26/08/2025
'উস্তাযাহ আমার স্মরণশক্তি অত্যাধিক দুর্বল৷ আমি কি হিফজ করতে পারব?'
ক্লাসের সবকটা কন্ঠ যেন এক ধাক্কায় চুপ হয়ে গেল। মুহূর্তের মাঝেই একটা থমথমে পরিবেশে আমরা আটকে গেলাম। এই ক'দিনের মধ্যে আমরা খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছি যে, ফাত্বিমাহ উস্তাযাহ কোনো নেগেটিভ কথা শুনতে পছন্দ করেন না। উস্তাযাহ কে 'পারছি না' শব্দ দু'টো বলার থেকে বিরতিহীন ভাবে ২৪ ঘন্টা হিফজ রিভাইস দেওয়াও আমাদের কাছে বেশি স্বস্তির বলে মনে হয়৷ সেখানে এহেন প্রশ্ন যে উস্তাযাহ কে বেশ রাগিয়ে দিবে তা আমরা খুব ভালোই টের পাচ্ছিলাম। কয়েকজন পার্সোনাল গ্রুপে নিজেদের মনের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছিল, 'নাহ! বারাকাহ আজ বকা খাবেই! কেন যে এরকম নেগেটিভ কথা বলতে গেল!'
একেকটা সেকেন্ড যেন ঘন্টার মত পার হচ্ছে। আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে উস্তাযাহ'র উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু উস্তাযাহ তখনো নিশ্চুপ৷ আমরা ধরে নিলাম 'ঝড়ের পূর্বাভাস'।
বারাকাহ মেয়েটাকে ক্লাসের সবাই খুব পছন্দ করে৷ পাকিস্তানি, কম বয়সী, এতিম একটা মেয়ে। বিশাল যৌথ পরিবারের বড় ছেলের বৌ। বিয়ের প্রায় ৮ বছর পার হতে চললো, এখনো তার কোল খালি৷ সেই সূত্র ধরে ক'মাস হলো বাড়ি বদল করে এখন ওর নতুন জায়গা হয়েছে ভাইয়ের বাড়িতে। এই নিয়ে ভাইয়ের বাড়ির লোকেরাও যে তাকে নিত্যদিন কথা শোনায় তা তার চোখ দু'টো দেখেই অনুমান করা যায়৷ প্রতিদিন টলমল দু'টো চোখ আর ক্লান্তিতে ভরা কন্ঠ নিয়ে ক্লাসে এসেই একটা হাসি নিয়ে সবাইকে সালামুন আলাইকি বলে উঠে৷ হিফজের পড়া শোনানোর পর তার উজ্জ্বল মুখ খানা দেখে মনে হয়, পৃথিবীর সবথেকে সুখী মেয়েটির নাম বুঝি বারাকাহ!
বারাকাহ শারীরিক ভাবেও বেশ অসুস্থ থাকে সবসময়। যেমন তেমন কোনো অসুখ না৷ বেশ বড় রকমের হার্টের অসুস্থতা নিয়ে ও দুনিয়াতে এসেছে। তবুও কোনো কিছু তাকে হিফজের দারস থেকে দূরে রাখতে পারে না৷ অসুস্থতার সাথে সম্পর্কের বেহাল দশা, বড় সংসারের কাজের ধকল সব কিছু সামলিয়ে কুর'আন হিফজের ভাবনা হয়তো কারো স্বপ্নেও আসবে না৷ অথচ বারাকাহ সেই স্বপ্ন ছুঁতেই আমাদের সহযাত্রী হয়ে আজ হিফজের দারসে বসে আছে!
মিনিট তিনেক পর। নিরবতা ভেঙে সবাইকে অবাক করে দিয়ে, উস্তাযাহ বারাকাহ'র প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বেশ শান্ত কন্ঠে ফিরতি প্রশ্ন করলেন, 'বারাকাহ, তুমি কি কুর'আন হিফজ করতে ভালোবাসো?'
সবাই নিশ্চুপ৷ যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। থমথমে পরিবেশ৷ তখনো পর্যন্ত আমরা জানি না একটু পরেই এই থমথমে পরিবশেটা রব্ব তার অশেষ দয়ায় প্রশান্তিময় করে তুলবেন!
বারাকাহ কাঁপা গলায় বললো, 'উস্তাযাহ! আমি আমার রব্বের জন্য কুর'আন হিফজ করতে ভালোবাসি৷ ওয়াল্লাহি! এই দুনিয়ায় কুর'আন হিফজ থেকে অধিক প্রিয় আমার কাছে আর কিছুই নেই৷ আমি চাই না আমার জীবনের একটা মুহূর্তও কুর'আন বিহীন কাটুক। কিন্তু...'
একটু থেমে খানিকটা দম নিয়ে বারাকাহ আবার বললো, 'কিন্তু আমার ভয় হয়। আমার দুর্বল মেধা, অসুস্থতা আর গুনাহ বুঝি আমাকে কুর'আন হিফজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়!'
উস্তাযাহ নরম গলায় বললেন, 'বান্দী তার রব্বের জন্য কুর'আন হিফজ করতে ভালোবাসে অথচ রব্ব তার বান্দীর দিলে কুর'আন ঢেলে দিবেন না এমন কি কখনো হতে পারে বারাকাহ?
ততক্ষণে ক্লাসের সবার চোখ ভিজে এসেছে৷ কান্নার আওয়াজে চারদিক ভারী হওয়ার বদলে অনেক বেশি প্রশান্তময় হয়ে উঠেছে। কারণ এই কান্না যে কুর'আনের প্রতি মুহাব্বাত থেকে আসা কান্না, এই কান্নায় মিশে আছে নিজেদের ক্ষুদ্র যোগ্যতা নিয়েও রব্বকে রাজি-খুশি করে মরিচাধরা অন্তরগুলোতে কুর'আন কে ধারণ করতে চাওয়ার আকুলতা। উস্তাযাহ'র কন্ঠেও কান্নার রেশ স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে৷ কুর'আনের প্রতি মুহাব্বাত বুঝি এমনই হয়! এক বান্দীর কুর'আনের প্রতি মুহাব্বাত রব্বের অসংখ্য বান্দীর হৃদয়ে মুহাব্বাতের ঝড় তুলে দেয়! সেই ঝড় থামাবার সাধ্যি কার আছে!
উস্তাযাহ আমাদের ব্যাচের নাম দিয়েছিলেন Golden 13। ১৩ জনের এই ছোট্ট হিফজের কাফেলায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু গল্প আছে। প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা, স্ট্রাগল আলাদা। এই গল্পগুলোর কোনোটাই রূপকথার মত চোখ ধাঁধানো না, চলার পথটাও খুব একটা মসৃণ না৷ কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করতাম, আমাদের জার্নির শেষটা রূপকথার গল্পগুলোর থেকে অনেক বেশি রাজকীয় হবে৷ এই জীবনে আমরা কেউ রূপকথার সেই কাল্পনিক রাজকন্যার মত না হলেও কুর'আন হিফজ আমাদের পরের জীবনে সত্যিকারের রাজকন্যা করে তুলবে। কুর'আনের একেকটা আয়াত পড়তে পড়তে আমরা জান্নাতের একেকটা সিঁড়ি পেরোবো৷ রব্বের'র দয়ায় জান্নাতের সর্বশেষ সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা আমাদের আসল রাজ্যে রাজকন্যার ন্যায় প্রবেশ করবো। (ইন শা আল্লাহ তা'য়ালা) কেমন হবে সেই মুহূর্তটা! রব্বের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বারবার মাথা ঝুঁকে আসবে না? জান্নাতে তো কোনো কষ্ট থাকবে না, কান্নাও নিশ্চয়ই থাকবে না৷ সেই দিনটায় কী তবে আমাদের খুশির কান্না আসবে? দুনিয়াতে বসে কী কল্পনা করা যায় সেই মুহুর্তগুলো?
এমন মুহূর্ত পেতে রাতের পার রাত চলতো আমাদের কুর'আন নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা।
কত রাত যে আমাদের কান্নার সাক্ষী হয়ে আছে! দিনের বেলার হাজারটা ক্লান্তি পার করে রাত্রি বেলা আমরা কুর'আন হিফজে ডুবে যেতাম। ওপাশ থেকে মেসেজের টুং টাং আওয়াজে একেকজনের পড়ার রিপোর্ট আসতো, চলতো নিচু আওয়াজে একে অপরকে সবক শোনানো৷
কত শত রাত্রি কেটে গেছে কুর'আনের মুসহাফ কোলে নিয়ে, মুসহাফে কান্নার দাগগুলো যেন রব্বের নিকট সৌভাগ্যবতীদের পাশে নিজেদের নাম লিখিয়ে নেওয়ার আর্জি জানাতো! আমাদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলতো কুর'আন কে ভালোবাসার পরিমাণ নিয়ে। আমরা শিখেছিলাম, হিফজ শুধুমাত্র কুর'আন মুখস্থ করে যাওয়া না বরং কুর'আনের মুহাব্বাতে পুরোপুরি নিজেকে ডুবিয়ে ফেলা৷
হঠাৎ একদিন বারাকাহ জানালো ওর তালাক্ব হয়ে গেছে৷ আমরা যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলাম। এমন ভালো একটা মেয়েকেও কেউ ছেড়ে চলে যায়! স্বান্তনা দিচ্ছিলাম। এত কষ্টের মধ্যেও বারাকাহ'র কন্ঠে বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্টি ছিল না, রব্বের প্রতি কোনো অভিমান ছিল না৷ রব্বের ফায়সালায় ও পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল৷ বারাকাহ প্রায়ই তার জীবনের মিরাক্কেল নিয়ে কথা বলতো৷ আমরা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইতাম, কিসের মিরাক্কেল? বারাকাহ বলতো, 'কুর'আন হিফজ আমার জন্য একটা স্বপ্নের মত। এমন একটা স্বপ্ন যাকে আমি দু'হাত বাড়িয়ে ছুঁতে যাই, কিন্তু ছোঁয়ার আগেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। কুর'আন হিফজ করার মত উপযুক্ত মেধা, যোগ্যতা আমার নেই। আমি বড়ই অক্ষম৷ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমার রব্ব অক্ষম নন৷ আমার রব্ব একদিন আমার জীবনে মিরাক্কেল ঘটাবেন৷ এই দুর্বল মেধা নিয়েও আমি কুর'আন হিফজ করার মর্যাদা পাব৷ সৌভাগ্যবতীদের তালিকায় নিজের নামটাও জুড়ে দিতে পারব৷ যেদিন এই মিরাক্কেলটা ঘটবে, সেদিন আমি আমার স্বপ্ন ছুঁতে পারব'
আমরা সবাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিলাম বারাকাহ'র জীবনে মিরাক্কেল ঘটবে৷ ঘটবেই ঘটবে। রব্বের প্রতি ছিল আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের সবার বিশ্বাস কে সত্যতায় রূপ দিতেই মাত্র ৬ মাসের মধ্যে বারাকাহ কুর'আন হিফজ সম্পন্ন করে ফেললো। তার বলা সেই দুর্বল মেধা নিয়েই সে এখন পুরো কুর'আন সিনায় নিয়ে ঘুরছে! সুবহানআল্লাহ!
বারাকাহ'র বিদায়ের দিন উস্তাযাহ'র কান্না, বারাকাহ'র কান্না কে ছাপিয়ে যাচ্ছিল আমাদের সব সহপাঠীদের কান্নার আওয়াজগুলো। কি এক উৎসবমুখর দিন ছিল সেদিন! যেন মনে হচ্ছিল ঈদের দিন! এক সহপাঠী বোন তো রসিকতার সুরে বলেই উঠলো, ঈদ মুবারক! আমরাও হেসে সমস্বরে বলে উঠলাম, তাকাব্বালাল্লহু মিন্না ওয়া মিনকুম!
এরপর আর বারাকাহ'র সাথে তেমন যোগাযোগ হয়ে উঠে নি আমাদের। কেমন যেন ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেল মেয়েটা৷ তবে এতে আমাদের কোনো অভিমান নেই। আমরা জানি, আমাদের মধ্যে বাহ্যিক দূরত্ব বাড়লেও, আমরা একে অপরের অন্তরের খুব কাছাকাছি আছি, দু'আয় আছি। এই দুনিয়াতে বারাকাহ নামের মেয়েটার সাথে আমাদের আর দেখা না হলেও, আরেকটা দুনিয়ায় রব্ব ঠিকই আমাদের মিলিয়ে দিবেন।
এরপর আরো কিছু দিন কেটে গেছে। ব্যক্তিগত কিছু কারণে আমাদের অনেকের হিফজের দারসও বদলে গেছে, বদলে গেছেন উস্তাযাহ, পেয়েছি আরো নতুন এক ঝাঁক কুর'আনের সহপাঠী৷ কিন্তু হিফজ থেমে নেই। নতুন ক্লাসের প্রথম দিনটি আমার কাছে খুবই স্মরণীয় একটা দিন ছিল।
নতুন ক্লাসে উস্তাযাহ খুব নরম সুরে সবাইকে একে একে জিজ্ঞেস করছিলেন, 'কুর'আন হিফজের মূল্য তোমাদের জীবনে ঠিক কতটুকু?'
আমার পালা এলো।
আমি ধরা গলায় বারাকাহ'র কথাগুলোই বললাম, ' #উস্তাযাহ! আমি আমার রব্বের জন্য কুর'আন হিফজ করতে ভালোবাসি৷ ওয়াল্লাহি! এই দুনিয়ায় কুর'আন হিফজ থেকে অধিক প্রিয় আমার কাছে আর কিছুই নেই৷'
এ যেন আমাদের সবার কথা!
কুর'আন হিফজের প্রত্যেকটা ছাত্রীর রূপকই যেন বারাকাহ! টের পেলাম চোখ ভিজে যাচ্ছে। দাঁত দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম উস্তাযাহ সহ আরো অনেকে ভেজা চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ আবারো খুব্ব করে অনুভব করলাম, কুর'আনের জন্য মুহাব্বাত বুঝি এমনই হয়!
Golden 13 এখন এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু আমাদের মাকসাদ এখনো একই আছে। আমরা আমাদের রব্বের প্রতি সুধারণা রাখি৷ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে রব্ব একদিন মিরাক্কেল ঘটিয়ে দিবেন৷ ইন শা আল্লাহ একদিন আমরা পুরো কুর'আন সিনায় নিয়ে রাজকীয় ভাবে বিদায় নিব৷ অতঃপর কুর'আন তিলাওয়াত করতে করতে জান্নাতের একেকটা সিঁড়ি পেরোবো৷ ইন শা আল্লাহ তা'য়ালা। 🌿
|| Miracle
© আয়িশা মুতাদায়্যিনাত