24/07/2025
#অন্তিম_প্রেমের_অনন্ত_স্বরলিপি
✍️ DH. SAYED
রাত্রি তখন আধো জ্যোৎস্নার আচ্ছাদনে নিমগ্ন। শহরের নিস্তব্ধতা যেন কোনো এক অতল ব্যথার প্রতিধ্বনি।
সেই নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটি ছায়ামূর্তি— "রুদ্রানিল"।
চোখে তার দূরাগত অতীতের কুয়াশা, মনে অপূর্ণতার নিঃশব্দ গর্জন।
বহুদিন পর ফিরে এসেছে সে তার নিজ জন্মশহরে,
যেখানে— প্রেম একদিন তাকে করেছিল একসাথে নিঃস্ব আর নবজাগরিত।
রুদ্রানিল, একজন স্বভাবচিন্তক, অভ্যন্তরীণ জগতের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত মানুষ।
সে একসময় ভালোবেসেছিল এক নারীকে—"অভিশারিণী নীলমাধুরী"।
নীলমাধুরী—
যার নয়নে ছিল নৈরাশ্যের মেঘলা সমুদ্র,
যার হাসিতে লুকিয়ে ছিল সহস্র অভিমানিত স্বপ্ন,
যার প্রতিটি কথায় ছিল চিরন্তন ব্যঞ্জনার স্পর্শ।
তারা একসময় ছিল একে অপরের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা—
কিন্তু সময়ের চোরাবালিতে নিঃশব্দে তলিয়ে গেছে সেই অধ্যায়।
আজ, দশ বছর পর, রুদ্রানিল আবার সেই শহরে—
যেখানে প্রেম রচিত হয়েছিল আর প্রেমই ভেঙে গিয়েছিল।
সে হাঁটে— যেন প্রতিটি পা ফেলে সে তার অতীতকে পুনরাবিষ্কার করছে।
স্মৃতির প্রতিটি দেয়ালে আজো অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা আছে নীলমাধুরীর নাম— অনুভবের অদ্ভুত ব্যাকরণে।
হঠাৎ
পুরনো এক লাইব্রেরির পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে চোখে পড়ে তার— এক কণ্ঠ, এক ছায়া,
যা রুদ্রানিলের হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করে।
কণ্ঠটি বলে—
“আকাশকে কখনও ভুলে যাস না, রুদ্র…
সে কখনো তোমার নয়, তবু তার নীচে তুই দাঁড়িয়ে ছিলিস…”
রুদ্রানিল থেমে যায়। শিরায় রক্ত চলাচলের মতোই থেমে যায় সময়।
সে জানে—
এই শব্দ… এই সুর… এই ব্যথা…
এ নীলমাধুরীর।
রুদ্রানিলের শরীরে এক অজানা শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। তার হৃদয়ের প্রতিটি কোষে যেন এক অদৃশ্য অগ্নিস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, যা স্মৃতির প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করে। সে পুনরায় তাকায়, কিন্তু চোখে পড়ে না সেই অপ্রকাশিত চিত্র— "নীলমাধুরী"। শুধু তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, যেন শূন্য থেকে এক ঝলক অনুভূতির বন্যা।
"এত বছর পর, তুমি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারবে, নীল?"— নিজের মনেই প্রশ্ন তোলে রুদ্রানিল।
তার মনের গভীরে এক প্রবল শিহরণ জাগে, যেমন কোনও পুরানো অভিমানী সুর ফিরে আসে, কিন্তু ভাঙ্গা সুরে কোনো উচ্চারণ নেই।
সে চুপচাপ লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে অনেক বইয়ের ভীড়ে সে নিজেকে হারাতে চায়, কিন্তু মনের মধ্যে এক বিশাল ফাঁকা জায়গা, যেখানে নীলমাধুরীর অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে, আর তাকে শূন্য করে তোলে।
লাইব্রেরির খোলামেলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে আসে ঝলমলে রোদ, কিন্তু তা যেন অন্ধকারের আরও গভীরে ডুব দিতে চায়।
বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে রুদ্রানিল, কিন্তু তার মনের পর্দায় নীলমাধুরীর মুখাবয়ব বারবার ভেসে ওঠে। সে জানে, এই মুহূর্তে এই শহরে, কোনও না কোনও স্থানে, নীলমাধুরী রয়েছে— তার সেই হাসি, তার সেই দুঃখভরা চোখ, আর সেই কন্ঠের লেশ যেন এখনো তার অন্তরে সুর দিয়ে গুঞ্জরিত।
বইয়ের মলাটে চোখ রেখে সে এক গভীর অনুভূতিতে ডুবে যায়। অতীতের কথাগুলো ফিরে আসে, কিন্তু সে কি ভুলে যেতে পারবে সেসব? সেই মুহূর্ত, যখন তারা একে অপরকে অভ্যন্তরীণভাবে চেনেছিল। যখন পৃথিবী ছিল তাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু নীলমাধুরীর অভিমানী মনে, রুদ্রানিলের অব্যক্ত ভালোবাসা কোনও এক মেঘে হারিয়ে গিয়েছিল।
একদিন, কোনো এক সন্ধ্যায়, রুদ্রানিল নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে গিয়েছিল— কিন্তু নীলমাধুরী তাকে থামিয়ে দিয়েছিল।
“প্রেমকে পোষ মানাতে হয় না, রুদ্র… এটা এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রক্রিয়া, যা শুধুই অপেক্ষা করতে শেখায়।”
তার পরপরই, তারা একে অপর থেকে দূরে চলে যায়, জীবন নিজস্ব পথ ধরে চলে যায়। কিন্তু রুদ্রানিল জানে, নীলমাধুরী কোথাও তার অন্তরে এখনও আটকে আছে— একদম ঠিক যেমন সে ছিল, ঠিক যেমন তাকে সে ভালবাসতো।
হঠাৎ রুদ্রানিলের দৃষ্টি একদম নতুন একটি বইয়ের দিকে চলে যায়। বইটির নাম “অলিখিত চিহ্ন”। সে মলাট খুলে, একটি পাতা উল্টে দেখে, সেখানে তার হাতের লেখা—
"ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না, শুধু রূপ পরিবর্তন করে।"
এটাই তার জীবনের শ্লোক। এটা নীলমাধুরী তার জন্য লিখে গিয়েছিল।
এখন, রুদ্রানিল জানে, সে এক নতুন যাত্রায় পা রাখতে চলেছে। এটি তার আত্মার যুদ্ধ, যা শেষ হবে নাকি শুধুই নতুন করে শুরু হবে—
এখন পর্যন্ত সেই উত্তর অজানা।
রুদ্রানিলের চোখ স্থির হয়ে থাকে বইটির পাতায়, যেখানে তার অতীতের প্রতিধ্বনি জেগে ওঠে এক নিঃশব্দ গর্জনে।
এই লাইনটি—
"ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না, শুধু রূপ পরিবর্তন করে"
সে নিজে একদিন বলেছিল, কিন্তু আজ, এই বাক্য যেন নিজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করছে।
কে রেখেছে এই বই এখানে?
নীলমাধুরী?
নাকি নিয়তির নিখুঁত পরিহাস?
তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না এই ঘটনাটিকে কেবল ‘দৈবতা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তার মনোজগতের সমস্ত গোপন দ্বার খুলে গিয়েছিল যেন।
অবচেতনে যে স্মৃতি সে কবর দিয়ে রেখেছিল,
তা আজ রক্তক্ষরণ করতে শুরু করেছে— ধীরে, অথচ নিশ্চিতভাবে।
রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে। শহরের বাতাসে এখন আর তাপ নেই, আছে কেবল থমকে থাকা নিঃশ্বাস।
রুদ্রানিল হেঁটে চলে আসে নদীর ধারে—
যেখানে তারা একবার বসেছিল নীরবতায় ডুবে, অথচ হৃদয়ের শব্দ ছিল উচ্চারিত।
সেই নদী—
যা এখনো বহমান,
কিন্তু তার ধারায় নেই সেই চঞ্চলতা,
যেমন নেই রুদ্রানিলের হৃদয়ে প্রশান্তির ব্যঞ্জনা।
হঠাৎ, সাঁঝবাতির আলোকে রুদ্রানিলক দেখতে পান
এক জননীমূর্তি—
সে বসে আছে সিঁড়িতে, হালকা নীল শাড়ি পরে, চোখ দুটি স্থির নদীর গহীনে।
চোখের কোণজুড়ে অদ্ভুত এক দ্যুতি,
যা নিঃসন্দেহে বলে দেয়— সে নীলমাধুরী।
তবে সময় তার রূপের ভাষা পাল্টে দিয়েছে।
আগের মতো আর বিদ্রোহিণী নয় সে—
বরং একধরনের অন্তর্গত মৌনতা তাকে ঘিরে রেখেছে।
রুদ্রানিল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে—
এ যেন কোনো দেবীমূর্তির দর্শন,
যার দিকে তাকালেও উচ্চারণ করা যায় না কোনো শব্দ।
কিন্তু তার ভিতরে চলে এক অবর্ণনীয় উথালপাথাল—
ভালোবাসা, ক্রোধ, ব্যথা, স্মৃতি, প্রশ্ন—
সব একসাথে গলিত হয়ে ছুটে আসছে তার কণ্ঠের দিকে।
হঠাৎ নীলমাধুরী বলে ওঠে,
“তুমি জানো, সময় আমাদের চিঠি পাঠিয়েছে, কিন্তু আমরা একে অপরকে গন্তব্যই লিখিনি—
তাই হয়তো সব পত্র ফেরত গিয়েছে।”
রুদ্রানিল স্তব্ধ হয়ে যায়।
সে বলতে চায়, “তুমি কি আজও আমাকে অনুভব করো?”
কিন্তু তার কণ্ঠে উঠে আসে শুধুই নিঃশ্বাস।
নীলমাধুরী ধীরে উঠে দাঁড়ায়, চোখ তুলে রুদ্রানিলের দিকে চায়।
তার চোখে লেখা—
অস্পষ্ট অভিমান, অথচ গোপন মমতা।
সে শুধু বলে—
“আজ নদীর জল স্বচ্ছ, রুদ্র…
আমরা কি এবার ডুবে দেখতে পারি, কে কাকে কতটা হারিয়েছে?”
মাধুরী সামনে হেঁটে যায়—
পেছনে ফেলে যায় রুদ্রানিলের ভেতরের অতলান্ত প্রশ্নসমূহ।
রুদ্রানিল স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে— তাকে যেন সমগ্র শহর ভুলে গিয়েছে,
শুধু চারপাশের বাতাস, পায়ের নিচের ধূলি,
আর তার বুকে দহন জাগানো নীলমাধুরীর সেই বিদীর্ণ বাক্যই—
“আমরা কি এবার ডুবে দেখতে পারি, কে কাকে কতটা হারিয়েছে?”
এ কী ছিল?
পুনর্মিলনের আভাস?
না কি নৈরাশ্যের স্বগতোক্তি?
সে বুঝে উঠতে পারে না।
শহরের পুরাতন রেলস্টেশনের দিকে পা চালায় রুদ্রনিল— যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল।
একটা শরৎকালীন দুপুর, কাশফুলের মত নিস্তব্ধ,
আর এক অচেনা সাদা ওড়না—
যা বাতাসে ভেসে এসে তার বুকের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল,
যেন ভবিষ্যতের এক অনিবার্য ঘোষণা।
আজ সেই প্ল্যাটফর্মের কাঠের বেঞ্চগুলো ভাঙা,
কিন্তু সময় যেন কিছুই ভাঙতে পারেনি তাদের স্মৃতি থেকে।
রুদ্রানিল জানে— আরেকবার কথা বলতেই হবে নীলমাধুরীর সঙ্গে,
তবে এবার শব্দের ব্যাকরণ ছাড়িয়ে অনুভবের ব্যাকরণে।
সে অপেক্ষা করে।
যেন নিজেকে এক অবিরাম স্থবিরতায় বেঁধে রাখে।
চারিদিকে মানুষ আসছে-যাচ্ছে, সময় এগিয়ে যাচ্ছে,
কিন্তু সে দাঁড়িয়ে থাকে এক চেতনাহীন চৌরাস্তায়—
যেখানে হৃদয় ও যুক্তি একে অপরকে পথ ছেড়ে দিতে নারাজ।
এমন সময়, এক শিশুর কণ্ঠে ভেসে আসে—
“দিদি! তোমার বই পড়ে ফেলেছি!”
রুদ্রানিল চমকে উঠে দেখে,
এক বাচ্চা মেয়ে হাতে একটি বই ধরে আছে যার লেখক নীলমাধুরী!
তাহলে সে এখন একজন লেখিকা?
যে নিজের অনুভবগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে অক্ষরের সঞ্চারে?
তাহলে কি সেই "অলিখিত চিহ্ন" বইটিও তারই লেখা?
রুদ্রানিলের মস্তিষ্কে চলতে থাকে ঘূর্ণাবর্ত।
সে বইটি নিয়ে পড়ে—
প্রথম পাতায় লেখা:
"এই গ্রন্থ উৎসর্গ— তাকে,
যে নীরব থেকে আমায় বলেছিল—
‘তুমি একদিন আমার গল্প হবে।’"
রুদ্রানিল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
সে যেন ধসে পড়ে এক অদৃশ্য স্রোতে—
যেখানে ভালোবাসা, বিসর্জন, মূক অভিমান ও দহনের শব্দ একসাথে গুঞ্জরিত।
সে ঠিক করে— আগামীকাল সন্ধ্যা।
নদীর ধারে, শেষ আলোয়,
সে নীলমাধুরীর সামনে দাঁড়াবে।
তাকে বলবে—
এই দীর্ঘ নীরবতার নাম ছিল ভালোবাসা।
যা উচ্চারিত হয়নি, তাই তো চিরস্থায়ী সে।
নদীর ধারে সেই সন্ধ্যা—
এক অদ্ভুত রঙ ছড়িয়ে রেখেছে আকাশজুড়ে।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ঠিক যেমন প্রেম অস্ত যায়, তবু নিভে না।
রুদ্রানিল আগে থেকেই এসেছে।
আজ আর সে দ্বিধায় নন, না সংকোচে।
আজ সে তার সমস্ত অনুক্ত কথাকে অক্ষরে রূপ দিতে চায়,
যতই তা হোক অসম্পূর্ণ অথবা অব্যক্তের অতল থেকে উঠে আসা।
নীলমাধুরী আসে।
চিরচেনা শাড়ি, কিন্তু চোখে আজ অন্যরকম ভাষা—
একান্ত নির্লিপ্ত, অথচ গভীরভাবে আকুল।
তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়, যেন সময়কে থামিয়ে রেখে।
তাদের মাঝখানে ছিল না কোনো স্পর্শ,
ছিল কেবল অতীতের ছায়া আর ভবিষ্যতের প্রতীক্ষা।
রুদ্রানিল বলে না “কেমন আছো?”
সে বলে না “আমি এখনো তোমায় ভালোবাসি।”
সে কেবল বলে—
“আমরা কি শেষ হতে পারি, যদিও কোনো শুরু ছিল না?”
নীলমাধুরী একটু হেসে ফেলে।
তবে সে হাসি নয়—
তা ছিল এক দীর্ঘ সহানুভূতির চাপা উজ্জ্বলতা।
সে বলে—
“তুমি কি জানো, ভালোবাসাহীন ভালোবাসা কেমন হয়?
যেখানে নেই দাবি, নেই প্রত্যাশা,
আছে কেবল এক অলিখিত সংলাপ—
যা হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়,
কিন্তু মুখে উচ্চারিত নয়।”
রুদ্রানিল চুপ করে শোনে।
সে বোঝে, নীলমাধুরী বদলে যায়নি—
বরং বিবর্তিত হয়েছে।
সে বলে—
“আমার মনে হয়, আমাদের প্রেমটা একেকজন আলাদা ভাষায় লিখেছি।
তুমি অভিমান দিয়ে, আমি অপেক্ষা দিয়ে।
তাই শব্দগুলো কখনও একে অপরের অর্থ বুঝতে পারেনি।”
নীলমাধুরী নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
সে বলে—
“তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আজও নিঃশব্দ,
তবে তাতে শব্দের ঘাটতি নেই।
তুমি শুধু ভুল করেছো ভাষা নির্বাচন করতে,
আর আমি ভুল করেছি সময়।”
এই সংলাপ—
এই অদ্ভুত, প্রশান্ত অথচ জ্বলন্ত মুহূর্ত—
তাদের জীবনের সবচেয়ে গভীর সংলাপ হয়ে থেকে যায়।
তারা উঠে পড়ে—
একসাথে হাঁটতে থাকে,
কিন্তু সেই হাঁটায় নেই প্রেমিক-প্রেমিকার স্পর্শ,
আছে সহযোগী স্মৃতির দুই সঞ্চারিত আত্মা।
বিদায়ের আগে নীলমাধুরী বলে—
“ভালোবাসা শেষ নয়, রুদ্র,
আমরা কেবল তার ব্যাকরণ বদলে ফেলেছি।
তাই আজ আমরা শব্দের প্রেমিক, কিন্তু বাক্যহীন।”
রুদ্রানিল তাকিয়ে থাকে তার পেছনে চলে যাওয়া পদক্ষেপে—
যা নিঃশব্দ অথচ উচ্চারিত হয়ে থাকে হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি-তন্তুতে।
রাত্রি গভীর।
আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক অন্তঃস্থ বিষাদের ক্যানভাস—
তাঁরা নেই, চাঁদ নেই,
তবু অন্ধকারের বুক চিরে জ্বলছে এক ধরণের মৃদু আলো,
যা রুদ্রানিলের হৃদয়ে জন্ম নিয়েছে নীলমাধুরীর বিদায়ের মুহূর্তে।
সে জানে,
এই ভালোবাসা বাহ্যিক নয়—
এ এক অন্তর্মুখ প্রেম,
যা শব্দে নয়, চেতনায় বাস করে।
প্রেম, যা কোনো পরিণতির সন্ধান চায় না—
শুধু অস্তিত্বে এক প্রকার অনির্বচনীয় উত্তাপ রেখে যায়।
রুদ্রানিল আজ নিজেকে প্রশ্ন করে—
“ভালোবাসা যদি স্পর্শে না থাকে, তবে কি তা নিঃশেষ হয়?”
সে উত্তর খুঁজে পায় না,
কারণ তার বুকের ভেতরে এক বহ্নিশিখা জ্বলছে,
যা নীলমাধুরীর কোনো এক নিঃশব্দ স্পর্শ থেকে জন্ম নিয়েছিল।
সে লিখে।
প্রতিটি রাতে সে তার ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলে সেই অনুভূতির ভাষ্য,
যা উচ্চারিত হয়নি,
কিন্তু অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জীবন্ত হয়ে আছে।
“নীল,
তুমি আজও আমার মধ্যে আছো,
কিন্তু আমার ছায়ার মতন নয়—
বরং আমার নিঃশ্বাসের মতো—
যা আমি অনুভব করি,
তবু কখনো দেখতে পারি না।”
নীলমাধুরীও কি ভাবে তাকে নিয়ে?
সে কি এখনো সেই পুরাতন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের গল্পগুলো নতুন করে লেখে?
তাদের দেখা নেই, কথা নেই,
তবু ভালোবাসা আছে।
একটি বিপরীতমুখী ঘূর্ণির মতো—
যা বাহিরে নয়,
হৃদয়ের গভীরে ঘুরপাক খায়।
একদিন হঠাৎ,
রুদ্রানিল ডাক পায় এক সাহিত্য সম্মেলনে।
বিষয়— “মৌন প্রেমের ব্যাকরণ”।
সেই আলোচনায়, এক অপরিচিত লেখিকা আসে,
যার মুখ আড়াল, কিন্তু কণ্ঠ......
রুদ্রানিল শিউরে উঠে।
সেই কণ্ঠ বলে—
“ভালোবাসার সবথেকে শক্তিশালী রূপ হলো তা,
যা কেউ জানে না—
তবু তীব্রভাবে অনুভব করে।”
রুদ্রানিল বুঝে যায়—
এ কোনো এলোমেলো সম্মেলন নয়—
এ এক আত্মিক সম্মিলন।
সেদিন তারা আর মুখোমুখি দাঁড়ায় না,
তবে তাদের হৃদয় দুটি একই বহ্নিশিখায় দীপ্তিমান থাকে।
এবার, কারো কিছু বলার দরকার পড়ে না।
সম্মেলনের পরবর্তী সকাল—
রুদ্রানিল একা বসে থাকে এক নির্জন ক্যাফেতে,
সম্মেলনের হলঘরের কাছে,
যেখানে বাতাসও আজ অতীতের মতো ভারী,
আর কফির তাপে ছুঁয়ে থাকে স্মৃতির ঠাণ্ডা রেখা।
সে জানে, গতকাল যা ঘটেছে,
তা কোনো দৈব নয়, কোনো কাকতাল নয়,
বরং—
একটি অমোচনীয় প্রমাণ যে,
ভালোবাসা কখনো ভোলার বিষয় নয়,
বরং গ্রহণের অধ্যায়।
নীলমাধুরীর মুখ সে দেখেনি,
কিন্তু তার কণ্ঠের প্রতিটি কম্পন,
তার উচ্চারণের প্রতিটি যতি,
রুদ্রানিলের হৃৎকম্পের সাথে সমান্তরাল ছন্দে নেচে উঠেছিল।
সে উপলব্ধি করে—
তাদের প্রেম এখন আর জীবনের কাঠামোর মধ্যে নেই।
তা আজ সময়-উত্তীর্ণ, শরীর-অতিক্রান্ত, বাস্তব-উপরিত।
তার প্রেম এখন এক ধরণের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি,
যা বলায় নয়, থাকা যায় নির্বচনে।
সে লেখে তার ডায়েরির শেষ পাতায়—
“নীল,
তোমাকে হারাইনি।
তোমাকে আর চাইও না।
কারণ তুমি এখন আমার মধ্যে আছো—
একটি ‘চাওয়া’র পরবর্তী রূপে—
যেখানে নেই আহ্বান,
নেই প্রত্যুত্তর,
তবু আছো, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।”
এমনই এক দিনের শেষবেলায়,
সে আবার হাঁটে সেই নদীর পাড়ে।
একটি চিঠি হাতে,
যার প্রাপক— অলিখিত,
তবে পাঠানো ঠিকানায় লেখা—
"নীলমাধুরীর হৃদয়ের এক কোণ, যেখানে আমাদের প্রেম এখনো জেগে আছে।"
সে চিঠিটি নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।
না ফেরার আশায় নয়,
চির থেকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।
চিঠির প্রথম বাক্য ছিল—
“প্রেম যদি সত্য হয়, তবে তাকে পাঠাতে হয় বাতাসে…
যতক্ষণ না সে নিজে ফিরে আসে—
একটি নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে।”
চিঠি ভেসে যায়।
রুদ্রানিল ফিরে আসে।
পিছনে পড়ে থাকে কেবল ভালোবাসার এক না-হওয়া শেষ অধ্যায়—
যা শেষ নয়,
তবু শেষের মতো পূর্ণ।
-------
শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল, আলো, যানজট—
সবই থেমে যায় যখন হৃদয় নিজস্ব এক অচিন্ত্য সুরলিপি বাজাতে শুরু করে।
রুদ্রানিল এখন নিজেকে আর খুঁজে ফেরে না;
সে জেনে গেছে—
নীলমাধুরীকে হারানো মানে তাকে হারানো নয়,
বরং ভালোবাসার নতুন রূপে পুনর্জন্ম দেওয়া।
সে নিয়মিত লেখে,
কিন্তু তার লেখাগুলোর পাঠক আর কেউ নয়—
শুধু সময় আর স্মৃতি।
একদিন, এক নিঃশব্দ বিকেলে
একটি ডাকবাক্সে পড়ে থাকা একটি চিঠি হাতে পায় সে—
চিঠির খাম সাদা, কালি নীল,
অদ্ভুতভাবে চেনা হস্তাক্ষরে লেখা—
“রুদ্রানিল”।
ভেতরে কেবল একটি লাইন—
"ভালোবাসা শেষ হলে তবেই সে চিরস্থায়ী হয়।"
— নীল।
রুদ্রানিলের ঠোঁটে তীক্ষ্ণ এক হাসি।
না, তা আনন্দের নয়—
তা সম্পূর্ণতার তীব্র নিঃশ্বাস।
সে জানে—
তারা কোনোদিন একে অপরের কাছে ফিরবে না।
কোনো ছাদের নিচে বসে শীতের বিকেলে কফি খাবে না,
কোনো ছবি তোলার মুহূর্তে একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে না।
তবু—
তাদের প্রেম শেষ নয়।
কারণ এই প্রেম নিরাবরণ, নির্গন্ধ, নির্বাক,
তবু অতীব জীবন্ত।
এ প্রেম,
যা রক্তে নেই, তবু রক্তপ্রবাহে,
শরীরে নেই, তবু প্রতিটি ছায়ার ভিতর,
স্পর্শে নেই, তবু আত্মার গভীরতম স্তরে দগ্ধ হয়ে আছে।
আজ থেকে রুদ্রানিল লিখে না আর,
সে শুধু জেগে থাকে,
প্রতিটি নিশীথে—
যেন কোনো সুর একদিন বাতাসে ফিরে আসে,
যা নীলমাধুরীর কণ্ঠে ছিল একসময়,
আর এখন হয়ে উঠেছে অন্তিম প্রেমের অনন্ত স্বরলিপি।
*****
রুদ্রনীলে'র ভালোবাসা কোন উপন্যাস নয়,
এ এক চেতনা— যা সময় ও শরীরের বাইরে,
আর শুধু তাদের নয়— এ লেখা সব ভালোবাসাহীন ভালোবাসার জন্য চিরন্তন উৎসর্গ।
==========