17/06/2025
রুজি রোজগারে বারাকাহ হওয়ার আমল
প্রশ্নঃ
১০৭০৭১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, Ki kore rijjik barbe
উত্তরঃ
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনী ভাই!!
মহান আল্লাহ তাআলা বলেনঃ-
وَمَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ اِلَّا عَلَی اللّٰہِ رِزۡقُہَا وَیَعۡلَمُ مُسۡتَقَرَّہَا وَمُسۡتَوۡدَعَہَا ؕ کُلٌّ فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ
অর্থঃ- ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনও প্রাণী নেই, যার রিযক আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রাখেননি। তিনি তাদের স্থায়ী ঠিকানাও জানেন এবং সাময়িক ঠিকানাও। সব কিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। (সুরা হুদ, আয়াতঃ ৬)
ব্যাখ্যাঃ- আল্লাহ তাআলাই রিযকদাতা। সৃষ্টি করার সাথে সাথে একান্ত নিজ অনুগ্রহে রিযকের দায়িত্বও তিনি নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। কাজেই যার জন্য যে পরিমাণ রিযক বরাদ্দ আছে সে তা পাবেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁরই উপর ভরসা রাখতে হবে। একে তাওয়াক্কুল বলে। উপায় অবলম্বন করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। বরং বান্দার উপায় অবলম্বনকে তিনি তার জন্য বরাদ্দকৃত রিযক পৌঁছানোর দুয়ার ও মাধ্যম বানিয়েছেন। তাওয়াক্কুল যেমন তাঁর হুকুম, তেমনি কোন উপায় অবলম্বন করাও তার হুকুম। তাই কোন উপায় অবলম্বন না করলে তাতে তাঁর আদেশ অমান্য করা হয়। এ কারণে রিযকের সংকট দেখা দিলে তা তার আদেশ অমান্য করারই পরিণাম। উপায়-এর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই যে, তা অবলম্বন করলে রিযক প্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী হবে আর না করলে অপ্রাপ্তি অনিবার্য হবে। এজন্যই কখনও কখনও উপায় নিষ্ফল হয় এবং কখনও উপায় ছাড়াই ফল পাওয়া যায়। মূল দাতা যেহেতু আল্লাহ তাআলা, তাই তিনি চাইলে উপায়কে ফলপ্রসূ করতে পারেন, চাইলে নিষ্ফল করে দিতে পারেন এবং বিনা উপায়েও রিযক দিতে পারে।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেনঃ-
وَکَاَیِّنۡ مِّنۡ دَآبَّۃٍ لَّا تَحۡمِلُ رِزۡقَہَا ٭ۖ اَللّٰہُ یَرۡزُقُہَا وَاِیَّاکُمۡ ۫ۖ وَہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
অর্থঃ- এমন কত জীবজন্তু আছে, যারা নিজেদের খাদ্য সঙ্গে বয়ে বেড়ায় না। আল্লাহই তাদেরকে রিযক দান করেন এবং তোমাদেরকেও। ৩৯ তিনিই সব কথা শোনেন, সকল কিছু জানেন।
(সুরা আল আনকাবুত, আয়াতঃ ৬০)
ব্যাখ্যাঃ- চিন্তা কর,পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন হাজারো জীবজন্তু আছে, যারা খাদ্য সঞ্চয় করার কোন ব্যবস্থা করে না। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা নিজ কৃপায় প্রত্যহ তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করেন। পণ্ডিতগণ বলেন, সাধারণ জীবজন্তু এরূপই। কেবল পিপীলিকা ও ইঁদুর তাদের খাদ্য গর্তে সঞ্চিত রাখার ব্যবস্থা করে। পিপীলিকা শীতকালে বাইরে আসে না। তাই গ্রীষ্মকালে গর্তে খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য চেষ্টা করে। জনশ্রুতি এই যে, পক্ষীকুলের মধ্যে কাকও তার খাদ্য বাসায় সঞ্চিত রাখে। কিন্তু রাখার পর বেমালুম ভুলে যায়। মোটকথা, পৃথিবীর অসংখ্য ও অগণিত প্রকার জীবজন্তুর মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এই যে, তারা অন্য খাদ্য সংগ্রহ করার পর আগামীকালের জন্য তা সঞ্চিত রাখে না এবং এর প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জামও তাদের নেই। হাদীসে আছে, পশুপক্ষী সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে। তাদের না আছে ক্ষেতখোলা, না আছে জমি ও বিষয়সম্পত্তি। তারা কোন কারখানা অথবা অফিসের কর্মচারীও নয়। তারা আল্লাহ্ তা'আলার উন্মুক্ত পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং পেট-চুক্তি খাদ্য লাভ করে। এটা একদিনের ব্যাপার নয় বরং তাদের আজীবনের কর্মধারা, মোটকথা রিযিকের আসল উপায় আল্লাহরই দান,
এছাড়াও হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (তরজমা) নিশ্চয়ই রিজিক বান্দাকে সেভাবে তালাশ করে, যেভাবে তার মৃত্যু তাকে তালাশ করে।’-সহীহ ইবনে হিব্বান ৮/৩১, হাদীস ৩২৩৮
অর্থাৎ মানুষের মৃত্যু যেমন অবধারিত তেমনি তার রিজিকও তার কাছে পৌঁছা অবধারিত।
সারকথা এই যে, প্রতিটি প্রাণীর রিজিক আল্লাহ তাআলাই দান করেন এবং এই রিযিক অবশ্যই তার কাছে পৌঁছবে। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুমিন্তমুসলমানের ঈমানের অংশ।
আর আল্লাহ তাআলার চিরন্তন নীতি, পদ্ধতি হল, প্রিয় বান্দাদেরকে মাঝে মধ্যে বালা-মুসিবত ও অভাব-অনটন দিয়ে থাকেন। এর পিছনে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলার অনেক হেকমত-রহস্য থাকে। যেমন তাদের গুনাহ মাফ করা, মর্তবা বুলন্দ করা, তারা যেন কখনো আল্লাহমুখিতা থেকে গাফিল না হন সেজন্য সতর্ক করা, সর্বোপরি তাদের ঈমান ও ছবরের পরীক্ষা গ্রহণ করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) এবং আমি তোমাদিগকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন্তসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের কিছু ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। (হে নবী) আপনি সুসংবাদ দান করুন ধৈর্য্যশীলদের, যখন তাদের উপর বিপদ আপতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’’ (বাকারা : ১৫৫-১৫৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ এখনো তোমাদের কাছে আসেনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা, তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর সাথে ঈমান আনয়নকারীগণ বলে উঠেছিল, কখন আসবে আল্লাহর নুসরত। জেনে রাখ, অবশ্যই আল্লাহর নুসরত নিকটে। (সূরা বাকারা : ২১৪)
হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, (তরজমা) সবচাইতে অধিক বালা-মুসিবতে পতিত হয়েছেন নবী-রাসূলগণ, তারপর যথাক্রমে তাঁদের নিকটবর্তী ব্যক্তিগণ।’-জামে তিরমিযী ২/৬৫
সুতরাং জীবনের নানা রকম কষ্ট যেমন- বালা-মুসিবত (দুর্দশা বা বিপদ), চিন্তা-পেরেশানি (দুশ্চিন্তা), অভাব-অনটন ইত্যাদিতে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
প্রিয় দ্বীনী ভাই!!
রুজি রোজগারের বারাকাহ হওয়ার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর এবং দৈনিক ন্যূনতম দু'রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে পড়ে আল্লাহ তাআলার কাছে বিশেষভাবে দোয়া করবে। তিনি অবশ্যই দোয়া কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ।
রিযিক বৃদ্ধির জন্য এই আয়াত বেশি বেশি করে পড়বে:
اللَّهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِهِ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ
আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু; তিনি যাকে ইচ্ছা রিযিক দান করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।
—আশ্-শূরা - ১৯
والله اعلم بالصواب
রেফারেন্স উত্তরঃ
~~~~~~~~~~
প্রশ্নঃ
২৪২৫১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, দোকানে বেশী বেচা কোনা এবং রিজিক বৃদ্ধির কোনো আমল আছে কি না? থাকলে বলুন।
উত্তরঃ
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاتهبسم الله الرحمن الرحيمমহান আল্লাহ বান্দার প্রতি অনেক দয়াশীল। তিনি মানুষের প্রতি দয়া করে কিছু আমলের বরকতে রিজিক বাড়িয়ে দেন। সমাজে অবহেলার কারণে অনেক মানুষ সাধারণত এসব কাজ থেকে বিরত থাকে। কুরআন-সুন্নাহর ঘোষণায় রিজিক বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি আমল আছে। বরকত মানুষের জন্য জরুরি বিষয়। এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন, সে হিসেবে ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি কিংবা আমল-ইবাদতেও বরকত নেই। আবার অনেকে কঠোর পরিশ্রম করেন কিন্তু প্রাপ্তি সেভাবে আসে না। কাজে কোনো বরকত নেই।পক্ষান্তরে এমন অনেক লোক আছেন, যারা কম হায়াত পেয়েছেন কিন্তু ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, আমল-ইবাদতে বরকত লাভ করেছেন। অনেক অল্প পূজিতে ব্যবসা এবং অল্প বেতনে চাকরি করার পরও তার রিজিকের অভাব নেই। পরিবারে অফুরন্ত বরকত।সুতরাং সব কাজে বরকত অনেক জরুরি বিষয়। আর বান্দার রিজিক বৃদ্ধির কার্যকরী উপায়গুলো হলো-১. তাওবাহ-ইসতেগফারহরজত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যারা বেশি বেশি তাওবাহ-ইসতেগফার করে; তাদের সামনে যত সংকটই (অভাব) থাকুক না কেন, মহান আল্লাহ তাআলা তা সমাধান করে দেন।’ (মুসতাদরেকে হাকেম)সুতরাং বেশি বেশি তাওবাহ-ইসেতগফার করা-> أَستَغْفِرُ اللهَঅর্থ : আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।> أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِঅর্থ : আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর দিকেই ফিরে আসছি।> رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ (أنْتَ) التَّوَّابُ الرَّحِيْمُঅর্থ : 'হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবাহ কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী করুণাময়।'> أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهঅর্থ : 'আমি ওই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো মাবুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছেই (তাওবাহ করে) ফিরে আসি।'২. আল্লাহর রাস্তায় দান বা ব্যয় করাযারা আল্লাহর রাস্তায় দান করে, আল্লাহ তাআলা তাদের বেশুমার রিজিক দান করেন মর্মে মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে এভাবে ঘোষণা করেন-قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖ وَ یَقۡدِرُ لَهٗ ؕ وَ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَهُوَ یُخۡلِفُهٗ ۚ وَ هُوَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ‘(হে রাসুল! আপনি)বলুন, নিশ্চয়ই আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিজিক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিজিকতা।’ (সুরা সাবা : আয়াত ৩৯)৩. তাকওয়ার ওপর অটল থাকাআল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং তাকে ভয় করলে তিনি বান্দার প্রতি বরকত বা কল্যাণ দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-> وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ مَخۡرَجًا - وَّ یَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمۡرِهٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰهُ لِکُلِّ شَیۡءٍ قَدۡرًا‘আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করবে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’ (সুরা তালাক : আয়াত ২-৩)> وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُواْ وَاتَّقَواْ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ وَلَـكِن كَذَّبُواْ فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُواْ يَكْسِبُونَ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন (তাকে ভয়) করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও দুনিয়ার নেয়ামতসমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৬)সুতরাং শিরক, কুফর ও নেফাক থেকে নিজেদের ঈমানকে হেফাজত করতে হবে। সব হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহকে সব বিষয়ে বেশি বেশি ভয় করতে হবে। তবেই আল্লাহ তাআলা ওই বান্দার জন্য আসমানি ও জমিনের সব রিজিকে বরকতের দুয়ার খুলে দেবেন।৪. আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখাআত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণ নেমে আসে। এটি অনেক পরীক্ষিত একটি আমল। আত্মীয়-স্বজন তথা মা-বাবা, ভাই-বোন তথা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। হাদিসে এসেছে-হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কামনা করে যে, তার রিজিক বাড়াতে চায় বা প্রশস্ত করতে চায়; তার হায়াত বা আয়ুকে দীর্ঘ করতে সে যেন আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে।’ (বুখারি ও মুসলিম)৫. বার বার ওমরাহ করাযারা অভাব কমাতে চায়, গোনাহ কমাতে চায় তাদের জন্য বার বার ওমরাহ করা জরুরি। হাদিসে এসেছে-হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওমরাহ করে; ওমরাহ তার গোনাহ, তার অভাব অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি)৬. বিয়ে করারিজিক বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকরী আমল বিয়ে করা। যারা অবিবাহিত তারা নেক নিয়তে বিয়ে করলে মহান আল্লাহ তাদের অভাব দূর করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-وَأَنكِحُوا الْأَيَامَى مِنكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِن يَكُونُوا فُقَرَاء يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩২)৭. আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করাঅভাব থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে, রিজিকে বরকত পেতে চাইলে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়ার বিকল্প নেই। যে কোনো বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার কথা মহান আল্লাহ এভাবে বলেছেন-وَ قَالَ رَبُّکُمُ ادۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ عَنۡ عِبَادَتِیۡ سَیَدۡخُلُوۡنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیۡنَ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা অহংকারে আমার উপাসনায় বিমুখ, ওরা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা গাফির/মুমিনুন : আয়াত ৬০)৮. অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণ ও দান করাদান ও সদাচরণে রিজিক বাড়ে। রিজিক বাড়াতে চাইলে অসহায়-অভাবিদের প্রতি সদয় আচরণ করা। অভাবিদের প্রতি দয়া করলে আল্লাহ রিজিক বাড়িয়ে দেন। হাদিসে এসেছে-অসাহয়ের প্রতি দান ও সদাচরণে এ তাগিদ দিয়েছেন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- ‘দান করার কিছু যদি না থাকে তবে একটি খেজুরের অংশ দিয়ে হলেও দান করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।’৯. ইবাদতের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখাইবাদত তথা নামাজে খুব বেশি মনোযোগী হওয়া। নিজে যেমন প্র্যত্যেক ওয়াক্তর নামাজ পড়তে হবে তেমনি পরিবারের লোকদের নামাজ পড়ানো ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। আর তাতে আল্লাহ রিজিক বাড়িয়ে দেবেন বলে এভাবে ঘোষণা করেছেন-وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَّحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না। আমি আপনাকে রিজিক দেই এবং আল্লাহকে ভয় করার পরিণাম শুভ তথা কল্যাণকার।’ (সুরা ত্বাহা : আয়াত ১৩২)১০. যে কোনো কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলারাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন খাবার খায় আর যদি বিসমিল্লাহ বলে; তবে শয়তান ওই খাবারে অংশ নিতে পারে না। যেটুতু খাবার আছে তা (পরিমাণে কম হলেও) তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।অনুরূপভাবে কেউ যদি ঘরে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে তখনও শয়তান তার সঙ্গে বাসায় ঢুকতে পারে না। এভাবে বান্দা যখন সব কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে, তখন শয়তান সব কাজ থেকে মাহরুম হয়। আর আল্লাহ তাআলা সব কাজেই বরকত দান করেন।১১. কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোকুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো খুবই জরুরি। কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন এবং কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়া। যে যতবেশি কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াবে তার জন্য ততবেশি বরকত নেমে আসবে।যে ঘরে কুরআন তেলাওয়াত হবে, কুরআনের চর্চা হবে, কুরআনের ওপর আমল করা হবে, সে ঘরেই নেমে আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত ও কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে বলেন-> وَهَـذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ‘এটি এমন একটি কিতাব, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর; যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৫৫)> وَهَـذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ مُّصَدِّقُ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَلِتُنذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالآخِرَةِ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَهُمْ عَلَى صَلاَتِهِمْ يُحَافِظُونَ‘এ কুরআন এমন কিতাব, যা আমি নাজিল করেছি; বরকতময়, আগের গ্রন্থের সত্যতা প্রমাণকারী এবং যাতে আপনি মক্কাবাসী ও পাশ্ববর্তীদেরকে ভয় প্রদর্শন করেন। যারা পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে তারা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার স্বীয় নামাজ সংরক্ষণ করে।’ (সুরা আনআম: আয়াত ৯২)রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এ কিতাব (কুরআন) দিয়ে বহু মানুষকে (বরকতের মাধ্যমে) ওপরে ওঠাবেন। আবার বহু মানুষকে নিচে নামাবেন।’(মুসলিম)অর্থাৎ যা কুরআনুল কারিমে অনুসরণ করবেন, তাদের জন্য এ কিতাব হবে বরকতের কারণ। আর যারা এ থেকে দূরে সরে যাবে তা হবে তাদের জন্য অমঙ্গলজনক হওয়ার কারণ।১২. সকালবেলা কাজ শুরু করাদিনের শুরুতে কাজ শুরু করা। যদি কারো অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য একটু বেলা করে হয় তাতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং নিজ ঘরের কাজ দিয়ে হলেও সকাল সকাল কাজ শুরু করা। কেননা সকালবেলার কাজে আল্লাহ তাআলা বরকত দান করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করেছেন-اللَّهُمَّ بَارِكْ لِأُمَّتِي فِي بُكُورِهَاহে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে সকালবেলা বরকত দান করবেন।অন্য বর্ণনায় এসেছে- তিনি বলেছেন, আমার উম্মতের জন্য সকালবেলার সময়টাতে বরকত দেয়া হয়েছে।সুতরাং কেউ যদি সকালের সময়টিতে ঘুমিয়ে থাকে তবে কিভাবে বরকত আসবে। এ কারণেই দিনের শুরুতে মহান আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ শুরু করার মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণ করা জরুরি।১৩. আল্লাহর ওপর ভরসা করাবরকত লাভের অন্যতম চাবি বা আমল হলো আল্লাহর ওপর ভরসা করা। মুমিন যত বেশি আল্লাহর ওপর ভরসা করবে ততবেশি তাকে সাহায্য করবেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি আস্থা, নির্ভরতা বা ভরসা যতি বেশি কমবে, সে ততবেশি অপমাণিত ও লাঞ্ছিত হবে। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘আল্লাহর প্রতি যেরকম ভরসা বা আস্থা রাখা দরকার, তোমরা যদি সেই মাপের আস্থা রাখতে পার, তাহলে আল্লাহ তাআলা পাখিকে যেভাবে রিজিক দেন তোমাদেরও সেভাবে রিজিক দেবেন।’১৪. সালামের ব্যাপক প্রচলন করাপরিপূর্ণ, সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ সালামের ব্যাপক প্রচলন করা বরকত লাভের অন্যতম মাধ্যম। পরিপূণ সালাম হলো-اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُঅর্থ : ‘আপনার উপর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।’এ সালের পুরোটাই শান্তি, রহমত ও বরকতের দোয়া। যারা নিয়মিত বেশি বেশি সালামের ব্যাপক প্রচালন করার চেষ্টা করেন। ঠিক সালামের উত্তরদানকারী ব্যক্তিও ঠিক একই দোয়া করেন-‘আপনার ওপরও শান্তি, রহমত ও বরকত নাজিল হোক।’সুতরাং জীবনে বরকত লাভে সহজ ও প্রচলিত এ আমলগুলোর প্রতি একটু খেয়াল রাখলেই বা যত্নবান হলেই জীবনে নেমে আসবে অবিরত রহমত, বরকত।১৫. আল্লাহর জন্য হিজরত করাআল্লাহ তাআলা অনেক নেয়ামত দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছেন, তা অনুসন্ধানে হিজরত বা দেশে-বিদেশ ভ্রমণ করা। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াব্যাপী ভ্রমণ তথা রিজিকের তালাশ করা।উল্লেখিত কাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে পারলে মহান আল্লাহ বান্দার সব অভাব দূর করে দেবেন। রিজিকে বরকত দেবেন।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সহজ এ আমলগুলোর মাধ্যমে রিজিকে বেশি বেশি বরকত লাভের তাওফিক দান করুন। উল্লেখিত আমলগুলো নিয়মিত পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিনوالله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে… আরিফুর রহমান
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
লেখক ও গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা