07/04/2025
দিনাজপুর সদর উপজেলার বনতারা গ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একপ্রকার অবরুদ্ধ জীবন-যাপন করছেন। যারা স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ী তারা কেউ দোকান খুলতে পারছেন না।
কারণ গ্রামের একজন, সবুজ দাস, ঢাকার গার্মেন্টস কর্মী, সে নাকি ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা করেছে। তার অপরাধে গ্রামের সব হিন্দুই দোষী! রীতিমতো মাইকিং করে সবাইকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
আর এই ঘটনা চলছে তিন দিন ধরে। কিন্তু সবার অপ্রিয় "ডেইলি স্টার" টু সবার প্রিয় "আমার দেশ" কোথাও দেশের এই ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট নেই। যেমন ফিলিস্তিনের অনেক ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো চেপে যায় বা বিষয়টি এমনভাবে দেখানোর চেষ্টা করে যাতে আপনার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়।
কিন্তু তারপরও সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমে আমরা এর ভয়াবহতা যেভাবে দেখতে পাচ্ছি ফেসবুকে, ইনস্টায়-- তেমন কিন্তু দিনাজপুরের ঘটনাটা নিয়ে অনেকে কথা বলছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বীই। বাকিদের এই স্বদেশবাসীদের জন্য সময় নেই।
আজ সকালে ওখানকার স্কুল শিক্ষক উপেন্দ্র রায় এ নিয়ে বলেন যে, সবুজ দাসের ভুলের জন্য সব হিন্দুকে অবরুদ্ধ করে রাখার মানে কী? দোকানপাট বন্ধ রাখার মানে কী? তার নামে মামলা, তদন্ত করে শাস্তি দিক সে দোষী হলে।
তারপর জনতা এই যৌক্তিক কথাতেও ক্ষেপে গিয়ে তার বাড়িতেই হামলা করে। সবুজ দাস ঢাকায় থাকে, তাকে তো পায়নি, হাতের নাগালে "শিক্ষক" উপেন্দ্র রায়কে পেয়ে তাকে "গার্মেন্টস কর্মী" সবুজ দাসের "সহযোগী" বানিয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানো হয়।
মজার বিষয় এটাই যে, প্রশাসনের কেউ তিনদিন পর যাও এলো, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের পরিপন্থী এই হিন্দু নাগরিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া নিয়ে কোন টু-শব্দ করলো না। গ্রামের বাজার, সেখানে পুঁজিই বা কী যে দোকান বন্ধ থাকলে পুঁজি ভেঙে খাবে। আমার এক কাকুকে দেখেছি সে শুক্রবারও দোকান খুলে বসে থাকতো। একদিন বন্ধ থাকা মানেই পেটে টান পড়া যে! সেখানে আজ চার দিন হলো তাদের অবরুদ্ধিকরনের।
আমি ফিলিস্তিনের ভয়াবহতা, দুর্ভোগের সাথে এর তুলনা টানতে চাই না। কিন্তু কষ্ট তো কষ্টই!
এদিকে শুনতে পারলাম, সবুজ দাস থেকে নাকি তার এলাকার বন্ধু টাকা ধার নিয়েছিল। সবুজ নির্দিষ্ট সময় পরে বারবার টাকা চাইলে ঝগড়া লাগে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বন্ধু তাকে মা লু সম্বোধন করে, বিপরীতে সবুজ বলে তোরা সবাই চোর, টাকা মেরে দিছিস আমার। - এই মেসেজটাই নাকি হচ্ছে ধর্ম অবমাননা!
লক্ষ্য করবেন, এইসব ধর্ম অবমাননার অধিকাংশ ঘটনা ঘটেই তর্কাতর্কি থেকে। এখন যৌক্তিক আলোচনার খাতিরে যদি বলি, আপনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন, বাংলাদেশে কোন হিন্দু কি নিজ থেকে এসব তর্কাতর্কির সূচনা করে? কখনো দেখেছেন? অনেক ভিন্নধর্মী মানুষ আমাকে বলেছে, তোমাদের (হিন্দুদের) অনেকের সাথে কথা হয়, তোমার মত তারা এতকিছু জানেনা।
আমি হেসে চেপে যাই যে, চর্চা কম থাকলেও মোটামুটি জানে সবাই, কিন্তু একরকম ভয়ে - জানিনা- বলে এড়িয়ে যায়।
আজকে দুপুরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী অখিল কর্মকারের সাথেও একইরকম ব্যাপার ঘটেছে। লোকটাকে মারের ভিডিও দেখলাম। মাথায় টাক, আধপাকা চুল, শার্ট ছিড়ে ফেলায় খোলা বুকের পশম সব সাদা, ষাটের ঘরে বয়সী -- নিশ্চয়ই লোকটা ৭১ দেখেছেন, ১৯৯০-১৯৯২ দেখেছেন, ২০০১, ২০১৩-২০১৫ দেখেছেন। দেখেছেন ২০২১। তাও দেশটা ছাড়েননি। হয়তো তার "বোকামি"র খেসারত আজকে দিলেন আরকি। সম্ভবত ঐ টাকাপয়সা নিয়ে কোন কথা কাটাকাটি হয়েছে, তারপর যেহেতু হিন্দু, ব্যাস লাগিয়ে দাও ট্যাগ।
এসব নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। বলবে না। আমি কয়েকদিন একটু বিরতি নিয়েছিলাম। দিনাজপুর সদরের খবর প্রথমদিনই চোখে পড়েছিল যখন সন্ধ্যায় মাইকিং করছিল। কিন্তু দেখছি তিনদিন কেটে গেল- অচ্ছুৎ অস্পৃশ্য আমাদের জন্য কেউ কিছু বলছে না।
ভগবানের কাছে একান্তে ফরিয়াদ জানিয়েও শান্তি পাই না৷ তাই এই ডিজিটাল ডায়েরিতে লিখে রাখলাম। যাতে ভবিষ্যতে কোন প্রশাসনিক অস্বীকার দেখলে মুচকি হাসতে পারি।
(সাথে কোন ভিডিও বা ছবি যুক্ত করিনি কারণ আমি চাই সবাই নিজেরা সার্চ করে করে বিষয়গুলো বের করুক। তাহলে এদেশের মিডিয়ার বৈষম্যের নগ্নতা, যা নিয়ে বিগত আমলেও কথা বলেছি, তা প্রমাণিত হবে।)