29/07/2025
প্রতীকী মূল্যে ফৌজদারহাট জলিল টেক্সটাইলের ৫৪.৯৯ একর জমি পাচ্ছে সেনাবাহিনী
চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (বিওএফ) বা বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা সম্প্রসারণের জন্য ১৭ কোটি টাকার বিনিময়ে বন্ধ থাকা চট্টগ্রামের জলিল টেক্সটাইল মিলসের ৫৪ দশমিক ৯৯ একর জমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলের নিয়ন্ত্রণাধীন টেক্সটাইল মিলটি চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকায় অবস্থিত।
টেক্সটাইল মিলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠকে অনুমোদন পেলে জলিল টেক্সটাইল মিলসের ৫৪ দশমিক ৯৯ একর জমি প্রতীকী মূল্যে বিওএফ-কে দেওয়া হবে। প্রতীকী মূল্য হিসেবে ১৭ কোটি ৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা (কম/বেশি) বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনকে (বিটিএমসি) দেওয়া হবে। বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার পক্ষ থেকে এ অর্থ দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর সেনাসদরের কিউএমজি শাখা বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি সম্প্রসারণের জন্য জলিল টেক্সটাইল মিলসটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠায়।
এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের জন্য গত বছরের জুনে বিশেষজ্ঞ দলসহ সেনাপ্রধান মিলটি পরিদর্শন করেন। মিলটি চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হওয়ায় এবং নিকটবর্তী সীমান্ত থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় মিলের জমিতে বিওএফের সম্প্রসারিত শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য ৫৪ দশমিক ৯৯ একর জমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনুকূলে দেওয়ার বিষয়ে সেনাবাহিনী প্রধান প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা ও মৌখিক সম্মতি নিয়েছেন।
এছাড়াও মিলের জমিসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, যাবতীয় পাওনা, আইনগত এবং অন্যান্য বিষয়াদি নিরসন করে প্রতীকী মূল্যে সেনাবাহিনীর অনুকূলে হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বলেও চিঠিত উল্লেখ করা হয়।
বিটিএমসির হিসাব অনুযায়ী, জলিল টেক্সটাইল মিলসের কাছে ইউটিলিটি বিলসহ অনেক টাকা পাওনা আছে। এসব পাওনা পরিশোধ ছাড়া সেনাবাহিনী যে উদ্দেশে মিলটি চাচ্ছে, সে কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। এছাড়া, হস্তান্তর চুক্তি অনুযায়ী সরকারি পাওনা এবং ২০২০-২১ সালের অডিট হিসাব অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে মিলের ৫৪ দশমিক ৯৯ একর জমির মধ্যে ৪৬ দশমিক ৯৩ একর জমির মৌজা মূল্য ৬০ কোটি ৯৭ লাখ ৮৩ হাজার ৯৬৫ টাকা এবং ৮ দশমিক ০৬ একর জমির (আবাসিক) মৌজা মূল্য ৫০ কোটি ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯০ টাকা।
জানা গেছে, ব্যক্তি মালিকানায় ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার ফৌজদারহাট এলাকায় মেসার্স জলিল টেক্সটাইল মিলস স্থাপন করা হয়। মিলসটির জমির পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৯৯ একর। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করার পর উইভিং এবং ডাইং বিভাগ স্থাপনের মাধ্যমে মানসম্মত উৎপাদনের জন্য তিনবার স্বর্ণপদক লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি।
লাভজনকভাবে পরিচালিত মিলটি বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতিমালার আওতায় ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মিলের সাবেক শেয়ার হোল্ডারদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মালিকপক্ষের মধ্যে অন্তর্কলহের কারণে ১৯৯৭ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে তৎকালীন সরকার দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মিলটি অধিগ্রহণ করে। ওই দিন সরকার মিলের সাবেক ৪০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার সেলিম চৌধুরী গংদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে মিলটি হস্তান্তর করে।
সেলিম চৌধুরী গং মাত্র ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা দিয়ে মিলটি অধিগ্রহণের পর হস্তান্তর চুক্তির ৩ নম্বর শর্তানুযায়ী সরকারি পাওনা ৪ নম্বর শর্তানুযায়ী ৬০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ ৫ ও ৬ নম্বর শর্তানুযায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ, ৮ নম্বর শর্তানুযায়ী ২০০০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে মিল চালু, ১০ নম্বর শর্তানুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়, বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়ে পরিচালনা পর্যষদ না করে চুক্তির সব শর্তই লঙ্ঘন করে।
সুচতুরভাবে মালিকপক্ষ ২০০০ সালের শেষের দিকে নামমাত্র একটি ইউনিট চালু করে পরবর্তী সময়ে শ্রম আইন বহির্ভূতভাবে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনিটটিও বন্ধ করে দেয়।
এ অবস্থায় ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় মালিকপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৬ মাসের মধ্যে মালিকপক্ষ মিল চালু না করলে হস্তান্তর চুক্তির ১৬ নম্বর শর্তানুযায়ী সরকার মিলটি অধিগ্রহণ করার ঘোষণা দেয়।
মালিকপক্ষ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ২০০৫ সালের ২০ নভেম্বর সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিলটি বন্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি জলিল টেক্সটাইল মিলস পুনঃগ্রহণ করে সরকার এবং মিলসটি বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়।
জলিল টেক্সটাইল মিলস্ পুনঃগ্রহণ আদেশের বিরুদ্ধে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সেলিম চৌধুরী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (নং-২৬৩০/২০১৭) দায়ের করেন। এ মামলাটি দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ এবং বিচারপতি ফয়েজ আহমেদের দ্বৈত বেঞ্চ চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি সেটি ডিসচার্জ করেন অর্থাৎ বিটিএমসির পক্ষে রায় হয়। এ বিষয়ে বিটিএমসির পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন।
পরবর্তীকালে আবদুস সেলিম চৌধুরী আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল (নং-২০৮৯/২০২৫) দায়ের করে। এ সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল আপিল বিভাগে গত ২৯ জুন শুনানি হয়। এক্ষেত্রে রিট পিটিশনটি ডিসমিস হয়েছে মর্মে সরকার পক্ষের আইনজীবী প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন।
জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল।
যোগাযোগ করা হলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমরাস্ত্র কারখানায় প্রধানত যুদ্ধসামগ্রী বানানো হয়। বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকার থেকে এটি (জলিল টেক্সটাইল মিলস) বিওএফকে দেওয়া হচ্ছে।