30/07/2025
পিআর ও চলতি নির্বাচন এর সুবিধা অসুবিধা,জানা প্রোয়জন,জানতে হলে পুরো টা পরতে হবে।
পিআর পদ্ধতির আদ্যোপান্ত
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা খুবই মনোমুগ্ধকর—“জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার।” কিন্তু বাস্তবে যখন দেখি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে কেউ ৭৫ শতাংশ আসন নিয়ে বসে আছে, তখন মনে হয়—গণতন্ত্র কি ‘জনগণের’ না ‘জোর যার, মুলুক তার’ স্টাইলে চলছে?
যা হোক, আজ কথা বলব এমন এক পদ্ধতি নিয়ে, যা হয়তো এই গণতন্ত্রের গণনা-কেন্দ্রিক বৈষম্য কিছুটা হলেও কমাতে পারে—এর নাম প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি।
পিআর পদ্ধতি কী?
ধরুন, ১০০টি আসনের একটা সংসদে একটি দল ১০% ভোট পেল। তাহলে এই পদ্ধতিতে তারা ১০টি আসন পাবে। যে দল ২০% ভোট পাবে তারা ২০টা আসন পাবে। ব্যাস, এর বাইরে কোনো ম্যাজিক নেই। যতটুকু ভোট ততটুকু আসন। কে কাকে হারাল সেটা বড় নয়, কে কত ভোট পেয়েছে সেটাই মূল।
এটাকেই বলে Proportional Representation—সংসদে আসন পাবে ভোটের অনুপাতে।
সোজা হিসাব, ফাঁকি নাই। কোন দল অল্প ভোট পেলেও তাকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই।
ফলে এই পদ্ধতিতে গড়ে ওঠে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ।
প্রথাগত নির্বাচন পদ্ধতির সমস্যা কোথায়?
বাংলাদেশে বর্তমানে চালু আছে FPTP—First Past The Post পদ্ধতি। নামটা শুনলে মনে হয় ঘোড়দৌড় চলছে। যে আগে পৌঁছাবে, সে জিতবে।
এখানে কে কত ভোট পেল, সেটা কোনো ব্যাপার না—কে আগে ফিনিশ লাইন পার করল, সেটাই মূল। এভাবে সমাজের বড় একটি অংশের প্রতিনিধি সংসদে অনুপস্থিত থাকে।যখন সমাজের একাংশ কথা বলার সুযোগ পায় না, তখন জুলুমের সৃষ্টি নেয়। সেই জুলুম ক্ষমতাবানকে করে তোলে স্বৈরাচার!
ইতিহাস বলছে, এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের ফলাফল তেমন একটা সুখকর নয়। কারণ,
২০০১ সাল:
বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৪০.৮৬% → আসন ১৯৩
আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.২২% → আসন মাত্র ৬২
আবার এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ২০০৮ সালের নির্বাচন:
আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮.০৪% → আসন ২৩০
বিএনপি পেয়েছিল ৩২.৫০% → আসন ৩০
অর্থাৎ যেই দল বিপক্ষ দলের চেয়ে মাত্র দশটা ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছে, সে পেয়ে যাচ্ছে ২৩০ আসন। আর মাত্র ১০ টি ভোট কম পেয়ে যেই দল হেরেছে তারা পাচ্ছে মাত্র ৩০ আসন!
অনেকটা লটারির মত,তাই না! জিতলে বাজিমাত,হারলে সান্ত্বনামূলক কয়েকটি আসন।
অথচ ভোটের ব্যবধানটা খুবই ক্ষুদ্র—আসনের ব্যবধানটা বিশাল! এটাই প্রচলিত পদ্ধতির সমস্যা।
বাস্তব উদাহরণ—ভোট গেছে সাগরে!
ধরুন, একটা আসনে ১০০ জন মানুষ ভোট দিলো।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে চারজন প্রার্থী।
ভোটের ফলাফল প্রকাশ হলো:
প্রার্থী ক: ২৫ ভোট
প্রার্থী খ: ২৪ ভোট
প্রার্থী গ: ২৩ ভোট
প্রার্থী ঘ: ২৮ ভোট
হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, প্রার্থী ঘ-ই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন—২৮ ।
তবে বাকি তিনজনের সম্মিলিত ভোট: ২৫ + ২৪ + ২৩ = ৭২ ভোট।
মানে, ৭২% ভোটার এই প্রার্থীকে ভোট দেয়নি। প্রচলিত ব্যবস্থায় তবুও তিনিই জিতে যাবেন। কারণ তিনি একক ভোট অন্যদের চেয়ে বেশি পেয়েছেন।
৭২ জন মানুষ যাকে চাইলো না, সেই লোকই এখন সংসদে যাবে তাদের হয়ে কথা বলতে! এটা কেমন গণতন্ত্র?
আবার ধরুন, নির্বাচন হলো।
দল ক কিছু আসনে ১০১ ভোট পেয়ে জিতে গেল।
দল খ ঐ আসনগুলোতে ১০০ ভোট করে পেয়েও হেরে গেল।
ফলে দল ক পেল ২৩০টা আসন।
আর দল খ পেল মাত্র ৩০টা!
মাত্র ১টা ভোটের ব্যবধানে দল ক ২০০টা আসনের মতো বিশাল লিড পেয়ে গেল?
এটা কি গণতন্ত্র? না,এটা ভাগ্যের খেলা! লটারির মতো, জিতলে লাখ টাকার গাড়ি, হারলে ৫ টাকার চকলেট!
ভোট যদি আসনে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে ভোটারদের আশা প্রতিফলিত হবে কোথায়?
পিআর পদ্ধতি আর কোন দেশে আছে?
পিআর প্রথম চালু হয়েছিল ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
এছাড়াও উন্নত দেশের সংগঠন OECD-এর ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ এই পদ্ধতিতে ভোট করে।
পিআরের ভেরিয়েশন
পিআর পদ্ধতির তিনটি সিস্টেম রয়েছে:
১. মুক্ত তালিকা: ভোটাররা শুধু দল না, তালিকার প্রার্থীকেও বেছে নিতে পারে।
২. বদ্ধ তালিকা: দল নির্ধারণ করে দেবে কে যাবে সংসদে।
৩. মিশ্র পদ্ধতি: কিছু আসন FPTP, কিছু আসন PR।
পিআর পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:
১. আনুপাতিক পদ্ধতিতে(PR) নির্বাচন হলে বার বার সীমানা নির্ধারণের কোন প্রয়োজন নেই, সারাদেশই একটি constituency!
২. আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন হলে এমপিদের স্থানীয় ভাবে কোন কাজ থাকেনা, ফলে উপজেলা পরিষদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে তথা স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে। এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এর দ্বন্দ্বও চুকে যাবে।
৩. আর মেম্বার অব পার্লামেন্ট (এমপি)এর কাজ যে শুধু জাতির স্বার্থে আইন বানানো সেটাও কার্যকর হবে।
৪. প্রবাসীরাও সহজে ভোট দিতে পারবে !
৫. যেহেতু ১ টিই constituency, তাই সহজে অগ্রিম ভোটও গ্রহন করা যেতে পারে!
৬. আর অগ্রিম ভোট হলে ভোটের দিনে ভোটারের অতিরিক্ত চাপও কমবে।
৭. কোন সাংসদ মৃত্যুবরণ করলে উপনির্বাচনের প্রয়োজন নেই, রাজনৈতিক দল থেকে সরবরাহকৃত তালিকার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী ব্যক্তি সাংসদ হতে পারেন।
৮. পি.আর পদ্ধতিতে ভোটাররা যেহেতু কোন ব্যক্তিকে নয় বরং দলকে ভোট দেন, সেহেতু স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তির প্রভাব নিয়ে মারামারি, হানাহানির পরিমানও কমিয়ে আনা যেতে পারে।
পিআর পদ্ধতির ইতিবাচক প্রভাব
উল্লেখিত সুবিধাসমূহ ছাড়াও বেশ কিছু ইতিবাচক সুফল পাওয়া যাবে।যেমন:
১.দলীয় মনোনয়ন বানিজ্য বন্ধ হবে।
২.ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ হবে।
৩.নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে।
৪.ভোটের পর ব্যক্তিগত আক্রোশ বন্ধ হবে।
৫.সংসদে সব দল ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
৬.এমপিদের স্বেচ্ছাচারী, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ বন্ধ হবে।
৭.দলীয় গ্রুপিং বন্ধ হবে। ক্যাডার পোষা বন্ধ হবে।
৮.স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতা ফেরত পাবে।
৯.প্রধানমন্ত্রী ও সরকার দল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারবে না।
পিআর পদ্ধতি নিখুঁত না, কিন্তু বর্তমান সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোটের অঙ্কটাই ঠিকঠাক বসে না, সেখানে গনতন্ত্রের বাক্য ফুলঝুরি হয়ে থাকে—বাস্তব হয় না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন,উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও দেশে বিভিন্ন নির্বাচনের বৈষম্যমূলক ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এখন এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সংগৃহীত