07/05/2025
আমার বন্ধু আরমান। অনেক বই পড়ে সে। কিন্তু বইয়ের রিভিউ লিখতে জানে না। যার কারণে নিজে পাঠক হলেও এখনো কাউকে পাঠক বানাতে পারেনি। এ দুঃখটা সে-ও গভীরভাবে উপলব্ধি করে।
সরকারি ছুটির দিন। আমি আর আরমান গেলাম পাঠক সমাবেশে। সেদিনও বেশকিছু বই কিনল আরমান। আমি কিনলাম মাত্র একটি মাত্র। পাঠক সমাবেশ থেকে বের হয়ে একটু সামনে যেতেই আবিদের সাথে দেখা। সে-ও আমার বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কথায় কথায় ইসলামি ইকোনমিক সিস্টেম নিয়ে আলাপ উঠল। আমরা দুজনই কথা জারি রাখলাম। আরমান চুপচাপ শুনছে।
একপর্যায়ে আবিদ বলল, 'গত সপ্তাহে তোমার রিভিউটি পড়ে বইটি সংগ্রহ করেছি।' কথাটা বলে আবিদ একটি বই দেখাল। আমি বললাম, 'বাহ, খুব ভালো কাজ করেছো। এ বইটি তোমার কাজে আসবে ইনশাআল্লাহ।'
আমরা বাসে উঠলাম। আরমান জিজ্ঞেস করল, রুমি, তুই যেভাবে বইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরলি, তা আমাকেও শেখাবি? আমি বললাম, মানে, তুই জানতে চাচ্ছিস, 'কীভাবে বইয়ের রিভিউ লিখতে হয়', তাই তো? আরমান মাথা নাড়াল। আমি তাকে সংক্ষিপ্তভাবে ১৫টি পয়েন্টে বিষয়টি বোঝালাম। চলুন, আপনাদেরকেও বলি—
১ নং পয়েন্ট : বইটি সম্পূর্ণ পড়া
কোনো বইয়ের ওপর রিভিউ লিখতে হলে, আগে সে বইটি পুরোপুরি পড়তে হবে। আধাআধি পড়ে কখনোই একটি বইয়ের আদর্শ রিভিউ দেওয়া সম্ভব হবে না। কোনো বইয়ের ওপর ভাসাভাসা জ্ঞান রেখে রিভিউ লিখলে এতে পাঠক নানাভাবে বিভ্রান্ত হতে পারেন।
২ নং পয়েন্ট : গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করা
একটি ভালো রিভিউ তখনই হয়, যখন পাঠক পড়ার সময় সে বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি লিখে নোট রাখে। কারণ, এতে রিভিউটি যে পড়বে, সে বইটির সম্পর্কে আগ্রহী হবে দ্রুত। যেমন, হজরত উমর রা. জীবনী পড়ার সময় কেউ লিখে রাখল যে, 'হজরত উমরের শাসনকালেই দুধের শিশুদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়।' এ তথ্যটি পাঠককে আকর্ষিত করবে।
৩ নং পয়েন্ট : ইস্যু বুঝে রিভিউ লেখা
চারদিকে চলছে জুলুম ও নির্যাতনের ঘটনা। পুরো দেশের মানুষ আছে আতঙ্ক। আপনি এ সময় কোনো লেখকের প্রেমের কবিতা বই নিয়ে রিভিউ লিখলেন—এটা আপনাকে আরও বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে পড়বে। ইস্যুকেন্দ্রিক বইগুলোর রিভিউ বেশিরভাগ সময়ই পাঠককে বইটি পড়তে উৎসাহিত করে। যেমন, আপনি এ সময়ে কাশ্মীরের ইতিহাসের ওপর লেখা একটি বইয়ের রিভিউ লিখলেন।
৪ নং পয়েন্ট : রিভিউ সংক্ষেপে লিখুন
যে বই-ই পড়ে না, সে আপনার ইয়া বড় রিভিউ পড়বে? কখনোই না। সুতরাং রিভিউ লেখার ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ধারাটা ফলো করুন। অনেক সময় দুটি বাক্যও বইটি পড়তে উৎসাহিত করে।
৫ নং পয়েন্ট : লেখকের লেখা নিয়ে মন্তব্য দিন
বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ পাঠক সরল ভাষা ও সাবলীল বাক্য গঠনকে বেশি পছন্দ করে। আপনি হয়তো বইয়ের বিষয়কে গুরুত্বভাবে তুলে ধরলেন, কিন্তু বইয়ের ভাষা যে খুবই জটিল ও কঠিন, তা লিখলেন না। এমনটা করা যাবে না।
৬ নং পয়েন্ট : চরিত্র বিশ্লেষণ করুন
গল্প, উপন্যাস ও ইতিহাসের বইগুলো নিয়ে যখন রিভিউ লিখবেন, তখন আকর্ষণীয় চরিত্রগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন৷ মজার বা জটিল চরিত্রগুলো শুরুর দিকে তুলে ধরতে পারেন।
৭ নং পয়েন্ট : পাঠক ক্যাটাগরি স্পষ্ট করুন
এ বইটি সিরিয়াস পাঠকদের জন্য, বা যারা এ বিষয়ে আরও চার-পাঁচটি বই পড়েননি, এ বইটি তাদের জন্য নয়—এ লাইনগুলো রিভিউ থাকলে মানুষের ভেতর বইটির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। অহেতুক বই সংগ্রহ করা এবং সব বিষয়ে সবার সব বই পড়া—এটা কোনোমতেই জরুরি বিষয় হতে পারে না। তাই রিভিউতে পাঠকের ক্যাটাগরি বা শ্রেণি উল্লেখ করুন।
৮ নং পয়েন্ট : ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরুন
রিভিউ মানে সব পজিটিভ বিষয় থাকবে, তা নয়। বইয়ের রিভিউতে পাঠক নেগেটিভও জানতে চায়। যেমন, বই তো দারুণ; কিন্তু লেখক একজন অগ্নিপূজক। বা লেখক মুসলিম হলেও আহলে কুরআন। অথবা তিনি স্পষ্টভাবে এ বইতে সত্যকে আড়াল করতে চেয়েছেন। এ জাতীয় রিভিউ মানুষের আরও উপকারে আসে।
৯ নং পয়েন্ট : রহস্য বা মূল টপিক উন্মোচন করবেন না
রিভিউ লিখতে গিয়ে এমনটা যেন না হয় যে, আপনি পাঠকের কিউরিওসিটি বাড়াতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বা বইয়ের পুরো সারমর্ম লিখে ফেললেন। এটা অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন।
১০ নং পয়েন্ট : বইয়ের ছবি যুক্ত করুন
অনেকে রিভিউ লিখে ডাইরেক্ট পোস্ট করে দেয়। এমনটা করবেন না। চেষ্টা করুন আপনার লেখা রিভিউটির সাথে সুন্দর একটি ছবি যুক্ত করতে। সেটা সম্ভব না হলে গুগল বা ফেসবুকে বইটির ভালো ছবি তালাশ করে এরপর ছবিসহ লেখাটি আপলোড দিন।
১১ নং পয়েন্ট : রেটিং দিন
আপনি হয়তো জানেন না, এমন অনেক পাঠক আছেন, যারা রকমারি ও ওয়াফিলাইফের মতো অনলাইন বুকশপে গিয়ে বইয়ের রেটিং দেখে তারপর বই অর্ডার করে। তাই রিভিউ বইটি পড়ে আপনি দশের ভেতর কত দেবেন, তা লিখুন। যেমন : রেটিং = ৭/১০
১২ নং পয়েন্ট : পাঠকের কমেন্টের রিপ্লাই দিন
রিভিউ তো ভালোই লিখলেন, কিন্তু এক রিভিউতে যে সবার প্রশ্নের উত্তর আসবে, তা তো না-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে রিভিউ পোস্ট করার পর মানুষের কমেন্ট বা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন। পোস্ট করেই হারিয়ে যাবেন না।
১৩ নং পয়েন্ট : সব বইয়ের রিভিউ লিখতে নেই
রিভিউ লেখার ক্ষেত্রে আপনি তিনটি স্তর নির্ধারণ করতে পারেন। প্রথম স্তর হলো, আপনি আপনার ভালো লাগা বইগুলো নিয়ে রিভিউ লিখুন। দ্বিতীয় স্তর হলো, যে বইগুলো অনেকেরই পড়া উচিত। তৃতীয় স্তর হলো, আপনার নিকট ভালো না-লাগা বই।
১৪ নং পয়েন্ট : লেখালেখির চর্চা করুন
এ পয়েন্টটি শেষের দিকে এলেও এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আপনি যদি লিখতেই না পারেন, সেক্ষেত্রে ভালো রিভিউ লিখতে হলে অবশ্যই লেখালেখির চর্চা করতে হবে। আর সেটা সম্ভব আজ থেকেই। আপনি যেভাবেই লিখুন না কেন, আজই লিখতে শুরু করুন। ইনশাআল্লাহ লিখতে লিখতেই লেখার হাত তৈরি হবে।
১৫ নং পয়েন্ট : পাঠকের দায়িত্ব
সর্বশেষ বলব, আমরা যখন একটি ভালো রিভিউ পড়ব, তখন আমাদের দায়িত্ব হলো, সে রিভিউটি শেয়ার দিয়ে অন্যদের পড়ার সুযোগ দেওয়া। যিনি এত সুন্দর করে রিভিউ লিখেছেন, তাকে ধন্যবাদ ও শুকরিয়া জানানো। এবং সামনে যেন সে আরও ভালো ভালো রিভিউ লেখেন সে-ই অনুরোধ জানানো।
লিখেছেন,
রাশেদ মুহাম্মাদ
হেড, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং
Ettihad Publication
Collected...