাতে ভরা ব্যাগে তরকারি, কখনো আদর মেশানো রান্না করা মাছের ঝোল। আমি জানি, তিনি কখনো তাঁর ছেলেদের জন্য এতটা করেননি—সেই অর্থে হয়তো কিছু বলার নেই, কিন্তু অনুভব করার মতো অনেক কিছু আছে।
মাদ্রাসা থেকে ছুটি পেলে আমি বাড়ি যেতাম, আর নানা সব সময় একটাই কথা বলতেন, “কয়দিন ছুটি দিছে নানু ভাই ? মুখে হাসি থাকলেও চোখে থাকতো অজানা এক অস্থিরতা—যেন এই সময়টুকুও ধরে রাখতে চান আরো কিছুটা সময়।
আবার মাদ্রাসায় ফেরার সময় ব্যাগটা আমি কখনোই বহন করিনি। সেই ব্যাগটাতে ছিল আমার কাপড়চোপড়, বইপত্র, আর নানার শেষ না হওয়া ভালোবাসা। তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিতেন সেই ভার, আর আমি শুধু হেঁটে যেতাম তার পাশে পাশে। জানতাম না, ছোট্ট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি তাঁর কাঁধে ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আজ আমি একজন হাফেজ। আমি জানি, এই কুরআনের নূর, এই যতটুকু ইলম অর্জন করেছি, তার পেছনে মায়ের দোয়া যেমন আছে, তেমনি আছে নানা-নানির অশেষ মেহনত আর ত্যাগ।
তারা শুধু আমাকে আশ্রয় দেননি,
আমাকে পথ দেখিয়েছেন, আমাকে মানুষ করেছেন।
আজও তারা বেঁচে আছেন। কিন্তু সময় আমাদের মাঝে এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি করেছে। এখন আর আগের মতো দেখা হয় না, কথাও হয় না প্রতিদিন। কিন্তু যখনই কোনো কষ্টে ভেঙে পড়ি, তখন মনে পড়ে—কোনো একদিন, আমার ব্যাগের ওজনটা তিনি বয়ে নিয়েছিলেন কাঁধে, আর আমার সব দুঃখগুলো তিনি রেখে দিয়েছিলেন নিজের মনে।
নানা, আপনি জানেন না, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।