22/07/2025
উপসম্পাদকীয় :
মাইলস্টোন স্কুলে আকাশ থেকে ছুটে এলো ট্র্যাজেডি: একটি স্কুল, একটি জাতি ও অনেক প্রশ্ন”
কেফায়েত উল্লাহ কায়সার :
২১ জুলাই, ২০২৫—এক ভয়াবহ দিন, যেটি স্মরণ থাকবে দেশের শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা ইতিহাসে এক মর্মান্তিক, অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় হিসেবে। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৩১ জন নিহত ও ১৬৪ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনার অভিঘাত কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, জনজীবন, ও শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে।
মৃত্যুর মুহূর্ত: ১টা ১৩ মিনিট
ঘটনার দিন ২১ জুলাই দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মাত্র ৭ মিনিট পর, দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে বিমানটি আঁচড়ে পড়ে মাইলস্টোন স্কুলের ইংরেজি শাখার জুনিয়র সেকশনের দুই তলা একটি ভবনের উপর, যেটির নিচে ছিল তৃতীয় শ্রেণির শ্রেণিকক্ষ। সে সময় স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেছে। কিছু শিক্ষার্থী বের হচ্ছিল, বাকিরা ব্যাগ গুছাচ্ছিলো। এবং তারপরই... ধ্বংস, মৃত্যু ও আর্তনাদের বিভীষিকা।
বিমানটি চালাচ্ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর, রাজশাহীর এক শিক্ষক পরিবারের সন্তান। মাত্র এক বছর আগে তিনি বিয়ে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে। দুর্ভাগ্যবশত, এই দুর্ঘটনায় তিনিও মারা যান।
প্রশ্নবিদ্ধ পেশাগত নিরাপত্তা ও জনবসতির উপর প্রশিক্ষণ।
এই দুর্ঘটনা যেন হুবহু পুনরাবৃত্তি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ঘটনার, যেখানে জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা আসিম জাওয়ায়েদের বিমান সাগরে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট মারা গেলেও, জনবসতিহীন এলাকায় বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দিয়াবাড়ির মতো জনবহুল এলাকায় এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ কীভাবে পরিচালিত হলো—এই প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিকে যায়।
জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও আতঙ্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিমান চলাচলের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণের স্থান ও রুট নির্ধারণে কেমন অসাবধানতা ছিল, তা এখন জাতির সামনে উন্মোচিত হচ্ছে।
শিক্ষাঙ্গনের উপর আগ্রাসন: মানসিক ধ্বংসযজ্ঞ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জাতির ভবিষ্যতের কারিগর। সেখানে পড়াশোনা চলাকালে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া একটি অভূতপূর্ব ও মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, চিকিৎসাধীন। স্কুল প্রাঙ্গণ এখন আর শুধুমাত্র একটি পাঠশালা নয়, বরং একটি ট্র্যাজেডির নিঃশব্দ স্মারক।
এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কেবল চিকিৎসা নয়, শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করা জরুরি। স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই ক্ষত মুছবে না।
রাষ্ট্রীয় শোক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নড়চড়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২২ জুলাই জাতীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে। কিন্তু শোক প্রকাশ যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত। বর্তমানে স্কুল শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চলছে। তাদের একটাই দাবি: দায়ীদের শাস্তি, নিরাপত্তা নীতির পরিবর্তন, এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ।
এদিকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের (বিএনপি, জামাত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন) নেতাদের সঙ্গে। যদিও এই ঘটনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তবুও এর রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত এতটাই ব্যাপক যে, জাতীয় ঐকমত্যে উপনীত না হলে সংকট উত্তরণ অসম্ভব হয়ে উঠবে।
আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি একটি ইঙ্গিত—আমরা হয়তো নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের নামে এমন একটি ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছি, যেখানে সাধারণ নাগরিকের জীবন ও নিরাপত্তা মুখ্য নয়। যেকোনো সময়, যেকোনো স্কুলের আকাশ থেকে বোমা নয়, প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এসে পড়তে পারে—এ বাস্তবতা অগ্রহণযোগ্য।
জাতি যদি এই ঘটনাকে কেবল "দুর্ভাগ্যজনক" আখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়, তবে এ দায় থেকে কোনোদিনই মুক্তি মিলবে না।
আমাদের করণীয়-
প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনার নীতিমালা পুনর্বিন্যাস: জনবসতির উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।
নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নিরূপণ: বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে।প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা মূল্যায়ন: ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন: নিহতদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবা: দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাদার কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা চালু করতে হবে।
মোট কথা- মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আমাদের শিক্ষা দেয়—"দুর্ঘটনা" নামক শব্দটি কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় অবহেলার ফল। আমরা যদি সতর্ক না হই, প্রশ্ন না তুলি, জবাবদিহি দাবি না করি—তবে এমন মৃত্যু আমাদের ভবিষ্যতেও তাড়া করে ফিরবে।
আজ আমরা কাঁদি মাইলস্টোনের জন্য, আগামীকাল কাঁদবো হয়তো আমাদের নিজ সন্তানদের জন্য।