15/06/2025
৭নম্বর ফ্ল্যাট
পর্ব- ৫ (শেষ): শেষবারের মতো দরজা খোলা
রাশেদের হাতে এখন সব প্রমাণ। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই—সাফওয়ান আসলে তানভীর।
আর এই তানভীর, এক সময়ে আনিলার স্বামী ছিল। হঠাৎ করে পাঁচ বছর আগে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কেউ জানত না সে কোথায় গেছে। কেউ জানতে পারেনি কেন সে উধাও হলো।
এবং আজ, এত বছর পর, অন্য নামে সে ফিরে এসেছে সেই পুরোনো ফ্ল্যাটে—৭ নম্বর ফ্ল্যাটে।
রাশেদ তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছে:
“এই মানুষটা ভালোবাসার নামে যা করেছে, সেটা শুধু অপরাধ নয়—একটা অসুস্থ মন মানসিকতার ফল। তার কাছে ভালোবাসা মানে অধিকার, মানে বন্দিত্ব। সে নিজেকে ঈশ্বর ভাবে, আর আনিলা—শুধু একটা সম্পত্তি।”
তানভীরের অতীত জীবন ঘেঁটে দেখা গেছে, শৈশবেই বাবার কাছ থেকে সহিংস ব্যবহার পেয়েছে। তার মাকে মারধর করতে দেখেছে। সেই ঘরেই বড় হয়েছে, যেখানে ভালোবাসা মানে ছিল শ্বাসরোধ। তাই যখন সে আনিলাকে পেল, সে ভাবল, এবার ভালোবাসা তাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না।
আর যদি যায়—তবে তাকে ধরে রাখতে হবে, যেভাবেই হোক।
ভালোবাসার নামে বন্দিত্ব
তানভীর বিয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে আনিলাকে বন্ধুদের থেকে, পরিবারের থেকে, এমনকি চাকরির জায়গা থেকেও আলাদা করে দিয়েছিল।
প্রথমে ভালোবাসার অজুহাতে, পরে সন্দেহ আর গালিগালাজে।
এক পর্যায়ে সে আনিলাকে নিজের ফ্ল্যাটেই বন্দি করে রাখতে শুরু করে। বন্ধ দরজা, বন্ধ জানালা, বন্ধ মোবাইল।
একদিন আনিলা পালাতে চেয়েছিল। সেই রাতে, তানভীর প্রথমবারের মতো মারধর করে। তারপরই সে নিখোঁজ হয়—বলে যায়নি কোথায় গেল। আসলে, সেদিন রাতেই সে আনিলাকে অজ্ঞান করে কোথাও সরিয়ে ফেলেছিল।
পাঁচ বছরের অন্ধকার
রাশেদের প্রশ্ন—যদি এখন আনিলা এই ফ্ল্যাটের বেসমেন্টে বন্দি থাকে, তবে গত পাঁচ বছর কোথায় ছিল?
তদন্তে জানা যায়, তানভীর তার এক বন্ধুর পুরনো পাহাড়ি কটেজে ছিল এই সময়।
সেই বন্ধুটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় কটেজ ছেড়ে দেয়, আর তানভীর সেই সুযোগে পাহাড়ের মাঝে থাকা জায়গাটিকে ব্যবহার করে তার ‘নতুন সংসার’ গড়েছিল।
সেখানে ছিল না মোবাইল নেটওয়ার্ক, না কোনো প্রতিবেশী।
আনিলাকে সে সেখানেই রেখেছিল—প্রথমে অনেক যত্নে, পরে ভয় আর মানসিক নির্যাতনের ঘেরাটোপে।
কিন্তু কটেজে এক ভয়াবহ আগুন লাগে—সেখানে থাকাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—ফিরে যাবে ঢাকায়, নিজের পুরনো বাসায়। নতুন পরিচয়ে, নতুন মুখে।
ফ্ল্যাটের রাত ৩টার রহস্য
৭ নম্বর ফ্ল্যাটে এক অদ্ভুত বিষয় ছিল।
প্রতিবেশীরা বারবার বলেছে—রাত ৩টার সময় নাকি ওখান থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যেত।
কখনো রান্নার গন্ধ, কখনো হাঁটার আওয়াজ। অথচ ওই ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না—বা থাকলেও, সেটা কখনো নিশ্চিত নয়।
রাশেদ বিষয়টা বুঝতে পারে যখন বেসমেন্ট থেকে উদ্ধার হয় এক পুরনো ক্যামেরা।
সেখানে ছিল কিছু ভিডিও—যেখানে দেখা যাচ্ছে, আনিলা একা বসে আছে অন্ধকার ঘরে। সে কখনো কথা বলছে নিজে নিজে, কখনো কাঁদছে। কখনো একটি কল্পিত বাচ্চার সঙ্গে কথা বলছে।
এই ভিডিও থেকেই রাশেদ নিশ্চিত হয়—এই ফ্ল্যাটে ‘বাচ্চার কান্না’ কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা নয়।
বরং এটি মানসিক বিকারের ফল। আনিলা, দিনের পর দিন বন্দিত্বে থেকে, নিজের এক কাল্পনিক সন্তান সৃষ্টি করেছে—আর তার কান্না যেন প্রকৃত বাস্তব হয়ে উঠেছে দেয়ালের ওপারে।যার আওয়াজ আসলে ছিল এক বন্দি নারীর আত্মা ভাঙার শব্দ।
থানা প্রেসার দিচ্ছে
ফ্ল্যাটের বেজমেন্টে পাওয়া ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে কিছু ভয়ংকর ভিডিও পাওয়া গেছে।সেই ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা গেছে—ডেলিভারি বয় নিহাল ভয়ে কাঁপছে, বাঁচার জন্য কাকুতি করছে, আর তানভীরের কণ্ঠে বরফঠাণ্ডা এক বাক্য—
“যে বেশি জানে, সে বাঁচে না।”
ভিডিওর শেষ অংশে এক বিকট চিৎকার, তারপর অন্ধকার।
ভিডিওর পাশেই, বেজমেন্টের একটা কংক্রিটের দেয়ালে হালকা ফাটল ছিল।
পুলিশ ভেঙে দেখে — পলিথিনে মোড়ানো একটা মৃতদেহ, মুখ চেনার মতো অবশিষ্ট কিছু নেই।
তবু পোশাক, ঘড়ি আর সাথে থাকা ফোন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় — এটাই ডেলিভারি বয় নিহাল।
রাশেদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মনে মনে বলে—
“ও শুধু ভুল জায়গায় গিয়েছিল, ভুল দরজায় কড়া নেড়েছিল।”
নিহাল আর জীবিত নেই—এটা এখন নিশ্চিত।
রাশেদের নোটে লেখা ছিল...
“তানভীর ভিডিও করতো, কারণ ও চেয়েছিল নিজের ‘ভালোবাসা’কে প্রমাণ রাখতে।
ও বিশ্বাস করতো, সে যা করছে, তা একদিন সবাই বুঝবে—যেন ও কাউকে ফেলে দেয়নি, বরং নিজের মতো করে ভালোবেসেছিল।
এই ভিডিওগুলো আসলে ছিল—একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের নিজস্ব প্রেমের ডায়েরি।
যেখানে কান্না ছিল ‘প্রমাণ’, বন্দিত্ব ছিল ‘ভালোবাসা’, আর খুন ছিল ‘অধিকারের শেষ সীমা’।
তানভীর শুধু ভালোবাসেনি, সে ভালোবাসাকে বন্দি করে রাখতে চেয়েছিল — ক্যামেরার ফ্রেমে, দেয়ালের ভিতরে, একটা বন্ধ ফ্ল্যাটে।”
সবার চোখ এখন তানভীরকে ধরার দিকে।
হঠাৎ ফোন আসে
রাশেদকে ফোন করে একজন ইমাম সাহেব।
“এক লোক গতকাল রাতে এসে কান্না করতে করতে নামাজ পড়ে, তারপর বললো, সে কাউকে বাঁচাতে চায়। নাম বললো তানভীর।"
ইমাম সাহেব তানভীর এর মোবাইল নম্বর রাশেদকে দেন— +88017**69
রাশেদ ট্র্যাক করেন — লোকেশন দেখা দিচ্ছে শহর থেকে ২ ঘণ্টা দূরে এক পুরোনো পরিত্যক্ত ট্রেন স্টেশনে।
রাশেদ মনে মনে ভাবে,
“তানভীর হয়তো বুঝতে পারছে , নিজের কিছু আর ঠিক হবে না। কিন্তু আনিলার জন্য শেষবারের মতো কিছু ভালো করে যেতে চায়…
হয়তো তাই সে গিয়েছিল মসজিদে।
একটা পথ যেন কেউ খুঁজে পায়, ওর বিকৃত ভালোবাসার চক্র থামাতে।”
কিন্তু তার মানসিক বিকার তাকে শেষ অবধি আবার দখলে নেয়।
শেষ মুখোমুখি
রাশেদ ও পুলিশের একটি ছোট দল যায় সেই ট্রেন স্টেশনে।
ভোর হয়ে আসছে। কুয়াশা ঘিরে রেখেছে চারপাশ। প্ল্যাটফর্মের এক কোণে বসে আছে এক লোক। বড় দাড়ি, কালো কুর্তা, মাথায় হাত দিয়ে।
রাশেদ এগিয়ে যায়, বলে, “তানভীর, এবার চল। খেলা অনেক হয়েছে।”
তানভীর ধীরে তাকায়, হালকা হাসে।
“আনিলা কেমন আছে এখন? সে কি এখনো আমায় খোঁজে?”
রাশেদ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“সে তোকে ভয় পায়, তানভীর। ভালোবাসে না। তাকে তুই কষ্ট ছাড়া কিছু দিসনি।”
তানভীর চিৎকার করে উঠে—
“মিথ্যে! ও বলেছিল, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না! আমি ওর জন্য সব কিছু করেছি!”
রাশেদ ধীরে বলে,
“তুই যাকে ভালোবাসা বলিস, সেটা শুধু নিয়ন্ত্রণ। তুই একটা মানুষকে নিজের বাসনা অনুযায়ী তৈরি করতে চেয়েছিস। ওটা ভালোবাসা নয়, ওটা বন্দিত্ব।”
শেষ সিদ্ধান্ত
তানভীর পকেট থেকে বের করে ছোট একটি পিস্তল।
নিজের দিকে তাক করে, বলে,
“আনিলাকে আমি শেষবারের মতো ভালোবাসি। আমি ওকে আর কোনো দিন কষ্ট দেব না।”
পুলিশ এগিয়ে আসে। রাশেদ চিৎকার করে, “তানভীর, থাম! কিছু করার আগে ভাব!”
কিন্তু খুব দেরি হয়ে গেছে।
‘ঠাস্’ — গুলির শব্দ প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে দেয়।
তানভীর পড়ে থাকে নিজের রক্তে ভেজা, মুখে এক অদ্ভুত শান্তির ছায়া।
৭ নম্বর ফ্ল্যাট — চিরতরে বন্ধ
তানভীরের মৃত্যুর পর, ৭ নম্বর ফ্ল্যাট আর কখনো ভাড়া দেওয়া হয়নি।
বাড়িওয়ালা নিজেই তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
লোকমুখে ছড়িয়েছে—রাত গভীর হলে, এখনো ওই ফ্ল্যাটের দেয়ালের পেছন থেকে এক নারীর গলা শোনা যায়।
“তানভীর… দরজাটা খোলো…”
আনিলার মুক্তি
আনিলাকে উদ্ধার করে পাঠানো হয় মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
প্রথম দিকে কথা বলতে পারত না।
তার চোখে ছিল ভয়, মুখে ছিল নিশ্চুপতা।
তবে সময়ের সাথে সে আবার কথা বলতে শুরু করে, ধীরে ধীরে সাহস খুঁজে পায়।
সে এখন জানে—সে বন্দি ছিল না ভালোবাসায়, সে বন্দি ছিল এক অসুস্থ মানসিকতার মাঝে।
রাশেদের শেষ নোট
ফাইল বন্ধ করার আগে রাশেদ লিখে রাখে তার রিপোর্টে:
“৭ নম্বর ফ্ল্যাটে যতবার দরজা খোলা হয়েছে, ততবার কেউ একজন হেরে গেছে।
কেউ বাঁচতে চেয়েছে, কেউ বাঁচাতে চেয়েছে, আর কেউ শুধু নিজের জগতটাকে জোর করে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে।
কিন্তু এবার দরজা বন্ধ হলো—চিরতরে।
একজন মুক্ত, একজন মৃত।
আর ভালোবাসা?
সেটা হয়তো এবার সত্যি বুঝলো, আসল অর্থ কী।”
শেষ কথা:
এটা কোনো ভূতের গল্প নয়। এটা এক বিকৃত ভালোবাসার গল্প—যা মানসিক রোগকে অস্বীকার করে, ভালোবাসার নামে শ্বাসরোধ করে।
আর সেই চেপে রাখা ভালোবাসা, একদিন ঠিকই রক্ত ঝরায়।
( সমাপ্ত)
“৭ নম্বর ফ্ল্যাট” শেষ হলো আজ।
গল্পটা কেমন লাগলো? কমেন্টে জানাও—ভালোবাসা কি সবসময় মুক্তি দেয়, নাকি শ্বাসরোধ করে?
শেয়ার করো, যদি মনে হয়, এই গল্পটা অন্য কারও চোখ খুলে দিতে পারে।
এমন আরও হরর-মিস্ট্রি-মানবিক গল্প।
যারা যারা গল্প পছন্দ করেন পেইজে একটিভ থাকবেন।
সামনে আসছে আরো মজার মজার গল্প। #কিচেনক্রিয়েটিভিতে #৭নম্বরফ্ল্যাট #রহস্য