15/08/2025
বিদেশমুখী নয়, জন্মভূমিতে বেঁচে থাকা চাই
*******************"***************
মহাস্থবির এস লোকজিৎ ভিক্ষু
কালের স্রোতে, যুগে যুগে, মানবসভ্যতা উত্থান-পতনের অসংখ্য অধ্যায় রচনা করেছে। ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখি, যে জাতি সংগ্রাম করেছে, প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, নিজের ধর্ম ,ভূমি ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছে, তারা অমর হয়ে আছে; আর যারা হতাশার কাছে নত হয়েছে, তারা হারিয়ে গেছে সময়ের গর্ভে।
আমাদের বাংলাদেশী বৌদ্ধ সমাজও ব্যতিক্রম নয়। সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের পর আজও আমরা এ দেশে টিকে আছি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, নীতি ও আদর্শকে লালন করে আমরা এক নবীন শক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করছি, আমাদের মেধাবী ও অর্থবিত্তশালী সন্তানদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ হারে বেড়ে গেছে।
আমি স্বীকার করি, বৌদ্ধ সমাজের সর্ববৃহীত উন্নতির পিছনে বিদেশে যারা গমন করেছেন, প্রবাস জীবনে অবস্থান করছেন তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন অনেক সময় অনস্বীকার্য। কেউ কেউ ভালো শিক্ষার জন্য, কেউ উন্নত কর্মসংস্থানের জন্য, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগের জন্য বিদেশে যান। কারণ এদেশে থাকা সত্ত্বেও বহু যোগ্য তরুণ-তরুণী উপযুক্ত কাজ বা সুযোগ পাচ্ছেন না, যা তাদের মেধার পূর্ণ বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শুধু প্রয়োজন নয়, এখন প্রতিষ্ঠিত অনেকেই বিদেশে যাওয়াকে এক ধরণের ‘অবশ্যপালনীয় সাফল্য’ এবং 'নিরাপদ জীবনের প্রয়োজন 'মনে করছেন। এই প্রবণতাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
গত বছর থেকে আমি নিজেও এক ধরণের হতাশায় ডুবে ছিলাম! আমাদের জন্মভূমিতে কি আমরা টিকে থাকতে পারবো? আগে যখন কেউ বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত, আমি নিরুৎসাহিত করতাম; কিন্তু গত বছর থেকে সেই বিষয়ে আমার নীরবতা বেড়ে গিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই আমি উৎসাহ দিয়েছি।কিন্তু আজ আমার চিন্তার গতিপথ বদলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট দানশীল ব্যক্তিত্ব, পরম কল্যাণকামী ও শ্রদ্ধাভাজন উপাসক বাবু নেত্রসেন বড়ুয়া ও তার সহধর্মিণীসহ আমার বিহারে এসেছিলেন। পতেঙ্গা শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার ও আরডিএ ধ্যান কেন্দ্রের ভূমি ক্রয়ের জন্য শ্রদ্ধা প্রদান করেন। তাঁর সাথে নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি গভীরভাবে বললেন- "ভান্তে, আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশমুখী হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যদি মেধাবী, অর্থবিত্তশালী সন্তানরা চলে যায়, তাহলে আমরা খুব দ্রুত বিলীন হয়ে যাবো। যারা থাকবে, তারা প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে নিজের আদর্শ ভুলে যাবে। আমি পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি, কিন্তু এদেশের মতো এত মায়াময়, সুন্দর দেশ আর দেখি নাই। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও দেশ ছেড়ে যাওয়া সমাধান নয়। সংগ্রাম করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে।" তার কথাগুলো যেন আমার হৃদয়ের গভীরে ছুঁয়ে গেল। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জমে থাকা হতাশার মেঘ মুহূর্তে কেটে গেল। মনে হলো, হ্যাঁ, সংগ্রাম ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি অমর হয়ে থাকতে পারেনি।আমি স্মরণ হলো সম্প্রতি একজন রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা, যেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন একটি ক্ষুদ্র জাতির ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম সংগ্রামের কাহিনি। তারা প্রতিকূলতার মুখে পিছু হটেনি, আজ তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শক্তিতে বিশ্বসেরা জাতিগুলোর একটি। এই ইতিহাস আমাকে শিখিয়েছে, হতাশা নয়, সংগ্রামই জাতির বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
বাংলা প্রবাদে আছে- "যে নদী হারায় স্রোত, চলিতে না পারি সহস্র শৈবাল দম বাঁধিয়াছে তারে; যে জাতি জীর্ণশীর্ণ অচল অসার ,পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।" মেধাশূন্য জাতি হলো স্রোতহীন নদীর মতো, যেখানে জীবনের গতি থেমে যায়। তাই মেধা, অর্থ ও নৈতিক শক্তিসম্পন্ন মানুষদের এই ভূমিতে থাকা অত্যন্ত জরুরি। নতুবা সমাজে এক শূন্যতা তৈরি হবে, যা দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাবে।
আমাদের চারপাশে আমরা এমন কিছু সম্প্রদায় দেখেছি, যারা বিদেশে পালিয়ে গিয়ে ধ্বংসের পথে গেছে। বিপরীতে, ভারতে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেদের ভূমি আঁকড়ে ধরে সংগ্রাম করেছে, আর তাই তারা এখনো টিকে আছে। এদেশের বৌদ্ধ সমাজের ক্ষেত্রেও একই সত্য প্রযোজ্য।
আমরা গত ৫০ বছরে দেখেছি, বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজ, ধর্ম ,শিক্ষা, জ্ঞান, অর্থ ও সংস্কৃতিতে অভাবনীয় উন্নতি করেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে হতাশা ও সুযোগ হারানোর ভয়ে আমরা নিজেরাই আমাদের শক্তি হারিয়ে ফেলি। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে এ উন্নতির ধারা থমকে যাবে, এমনকি পিছিয়ে যাবে। তাই আমি মনে করি, আমাদের দায়িত্ব হলো শিক্ষা, অর্থনীতি ও মেধায় সমৃদ্ধ মানুষদের একত্রে, ঐক্যবদ্ধভাবে এই ভূমিতে থেকে সমাজকে রক্ষা করা। সংগ্রামের পথে অটল থেকে আমরা যেমন অতীতে টিকে ছিলাম, তেমনই ভবিষ্যতেও থাকতে পারবো। দেশকে ত্যাগ নয়, দেশকে ধারণই আমাদের সত্যিকার জয় এনে দেবে।
আমার এই ভাবনাগুলো এক ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র অনুভূতি, তবুও মনে করি, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। ভিন্ন মত, ভিন্ন চিন্তা, বিভিন্ন সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সত্য, একতা, ধর্ম অনুরাগের মাধ্যমে মৈত্রীময় সংগ্রামই টিকে থাকার শাশ্বত পথ।