Enjoy and Fresh Mind

Enjoy and Fresh Mind আনন্দ এবং মন ভাল করার পেইজ।

আমার বউ ইদানিং ভীষণ আনরোম্যান্টিক হয়ে গেছে।এই যেমন একটু আগে ও টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে উপুর হয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো। আমি ওর সামনে...
11/07/2024

আমার বউ ইদানিং ভীষণ আনরোম্যান্টিক হয়ে গেছে।

এই যেমন একটু আগে ও টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে উপুর হয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো। আমি ওর সামনের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে বললাম,
"মাননিয়া সহধর্মিনী,
বিনীত নিবেদন এই যে আমি আপনার সহিত চুমু খাইতে চাই।"

ও বইয়ে আগের পৃষ্টা উল্টে কী যেন একটা খুঁজতে খুঁজতে উত্তর দিলো, "উহু! আমার পিরিয়ড চলতেছে। যাও তো গিয়ে ঘুমাও!"

আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে গেলাম! চুমো খাবার সাথে এর সম্পর্ক কী?
আমি বুঝে উঠতে পারলাম না!

সেদিন মাঝরাতে ও কী যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে প্রচন্ড লাফিয়ে জেগে উঠলো! ভয়ে ওর গা কেঁপে ঘাম দিচ্ছিলো।

আমি ওর ভয়টা কাটানোর জন্য দ্রুত ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলাম।

ও এক ঝটকায় আমায় ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, "তোমার খালি এসব মতলব? সুযোগ পাইছো আর জড়িয়ে ধরা লাগবে। ঠিক না?"

আমি রোবটের মতন বসে রইলাম। ও ওপাশ ফিরে কোলবালিশ জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো!

আরেকদিন হয়েছে কী, রাতের বেলা ওর প্রচন্ড দই খেতে ইচ্ছে হলো। আমি মোটরসাইকেল নিয়ে সারা শহর ঘুরে এই মাঝরাতে দই কিনে আনলাম। ঘেমে নেয়ে একসের হয়ে গেলাম।

বাসায় ফিরে দেখি ও টেলিভিশনে কার্টুন চ্যানেল দেখছে। মাঝরাতে কিছু অদ্ভুত কার্টুন দেখায়। এগুলো দিনে চলে না।

ও দই এর হাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। গিয়ে প্রায় আধঘন্টা পর ফিরলো।

"দই খেলে না?"

"খেয়েছি তো!"

"সব খেয়ে ফেলেছো?"

"নাহ! অনেকটুকু খেয়েছি। বাকীটা ফ্রিজে রেখেছি।"

"আমায় দেবে না?"

"ওমা! খেতে তো চেয়েছি আমি! তোমায় কেন দেবো?"

আমি হাতমুখ ধুয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম। বউও একটু পর এলো। আমি বললাম, "তোমার কি এখন মন ভালো?"

ও একমুখ হাসি হেসে বললো, "খুব খুব খুব।"

আমিও হেসে বললাম, "তাইলে চুমু খাই?"

ও মুখ গোমরা করে বললো, "কাজ নাই? তোমায় আমি চিনি না? আমি এ শীতে সকাল সকাল স্নান করতে পারবো না। যাও, আজকে তুমি সোফায় ঘুমাবা।"

সেদিন অফিস থেকে ফিরেছি।
এত এত কাজ ছিলো, মনে হচ্ছিলো দেহের হাড়ের স্ক্রু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছিলাম না। টায়ার্ডনেস বুঝি এটাকেই বলে!

কোন রকমে স্নান করে, দু'টো খেয়ে চিৎ হয়ে শুয়েছি। বউ পাশে শুয়ে আমার বুকে মাথা রেখে চোখ পিটপিট করে বললো, "এই শুনো না..."

আমি রিস্ক নিলাম না।
বললাম, "প্লিজ, অন্য দিন। আজকে আমি দাঁড়াতেও পারবো না।"

আনরোমান্টিক বউ
পর্ব-১ |

বিদেশ থেকে আজ আমার স্বামীর লাশ এলো। স্তব্ধ আমিটা যখন প্রাণপ্রিয় স্বামীর চিরকালের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে চিৎকা...
11/07/2024

বিদেশ থেকে আজ আমার স্বামীর লাশ এলো। স্তব্ধ আমিটা যখন প্রাণপ্রিয় স্বামীর চিরকালের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম, ওমনিই আমারই স্বজনদের কথাগুলো আমার কানে এসে সুচারু তীরের মতো বিঁধতে লাগল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কান্নারা আর এলো না।

আমার ভাসুর আর জায়েরা মিলে তখন জমি-জমার হিসেব কষতে ব্যস্ত। খালা আমাকে চুপিসারে জানিয়ে গেল,
-“বার বার বলছিলাম, জামাইয়ের থেকে তার পাওনা সব লিখ্যা নিতে। নিছোস? নেস নাই। এখন কী করবি? শ্বশুরবাড়ি থেকে এক আনাও পাবি না। জন্ম দিছোস মাইয়া, সব তো তোর দেবর-ভাসুরদের নামে হইয়া যাইবে।”

এখন কী হিসেব কষার সময়? আমি এক হাতে আমার পাশ থেকে কুহুকে আগলে নিই। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে, ও বুঝতে পারছে না। বয়সই বা কত? সবে পাঁচ। ও শুধু বুঝতে পারছে, কিছু একটা ঘটেছে। যা ঘটেছে, তা ভালো কিছু নয়, তা মারাত্মক খারাপ।

আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই। যৌথ পরিবারের প্রায় অনেকটা খরচ আমার স্বামী বহন করত। তার মৃত্যুতে কেউ কষ্ট পাক বা না-পাক, টাকা-পয়সার চিন্তা করতে ভোলেনি। আমি আজ নতুন করে মানুষ চিনলাম। এরাই না বিদেশি পয়সার জন্য সব সময় আমায় মাথায় করে রাখত?

সারাটাদিন আমি আর কাঁদলাম না। চুপ হয়ে মেয়েকে নিয়ে মুহিবের নিথর শরীরটার পাশে বসে রইলাম। বিকেলে জানাজা হলো। বাড়িটা আস্তে-আস্তে খালি হচ্ছিল। আমি চুপ হয়ে বসার ঘরের এক কোণায় বসে বসে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব কষছিলাম যখন, প্রতিবেশীদের টুকিটাকি কথা ফের কানে এলো। একজন বলছে,
-“অল্পবয়সে বিধবা হইলো, এখন তো ঠিকই বেশ্যাপনা করে বেড়াবে।”

আরেকজন বলল,
-“মেয়েটার কথা ভাবছো? ওইটুকুন বাচ্চা! মা ভেগে যাবে আরেকটার সাথে, সব কষ্ট এসে পড়বে বাচ্চা মেয়েটার ওপর।”

আমি তাদের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কোত্থেকে যেন মা হুট করে এসে তাড়া দিতে লাগল আমাকে,
-“ওঠ, অনু। ব্যাগ গোছা। বাসায় যাবি আমার সাথে।”

একবাক্যে বলে দিলাম মাকে,
-“বাড়ির পরিস্থিতি তো দেখছই। সবটা ঠিক হোক? কুহুকে নিয়ে দু-চারদিনের জন্য বেড়াতে যাবনি, হুঁ? তুমি কি আজ যাবে না-কি থাকতে চাইছো?”

মা কিছু বলার আগে আমি আবার বলে উঠলাম,
-“মা, আজ বরং চলে যাও। কাল এসো। বাড়িতে অনেক মানুষ। জায়গা হবে না থাকার।”

মা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে অন্যপাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
-“এরা তোকে শান্তি দেবে না। বাঁচতে পারবি না।”

শক্ত চোখে তাকিয়ে সামান্য হাসলাম ভাগ্যকে পরিহাস করে,
-“ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে কীভাবে থাকি, বলো? মুহিব বেঁচে থাকতে আমাকে বেশিদিন বাপের বাড়ি থাকতে দিতে চাইত না। ও বার বার বলত, আমি যে ও-বাড়ি যাই, আমার ভাবি মনে মনে বিরক্ত হতে পারেন; হয়তো ভদ্রতার খাতিরে বলতে পারেন না। আচ্ছা মা? অন্যের বিরক্তির কারণ কেন হব?”

মা হয়তো আমাকে বুঝল। কিন্তু সেসব আরও কঠিন হয়ে বলল,
-“তোর বাপের বাড়ি আছে। তোর বাপের যতটুকু টাকা আছে, তুই আর কুহু তিনবেলা খেতে-পড়তে পারবি।”

অনড়ভাবে বললাম,
-“ওই টাকায় ভাইয়ার অধিকার। আমার সংসার আমি ছাড়ব না। মরলেও এখানেই মরব।”

মা দ্বিতীয়বার আর কিছু বলার সাহস পেল না। আস্তে-আস্তে আমার সংসারটা কেমন যেন হয়ে উঠতে লাগল। বড়ো জিদ করে তো বলেছিলাম, আমার সংসার আমি ছাড়ব না। কিন্তু..

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন চারটি দিন কাটল আমার। আমি ভেঙে পড়িনি। বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও, ভালোবাসায় আমাদের কোনো অংশেই কমতি ছিল না। তাই তো প্রতিবার দেশ ছাড়ার আগের রাতে আমি তার বুকে নির্ঘুম পড়ে থেকে ফোঁপাতাম। অসম্ভব ধৈর্যসম্পন্ন মুহিব আমাকে শান্ত করতে কত কী-ই না করত! ছেলেভোলানো সব কথা বলত। এক পর্যায়ে আমি বুঝদার বাচ্চাদের মতো কান্না থামিয়ে তার কথা শুনতে লাগলে, সে রসিকতা ছেড়ে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরত নিজের বুকে। তারপর বলত,

-“অনিন্দিতা, আগামীকাল এই সময়টায় আমি তোমার থেকে কয়েকশত কিলো দূরে থাকব। তখন চাইলেও তুমি আর রাগ দেখাতে পারবে না, চাইলেও গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে পারবে না। কেননা তখন আমি এভাবে বুকে জড়িয়ে তোমার মান ভাঙাব না। এভাবে টুকটাক আদরে তোমায় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে ভাবাব না। আগামীকাল মাঝরাতে যখন তোমার ঘুম ভাঙবে, তুমি অর্ধ অচেতনতায় বিছানা হাতড়ে আমায় খুঁজবে। বিনিময়ে এক বুক হাহাকার পাবে। আর কয়েক ঘন্টা আছি আমি। আমাকে নিয়ে তোমার পৃথিবীতে যত কথা আছে, আমাকে বলো। আমি শুনব। মৃত্যুর কাটা সেকেন্ডের চেয়েও দ্রুত এগোয়। আমি কাল যাব, এটা সত্য। দূরত্ব বাড়বে, সেটাও সত্য। অথচ দীর্ঘসময়ের এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে আমি আবারও তোমার কাছে ফিরব—এই কথাটা অসত্য প্রমাণ হতে সময়ের প্রয়োজন পড়বে না। প্রতিবছর অসংখ্য প্রবাসী লাশ হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরছে। আমি তোমায় গ্যারান্টি দিতে পারব না যে, নেক্সট লাশটা তোমার স্বামীর হবে না। ওদের স্ত্রী/সন্তানরা শেষ বিদায় জানাতে পারে না। অসংখ্য না বলা কথা থেকে যায় ওদের। অসংখ্য পরিকল্পিত ভবিষ্যৎকে অতীত বানিয়ে রেখে যায় ওরা। আমি তোমায় পরিকল্পনা করতে বারণ করি। আমি তোমায় শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ দিই। তাই প্রতিবার তুমি আমাকে বিদায় জানাবে, ঠিক যেমন ধরো আর এই বুকে আসতে পারবে না। অনিন্দিতা! আর কয়েক ঘন্টা আছে। আমাকে বিদায় জানাও।”

আমি তার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তারপর আস্তে-আস্তে মানিয়ে নিতে লাগলাম। প্রতি বিদায়ে তাকে আমি শেষবারের মতো বিদায় জানাতাম। তাকে নিয়ে যত ভাবনা-চিন্তা ছিল, যত রাগ-অভিমান ছিল, সব বলতাম। এই তো, পাঁচ মাস আগে যখন নিয়মমাফিক আবারও বিদায় জানানোর দিন, মুহিব আমার চুল আঁচড়ে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বলেছিল,
-“আমি না থাকলেও, তুমি নিজের খেয়াল রাখতে কার্পণ্য করবে না। নিজের যত্নে খামতি রাখবে না। খাওয়া-দাওয়ায় হেলা করবে না। কুহুকে অযথা বকাবকি করবে না। রাগ উঠলে কাগজে লিখবে, এরপর পানিতে ভিজিয়ে ফেলবে কাগজটা। দেখবে, ঠিক শান্তি লাগছে। জীবন আমাদের প্রতিপদে জীবিকার শিক্ষা দেয়। তুমি হতাশ হবে না, শিক্ষা নেবে, এগিয়ে যাবে। জীবনের প্রতিকূলে যেতে চেয়ো না, স্রোতের টানে ভেসে যাবে। অনুকূলে তাল মেলাতে থেকো। বিশ্বাস করো, জীবনকে একবার নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে শিখে গেলে, এর চেয়ে সুন্দর কিছু আর খুঁজে পাবে না। অনিন্দিতা, তুমি অত্যন্ত বুঝদার একজন মেয়ে। আমার কথাগুলোকে মনে রেখো সর্বদা।”

আমি মনে রেখেছি সেসব। ভুলিনি কিছুই। ভুলতে পারিনি। সেজন্যই এতখানি স্বাভাবিক সম্ভবত!

_____
সকাল থেকে আমার মেয়েটা বেশ হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। আমার ননদের ছেলে-মেয়েরা ওর সমবয়সী, ওদেরকে পেয়ে আনন্দ ধরছে না। কুহুর দিনগুলো এভাবেই আর রাতগুলো আমার বুকে শক্ত করে মিশে থেকে কাটছে। ছোট থেকেই বাবার সান্নিধ্য সেভাবে সে পায়নি বলে কোনো ধরনের শক্ত অনুভূতি মেয়েটা পাচ্ছে না। এখানে ওর দোষ নেই। ওর সাথে ওর বাবার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। কিঞ্চিৎ যা-ও ছিল, বড়ো হতে হতে সে-সব আর মনে থাকবে না, এটা ধ্রুব সত্য।

মুহিবের মৃত্যুর চতুর্থ দিন আজ। আয়েশা ভাবি আর রিমা ভাবি মিলে দুদিন ধরে কথা শোনাচ্ছে। ওরা চেয়েছিল আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে খাওয়াতে। কিন্তু মৃত্যু উপলক্ষে লোক খাওয়ানোটা মুহিব ঠিক পছন্দ করত না, তাই কঠিনভাবে জানিয়েছি তাদের,
-“এসব কিছুর প্রয়োজন নেই।”

মুহিবের বড়ো ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন, এজন্য কেউ আর আমার ওপর উচ্চবাচ্য করতে পারেনি, মেনে নিয়েছে আমার কথা। মুহিবের রেখে যাওয়া কথাগুলোকে আদর্শ মেনে দিন চলতে শুরু করলাম। চাকরির চিন্তাটা যখন মাথায় এলো, তখন খুব মনে পড়ল মুহিবের জোর করে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার দিনগুলো। বিয়ের পর পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা ছিল না, তবুও মুহিবের রোজ এক কথা, “বিয়ে মানে সংযুক্তি, নির্ভরশীলতা নয়। আগামীদিনটিতে আমি কর্মক্ষম হয়ে গেলে তুমি যেন সার্টিফিকেটের দোহায় দিয়ে আফসোস না করো, তার খেয়াল রাখাটাও আমার দায়িত্ব।”

আমি অকম্পিতভাবে সার্টিফিকেটগুলো ছুঁয়ে গেলাম। ছুঁয়ে গেলাম আমার নামটা, অনিন্দিতা অনু, অভিভাবক মুহিব আহসান। একাধারে ছোটখাটো যত জব সার্কুলার পেলাম, সবেতেই অ্যাপ্লাই করতে লাগলাম। বাছ-বিচার তেমন একটা করলাম না। সিভি দেখে তন্মধ্যে বেশ ভালো একটা কোম্পানি থেকে ডাকা হলো আমাকে। অল্পতেই ঘাবড়ে যাওয়া আমি প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবলের দ্বারা ভাইবাতেও উত্তীর্ণ হলাম। জয়েনিং সোমবার।

এ নিয়ে বাড়িতে কম ঝামেলা হয়নি। বড়ো ভাই একবার বলেছেন,
-“অনু, তোমার এসব কাজ করা লাগবে না। আমরা মরে যাইনি।”

নিজের জায়গায় শক্ত থেকে আমি বলেছি,
-“মুহিব চাইতো না আমি কখনও কারোর ওপর নির্ভরশীল হই। আমি ওর চাওয়াকে সম্মান করি।”

বড়ো ভাই আর কিছু বলেননি। সেই সাথে জায়েদের আমার মুখের ওপর বলা “চাকরি করে দুনিয়া কিনে নেবে নাকি” কথাটা থেমে গেল সামনা-সামনি। গোপনে শুরু হলো এর ওর কাছে আমার নিন্দে। ব্যাপারটা ধরতে পারি আমি, তারপরও চুপ থাকি। তর্ক সুশিক্ষিতার শিক্ষা ধ্বংস করে অশিক্ষিতার পর্যায়ে নামিয়ে আনে। মুহিব না আমাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে উঠে-পড়ে লাগত?

বাড়িটায় আগের মতোই থাকার চেষ্টা করি। ওদের কারো কথাকে তোয়াক্কা করি না। সরাসরি কেউ অবশ্য কিছু বলার সাহসও পায় না। গতকাল বড়ো আপা বলেছিল, একটু হিসেব করে চলতে এখন।

আমি অবাক হয়ে তখন শুধিয়েছি,
-“কেন? সহানুভূতি দেখাচ্ছেন? না-কি আমার স্বামীর রেখে যাওয়া টাকার অভাব?”

মুখের ওপর এভাবে বলে ফেলাতে বড়ো আপা ঘাবড়ে গিয়েছেন, ইতস্তত করতে করতে বলেছেন,
-“তোর আর কুহুর ভালোর জন্যই বলেছিলাম, ছোট।”
-“আপা, এত ভালোর দরকার নেই। আল্লাহ যতদিন হাত-পায়ের জোর রেখেছেন, ইনশাআল্লাহ অভাব আসবে না আমার আর কুহুর লাইফে। জীবন চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, আমি করব। স্বামী বেঁচে আছে মানে নারী রানি। স্বামী নেই মানেই দুঃখিনী? এ কোন নিয়ম?”

কোত্থেকে যেন ছোট আপা এসে বললেন,
-“এই তোর দুঃখ লাগছে না, অনু? বর মরেছে মাস গেল মাত্র, বিন্দুমাত্র শোক নেই?”

আমি শক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“শোক নেই, আপা। মৃতদের জন্য মনে শোক রাখা উচিত না, দুঃখ পাওয়া উচিত না। মৃত্যু কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত হয় না। প্রতিটি মানুষের হায়াত সৃষ্টিকর্তা তার জন্মের সময়ই লিখে রেখেছেন। এর কিঞ্চিৎ বেশি বাঁচার সামর্থ্য কারোর নেই। তবে মৃত্যুর মতো এত সত্য বিষয়ের সাথে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দটা যোগ করে কেন শোক পালন করব?”

ওরা আর কিছু বলেনি এরপর আমাকে। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে স্বামী শোকে পাথর বনে গিয়েছি। ব্যাপারটা তা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে মৃত্যু, আর মুহিব আমাকে এই বিষয়টা সহজভাবে গ্রহণ করতে শিখিয়েছিল। যে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে, সে দুনিয়া জয় করতে পারে। সেদিন মুহিবের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমি সামান্য নড়বড়ে হয়েছিলাম অবশ্য, তারপর নিজেকে শক্ত করতে আমার খুব একটা সময় লাগেনি।

দিনগুলো এভাবে কাটল। আস্তে-ধীরে সোমবার চলে এলো। একটা হালকা রঙের সুতির শাড়ি পরে নিলাম। চুলগুলোয় খোঁপা, হাতে ব্রেসলেট, গলায় একটা সরু চোকার্স। সাজসজ্জা এমনিতে পছন্দ না আমার, তবে সাজলে নাকি মেয়েদের আত্মবিশ্বাসের বাড়ে। এই কথাটাও আমাকে আমার সেই বিখ্যাত দার্শনিক মুহিব আহসান জানিয়েছিলেন। লোকটার কথায় জাদু ছিল! মনে পড়লেই ঠোঁটের ভাঁজে আপনা থেকেই কী মিষ্টি একটা হাসি চলে আসে..

অফিস যাওয়ার পথে কুহুকে বাড়িতে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ওকে নিয়েই বেরোলাম। পথিমধ্যে মায়ের বাড়ি, ওকে সেখানে রেখে আমি ফের রওয়ানা হলাম। ঘন্টাখানেকের রাস্তা৷ বাসে গেলে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম দিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে ইচ্ছে করল না। একটা ক্যাব বুক করে নিলাম। এরপর পৌঁছালাম আমার গন্তব্যে।

অফিসে প্রথমদিন আমিসহ আরও দু'জনের জয়েনিং হলো। সবাই ফুল দিয়ে আমাদের অভিবাদন জানাল। নতুন ছেলে-মেয়ে দু'জন অন্য টিমের। আমাদের টিমের লিডার আজ ছুটিতে আছেন। তাই তার অ্যাসিসটেন্ট আমাকে আমার কাজগুলো বুঝিয়ে দিলো। প্রথম দুটো দিন সাধারণভাবেই কাটল। সকালে কুহুকে মায়ের বাড়ি রেখে বের হওয়া, এরপর ৯-৫টা অফিস। তারপর মায়ের কাছ থেকে কুহুকে নিয়ে বাড়ি ফেরা। এই তো, এভাবেই যাচ্ছে।

অথচ বিপত্তি ঘটল যেন ঠিক ক'দিন পর! আমাদের টিম লিডারকে দেখে আমি ভড়কে গেলাম, পায়ের মাটি নড়বড়ে হয়ে উঠল। এতটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ব জানলে সম্ভবত এই শহরেই থাকতাম না। আমাকে দেখে তিনিও অবাক হয়েছেন। অবিশ্বাস্য গলায় ডেকেছেন,
-“অনিন্দা!”

লেখক: নবনী
|পর্ব ১|

গল্প-জুজুবুড়িশেষ পর্বআব্বু যদি একটা দিনের জন্যও আগের মতো হয়ে যেতেন, আগের মতো সেই খোলামেলা, হাসিখুশি মানুষটি, তবে হয়তো...
11/07/2024

গল্প-জুজুবুড়ি
শেষ পর্ব

আব্বু যদি একটা দিনের জন্যও আগের মতো হয়ে যেতেন, আগের মতো সেই খোলামেলা, হাসিখুশি মানুষটি, তবে হয়তো আমাদের পরিস্থিতিটুকু এতোটা ঘোলাটে হয়ে উঠতো না। আম্মু আব্বুকে বলতেন এই বাড়ির ভূতুড়ে কাহিনী। আব্বু সেদিনই আমাদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন। সেই অভিশপ্ত ভয়ানক ঘটনাগুলো থেকেও আমরা মুক্তি পেতাম চিরদিনের জন্য।

কিন্তু, অবস্থাটা সেরকম ছিলো না। বাবার ইনসিকিউরিটি আর তার সাথে ঝগড়ার জন্য আম্মু বাবাকে আন্টির কথাগুলো বলতে পারলেন না। এর বদলে , আম্মু ইদ্রিস নানাকে খবর দিলেন। ইদ্রিস নানা ছিলেন আম্মুর ছোট চাচা। অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। অনেক কিতাব পড়া ছিলো তার। যেকোন সমাবেশে তার বক্তব্য সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো। অনেক হোমড়া-চোমড়া লোকদের সাথেই তার যোগাযোগ ছিলো। অথচ তার মনে কোনো অহংকার ছিলো না। সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন, মাঝেমাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন।

ইদ্রিস নানা যেদিন আমাদের বাড়িতে এলেন, সেদিন ছিলো শুক্রবার। দুপুরবেলা। জুম্মার নামাজের পর তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। বাবাকে বলা হয়েছিলো নানা কেবল আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কেন যে এসেছেন, তার আসল কারণটা তাকে বলা হয়নি।

নানা এর আগে আমাদের সেই বাড়িতে আসেননি। বাড়িতে ঢুকেই তিনি বললেন, 'মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। এমনটা তো হয় না। তোমাদের কি কোনো সমস্যা হচ্ছে এই বাসায়?'

মা তখন নানাকে সব কথাই বললেন। বাবাও চুপচাপ শুনলেন সব আমাদের সাথে বসে। নানা সব কথা শুনে বললেন, 'তোমরা কাজটা ঠিক করোনি ‌‌। আরো আগেই তোমাদের এ বাসা ছেড়ে দেবার দরকার ছিলো। আমি আমার সারা জীবনে আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখেছি সত্যি, কিন্তু এতো বড় ধরনের ঘটনা কোথাও দেখিনি। তোমরা কি আজকেই এই বাড়িটা ছাড়তে পারবে?'

মা তাকালেন বাবার দিকে। বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, 'একটা বাড়ি পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ওই বাড়িটা খালি হতে আরো পনের দিন লাগবে‌। এখন মাসের মাঝামাঝি তো‌, এজন্য কোনো খালি বাসাও পাওয়া যাচ্ছে না।'
নানা বললেন, 'ঠিক আছে। আরো পনের দিন তোমাদের এ বাসায় থাকতে হবে‌। এ পনেরদিনে কি ঘটে যেতে পারে বলা যায় না। আমি আজকে একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। যদি ব্যবস্থাটা কাজে লাগে তো ভালো। যদি না লাগে, তবে কিন্তু তোমাদের এ বাসায় থাকা ঠিক হবে না এক মিনিটের জন্যও। তোমরা কি রাজি?'
মা সাথেসাথেই মাথা নাড়লেন, রাজি। বাবা যেন কতো কি চিন্তা করছিলেন। কিন্তু না রাজি হয়ে তো উপায়ও ছিলো না। এখন কোনো ব্যবস্থা না নিলে, সত্যি যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় এই পনেরদিনের মধ্যে, তখন কি হবে?

ঠিক হলো, ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে মাঝরাতে।এতোগুলো ঘটনা যখন কেবল মাঝরাতেই ঘটেছে, তার মানে সেই অশুভ শক্তি রাতেই প্রকট হয়, সূর্যের আলোতে বা সন্ধ্যায় তার বিরুদ্ধে কিছু করে লাভ নেই। এসব ক্ষেত্রে নাকি অশুভ শক্তি যখন প্রকট হয়, তখনই ব্যবস্থা নিতে হয়, নইলে তাকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না।

মাঝরাতের পর আমাদের কাজ শুরু হলো। আমাদের ড্রয়িংরুমটা তখন লোকে-লোকারণ্য। এ বাড়িতে জ্বীন ঝাড়া হবে এমন একটা কথা কেন যেন সন্ধ্যার পরই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো, রাতেই আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভীড় করেছিলো আমাদের বাড়িতে। এর মধ্যে ইদ্রিস নানার নাম অনেকে শুনেছিলেন,কেবল তাকে চোখের দেখা দেখতে এসেছিলেন অনেকে। লোকজনের ভীড়ে ঘরটা গমগম করছিলো‌। নানা বললেন, 'আমি কাজ শুরু করার পর যেন কেউ শব্দ না করে। কারো যদি মনে হয় এখানে চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন না, তবে তিনি যেন চলে যান। নইলে কারো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে কিন্তু দায়ী করতে পারবেন না।'
নানার কথা শুনে কেউ চলে গেলো না ঠিক, তবে ঘরটা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এতোজন লোক সব নিঃশ্বাস আটকে যেন বসে রইলো সেখানে। মহিলারা বসেছিলেন ভিতরের ঘরটায়। তাদের ঘর থেকে হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো, তবে সেটা আমাদের কাজে তেমন বাধা দিলো না।

নানা তার কাজ শুরু করলেন। বাড়ির সমস্ত লাইট বন্ধ করে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। সেই মোমবাতিটা রাখা হলো ঘরের মেঝেতে। রিমু আর নানা মেঝেতে আসন করে বসলেন। রিমু ভয় পাচ্ছিলো, তাই আম্মু বসলো তার সাথে। আব্বু একটু দূরে সোফায় বসে রইলেন।

নানা দোয়াদরুদ পড়তে লাগলেন।

সময় বইতে লাগলো। তেমন কিছুই হচ্ছিলো না। শুধু রিমুর একটু ঘুম পাচ্ছিলো হয়তো, সে ঝিমুচ্ছিলো। ঘরের লোকরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলেন কিছু না হওয়াতে। ঘরের মধ্যে একটু একটু গুঞ্জন শুরু হলো। সে শব্দ বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।
আর তখনই ব্যাপারটা ঘটলো।
নিভে গেল মোমবাতিটুকু।
আর যে অন্ধকারে ঘরটুকু ছেয়ে গেলো, সে অন্ধকারের মাঝে কার যেন আর্তনাদ আমাদের সবার বুক কাঁপিয়ে দিলো।
অন্ধকারে নানার চিৎকার শোনা গেলো, 'খবরদার, শব্দ করবেন না কেউ।'
কিন্তু সে কথা কি কেউ শোনে? ঘরের সবাই তখন ভয়ে আর্তনাদ করা শুরু করে দিয়েছে।
নানা আবার গর্জে উঠলেন, 'সবাইকে না থামতে বললাম? নইলে কিন্তু এবার সবার বিপদ হবে। এই ঘর থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবেন না।'
নানার ধমকে কাজ হলো। সবার গুঞ্জন এক নিমিষে থেমে গেলো।

নানা আবার দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন। আবার সেই চিৎকার, এবার আরো তীক্ষ্ণ, আরো কাছে। আমরা সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম‌। কেবল নানাকেই মনে হলো শান্ত। তিনি একদম ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, 'কে তুই? কি চাস?'
প্রথমে কোন কথা নেই। এরপর কে যেন ফ্যাসফ্যাসে টানা কণ্ঠে বললো, 'মেয়েটাকে লাগবে।'
'একে তুই পাবি না।'
'আমি ওকে নেবোই।'
'দেখি, কিভাবে নিস।'
বলেই নানা কিছু একটা ছুঁড়ে দিলেন রিমুর দিকে। আমাদের চোখে তখন অন্ধকার সয়ে এসেছিলো, তাই আবছাভাবে সব কিছু দেখতে পারছিলাম। রিমুর গায়ে জিনিসটা ছুঁড়ে দিতেই সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেলো, মনে হলো রিমুই বুঝি চিৎকার করছে, কিন্তু কণ্ঠটা তো তার নয়। হঠাৎই রিমু উঠে ছুটে গেলো নানার দিকে, দুটো হাত উঠিয়ে চেপে ধরলো নানার গলা, দুজন মানুষ দুদিক থেকে টেনেও রিমুকে সরাতে পারছিলো না। নানা আবার জিনিসটা ছুঁড়ে দিলেন রিমুর দিকে, রিমু ছিটকে দূরে সরে গেলো। এবার রিমুর শক্তিও যেন কমে এসেছে, চুপচাপ বসে কেমন যেন ঝিমুতে লাগলো সে।
নানা আবার চিৎকার করে বললেন, 'তুই ওকে কিছুতেই নিতে পারবি না। চলে যা এখান থেকে, এখনই চলে যা‌।'
আরো কি কি কথা বলতে লাগলেন নানা, আমার কানে গেলো না। মানুষজন আবার ফিসফিস করা শুরু করেছে। একসময় দেখলাম, রিমু ঘুমে ঢলে পড়লো। নানা বললেন, 'লাইট জ্বালাও, এবার ঘর বন্ধ করতে হবে।'
লাইট জ্বালানো হলো। নানা ঘুরে ঘুরে বাড়ির প্রতিটা কোণায় গিয়ে দোয়া পড়তে লাগলেন। শেষ কোণাটুকুতে দোয়া পড়ে তিনি সোফায় এসে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, 'আর কোন ভয় নেই।'

সবার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। ঘরে একটা দমবন্ধ পরিবেশ হয়ে পড়েছিলো, সে পরিবেশটা কেটে গেলো খুব দ্রুতই। মানুষজন আবার কথা বলা, হাসাহাসি শুরু করলো। রিমু ঘুমিয়ে পড়েছিলো, নানা মাকে বললেন ওকে ভেতর ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিতে। ওর উপর বেশ ধকল গেছে, এখন যাতে লম্বা একটা ঘুম দেয়। ওকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
মা রিমুকে ভিতর ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসলেন।

লোকজন এবার নানার কাছে ভীড় করলো। সবার নানারকম জিজ্ঞাসা, অনুরোধ সব বলতে লাগলো নানার কাছে। নানাও হাসিমুখে তার উত্তর দিতে লাগলেন‌। নানার ধৈর্য দেখে আমার অবাক লাগলো। এতো ভয়ংকর একটা কাজের পর একটুও ক্লান্ত না হয়ে কি সুন্দর সবার সাথে গল্প করে যাচ্ছেন। উল্টো বাবাকে মনে হচ্ছে ক্লান্ত। তিনি আগে থেকে যেমন সোফায় বসেছিলেন, তেমনিভাবেই সোফাতে বসে রইলেন।

আমি আবার নানার দিকে মনোযোগ দিলাম। মন দিয়ে নানার কথা শুনছি। কি অসাধারণভাবে তিনি ধর্মের কঠিন কথাগুলো মানুষকে সহজভাবে বলে চলেছেন।

তখনই, ঘরে যেন বাজ পড়লো। সকলের কথা থেমে গেল একসাথে।

আমি দেখলাম, রিমু এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মাঝে। তার চোখদুটো এখনো বন্ধ, যেন ঘুমের ঘোরে আছে সে। তার মুখটা ঘরের সেই কোণটার দিকে ফিরানো, যেই কোণটার দিকে তাকিয়ে একটা মেয়ে মারা গিয়েছিলো।

সেই কোণটার কাছে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তার সারা শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা। কেবল মুখটা খোলা। সেই মুখে ভয়ানক হাসি। তার চোখটা ঘুরছিলো সবার ওপর। রুমের সবাইকে দেখে নিচ্ছিলো সে।

রুমে মানুষদের আর্তনাদ শুরু হয়ে গেছে। এই মহিলাকে চিনতে পেরেছেন তারা। ইনি সেই, যিনি অনেক বছর আগে এ বাসায় থাকতেন। যার দুটো মেয়ে মারা যাবার পরও আবার ফিরে এসেছিলো। যাকে এ বাড়িতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

রুমের আলো ততক্ষণে নিভে গেছে। অশুভ এক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে আমাদের রুমটা।

মানুষজন ততক্ষণে দরজা খুলে পরিমরি করে ছুটতে শুরু করেছেন। এতো লোকে ভরা রুমটা নিমিষে শূন্য হয়ে পড়লো। খোলা দরজা দিয়ে পাশের বাড়ির বিদ্যুতের হলুদ আলো লম্বাটে হয়ে পড়ছিলো আমাদের ঘরের ভেতর। তাতে দেখলাম, রিমু টলমল পায়ে হেঁটে চলেছে। যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটছে সে।‌‌‌‌‌ রিমু হেঁটে যাচ্ছে সেই অভিশপ্ত অন্ধকার কোণটার দিকে। যে কোণটা এখন ভীষণ অন্ধকার। কিন্তু আমি জানি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।

ইদ্রিস নানা তখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, 'সিমা (আমার মায়ের নাম) জামাইকে নিয়ে দ্রুত বাইরে আয়।'
মা দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন না কি করবেন। অন্ধকারে বিকট এক হাসির শব্দ শুরু হয়েছে। নিচের তলায় মানুষের হুটোপুটির শব্দ শোনা যাচ্ছে, যে যেভাবে পারছেন পালাচ্ছেন এই বাড়ি ছেড়ে। কারণ সবাই জানেন, হাতে বেশি সময় নেই।

নানা আবার চিৎকার করে উঠলেন, 'সিমা, জলদি চলে আয়। তোর মেয়েকে আর বাঁচাতে পারবি না, ও আর তোদের মেয়ে নেই। ওকে বাঁচাতে গেলে তোরা সবাই মারা পড়বি। আয়, জলদি বাইরে আয়।'
মা তখনও দাঁড়িয়ে। হয়তো কি করবেন বুঝতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই বুঝি বাবাকে খুঁজলেন।‌‌‌‌‌ কিন্তু কোথায় বাবা?

আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম, বাবা অন্ধকার থেকে ছুটে গেলেন রিমুর দিকে। ওকে জাপটে ধরে বসে রইলেন। মেয়েকে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না কোন অশুভ শক্তির কাছে। বাবার চোখে পানি। বিড়বিড় করে মেয়ের কানে কথা বলছেন তিনি, যেন ক্ষমা চাচ্ছিলেন তার কাছে।

মা এটুকু দেখেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'তুই তোর নানার সাথে নিচে চলে যা। আমি আর তোর আব্বু রিমুকে নিয়ে এরপর আসবো।'
নানা ধমকে উঠলেন, 'আরে বোকা, ওর কাছে যাসনা। ও তোদের সবাইকে মেরে ফেলবে‌। এখনও সময় আছে, তাড়াতাড়ি জামাইকে নিয়ে চলে আয়।'

মা নানার কোনো কথা শুনলেন না। বাবার পাশে গিয়ে রিমুকে জড়িয়ে ধরলেন, এরপর ধাক্কা দিতে লাগলেন আস্তে করে, যেন রিমুর ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছেন। নানা আর আমি অবাক হয়ে আব্বু আম্মুকে দেখছি, কতোদিন তাদের একসাথে দেখিনি এভাবে। খুব ছোটবেলায়, আমরা যখন সকালে স্কুলে যেতে চাইতাম না, ঘুমিয়ে থাকতাম বিছানায়, তখন আব্বু আম্মু দুজন এভাবে একসাথে এসে ডেকে ডেকে আমাদের ঘুম ভাঙাতেন। আজও তারা দুজন সেভাবেই রিমুর নাম ধরে ডাকছেন জোরে জোরে।

ততক্ষণে মহিলাটির হাসির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে ঘর।

হঠাৎ দেখলাম, রিমু নড়ছে, যেন ওর ঘুম ভাঙছে‌। চোখ পিটপিট করে অবাক হয়ে সে আব্বু আম্মুকে দেখছে। আব্বু আম্মুকে সেও অনেকদিন এভাবে একসাথে দেখেনি। আব্বু আম্মু ভেজা চোখে জড়িয়ে ধরলেন রিমুকে।

অন্ধকারে সেই মহিলার আর্তনাদটাও বদলে গেছে। যেন কোনো কিছু না পাওয়ার কষ্টে, যন্ত্রণায় ভীষণ দুঃখে চিৎকার করছে সে।

শেষকথা

আমরা সেদিনই সেই বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাসের মাঝামাঝি বলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়নি, তবে বাবার এক বন্ধুর বাসায় সাবলেট হিসেবে ছিলাম সেই পনেরদিন। এরপর আরেকটা ছোটবাসায় ভাড়া উঠলাম।

বাবা আর নতুন চাকরি পাননি। সেই ছোট চাকরি আর টিউশনি করেই আমাদের সংসার চলছিলো। বাবা আগের মতোই সকালে যেতেন, রাতে আসতেন। কিন্তু আমাদের কোনো দুঃখ ছিলো না। আমরা আবার আগের বাবাকে ফিরে পেয়েছিলাম। যে বাবা হাসিখুশি, যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়। যিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও বাড়ি ফিরে ঘন্টাখানেক গল্প করেন ছেলেমেয়েদের সাথে।

এরপর বাবার প্রমোশন হলো। তার বেতন বাড়লো কিছুটা। আমাদের সংসারেও একটু স্বচ্ছলতা এলো। আমাদের স্কুল শেষ হলো, কলেজ শেষ হলো। একসময় গ্রাজুয়েশনও কমপ্লিট করলাম। আমার একটা চাকরি হলো। রিমুরও বিয়ে হয়েছে, দুবছর আগে। গত মাসে ওদের সংসারে নতুন অতিথি এসেছে। ফুটফুটে, সুন্দর, মিষ্টি একটা মেয়ে।

ঐ বাড়িটার খবর আর নেওয়া হয়নি। আর কখনো যাইনি ঐ বাড়িতে। আমরা চলে আসার দিন তিনতলা বাড়িটার প্রত্যেকটা ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাড়িটা একদম খালি হয়ে গিয়েছিলো। এরপর হয়তো আবার নতুন ভাড়াটিয়া এসেছেন ঐ বাড়িতে। সময়ের সাথে সাথে তো সবাই সবকিছু ভুলে যায়। ঐ বাড়িতে যে কি সব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিলো, হয়তো মনেই নেই কারো।

তবে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ঘটনা পড়লাম। একটা তিনতলা বাড়ির গল্প। বাড়িটা টঙ্গিতে। বাড়িটার প্রত্যেকটা ঘরে ভাড়াটিয়া থাকেন, শুধু একটা ঘর বাদে। সেই ঘরটি তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন। তবে অনেক সময় মাঝরাতে, যখন চারদিক নীরব নিস্তব্ধ হয়ে থাকে, তখন সেই ঘর থেকে নাকি কোনো এক মহিলার আর্তনাদ শোনা যায়। কারো যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় সেই শূন্য ঘরটা থেকে। কেন, কেউ জানে না...

(সমাপ্ত)
সোয়েব বাশার

গল্প- জুজুবুড়ি২য় পর্বমা পরদিন বাবাকে রিমুর কথা বলতে পারলেন না। বাবা শুনতেই চাইলেন না। কেবল চিৎকার করে বলতে লাগলেন, 'তা...
11/07/2024

গল্প- জুজুবুড়ি
২য় পর্ব

মা পরদিন বাবাকে রিমুর কথা বলতে পারলেন না। বাবা শুনতেই চাইলেন না। কেবল চিৎকার করে বলতে লাগলেন, 'তাহলে তুমি বলতে চাও, আমার মেয়ে পাগল?'
মাও ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, 'তা বলবো কেন? আমি বলতে চাইছি রিমু আমাদের এখনকার অবস্থা সহ্য করতে পারছে না। ওকে আমাদের দুজনেরই সাপোর্ট দেয়া দরকার।'
'কিসের সাপোর্ট? সোজা কথাই বলো, আমাদের টাকা পয়সা নাই দেখে তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।'

বাবার ইনকাম যে কমে গেছে, এই নিয়ে বাবা প্রচন্ড ইনসিকিউরিটিতে ভুগতেন। কেউ তার মনমতো কথা না বললেই বাবা ভাবতেন, তার ইনকাম নিয়ে খোঁটা দেয়া হচ্ছে। আমরা সেজন্য বাবার সাথে কথা বলার সময় বেশ হিসেব করেই বলতাম।
বাবার ঐ উল্টোপাল্টা কথা শুনে মা তাকে আর কিচ্ছু বললেন না। আমি মাঝখানে একবার আম্মুকে আমার সেই রাতে দেখা মুখটার কথা বলতে গিয়েছিলাম, আম্মু রেগে গিয়ে বললেন, 'তোর আব্বুকে বল, যা।'
আমার কথাটাও না বলাই রয়ে গেলো। রিমুকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হলো না। রাতের কথা তার মনে থাকে না।

সেই রাতের পর বেশ কিছুদিন সব ঠিক ছিলো। অস্বাভাবিক কিছু আর হয়নি। এরপর একরাতে রিমু আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললো, 'ভাইয়া, আমার খুব ভয় লাগছে।'
আমি ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তমুখে বললাম, 'আমাদের এতোদিন ভয় দেখিয়ে এখন তোর নিজের ভয় লাগছে? ঘুমা।'
আমার ধমক শুনে রিমু কিন্তু থামলো না। একইভাবে ভয় পাওয়া গলায় বললো, 'ভাইয়া, দরজার সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।'
আমার ঘুম ছুটে গেলো। তাকিয়ে দেখি, সত্যি তাই। ড্রয়িংরুমে কমলা রঙের যে ডিমলাইট জ্বলছিলো, তার আলোয় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আলোর বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন বলে তার মুখটা ছায়ায় ঢাকা ছিলো, দেখতে পারছিলাম না।

আমরা দু'জনেই চিৎকার করে উঠলাম‌। মহিলাটির তখনই সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে সরলো না। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আমরা দেখলাম, সে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।

সেসময়ই দরজায় আরেকজনের অবয়ব দেখলাম আমরা। আম্মু। আমাদের চিৎকার শুনে এসেছেন। কিন্তু লাভ কি? তিনি কি ঐ মহিলাকে দেখতে পারবেন? নাকি সেদিনের মতো মহিলাটি তার অদেখা রয়ে যাবে?

মহিলাটি রিমুর দিকের বিছানার সাইডে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ করে সে রিমুর এক হাত চেপে ধরলো। রিমু চিৎকার করে উঠলো। সাথে আম্মুর আর্তনাদ শোনা গেলো, 'কে? কে ওখানে?'
মা তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। আমরা দেখলাম, মহিলাটি নেই, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছেন ধোঁয়ার মতো।

আম্মু তেমনই ভয় পাওয়া গলায় বলতে লাগলেন, 'কে, কে ছিলো ওখানে? কোথায় গেলো ও?'
আমি বুঝলাম, এবার মহিলাটিও দেখা দিয়েছেন মাকে। কিন্তু, সে কে, তার কোন উত্তর কি আছে আমাদের কাছে?

সে রাতে, আরো একটা বাজে ঘটনা ঘটলো। মা আব্বাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলেন ঘটনাটা বলার জন্য। না ওঠালেই ভালো করতেন। বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন ঘটনাটা শুনে। চিৎকার করে বলতে লাগলেন আমাদের সবার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে। আব্বু আম্মুর মাঝে সে রাতে খুব বাজে একটা ঝগড়া হয়ে গেলো। আম্মু বললেন, আমাদের নিয়ে তিনি চলে যাবেন অন্য জায়গায়।

আম্মু আমাদের নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন না ঠিক, তবে বাড়ির পরিবেশ শান্তও হলো না। আব্বু আম্মুর মাঝে কথা একদমই বন্ধ হয়ে গেলো। বাবা সকালে বাইরে যান, রাতে বাড়িতে ফেরেন। মা ভাত বেড়ে রাখেন। বাবা ভাত খেয়ে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়েন। সেসময়টায় মা থাকেন আমাদের সাথে। বাবা ঘুমানোর অনেকক্ষণ পর মা যান বাবার পাশে ঘুমাতে। বাবা-মার মাঝে এতোটা দূরত্ব আমরা কখনো দেখিনি। আমাদের প্রচন্ড খারাপ লাগতো তখন। মনে হতো, আমরা এক অন্ধকার সময়ে চলে এসেছি। তার থেকে আলোয় যাওয়ার পথ হয়তো আর নেই।

এরমধ্যেই একদিন একজন মহিলা এলেন আমাদের বাড়িতে। তাকে আমরা চিনি না। সেদিন ছিলো শুক্রবার, বাবা গিয়েছিলেন টিউশনিতে। মা মহিলাটিকে ঘরে এনে বসিয়ে বললেন, 'আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।'
মহিলাটি বললেন, 'চেনার কথা নয়‌। আমি আপনার আগে এ বাড়িতে ভাড়া থাকতাম।'
মা উনার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলেন। খেতে খেতে তিনি বললেন, 'আপনাদের পাশের বাড়ির শায়লা আপার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, তাই একটু দেখতে এসেছিলাম তাকে। তার সাথে দেখা করার পর মনে হলো আপনার সাথেও দেখা করে যাই। মনে হলো, আপনাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার।'
'কি ব্যাপার?'
'আপনার ছেলে-মেয়ে আছে?'
'হ্যাঁ। এক ছেলে, এক মেয়ে।'
'আপনি কি বাড়িতে কোনো ভূতুড়ে ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন এই কয়দিনে?'
মা কোনোরকম রাখঢাক না করেই বললো, 'হ্যাঁ, অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আমাদের বাড়িতে। এজন্য খুব অশান্তিতে আছি আমরা।'
আন্টি বললেন, 'দেখেন, এসব ব্যাপার কাউকে বলাও যায় না, কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু নিজের চোখে দেখেছি, তা অবিশ্বাস করি কি করে?'
'কি হয়েছে, বলুন তো প্লিজ।'

আন্টিটি তখন এক ভয়ংকর গল্প শোনালেন। এ বাড়িতে প্রথম যে ভাড়াটিয়া ছিলেন, তার ছিলো দুই মেয়ে‌। একদিন রাস্তা পার হতে গিয়ে দুই মেয়েই বাসচাপায় মারা যান। মহিলাটির আর কেউ ছিলো না, তার স্বামী মারা গিয়েছিলেন আরো একবছর আগে, পরিবারেও হয়তো তেমন কেউ ছিলো না। মহিলাটি একদম পাগলের মতো হয়ে গেলেন দুই মেয়েকে হারিয়ে। সারাদিন বাসায় থেকে কান্নাকাটি করতেন, আশেপাশের সবাই সান্ত্বনা দিতো তাকে প্রথম প্রথম, কিন্তু যখন দেখতে পেলো মহিলাটির দু:খ-বিলাপ কমছেই না, উল্টো বাড়ছেই দিনে দিনে, তখন তারাও তার কাছে আসা কমিয়ে দিলেন। কয়দিনই বা একজনকে সান্ত্বনা দেয়া যায়?

তবুও এরমধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলাটির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু কেউ রাজি হয়নি তাকে ফিরিয়ে নিতে। শেষমেষ মহিলাটি একাই এখানে থাকা শুরু করেন। মহিলাটির কোনো আয়-রোজগার ছিলো না, পড়ালেখাও বেশি ছিলো না, আশেপাশের সবাই মিলে তাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিলো, তা দিয়েই হালকা-পাতলা দরজির কাজ করে তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন।

এরমধ্যেই তিনি একদিন বলতে শুরু করলেন, তার মৃত দুই মেয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে।

প্রথমে লোকজন ভেবেছিলো মেয়েদের শোকে মহিলার হয়তো নতুন কোনো পাগলামি শুরু হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরই অদ্ভুত কিছু ব্যাপার চোখে পড়লো সবার। মহিলাটির বাড়ির ভেতর থেকে বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় সব বাসায় আলো জ্বললেও মহিলাটির বাড়িতে আলো জ্বলে না, পুরো রাত তিনি অন্ধকারে থাকেন। মহিলার নিচের তলায় যারা থাকেন, তারা মাঝরাতে ওপরের তলায় কারো দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ পান।

মহিলাটির পাশের বাসার লোকজন একদিন মহিলাটির বাড়িতে যান কোন কাজে। গিয়ে দেখেন, বাড়ির মেঝে আর দেয়ালজুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আল্পনা আর নকশা কাটা। মহিলাটি কালো জাদুর চর্চা করছেন।
কথাটা ছড়িয়ে পড়তে একটুও সময় লাগলো‌ না। বাড়িওয়ালা এসে মহিলাটিকে শাসিয়ে গেলেন, আগামীকালের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হবে।

সেরাতে ভয়ানক এক চিৎকারে সবার ঘুম ভাঙলো‌। চিৎকার এসেছে মহিলাটার বাসা থেকে। সবাই গিয়ে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালো, ডাকাডাকি করলো, কিন্তু মহিলাটি দরজা খুললেন না। শেষমেষ দরজা ভাঙা হলো। সেখানে যারা যারা ছিলেন, প্রচন্ড ভয় নিয়ে দেখলেন, মহিলাটি মেঝেতে পড়ে আছেন, মৃত। তার চোখটি খোলা, মুখটি খোলা। প্রচন্ড এক যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে মুখে। মুখটা এতোটাই খোলা, যে চোয়ালের হাড় ভেঙে পড়েছে তার সাথে।
তিনি কেন মারা গিয়েছিলেন, কেউ জানতে পারেনি।

বাড়িটি খালি পড়েছিলো অনেকদিন। এরপর, সময়ের সাথে সাথে সেই ভয়ানক ঘটনাটাও সবার মনে ফিকে হয়ে এলো, বাড়িটাতেও নতুন ভাড়াটিয়া এলো। সেই ভাড়াটিয়ার পরিবারে একটা মেয়ে ছিলো, ছোট্ট ফুটফুটে মিষ্টি এক মেয়ে। সেই মেয়ে এখানে আসার কয়েকদিন পর থেকে হঠাৎ ভয় পেতে শুরু করলো। সে বলতো, সে জুজুবুড়িকে দেখতে পায়, সেই বুড়ি তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। তার বাবা মা মেয়ের কথা প্রথমে গুরুত্ব দিতো না, ভাবতো ছোট মানুষ, হয়তো নিজের বানানো কোনো ভূতের গল্প বলছে। তদের ভুল ভাঙলো, যেদিন মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো বাড়িতে। রাতে সবাই ঠিকঠাক ঘুমিয়েছিলো, সকালে উঠে আর মেয়েকে বিছানায় পায়নি তারা। খুঁজতে খুঁজতে এই ড্রয়িংরুমেই মেয়েটাকে ওরা দেখতে পায়। মেয়েটা ঐ কোণটার দিকে তাকিয়ে মেঝেতে পড়ছিলো। যতক্ষণে ওর বাবা-মা ওকে দেখতে পায়, ততক্ষণে সব শেষ।

আন্টির গল্পের এ অংশটুকু শুনে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের ড্রয়িংরুমের যে কোণটার কথা আন্টি বললেন, সেটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। প্রথম রাতে রিমু এক কোণটাতেই কাউকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছিলো খুব।

সোয়েব বাশার

আমার কেন জানি মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ভুল বুঝা চরিত্রটা হলো হিমু। হিমু আমরা বুঝিনি। হিমু আমরা ধরতে পারিনি। হিমু আ...
11/07/2024

আমার কেন জানি মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ভুল বুঝা চরিত্রটা হলো হিমু। হিমু আমরা বুঝিনি। হিমু আমরা ধরতে পারিনি। হিমু আমরা দেখতে পারিনি এবং সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য হলো, হিমুর একটা টুকরোও আমরা পড়তে পারিনি।
হুমায়ূন 'হিমু'কে নিয়েছিলেন সুবোধ ঘোষের ‘শুন বরনারী’ থেকে। যদিও বেশ তফাৎ আছে দুই হিমুর মধ্যে। হুমায়ূন একটা চরিত্র নিয়েছেন। যে পথে-ঘাটে হাঁটবে খালি পায়ে। হলুদ পাঞ্জাবি পরবে। নির্দিষ্ট কোনো ঘর থাকবে না। পরিবার থাকবে না। কোনো গন্তব্যও থাকবে না। আমরা এই চরিত্রটাই পড়েছি। সে অদ্ভুত সব কথা বলে। মজার মজার কাণ্ড করে। হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টুভাই উপন্যাসে হিমু পরিমল নামে একজনের হাত মাজারের রেলিং-এ আটকে ফেলেছিল তাকে কোনোরকম স্পর্শ করা ছাড়াই, শুধু কথা বলে। ওটা অলৌকিক নয়। ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু অলৌকিক হিমুর সাথে হয় না- তা বলা যাবে না। আমরা সেটা পড়ি। মজা পাই। আমরা যেটা পড়ি না, কেন হিমু হাঁটে? কেন মাথার উপর রোদ নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক যুবক বিড়বিড় করে যায় একা? সে আদৌ মায়া কাটাতে পেরেছে জগত সংসারের? তার চোখে কি জল জমে কখনও? সেও কি কান্না করে?
হিমু হালকা একটা চরিত্র হতো, যদি না তার কুৎসিত একটা শৈশব থাকতো। হিমুকে ডার্ক মানতেই রাজি নন পাঠক সমাজ। অথচ প্রায় প্রতিটা বইয়েই হিমুর ছোট্ট ছোট্ট ভয়ংকর শৈশব তুলে এনেছিলেন হুমায়ূন শুধুমাত্র এইটুকুন ধারণা দেওয়ার জন্য যে, উদোম পায়ে পথে-ঘাটে শুধু হাঁটাই হিমু নয়। হিমু আরও গভীর কিছু। এবং প্রায় প্রতিটা বইয়েই পাঠক সেটা পড়ার বাইরে রেখেছেন। ফলে হিমু হয়ে দাঁড়িয়েছে নিছক মজার কোনো চরিত্র, অনর্থক বিনোদনের খুচরো মাধ্যম, আপাদমস্তক হলুদ নিয়েও রঙহীন কোনো মানুষ।
হিমুর বাবা সুস্থ ছিলেন না। ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, পড়াশোনা করে যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, ট্রেনিং দিয়ে মহাপুরুষ হওয়াও সম্ভব। হিমু ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো, প্রধান এবং একমাত্র এক্সপেরিমেন্ট। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, গিনিপিগ। যদিও বেশীদিন পাননি, তবে যেটুকুন সময় পেয়েছেন হিমুকে তৈয়ার করেছেন। গুঁজে দিয়েছেন ভয়ানক শৈশব। হিমুর শৈশব সম্পর্কিত অল্পকিছু ঘটনা দিয়ে এর ভয়াবহতা অনুভব করা সম্ভব।

১. খুব ছোটবেলায় হিমুকে একটা টিয়ে পাখি কিনে দিয়েছিলেন তার বাবা। হিমু পাখি পেয়ে খুব খুশি। রাতদিন পাখির সঙ্গে থাকলো। আদর করল। ভালোবাসলো। পাখিটাকে কথা বলা শেখালো। যেদিন কথা বলল, সেদিন বাবা পাখিটাকে গলা টিপে মেরে ফেললেন। এটা ছাড়াও বিভিন্ন খেলনা কিনে দিতেন তিনি হিমুকে। খেলা শুরু করার পর ভেঙে ফেলতেন। শুধুমাত্র এটা বুঝানোর জন্য, মায়া জিনিসটা তাকে ত্যাগ করতে হবে। মায়ার কোনো একক সত্ত্বা নেই। ওটা সামগ্রিক। তুমি জগতের সব পাখি ভালোবাসবে। নির্দিষ্ট কোনো পাখি নয় শুধু। তুমি জগতের সব মানুষ ভালোবাসবে, নির্দিষ্ট কোনো মানুষকে নয়।
২. হিমু মাকে জন্মের পর থেকে পায়নি। মায়ের চেহারাটাও দেখেনি। মৃত্যুর পর মায়ের সমস্ত ছবি নষ্ট করে ফেলেছেন বাবা। সব ছবি নয়। একটা ছবি রেখেছেন। আট ইঞ্চি বাই বারো ইঞ্চি সাইজের এই ছবিটা বাবা তার বিছানার তোষকের নিচে খামের ভেতর সিলগালা করে রেখেছেন। সঙ্গে মায়ের লেখা একটা ডায়েরীও। এই খাম খোলার শর্ত আছে। যেদিন হিমুর হৃদয় সত্যিকার অর্থে আনন্দে পরিপূর্ণ হবে, শুধুমাত্র সেদিনই সে খামটা খুলতে পারবে। শর্ত শেষ নয়। খামটা খোলার পর ছবিটা একবার দেখে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ছবি, ডায়েরী, খাম সব। বাবা জানেন, একজীবনে বহুবার সত্যিকার আনন্দে হৃদয় পূর্ণ হওয়ার পরও হিমু ‘আর কোনোদিন দেখতে না পারার ভয়ে’ এই ছবি কোনোদিনই দেখবে না। জন্ম থেকে মা হারা একজন যুবকের জন্য বিষয়টা কি পরিমাণ নির্মম ভাবা যায়?
‘হিমু’-এর শেষাংশ পড়ার পর আমার কেন জানি মনে হয়, হিমুর মায়ের মৃত্যু হিমুর জন্মের সাথে সাথে হয়নি। কিছু দিন কিংবা কিছু মাস পর হয়েছে। ‘হিমু’ উপন্যাসের শেষদিকে হিমু চেতন আর অবচেতন জগতের মাঝখানে পৌঁছায় কুকুরের কামড় খেয়ে। তখন বাবার সাথে তার একটা কথোপকথন হয়। কাল্পনিক কথোপকথন। ঐ কথোপকথনে বাবা তাকে ‘হিমু’ ডাকে না। ডাকে, খোকা। হিমু জিজ্ঞেস করার পর বাবা উত্তর দেয়, ‘তোর মা তোকে খোকা ডাকতো।’ এই কথোপকথন কিন্তু বাস্তবিক নয়। পুরোটাই হিমুর অবচেতন মনের তৈয়ার করা দৃশ্য, সংলাপ। অর্থাৎ, হিমুর মা হিমুকে খোকা ডাকতো, বিষয়টা বাবা তাকে জানাচ্ছে এমন নয়, বিষয়টা হিমুর অবচেতন মন জানে। ছোটবেলার অধিকাংশ স্মৃতিই বড়ো হওয়ার পর গায়েব হয় মাথা থেকে। মায়ের গায়ের রঙ শ্যামলা, একটা চোখ অপর চোখ থেকে অল্প একটু বড়ো, কাজল পরতো, অসম্ভব সুন্দর ছিল, মায়ের মুখ নিঃসৃত ঐ খোকা ডাক- এইসব কিভাবে থাকলো হিমুর মাথায়, তা অবশ্য অস্পষ্ট।
৩. বাবার মৃত্যুর পর হিমু বাবার দিককার কোনো আত্মীয় স্বজনদের পায়নি। তাকে যেতে হয়েছে মায়ের দিককার আত্মীয় স্বজনদের নিকট। যাওয়ার এই বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন খোদ হিমুর বাবা-ই। তিনি চেয়েছেন পুত্রের শৈশব মামাদের সঙ্গে কাটুক। কারণ হিমুর মামারা পিশাচশ্রেণীর মানুষ। মন্দের সাথে না থাকলে ভালো ঠিক কতটা ভালো, জানা হবে না। মামারা সত্যিই পিশাচ ছিলেন। গর্ভবতী বিড়াল জবাই, কোঁচ গেঁথে হওয়া মৃত্যুর আগে গ্রামের নির্দোষ চারজনকে ডেথ কনফেশনে ফাঁসিয়ে দেওয়া সহ ভয়ানক কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে বইতে। মন্দ মানুষদের সাথেও অতিদ্রুত হিমুর সম্পর্ক সহজ হওয়ার পেছনে শৈশবের মামাবাড়ি অনেকটাই প্রভাব রাখে- তা আর বলতে।
৪. সর্বশেষ যেটি, সেটি যেকোনো মানুষকেই মানসিকভাবে চরম ধাক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে ঐ বয়সে। হিমু খুব দ্রুত টের পেয়েছিল, তার মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এবং কাজটা করেছেন তার বাবা। কারণ, পুত্রের মহাপুরুষ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো বাধা হবেন মা। বিষয়টা সরাসরি স্বীকার না করলেও সূক্ষ্ণভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বাবা, ‘তোর মা কিভাবে মারা গিয়েছিল তোকে খুঁজে বের করতে হবে। তোকে জ্ঞানী হতে হবে। আমি যা করেছি, তোর জন্য করেছি।’
মৃত্যুর আগে হিমুর বাবা স্বপ্নে দেখেন স্ত্রীকে। এই বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। কারণ, এই জায়গায় হিমুর বাবাকে প্রথমবার কিছুটা বোধহয় উপলব্ধি করতে দেখা যায়, মা হারিয়ে চলা দীর্ঘ পথটা বড্ড কষ্টের হবে পুত্রের জন্য। পুত্রের এই কষ্টের জন্য তিনি দায়ী। আক্ষেপটা ফুটে উঠে স্বপ্নের ভেতর। মা স্বপ্নে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওর কি কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে? কোনো মেয়ে ভালোবেসে তার হাত ধরেছে?’ বাবা উত্তর দেন, ‘না। সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে। তার জন্য নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ।’ মা চোখ মুছে রাগী স্বরে বলেন, ‘সে সাধনা করছে না, কচু করছে। তাকে তুমি আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি থাবড়ায়ে তার মহাপুরুষগিরি ছুটায়ে দেবো।’
এই আক্ষেপ বলি কিংবা অপরাধবোধ হিমুর বাবার অবচেতন মনে ছিল। সচেতন মনে কোনোদিন স্বীকার করেননি। কোথাও না কোথাও পুড়েছেন ঠিক, অন্য একটা জীবন পুত্রের হলেও হতে পারতো।
হিমুর প্রথম উপন্যাসের নাম হিমু নয়। ময়ূরাক্ষী। এটা একটা নদী। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন এই নদীর নাম প্রথম মাথায় আসে হিমুর। যদিও সে তখনও জানে না, এই নামে কোনো নদী আছে কিনা। একটা স্যার তখন বলেছিলেন তাকে, না থাকলে নাই। এটা তোর নদী। হিমু এই নদীকে স্বপ্ন দেখে প্রথমবার, এই ঘটনার তিন বৎসর পর। নদীর বর্ণনাটা এইরকম। ছোট্ট একটা নদী। নদীর জল স্বচ্ছ। নিচে বালি পর্যন্ত স্পষ্ট। দু’পাড়ের ঘাস সবুজ। ওপাড়ে একটা পাকুড় গাছ। বিশাল। সেই গাছে বিষন্ন গলায় একটা ঘুঘু ডাকে। সেই ডাকে কান্না মিশে আছে। নদীর ধার ধরে পানি ছিটাতে ছিটাতে সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি পরা একটা মেয়ে হেঁটে যায়।
আপাদমস্তক হিমু পড়ার পরও খুব কম মানুষের পক্ষেই ধরতে পারা কঠিন, ময়ূরাক্ষী আদৌ কোনো নদী নয়। এটা হচ্ছে হিমুর ঐ সংসার, ঐ পথ, ঐ গন্তব্য, ঐ ঘর, ঐ জীবন যেটা বাস্তবে সে কখনই যাপন করতে পারেনি, পারছে না এবং পারবেও না। কারণ, ওখানে শুধু নদী নেই। আছে একটা বিশাল পাকুড় গাছও, যে গাছে ঘুঘু ডাকে বিষণ্ণ স্বরে। এই ডাক হিমুরই গোপন দুঃখ। এই ডাকে তার চোখ ভিজে আসে। ঐ নদী জলে সে বেশিক্ষণ পা ডুবিয়ে বসেও থাকতে পারবে না, কারণ পাড় ধরে সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি পরা একটা মেয়ে হেঁটে যায়। এই নারী তার অচেনা, তার মুখ স্পষ্ট নয়, অথচ একইসঙ্গে এই নারী তার বহুদিনের চেনা। জন্ম জন্মান্তরের পরিচয়। ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের একদম শেষদিকে এই নারীর পরিচয় দেওয়া হয়। এই নারী হিমুর মা, যাকে হিমুর বাবা হত্যা করেছেন। অর্থাৎ, হিমুর কাল্পনিক ময়ূরাক্ষী বিষাদ আর মৃত্যুতে আচ্ছন্ন। চোখ খুললে হিমুকে নিজের সহ জগতের সমস্ত ঘটনা, বিষয়বস্তু ও মনুষ্য নিয়ে নির্মোহ থাকতে হয়, পাথর থাকতে হয়, স্থির থাকতে হয়। এটা বাবার তৈয়ার করা জগত। বিপরীতে ময়ূরাক্ষী তার নিজের তৈয়ার করা ঐ জগত, যেটা বাবা সহ পারিপার্শ্বিক সবার থেকে খুব যত্ন করে লুকানো। যেখানে সে চোখ ভিজাতে পারে অনায়াসে, যেখানে সে আটকাতে পারে মায়ায়। মূলত হিমুর দুই জগতই বাসযোগ্য নয়। সে না পারবে রিয়েলিটিতে বাস করতে, না পারবে ইমাজিনেশনে। দু’টোতেই প্রগাঢ় শূন্যতা, ভয়াবহ বিষাদ, শুকনো পথ, স্যাঁতসেঁতে নদীর পাড়।
হিমুর বাবা সফল হয়েছিলেন নাকি সফল হননি, তা স্পষ্ট নয়। হিমুর মতোই অস্পষ্ট। ‘এবং হিমু..’ উপন্যাসে আইসিইউতে বদরুল সাহেবকে রেখে যখন বের হয়ে পড়ে হিমু, আর ইরা বলে, ‘আপনার বন্ধুর পাশে থাকবেন না?’ হিমু ছোট্ট করে উত্তর দেয়, ‘না।’ ইরা অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাকে যদি বলি আমার হাত ধরতে, আপনি কি রাগ করবেন?’ হিমু জবাব দেয়, ‘আমি রাগ করবো না। কিন্তু ইরা, আমি তোমার হাত ধরবো না। হিমুরা কখনো কারও হাত ধরে না।’
হিমু ডুব দিতে পারে খুবই শান্ত থেকে। কোনোরকম উচ্ছ্বাস ছাড়াই ফেরত আসতে পারে আবার। মায়া ছেড়ে আসায় ওর জুড়ি মেলা ভার। হিমু পড়তে পড়তে আমার কখনো সখনো মনে হয়, হিমুর বাবা সফল। আবার ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে যখন খালা কাঁচা হলুদ বেঁটে হিমুর গায়ে মাখিয়ে ধমক দিতে দিতে গোসল করিয়ে দেন, হিমুর চোখে জল জমে। খালা অবাক হন। আমি অবাক হই। ওদের কথোপকথন।
‘কিরে কাঁদছিস কেন? চোখে পানি কেন?’
‘মহাপুরুষ ট্রেনিং-এ ফেইল করেছি বলে চোখে অশ্রু।’
‘হেঁয়ালি করে কথা বলবি না। কী সমস্যা বল।’
‘তোমার আদরটাই সমস্যা। এত আদর এত মমতা নিয়ে কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি।’
এইটুকুন পড়ে মনে হয়, হিমুর বাবা পুরোপুরি সফল হননি বোধহয়। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’ উপন্যাসে এই মতের পক্ষে ও বিপক্ষে ভয়ানক নির্দয় একখানা দৃশ্য বিদ্যমান। যারা হিমু খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, তারা ঠিক ধরে নিতে পারবেন, হিমুর সর্বমোট একুশটা উপন্যাসের ভেতর যে নারী সবচেয়ে বেশী টেনে ধরেছিল হিমুর পথ, আগলে দাঁড়িয়েছিল কিংবা বলা যায় গন্তব্যহীন একটা যাত্রার প্রতি চরম আক্ষেপে চোখে জল এনে দিয়েছিল, সে রুপা নয়। মারিয়া। যারা হিমু সিরিজের মাত্র দু’টো উপন্যাস পড়তে চান, আমি তাদেরকে ময়ূরাক্ষীর পর ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’ পড়তে সাজেস্ট করি সবসময়। এই উপন্যাসের শেষদিকে হিমু মারিয়া থেকে বিদায় নেয়। মারিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তী অংশ হিমুর বয়ানে, ‘কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার ভেতর একধরণের বিভ্রম তৈরী হলো। মনে হলো আমার আর হাঁটার প্রয়োজন নেই। মহাপুরুষ না, সাধারণ মানুষ হয়ে মমতাময়ী এই তরুণীটির পাশে এসে বসি। যে নীলপদ্ম হাতে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, সে পদ্মগুলি তার হাতে তুলে দিই।’
হিমু কখনই পারিপার্শ্বিক ঘটনা, পরিস্থিতি, মনুষ্য ও বন্ধন নিয়ে পুরোপুরি নির্মোহ হতে পারেনি আবার হিমু কখনই গাঢ় আবেগ মাখা কোনো বন্ধনে পুরোপুরি জড়াতেও পারেনি। বরং বসবাস করেছে মধ্যবর্তী একটা জায়গায়। এই জায়গায় সে গন্তব্যহীন হাঁটা হাঁটে, এই জায়গায় হাঁটতে হাঁটতে তার ক্লান্তিও জাগে, সে তখন বসে পড়ে চুপচাপ। ময়ূরাক্ষী বের করে আনে কল্পনায়। ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। চোখ ভেজায়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে হিমু একটা ঠেলাগাড়িওয়ালাকে জীবন বাঁচানোর বদলে উল্টো থাপ্পড় দেয়। এই জায়গায় বসে মাথায় হাত বুলায় পথশিশুর। কোনো একটা শিশুর ইচ্ছাপূরণে হাতির বাচ্চা ভাড়া করে ফেলে। মন্দ একটা মানুষকে খুব সহজে বদলে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নির্মল করার ক্ষমতা রাখে কড়া পাপ। বিভ্রম সৃষ্টি করে যায় অনর্গল। এই মধ্যবর্তী জায়গায় বসবাস বলেই হিমু জটিল। চূড়ান্ত জটিল। হিমু কোনোদিনও ক্লাস নাইন-টেন পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীর পাঠ্য নয়, ছিলও না। হুমায়ূন পড়া শুরু করার মাধ্যম তো নয়ই। সহজ ভঙ্গিতে লেখা বলে হিমু পড়া সহজ। ধরা সহজ নয়।
আমাদের প্রজন্ম হিমুর হাঁটা গলাধঃকরণ করে, আলাপের অংশ রাখে হলুদ রঙ, হিমুর প্রতি রুপার প্রবল প্রেম, ছাদের কার্নিশ, ইনট্যুইশন, রসিকতা। ওরা যেটি রাখে না, সেটি হলো একটা নদী। ময়ূরাক্ষী। যেটি বাস্তবে হিমুর কখনই হয়নি। হওয়ার উপায় ছিল। মানুষ ছিল। পথ ছিল। কিন্তু হয়নি কারণ ঐ নদীর পাড় ধরে সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি পরে যে দুঃখী নারী হেঁটে যায়, ঐ নারীকে কখনই দেখা হয়নি তার, কোনোদিন যার মায়ামাখা হাত বিলি কাটেনি চুলে, কখনই যে ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করেনি ক্লান্ত ললাট। ফলে পৃথিবীর সব নারীর মুখচ্ছবিতে ঐ নারী ফুটে ওঠে। পৃথিবীর সব নারীর হাত হয়ে উঠে ঐ নারীর হাত। সব চুম্বন শুধুই ঐ নারীর চুম্বন। হিমুকে তাই সব ছেড়েছুড়ে হাঁটতে হয়। না হাঁটলেও সে পারতো। কিন্তু তাতে বৃথা যাবে একটা মৃত্যু। ঐ মৃত্যুর দায়ভার হিমুর কাঁধে। যে রাস্তায় সে হাঁটে, ঐ রাস্তার পাশে বাড়ির ছাদে কার্নিশ নেই কোনো। হিমু আসবে বলে নীল শাড়ি পরে যে ছাদের কার্নিশ ধরে রুপা সেজেগুজে দাঁড়ায়, প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হিমু ঐ রাস্তায় কোনোদিন আসে না। হিমুর ঐ রাস্তায় আসা বারণ। হিমু তার ময়ূরাক্ষীর মতোই দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট আর গোপন।

Shakhawat


Address

Chittagong
Chittagong
4218

Telephone

+8801819066563

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Enjoy and Fresh Mind posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Enjoy and Fresh Mind:

Share

কাজ শিখুন, ক্যারিয়ার গড়ুন।

Garments University of Bangladesh একটি অনলাইন ভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার যুব সমাজকে পোশাক শিল্প সম্পর্কে সঠিক এবং শিক্ষনীয় তথ্য প্রদানের মাধ্যমে চাকুরী প্রার্থী হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত সকল শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণকে স্ব স্ব পদে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে চাকুরী ক্যারিয়ারে কিভাবে উন্নতিসাধন করা যায় তার সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। গার্মেন্টস মালিক কিভাবে অল্প শ্রমিক দিয়ে কোম্পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে তার সঠিক কলা কৌশল প্রদান করা হয়। নতুন উদ্দোক্তাগণ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ব্যবসায়ে লাভ ও ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত হতে পারে।

সর্বোপরি বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক এই খাত কে সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই শীর্ষ চুড়ায়। এখনো মানুষের মধ্যে গার্মেন্টস শিল্প সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা বিরাজ করে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এ শিল্পটাকে বিশ্বের দরবারে এমনভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে যেন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে বাংলাদেশই সেরা।