30/10/2025
বৌদ্ধ ধর্মে দেব-দেবীর মূর্তি কোথা হতে আসিলো..?
গুপ্ত উপাধিধারী প্রভাকর গুপ্ত একজন ভারি বিচারমল্ল ছিলেন। তিনি শুভাকর গুপ্তের মত প্রচার করিতেন, সর্ববাদী প্রমথনে শুভাকর সিংহস্বরূপ ছিলেন।( প্রভাকর গুপ্ত ও শুভাকর গুপ্ত ছিলেন গুপ্ত রাজবংশের রাজা, শাসনকাল ৬ষ্ট শতক)
ইহারা দুই জনে শুভাকর গুপ্তের দ্বারা একখানা বৌদ্ধদের স্মৃতির গ্রন্থ লেখান। তাহার কিয়দংশ পাওয়া গিয়াছে। কর উপাধিধারী অনেকেও #বৌদ্ধগ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। কয়েক জন তৈলিকপাদ বৌদ্ধধর্ম প্রচারে বিশেষ সহায়তা করিয়াছেন। বণিকদের তো কথাই নাই। ইঁহারাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আহারাদির ব্যবস্থা করিয়া দিতেন ও বিহারের অনেক খরচ চালাইতেন। তদ্ভিন্ন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিতেন, মঠ প্রতিষ্ঠা করিতেন ও পুস্তক লিখিয়া মঠকে দান করিতেন। ঐরূপে সকল জাতির লোকেই তখন বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন। মাছ মারিয়া খায় যে #কৈবর্ত সেও বাদ যায় নাই। #পাল_রাজারা তো বৌদ্ধ ছিলেনই। তাঁহাদের অধীন যত ছোটোছোটো রাজা ছিলেন তাঁহারাও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তবে মানতের বেলা তাঁহারা কোনো ধর্মই বাছিতেন না। রোগ শাস্তি, ভূত শান্তি, যুদ্ধে জয়-পরাজয় এই-সকলের জন্য সব রকমের দেবতার মানত করিতেন, #মহাভারতে'র পাঠ শুনিতেন, ব্রাহ্মণদের বাড়ি যজ্ঞে উপস্থিত থাকিতেন, হোমের ফোঁটা লইতেন, ব্রাহ্মণদিগকে ভূমিদান করিতেন, বিষ্ণু শিব প্রভৃতির মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতেন। অথচ তাঁহারা বৌদ্ধ ছিলেন।
কারণ, ঐ সঙ্গে সকালে উঠিয়া তাঁহারা 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি' 'ধর্মং শরণং গচ্ছামি' 'সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি' বলিতেন, সংঘ-ভোজন করাইতেন, সম্যক্ সম্ভোজন করাইতেন, স্তূপ নির্মাণ করাইতেন, বিহার নির্মাণ করাইতেন, বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করাইতেন এবং নানাবিধ বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করাইতেন।
#বৌদ্ধধর্ম_তো_শুধু_শীল_ও_বিনয়_লইয়া
তাহার মধ্যে দেবদেবীর মূর্তি কোথা হইতে আসিল...?
#ব্রহ্মদেশ, #সিংহল প্রভৃতি দেশে এখনো দেবদেবীর প্রাদুর্ভাব তত নাই(১৩৭০ বাংলা)।
কিন্তু বাংলায় খুব ছিল। যাহারা বাংলা হইতে বৌদ্ধধর্ম পাইয়াছেন তাঁহাদের মধ্যেও খুব আছে। যাঁহারা সিংহলের বৌদ্ধধর্ম দেখিয়া বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা করিয়াছেন তাঁহাদের দেবদেবীর কথা শুনিলে আশ্চর্য বোধ হইতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক মহাযান মতে অনেক দেবদেবী আসিয়া জুটিয়াছিলেন। #মহাযান মত'টা বড়োই দার্শনিক মত কিনা-একেবারে সাংখ্য ভাঙিয়া অদ্বয়বাদে উপস্থিত কিনা-তাই উহাতেই দেবদেবী সকলেরা, আগেই আসিয়া জুটিলেন।
বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ-মহাযান মতে এই তিনটি জিনিস সূক্ষ্ম হইয়া দাঁড়াইল প্রজ্ঞা, উপায় ও বোধিসত্ত্ব।
বুদ্ধ হইলেন- উপায়,
ধর্ম হইলেন-প্রজ্ঞা,
সংঘ হইলেন- বোধিসত্ত্ব,
দেখিতে দেখিতে প্রজ্ঞা ঠাকুরাণী বুদ্ধের শক্তি হইয়া দাঁড়াইলেন; কারণ, উপায় পুংলিঙ্গ এবং প্রজ্ঞা স্ত্রীলিঙ্গ। উভয়ের সংযোগে বোধিসত্ত্বের উৎপত্তি হইল।
প্রজ্ঞা নিষ্কাম নিষ্ক্রিয়, উপায়ও নিষ্কাম নিষ্ক্রিয়, সুতরাং সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চলে না। বুদ্ধ ও ধর্মের অপেক্ষা বোধিসত্ত্বের পূজা বেশি বেশি হইতে লাগিল। কারণ, নিষ্কাম নিষ্ক্রিয়ের উপাসনা করিয়া কী হইবে..?
সুতরাং সকাম সক্রিয় শক্তির উপাসনা হইতে লাগিল-অনেকগুলি বোধিসত্ত্ব ঠাকুর হইয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাদের মধ্যে #অবলোকিতেশ্বর প্রধান। বর্তমান কল্পের ধ্যানী বুদ্ধ #অমিতাভ ও তাঁহার শক্তি পাগুরা ইঁহাদের দুই জনের সংযোগে উৎপন্ন অবলোকিতেশ্বর- বর্তমান কল্পের প্রধান দেবতা।
তাঁহার অনেক মূর্তি, অনেক মস্তক, অনেক হস্ত, অনেক পদ, অনেক নাম, অনেক মন্দির। তাঁহার ভক্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। কারণ এই কল্পে কাহাকেও বুদ্ধ হইতে হইলে তাঁহার কৃপা ভিন্ন হইবার জো নাই। যাহা হউক, বুদ্ধাদির মূর্তিপূজা প্রচলিত হইবার সময় একটা বড়ো মুশকিল হইল-কারণ, এখন হইতে শক্তির সহিত জড়িত বুদ্ধমূর্তির উপাসনা আরম্ভ হইল। সুতরাং আমরা অর্থাৎ অভক্তেরা যাহাকে অশ্লীল বলি, সেই অশ্লীল মূর্তি সমূহেরও পূজা হইতে লাগিল।
ঐ মূর্তির যে কত বিচিত্র ভঙ্গি আছে তাহা এখনকার লোকে কল্পনা করিতেই পারে না। অনেকে ইহাকে বলেন। তন্ত্রে শিবশক্তি পূজা, যুগলাদ্য মূর্তির উপাসনা-এখানেও বুদ্ধ ও তাঁহার শক্তি পূজা, যুগলাদ্য মূর্তির উপাসনা। সুতরাং এই উপাসনারও নাম হইল #তান্ত্রিক_বৌদ্ধোপাসনা। বৌদ্ধধর্মে গোড়ায় যে কঠোরতা, কাঠিন্য ছিল এখন তাহা বেশ সরস হইয়া উঠিল। উহাতে লোকেরও মন ভিজিল। লোকে সহজে নির্বাণের পথ পাইল-ইহারই নাম #সহজিয়া_ধর্ম।
সহজিয়া ধর্মের অর্থ ভগবান বুদ্ধ যখন সহজ ভাবে থাকেন। যখন তিনি শক্তির সহিত মিলিত, অথচ শক্তির সন্তান-সম্ভাবনা উপস্থিত হয় নাই। এই সময় ভগবানের কাছে যাহা বর চাওয়া যায় তাহাই পাওয়া যায়। এই সময়েই তাঁহার করুণার পরমা স্ফুর্তি। সুতরাং ভক্তের পক্ষেও উপাসনার এই প্রশস্ত সময়। এই যে সরস মধুর ভাব, ইহা ক্রমে অন্য অন্য ধর্মেও ছড়াইয়া পড়িল। বৈষ্ণবের
যুগল মিলনও এই সহজরূপেরই রূপান্তর মাত্র; তবে বৈষ্ণবের সহজিয়া ও বৌদ্ধের সহজিয়া মতে একটু তফাত আছে। বৌদ্ধের সহজিয়া সম্পূর্ণভাবেই রূপক, এবং ঐ রূপক আপনাকে দিয়াও ফলাইতে পারা যায়। কিন্তু #বৈষ্ণবের সহজিয়া ঠাকুর-ঠাকুরাণীর সহজিয়া-তাহাতে একটু ভক্তিরস থাকে। নিজের দেহের উপর উহার চলে না।
★এই যে দেশব্যাপী বৌদ্ধধর্ম, ইহা এখন কোথায় গেল...?
যখন সহজিয়া ধর্মের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাবে বাঙালি একেবারে অকর্মণ্য ও নির্বীর্য হইয়া গিয়াছিল, ঠিক সেই সময় আফগানিস্তানের খিলিজিরা আসিয়া উহাদের সমস্ত বিহার ভাঙিয়া দিল-দেবমূর্তি, বিশেষত যুগলাদ্য মূর্তি চূর্ণ করিয়া দিল-সহস্র সহস্র নেড়া ভিক্ষুর প্রাণনাশ করিল। বড়ো বড়ো বিহারে যে-সকল যথার্থ পণ্ডিত ও সাধু ছিলেন তাঁহারাও ঐ সঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন-তাঁহারাই ঐ ধর্মের অস্থি ও মজ্জাস্বরূপ ছিলেন। অস্থি ও মজ্জার নাশ হইলে দেহেরও নাশ হয়, সেইরূপ তাঁহাদের মৃত্যুতে সহজিয়া বৌদ্ধধর্মেরও নাশ হইল।
#মুসলমান বিজয়ের এক বা দুই পুরুষ পূর্বে বল্লালসেন রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের সেন্সাস লইয়াছিলেন। সাড়ে তিন শত ঘর রাঢ়ী ও সাড়ে চারি শত ঘর বারেন্দ্র হইয়াছিল। ইহার উপর কিছু সাতশতী, কিছু পাশ্চাত্য ও কিছু দাক্ষিণাত্য ছিল। সুতরাং ব্রাহ্মণসংখ্যা তখন সবসুদ্ধ দুই হাজার ঘরের অধিক ছিল বলিয়া বোধ হয় না। এতদিন ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের সহিত ঘোরতর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। কখনো তাঁহারা হঠিতেন, কখনো বা ইঁহারা হঠিতেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ প্রণীত বহু-সংখ্যক দার্শনিক পুস্তকে এই ঘোরতর বিচারের নিদর্শন পাওয়া যায়। মুসলমান বিজয়ে বৌদ্ধ-মন্দিরের ও বৌদ্ধ-দর্শনের একেবারে সর্বনাশ হইয়া গেল। উহাতে ব্রাহ্মণদের প্রভাব বৃদ্ধি হইল বটে কিন্তু বৌদ্ধের বদলে এখন মুসলমান মৌলবি ও ফকির তাহাদের প্রবল বিরোধী হইয়া উঠিল। সুতরাং দেশের যেখানে যাহার জোর বেশি সেখানে তাহার আধিপত্য বিস্তৃত হইয়া পড়িল। ঐরূপে বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেল এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরণাগত হইল আর বৌদ্ধদিগের মধ্যে যাহারা তখন নিজের পায়ে দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল-মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হইতেই তখন তাহাদের উপর নির্যাতন উপস্থিত হইল। ব্রাহ্মণেরা তাহাদিগকে অনাচরণীয় করিয়া দিলেন অর্থাৎ অসভ্য বাগদি, কৈবর্ত, কিরাতের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন-আর মুসলমানেরা তাহাদের উপর নানারূপ দৌরাত্ম্য করিতে লাগিল। কিন্তু এই ধর্মপ্রচার ব্যাপারে ব্রাহ্মণদের একটু বাহাদুরি দিতে হয়। তাঁহারা বাংলার রাজশক্তির সাহায্য প্রায়ই পান নাই, তথাপি পাঁচটি মাত্র প্রাণী আসিয়া অর্ধেক দেশটাকে যে অল্পকালের মধ্যে হিন্দু করিয়া ফেলিয়াছিলেন ইহা অল্প বাহাদুরির কাজ নয়।
বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবকালে যাহারা অনাচরণীয় ছিল এবং মুসলমানাধিকারের পরে নূতন সমাজে যাহারা অনাচরণীয় হইল-বৌদ্ধধর্ম শেষে তাহাদের মধ্যে নিবদ্ধ হইয়া পড়িল এবং তাহারা ক্রমে প্রজ্ঞা, উপায় ও বোধিসত্ত্ব ভুলিয়া গেল।
#শূন্যবাদ, #বিজ্ঞানবাদ, #করুণাবাদ ভুলিয়া গেল; দর্শন ভুলিয়া গেল। শীল বিনয় ভুলিয়া গেল। তখন রহিল জনকতক মূর্খ ভিক্ষু অথবা ভিক্ষু নামধারী বিবাহিত পুরোহিত। তাহারা আপনার মতো করিয়া বৌদ্ধধর্ম গড়িয়া লইল। তাহারা কুর্মরূপী এক ধর্মঠাকুর বাহির করিল। এই যে কূর্মরূপ ইহা আর-কিছু নহে, স্তূপের আকার। কুর্মের যেমন চারিটি পা ও গলা-এই পাঁচটা অঙ্গ থাকে, স্তূপেরও তেমনি পাঁচটা অঙ্গ থাকিত। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারিদিকে চারিটি ধ্যানীবুদ্ধ থাকিতেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আর-একটি #ধ্যানীবুদ্ধ থাকিতেন-এইরূপে স্তূপটি পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের আবাসস্থান হইয়া ধর্মের সাক্ষাৎ মূর্তিরূপে পরিগণিত হইত। সুতরাং কূর্মরূপী ধর্ম ও স্তূপরূপী ধর্ম একই। পঞ্চ বুদ্ধের প্রত্যেকের যেমন একটি করিয়া শক্তি ছিল, ধর্মঠাকুরেরও তেমন একটি শক্তি হইলেন, তাঁহার নাম #কামিণ্যা। তিনি সব দেবতার বড়ো। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু, বরুণ, ভগবতী, বিশালাক্ষী, বাশুলি, কালী, গণেশ, রাজা, কোটাল, মন্ত্রী, এই-সকল ধর্মঠাকুরের আবরণ দেবতা। ধর্মঠাকুর আজও যে বাঁচিয়া আছেন, সে কেবল মানতের জোরে।
নদীয়ার উত্তর জামালপুরের ধর্মঠাকুরের মন্দিরে বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে বারো শত পাঁঠা পড়ে। ধর্মঠাকুর প্রত্যেক স্থানেই কোনো-না-কোনো রোগের ঔষধ দেন। #সোঁয়াগাছির ধর্মঠাকুর পেটের অসুখের ঔষধ দেন। বৈঁচির নিকটে অচলরায় পিত্তফোটের ঔষধ দেন। তিনি অনাচরণীয় জাতির হাতে পূজা খাইতে ভালোবাসেন। তাঁহার সেবকেরা প্রায় ডোম, হাড়ি ইত্যাদি অনাচরণীয় জাতি। ধর্ম-মঙ্গলের কালুরায়কে লাউসেন যখন স্বর্গে নিতে চাহিলেন, কালুরায় (ডোম) তখন জিজ্ঞাসা করিল, সেখানে মদ ও শুয়রের মাংস পাওয়া যায় কিনা। লাউসেন বলিলেন, "না।” কালুরায় উহা শুনিয়া বলিল, "আমি যাইব না।” লাউসেন তখন কালু ডোমের উপর ধর্মঠাকুরের পূজার ভার দিয়া গেল। সেই অবধি ডোমেরা তাঁহার প্রধান পূজক।
বাংলা দেশে ইহাই বৌদ্ধ ধর্মের শেষ পরিণাম।
#মূল_লেখক: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী.
(বিশিষ্ট বাংলা ভাষাবিদ, পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ)
#সংকলক: ভিক্খু তিষ্যানন্দ,
অধ্যক্ষ- আধুনগর জ্ঞান বিকাশ বিহার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
#নির্বাণার্থী নির্বাণার্থী