09/08/2025
আমার হাফেজা হতে বেশি সময় লাগলো অন্যদের থেকে।কিন্তু আব্বুর ইচ্ছে মেয়ে বুড়ি হয়ে গেলেও হাফেজা হতেই হবে।তাই হাল ছেড়ে দিতে পারিনি চাইলেও।হেফজ শেষ করেই ক্বওমীতে ছোট জামাতে ভর্তি হলাম।পিচ্চি বাচ্চাদের মধ্যে খুব অস্বস্তি লাগতো। ভাবতাম কবে যে বড় জামাতে পড়বো!
খুব দ্রুত সময় গড়ালো।আমি মেশকাত(অনার্স) জামাতে ভর্তি হলাম।হঠাৎ একদিন আমার হেফজখানার বান্ধবী 'সমাপ্তির' ফোনে 'হাদি' নামে একটা নম্বর সেভ করা দেখলাম।একটু পরিচিত লাগলো নামটা।কিজানি!হয়তো এটা ওর কোন আত্মীয়!তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কার নম্বর?
ও বলল- তোর মনে আছে!আমরা যখন নূরানিতে পড়তাম তখন হেফজখানায় হাদি নামে একটা দুষ্ট ছেলে ছিলো।ওটাই এই লোক।
কিছুক্ষণ ভাবার পরেই মনে পরলো।এই হাদি একবার আমার ফুল ছিঁড়ে দিয়েছিলো।ক্লাসের সবাই কাগজ দিয়ে ফুল বানিয়েছিলো তাই আমিও বানিয়েছিলাম।আমারটা অনেক সুন্দর হয়েছিলো কিন্তু এই ছেলে এসে নষ্ট করে দিয়েছিলো।বদ!
যাহোক নম্বরটা টুকে নিলাম। কি ভেবে নিলাম নিজেও জানি না।
কিছুদিন পরে মাথায় ভুত চাপলো। এই বেটাকে একটা শিক্ষা দিলে কেমন হয়?যদিও এ সমস্ত কাজ আমি জিবনেও করিনি।তবুও আজ করতে মন চাইলো।শয়তানে
ধরলে যা হহয় আরকি! ফোন দিলাম।এবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো।ইশ কেন কলটা দিলাম!কেটে দিলে কেমন হয়?না থাক এটা আরও লজ্জাজনক।তাই কাটলাম না।লোকটা রিসিভ করলো।প্রথমে ভেবেছিলাম মিথ্যা পরিচয় দিবো কিন্তু সহজে মিথ্যা বলতে পারিনা আমি।উল্টাপাল্টা বাজিয়ে ফেলি।তাই সত্যই বললাম যে,আমি মানজিয়া.....। কিন্তু এখন নিজের বোকামিটা বুঝলাম। একজন গায়রে মাহরামকে হুদাই ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার কোন মানে হয়না,ছেলেটা তো এখনো ছোট নেই।ছিহ,এটা ফালতু মেয়েদের কাজ। লোকটাও চুপ, আমিও থতমত খেয়ে চুপ।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করলো কি পড়ালেখা করছি হেনতেন।তারপর ফোন রাখলো।ছেলেটাকে ভদ্র মনে হলো।আসলে সবাই সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়ে যায় এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝলাম মোটেই কলটা দেওয়া ঠিক হয়নি।
কিছুদিন পর উনি আবার ফোন দিলো।অনেক দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করলাম।টুকটাক কথা বলল আমি উত্তর দিলাম শুধু।কিন্তু বুঝলাম উনি কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না।আজব,তো আমার কি!
কিছুদিন পর আবার ফোন দিয়ে সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিলো।হয়তো এতদিন খোঁজখবর নিচ্ছিলো!
আর জানালো উনি প্রস্তাব দিয়ে পাঠাবেন উনার আব্বুকে দিয়ে।আমি না করিনি।চুপ ছিলাম।তারপর বিয়ের কথাবার্তা এগুলো হাদি হাফেজ,মাওলানা এখন ইফতা বিভাগে পড়ছেন।উচ্চবিত্ত পরিবার। দুই ভাইবোন। আরও একভাই ছিলো কিন্তু মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে জোয়ান ছেলে ট্রেনের নিচে পরে মারা গিয়েছে অনেক আগে। আব্বুও রাজি হলেন কিন্তু উনার মা' র ইচ্ছে আলেমা মেয়ে বিয়ে করাবেন।তাই কাবিন করিয়ে রাখা হলো। দাওরা শেষ হলে তুলে নিবে ওরা।
এরপর নিয়মিত কথা হতো উনার সাথে।অনেক কথাবার্তার পর বুঝলাম আসলে উনি বুযুর্গটাইপ লোক।এতে একটু খুশি হলাম কারণ আমি যদিও মাদ্রাসায় পড়তাম কিন্তু অতো পরহেজগার ছিলাম না।দুলাভাইয়ের সাথেও পর্দার আড়াল থেকে অনর্গল কথা বলতাম।পরিবার দ্বীনহীন ছিলো বলেও একটু প্রভাব ছিলো আমার উপর।কিন্তু এবার মুটামুটি ভদ্র হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।উনার কথামত চলছি।দারুণ কাটছিলো সময়গুলো।উনার ইফতা শেষ।জেলার সবচেয়ে বড় মসজিদে ইমামতি পেলেন।আমি দাওরাতে ফেল করলাম। জায়্যিদের ছাত্রী ছিলাম কিন্তু এবছর একেবারে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ায় সোজা ফেল।মুটামুটি কাঁদলাম।উনি সান্ত্বনা দিলেন।বেশ আমি সব ভুলে গেলাম।এত সুন্দর সময় গুলোর জন্য ফেলটাকে অন্তত মেনেই নেওয়া যায়।
এরপর ধুমধাম অনুষ্ঠান করে আমাকে শশুড়বাড়ি তুলে নেওয়া হলো।উনি আমার শশুড় শাশুড়িকে নিয়ে হজ্ব করলেন।আমাদের একজন কন্যা সন্তান হলো।ওর বয়স দেড় বছর চলছিলো।টুকটাক কথা বলে।কিন্তু প্রচুর কান্নাকাটি করে।উনি বাসায় থাকলে কোলে নিয়ে রুমের এ পাশ থেকে ওপাশে হাঁটাহাঁটি করতেন, দুআ পরে ফুঁ দিতেন।আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম।উনি দেখতে মাশাআল্লাহ।কিন্তু আমি সে তুলনায় একটু কমই। উনার মসজিদ দূরে হওয়ায় আমাকে শশুরবাড়ি রেখে ওখানে থাকতেন।১৫ দিন পর পর আসতেন । শাশুড়ি চাইতেন নাতনী নিয়ে যেন এখানেই থাকি।তাই উনি সাথে করে নিয়ে যাননি।আরও কিছুদিন যাওয়ারপর শশুড়বাড়ি থাকতে আর ভালো লাগছিল না।নিজের প্রয়োজনের জিনিস গুলো বার বার শশুড়কে বলতে লজ্জাবোধ হতো।এদিকে বাবুও বাবা বলতে পাগল ছিলো।তাই শাশুড়ির অনুমতিতেই উনি আমাকে নিয়ে গেলেন ওখানে।নতুন বাসায় জিনিস পত্র গোছাতে রাত হয়ে গেলো।উনি রাতে বললেন উনার খুব বুক ব্যাথা করছে। সূরা পরে ফুঁ দাও। আমি দিলাম। একটু কমলে বললেন, উনি মসজিদে থাকবেন।
বলে চলে গেলেন।এটা উনার অভ্যাস ছিলো।মসজিদে থাকতে অনেক ভালোবাসতেন।মসজিদেই আমল করতেন খুব।
খুব ভাগ্যবান মনে হতো নিজেকে।এতো ভালো মানুষটা আমার স্বামী!বিয়ের পর প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি ইসলাম অনুযায়ী নিয়েছেন।আমিও এখনো সে অনুযায়ীই চলছি।সব আছে এখন আমার।কিছুতেই কমতি নেই।খুশিতে বার বার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আল্লাহর কাছে দুআ করতাম।
পরদিন সকালে খুব ব্যস্ত ছিলাম।শশুড়বাড়ি থেকে লোকজন আসবে তাই।হঠাৎ উনি মসজিদের খাদেমের কাঁধে ভর দিয়ে বাসায় এসে বলতেছেন।
- মানজিয়া আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।দূত সূরা ইয়াছিন পড়ো।
আমি ঘাবড়িয়ে গেলাম হঠাৎ সুস্থ মানুষটার কি হলো।একা একা কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।কেঁদে কেঁদে ইয়াসিন তিলাওয়াত করছি শুধু।তারপর খাদেমের সাহায্যে গাড়ি করে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসি।এদিকে শশুড়বাড়ির মানুষও এসেছে।আমি তখন কাঁদতেও পারছিলাম না।বুক কাঁপছে।
ডক্টর উনাকে ইনজেকশন দিতে গেলে উনি বিসমিল্লাহ বলে ইনজেকশন দিতে বলল ডক্টরকে।আর সবাইকে ইয়াসীন পড়ার তাকিদ দিয়ে নিজেও ইয়াসীন পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে বিদায় নিয়ে চলে গেলো রবের কাছে।
ইশ কি যন্ত্রণা!দু'দিন অচেতন ছিলাম।আমার অজান্তেই দাফন কাফন হয়ে গেলো।ছোট মেয়ে ইসরার খোঁজ নেওয়ার মতো হুঁশেও ছিলাম না।শাশুড়ি দ্বিতীয় ছেলেকে হারিয়ে পাগল আর আমি স্বামীকে হারিয়ে প্রায় মৃত।
সময় বয়তে লাগলো ইদ্দত সমাপ্ত করে বাবার বাসায় আসলাম।শশুড়বাড়ি থেকে সব রকমের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম।কিন্তু আমি থেকেও যেনো নিজের মাঝে নেই।বিয়ের কথা উঠতেই থামিয়ে দিয়েছি।বড় বোনেরও ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে দুই সন্তান রেখে।কিছু মেয়েকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছি আপাতত। সুখস্বপ্ন অল্পক্ষণই আমার জিবনে বাস্তবায়িত হলো।আমি ভালোবাসি আমার স্বামীকে, তার কন্যাকে। তাই একাই হাল ধরলাম।এখন আমি একা, খুব একা তবে আমি উনার আমানতকে নিয়ে পরিপূর্ণ। মেয়েটা এতো ভদ্র হয়েছে বলার মতো না,প্রচন্ড মেধাবীও আমার কাছেই কুরআন পড়ছে।মাত্র ছয় বছর।কেউ যদি জিজ্ঞেস করে
তোমার বাবা কোথায়?
'ও'বলে,আল্লাহর কাছে।
কখনো জিজ্ঞেস করে না 'বাবা আসবে না?'
এতো বোঝমান কেনো মেয়েটার,,
এক বোনের জীবনী থেকে নেওয়া,,,কেন জানি পড়ার সময় চোখ ছলছল করছিলো,,,,, আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন,,,আমীন।