
26/05/2025
রাত তখন ২টা ৩৫। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস #গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মনিটরিং কক্ষে নিস্তব্ধতা। কেবল কম্পিউটারের স্ক্রিনে জ্বলজ্বলে ফুটে ওঠা সিসিটিভি ফুটেজ আর ক্লিক ক্লিক শব্দ। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ রাজিবুল হাসান টানা আট ঘণ্টা ডিউটির পরেও চোখের পাতা ফেলতে পারছেন না। ক’দিন ধরেই একটি গোপন তথ্য মাথার ভেতর ঘুরছে—একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারী চক্র আজ রাতেই একটি বড় চালান আনবে।
তথ্যটা এসেছিলো একটি অজ্ঞাত উৎস থেকে। মোবাইলে আসা একটি এনক্রিপ্টেড বার্তা—“EK-582, কালো ট্রলি, মাঝবয়সী পুরুষ, সোনালী ছায়ার নিচে অন্ধকারের বিস্তার।” বার্তাটার শেষ লাইনটা যেন ধাঁধার মতো। কিন্তু রাজিবুল জানেন, এসব তথ্য সহজে আসে না, আর এলেও হেলাফেলা করা যায় না।
EK-582 ফ্লাইটটি অবতরণ করলো ঠিক ৩টা ০৫ মিনিটে। ইমিগ্রেশন পার হওয়া যাত্রীদের চোখ দিয়ে স্ক্যান করছিলেন রাজিবুল নিজে। হঠাৎ করেই নজরে এলো এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। খুব সাধারণ পোশাক, চোখে ক্লান্তি, তবুও হাঁটার ভঙ্গিতে যেন কিছু চাপা উত্তেজনা। কালো ট্রলিটা টানতে টানতে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
মনিটরে চোখ রেখে রাজিবুল সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশ দিলেন, “ওই ট্রলিটা স্ক্যান করাও, হাফিজ। মনোযোগ দিও নিচের বেস চেম্বারে।”
স্ক্যানার রুমে বসা হাফিজ দ্রুত স্ক্যান করলো। স্ক্রিনে দেখা গেল ট্রলির নিচে ঘন এবং ভারী ধাতব বস্তু। অসমান আকৃতি। ব্যাগটি সাইডে নিয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। রাজিবুলও রওনা দিলেন।
ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনার ব্যাগে কি আছে, বলতে পারেন?”
সে থতমত খেয়ে গেল। মুখে জড়তা। “না মানে... জামাকাপড়... কিছু উপহার...”—তার গলায় কাঁপন। ব্যাগের নিচের চেম্বার কেটে বের করা হলো তিনটি মোটা সোনার বার, প্রত্যেকটি প্রায় ৭০০ গ্রাম। সঙ্গে কিছু হিরে বসানো গয়না। সব মিলিয়ে প্রায় ২ কেজি।
অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, তাকে এই ব্যাগটি কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে এক ব্যক্তি দিয়েছিলো, ঢাকায় একজন তাকে ফোন দিয়ে অ্যাড্রেস জানিয়ে দেবে। ওই ব্যক্তির নাম জানে না, কেবল একটা কোড—“সানশেড 71”।
“সানশেড 71”—এই শব্দটা মাথায় আটকে গেল রাজিবুলের। তিনি জানেন, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে এটি একটি ছদ্ম কোডনেম, যেটি পূর্ব এশিয়ার একটি মাফিয়া গ্রুপ ব্যবহার করে। এদের সঙ্গে কাজ করে কিছু আন্তর্জাতিক হ্যান্ডলার, আর স্থানীয় সাহায্যকারী। আগেও একবার এই কোড আসে, কিন্তু সে বার সব প্রমাণ ঘোলাটে ছিল।
রাজিবুল সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার আর শুধু বাহককে ধরে থেমে যাবেন না। পুরো জাল ভেদ করতে হবে। তিনি পরদিনই যোগাযোগ করলেন বাংলাদেশ পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (CID)-এর বিশেষ ইউনিটের সঙ্গে। সহকারী পুলিশ সুপার তানজিনা সিদ্দিকা তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এলেন।
তানজিনার কাছে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের ডেটা ছিলো। তিনি নিশ্চিত করলেন, “সানশেড 71” মূলত মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও হংকং-ভিত্তিক একটি চোরাচালান গ্রুপের কোড। তারা সাধারণত হিউম্যান কুরিয়ার ব্যবহার করে, আর মোবাইলের ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে কমিউনিকেশন চালায়। বাংলাদেশেও তাদের পক্ষে কাজ করছে এমন কেউ—কিন্তু তিনি কে?
তদন্তে ধীরে ধীরে একটি নতুন দিক খুলে যায়। রাজিবুল জানতে পারেন, গত তিন মাসে একই ফ্লাইট EK-582 দিয়ে ৬ বার সন্দেহজনক যাত্রী এসেছেন যাদের সবাই একই হোটেলে থেকেছেন—পুরনো ঢাকার গোপন একটি হোটেল, যার মালিক এক সাবেক বিমানবালা।
তদন্তে সেই হোটেলে গিয়ে পাওয়া গেল আরও অবাক করা তথ্য—প্রতিটি যাত্রীর ছবি তুলেছিলেন একজন ‘স্থানীয় গাইড’, যার নাম মাহফুজ। সে নিজেকে পর্যটকদের সাহায্যকারী বললেও, তার ফোনে পাওয়া গেল কয়েক ডজন এনক্রিপ্টেড বার্তা, যার বেশিরভাগই সেই অচেনা কোডে লেখা। তার একটিতে লেখা ছিল: “শুক্রবার, ৩ টা, ট্রলি ছায়ার নিচে, ALPHA-SHADOW।”
ALPHA-SHADOW শব্দটি আন্তর্জাতিক অপরাধ গোয়েন্দা ইউনিটকে সতর্ক করলো। কারণ এটি একটি বিশেষ মার্কিন তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছিলো—যেখানে বলা হয়েছিল, এশিয়ার কিছু রাষ্ট্রে মার্কিন ডলার ও সোনা চোরাচালানে এই কোড ব্যবহার করে একটি চক্র, যারা মূলত একটি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরের দুর্নীতিপরায়ণ সদস্যদের সাহায্যে পরিচালিত।
এবার তদন্তের থিমই পাল্টে যায়। এখানে শুধু চোরাচালান নয়, রয়েছে বড় ধরনের গোপন এজেন্ডা—অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করা, অবৈধ মুদ্রা প্রবাহ তৈরি করা এবং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে একধরনের হুমকির দেশ হিসেবে দাঁড় করানো।
রাজিবুল বুঝলেন, এটি কেবল বিমানবন্দর পর্যায়ে থেমে থাকবে না। তাই তিনি ও তানজিনা একটি ‘ডিকয় অপারেশন’ পরিকল্পনা করেন। এইবার তারা নিজেরাই তৈরি করলেন একটি কৃত্রিম ব্যাগ, যাতে রাখা ছিলো একটি GPS ট্র্যাকার ও শব্দগ্রাহী চিপ।
ঠিক নির্ধারিত সময়ে সেই ‘চালান’ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যায়। সেটি ধীরে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছায়—চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখান থেকে সিগন্যাল যায় সীমান্তের খুব কাছের একটি খামারবাড়িতে।
সেখানে রাতের আঁধারে অভিযান চালানো হয়। ধরা পড়ে আরও তিনজন বিদেশি নাগরিক—এবার চাইনিজ এবং থাই। তাদের ড্রোন, রেডিও কমিউনিকেশন সেট, এবং ভুয়া পাসপোর্ট সহ আটক করা হয়। সেখানে আরও পাওয়া যায় এক অদ্ভুত ম্যাপ, যেখানে বাংলাদেশের ভেতরের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ‘হট জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা।
তদন্তকারীরা বুঝতে পারলেন, এটি শুধু চোরাচালান নয়—এটি একটি অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি। একইসঙ্গে তারা মাদক ও অস্ত্র পাচারেরও পরিকল্পনা করছিল।
এরপর এক জার্মান NGO-এর আড়ালে ঢাকায় কাজ করা এক বিদেশির সন্ধান পাওয়া গেল, যিনি দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে ভুয়া জরিপ চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন। তার ল্যাপটপ থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণে উঠে আসে সেকেন্ডারি চ্যানেল—নতুন একটি প্ল্যান্ট বসানোর নামে বন্দরের কাছাকাছি এলাকায় এক গোপন ডিপো নির্মাণের কাজ চলছিল।
সব প্রমাণ একত্রিত করে রাজিবুল, তানজিনা ও একটি বিশেষ টাস্কফোর্স নিয়ে শেষবারের মতো অভিযান পরিচালনা করেন সেই গুদামে। সেখান থেকে উদ্ধার হয় ২৫ কেজির মতো স্বর্ণ, মিথ্যা নামের অধীনে রেজিস্টার করা কয়েকশ ফেক কোম্পানির দলিল, এবং সবচেয়ে অবাক করা জিনিস—একটি “গোল্ডেন ম্যাসেঞ্জার” নামের সফটওয়্যারের সার্ভার, যা দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক আর্থিক তথ্য হ্যাক করার চেষ্টা করছিল।
এর মধ্যেই রাজিবুলের হাতে আসে আরেকটি হুমকি—এইবার একটি চিঠি, হাতে লেখা, তাতে শুধু লেখা:
“তুমি জানো না তুমি কাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছ। পরবর্তী ছায়া, তোমার ছায়াতেই নেমে আসবে।”
চিঠির নিচে ইংরেজিতে লেখা—“Echo-37”। এটি একটি র্যাডিও সিগন্যাল কোড, যা মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যবহৃত হয়—অর্থাৎ পরবর্তী অপারেশন কেউ শুরু করছে। আর এটা যে থেমে যাবে না, সেটাও স্পষ্ট।
তবুও, রাজিবুল থামেননি। তথ্য সংরক্ষণ, সাক্ষ্য সংগ্রহ, এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ—সবই চালিয়ে গেলেন তিনি ও তাঁর টিম।
এই গোটা অভিযানটির কোড নাম রাখা হয়েছিল—“অপারেশন সোনালী ছায়া”।
সাংবাদিকরা যখন রাজিবুল হাসানকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ঝুঁকি কেন নিলেন? আপনি তো শুধু একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা।”
তিনি হেসে বলেছিলেন, “আমি কেবল আমার কর্তব্য করেছি। এ দেশের প্রতিটি সোনার কণা যেন বৈধভাবে আসে, সেটাই তো চেয়েছি।”
তানজিনা পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “সাহস থাকলেই ছায়া ভেদ করে আলো আনা যায়।”
এভাবেই একটি অদৃশ্য চক্র, একটি গোপন কোড, এবং কয়েকটি সাহসী মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে—একটি বড় আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র ভেঙে যায়। আর একটি বাক্য চিরতরে স্মরণীয় হয়ে থাকে:
“সোনালী ছায়া যতই গাঢ় হোক, সত্যের আলো একদিন তা ছিন্ন করবেই।”
উৎসর্গ :- প্রিয় সহকর্মী Rajibul Hasan Raziv ভাই কে ।
কার্টিসি : সাব্বির আহমেদ