26/01/2024
আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ কয়েকদিন ধরে একটা কথা ফিসফাস করছে যে আমি আমার স্বামীর হক আদায় পালন করছি না। নবনীর বাবা আর আমার বিছানা আলাদা। সে ছোট ছেলেকে নিয়ে ঘুমায়। আমি নবনীর ঘরে।
রোজ ভদ্রলোক অফিসে যাবার সময় ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি, লাঞ্চ রেডি করে দেই। রাতে সবার খাওয়া হয়ে গেলেও ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করি সে এলে একসাথে খাবো। ঝগড়া নাই,মনোমালিন্য নাই তবু আলাদা বিছানায় থাকার ব্যাপারটা প্রত্যেকের চোখে গিয়ে লাগছ।
ছোট জা টিপ্পনী কাটে। ননাশ বাড়িতে এসে ঝালাইপালাই করে গেলো,
-- 'তোদের ঝগড়া হয়েছে মিটিয়ে নে। বিছানা আলাদা করবি কেন? আমার ভাইএর কি এমন বয়স হয়েছে! বউয়ের কাছে আদর সোহাগ না পেলে অন্য নারীতে আসক্ত হবে। তখন তো আবার বলবি নে, আমার ভাইয়ের চরিত্র খারাপ।'
শ্বাশুড়ি মা তো একদিন ঘরে ঢেকে খুব বুঝালেন,
-- 'শোনো মা, স্বামী অসন্তুষ্ট থাকলে কোনো স্ত্রী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।'
সকাল পাঁচটায় ঘুম ভাঙে রাত এগারোটা বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সুযোগ হয়। শরীর, মন দুটোই ক্লান্ত থাকে একেবারেই ইচ্ছা করে না বাজে তর্ক করে শক্তি খরচ করতে।এক কান দিয়ে শুনে আরেকটা দিয়ে বের করে দেই। অবশ্য বিবাহিত জীবনে সুখী হতে হলে আপনাকে কথা হজম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে সুখী হওয়া যায় কি জানি না তবে সংসারে শান্তি থাকে।
তা যা বলছিলাম, ছেলেমেয়ের বাবারও কিন্তু বউকে ছেড়ে ঘুমানোর অভ্যাস নাই। এক সপ্তাহের জন্যে বাবার বাড়ি গেলে চারদিনের দিন ফোন করে বলে,
-- 'লাগেজ গুছাও। তোমাদের নিতে আসছি।'
একসময় খুব রাগ করতাম এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিয়ের ষোলো বছর পরও আসিফ ঘুমের ঘোরে বিছানা হাতড়ে আমায় খুঁজে। শারীরিক চাহিদার জন্যে নয় আসলে অভ্যাস। দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকতে থাকতে মনের অজান্তে একটা শরীরে পরিণত হয়। তখন একজনের অবর্তমানে অন্যজন ভীষণ অসহায় হয়ে পরে। অতএব আসিফেরও কষ্ট হচ্ছে। তবু দিন পনের আগে আসিফ অস্থির হয়ে বললো,
-- 'নীরা,ভাবতে পারছ আমাদের ছোট্ট নবনী প্রেম করছে!'
-- 'ভাবতে পারবো না কেন! নবনীর বয়স চৌদ্দ। কিশোরী বয়সে মেয়েদের আবেগ সবচেয়ে বেশি থাকে।'
আসিফ দুহাতে মুখ ঢাকলো।
-- 'সব আমার দোষ। আমি যদি তোমার কথা শুনে ওকে ফোন গিফ্ট না করতাম। মেয়েটা ওর জন্মদিনে একটা স্মার্টফোন উপহার চাইছে। আমি কি করে না করতাম বলো?'
-- 'ছেলেটার খোঁজ নিয়েছো?'
-- 'হুম। ক্লাস সিক্সে উঠার পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে। মোটর মেকানিক। বয়স বিশ-বাইশ।দেশের বাড়ি পাবনা.. '
-- 'আহা! এতকিছু কে জানতে চেয়েছি? চুপ করো।'
আসিফ রাগে ফেটে পরলো,
-- 'চুপ থাকব! তুমি কি বলছো নীরা? আমার মেয়ে জেএসসিতে ওদের স্কুলে টপার ছিল, শিক্ষকেরা আশাবাদী ও এসএসসিতে গোল্ডেন পাবে আর সেই মেয়ের পছন্দ মেকানিক। ছোকড়াটার গালে কষে দুইটা থাপ্পড় যদি না মারি... '
আসিফের হাত ধরলাম। ওর রাগ ভয়াবহ। ছেলেটার গায়ে হাত তুললে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।
-- 'তুমি কয়েকটা দিন টুটুলের সাথে ঘুমাও। আমি মেয়ের কাছে থাকব। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার মনে হয় ওকে কিছুদিন সময় দেওয়া দরকার।'
মেয়ের বাবাকে কিছু একটা বলে বুঝ দিয়েছি কিন্তু গত পনেরদিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মেয়েকে সামলানো এত সহজ নয়। এতো পড়াশোনা নয় যে পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করলে রুটিনমাফিক কয়েকঘণ্টা টেবিলে সময় দিয়ে অবস্থার উন্নতি ঘটাব।অথবা মেয়ের শরীর খারাপ, রাত জেগে ওর সেবা করবো,গল্পের বই পড়ে শোনাব। মন খারাপ হলে ঘুরতে নিয়ে যাব। এটা নবনী যাকে নয়মাস গর্ভে ধারণ করেছি, চৌদ্দ বছরের ওর হাড়-মাংসের বৃদ্ধি তিলে তিলে আমার যত্নে গড়া সেই মেয়েটা আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিনে বালিশ নিয়ে ঘুমাতে যাবার পর ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
-- 'আম্মু তুমি আমার ঘরে?'
-- 'হ্যা। আজ থেকে তোর সাথে কিছুদিন ঘুমাবো।'
-- 'কেন?'
-- 'তোর বাবা এসি ছাড়া ঘুমাতে পারে না। সর্দিতে আমার গলা বসে গেছে।'
-- 'কই তোমার গলা তো ঠিকই আছে।'
-- 'উহু! মাত্র লবঙ্গ দিয়ে রঙচা খেয়ে আসলাম তাই কিছুটা ভালো লাগছে।'
মেয়েকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছুক্ষণ খুকখুক করে আসলাম।তারপর বালিশ নিয়ে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে পরলাম। প্রথম কয়েকরাত কিছুই টের পেলাম না। পরিশ্রান্ত থাকি,মরার মত ঘুমাই।
তারপর একরাতে দেখি ফিসফিস করে কথা বলছে। স্তব্ধ হয়ে শুনছি আমারই মেয়ে কতটা দুঃসাহস হলে মা পাশে থাকা সত্ত্বেও বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। মা হলে বড় জ্বালা। সন্তানের সাথেও অভিনয় করতে হয়৷ ঘুমের ভান ধরে পাশ ফিরে মেয়ের উপর একটা হাত রাখলাম। আমি জেগে গেছি ভেবে দ্রুত ফোন কেটে দিল। রাতটুকু পাড় হল,মেয়ে ঘুমিয়ে গেল, আমার গোটারাত নির্ঘুম কাটলো।
যৌথ পরিবারের সন্তানেরা সাধারণত খুব মিশুক হয়।দাদা-দাদী, ফুপু, চাচা-চাচীর আদর পেয়ে হাসতে খেলতে বড় হয়। নবনীকেও সবাই খুব ভালোবাসে কিন্তু ও সম্পর্ক জড়ানোর পর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
এইটুকু একটা মেয়ে যার আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে গেছে।যেখানে বাবা-মায়ের প্রবেশ অনাধিকারচর্চা মাত্র।পরিবারের সবাই এটা খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করেছে আমি বরের সাথে ঘুমাচ্ছি না কিন্তু আমার মেয়েটা যে ঘর ছেড়ে খুব একটা বের হচ্ছে না। ছাদে উঠে না, বারান্দায় খাঁচার পাখিগুলোর সাথে কিচিরমিচির করছে না, পড়াশোনায় মন নাই তা কারো নজরেই পরছে না।
আমিও আগবাড়িয়ে কাউকে সমাধানের জন্য ডাকলাম না। আমাদের যুগে মেয়েরা প্রেম করলে বাপ দুটো চড় মারলে শান্ত হয়ে যেত। যুগ পাল্টেছে।।এখনকার যুগের ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্ববোধ প্রবল। এদের গায়ে আঘাত করা তো দূরের ব্যাপার তুই করলে বললেও ইগোতে লাগে।
নবনীর স্বভাব আরো চাপা। ও যদি এখনকার মেয়েদের মত রুপ সচেতন হত, সাজুগুজু করে টিকটক করতো বা ওর বয়সী ছেলেদের সাথে ফ্লাটিং করায় অভ্যস্ত থাকত তাহলে চিন্তার কিছু থাকত না।প্রেম আসত প্রেম চলে যেত ওর মনে প্রভাব ফেলত না।এযুগের প্রজন্ম কিন্তু এমন।
ওদের আবেগ ভেসে আসা পদ্মপাতার মতন। সামান্য ঢেউয়ে দূরে সরে যায়। হৃদয়ের গহীন ছুঁয়ে যেতে পারে না নবনী ব্যতিক্রম। অভিমানী,জেদী আর যেকোন সম্পর্কের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।তাই বলে একটা মেকানিক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে। নবনী পড়াশোনা করে গার্লস স্কুলে। কোচিং যে কয়েকজন ছেলের সাথে পরিচয় সবাই খুব টিপটপ,স্মার্ট। আমার শ্যামবর্ণ, সাধারণ চেহারার মেয়ে ওদের কাছে প্রশংসা পায় নাই। বর্ণচোরা, নরম স্বভাবের মেয়ে মিশতে জানে না। বন্ধুত্ব গড়ে উঠে নাই।
ফোন কিনে দেবার পর পরিচয় গড়ে উঠেছে একটা অজানা অচেনা মেকানিক ছেলের সাথে। ছেলেটার পড়াশোনা কতদূর, কি করে তা ওরকাছে বিষয়বস্তু নয় প্রধান কথা হচ্ছে ওই ছেলেটা ওর জীবনে প্রথম পুরুষ। কিন্তু এই সম্পর্কের শেষ কোথায়?
(চলবে)...
গল্পঃ বাস্তুবতার আলকে
প্রথম পর্ব || ০১
নতুন পাঠ'কেরা গল্পের কোনো প'র্ব মি'স না করতে চাই'লে সা'থেই থাকুন ❤️