04/09/2025
🌪 ভোলা ট্রাজেডি-১৯৭০ – ইতিহাসের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়
“৩-৫ লাখ প্রাণ হারাল এক ঝড়ে”
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় (The Great Cyclone of 1970) ভোলাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি।
👥 জনসংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি
সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৪.২ মিলিয়ন। ভোলার দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় ঘনবসতি ছিল। বিশেষ করে তজুমুদ্দিন উপজেলায় প্রায় ১.৬৭ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৫% বা প্রায় ৭৫,০০০ মানুষ এক রাতেই মারা যান।
💔 বেঁচে থাকা মানুষের লড়াই
মৃত্যুর ছায়া থেকেও অনেকে বেঁচে যায়। তীব্র বাতাস ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে মানুষ গাছের সঙ্গে বাঁধা পড়ে বা ছাদে উঠে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। অনেকের শরীরে তীব্র আঘাত ও ছাল উঠে যায়, যাকে বলা হয় “Cyclone Syndrome”।
তৎকালীন জরিপে মৃতের সংখ্যা কম দেখানো হলেও বাস্তবে ৩–৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন।
⚡ ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা
বাতাসের বেগ: ঘণ্টায় ১৯০–২৪০ কিমি
জলোচ্ছ্বাস: প্রায় ১০ মিটার
ঘরবাড়ি: ৮৫% ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত
মাছ ধরা শিল্প: ৯০% জেলে ক্ষতিগ্রস্ত, ৭৭,০০০ জেলের মধ্যে ৪৬,০০০ জন মারা যান
কৃষি ক্ষতি: প্রায় ৬৩ মিলিয়ন ডলারের ফসল নষ্ট
গবাদিপশু: প্রায় ২.৮ লাখ মারা যায়
📍 সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয় তজুমুদ্দিন উপজেলায়, যেখানে অর্ধেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ভোলা দ্বীপ, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, পটুয়াখালি, চট্টগ্রাম, মংলা, কক্সবাজারসহ বিস্তৃত দক্ষিণাঞ্চল বিধ্বস্ত হয়।
🆘 সাহায্য ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রাথমিক ত্রাণ পাঠায়, ২৪ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে পুনর্বাসনের ঘোষণা দেন এবং ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়। তবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এই সাহায্য ছিল অপর্যাপ্ত ও দেরিতে আসা। অবহেলা ও অমানবিকতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে আরও ত্বরান্বিত করে।
🌊 মানুষের বেঁচে থাকার গল্প
ঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় শিশু ও বৃদ্ধরা। বেঁচে থাকা মানুষরা গাছের ডালে, নৌকায় বা ছাদে উঠে ঠান্ডা ও ক্ষুধার সাথে রাত কাটায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় অনেকেই দীর্ঘ সময় সাহায্য পায়নি।
☁ ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম ও আঘাত
৮ নভেম্বর ১৯৭০ বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়, যা ১১ নভেম্বরের মধ্যে Severe Cyclonic Storm এ পরিণত হয়।
১২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল বেগে আঘাত হানে। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১০ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস, যা মুহূর্তেই জনপদকে পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়।
🌤 সমাপ্তি ও পরিণতি
১৩ নভেম্বর ভোর নাগাদ ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হতে শুরু করে। তবে রেখে যায় লাখো প্রাণহানি, কয়েক মিলিয়ন মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দাগ।
এই ঝড় শুধু প্রাণই কেড়ে নেয়নি—মানুষের মনে স্বাধীনতার দাবিকে আরও প্রবল করে তোলে।
(সংগৃহীত))