07/10/2025
রাউজানে এক শিক্ষকের স্বপ্নের পাঠশালা যেভাবে বদলে দিলো গ্রাম
আমির হামজা, রাউজান:
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কদলপুর গ্রাম। এই গ্রামের বুকে শিক্ষার যে আলো আজ জ্ব'লছে, তার পেছনে রয়েছে এক অদম্য মানুষের আজীবনের বিশাল সংগ্রাম ও স্বপ্নের গল্প। তিনি আর কেউ নয় বাবু সত্যপদ বড়ুয়া, একজন আদর্শ শিক্ষক এবং দক্ষিণ কদলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। যে স্কুল একদিন শুরু হয়েছিল দুটি টিনের ঘরে, আজ তা পাকা ভবনে দাঁড়িয়ে জয়নগর বড়ুয়াপাড়া গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, যা এই প্রবীণ শিক্ষকের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
২০০০ সালের কথা, কদলপুরের মতো একটি প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার প্রসার তখনো ছিল এক বড় কঠিন চ্যালেঞ্জ। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই ভাবনা থেকেই নিজের জায়গায় দুটি টিনের ঘর তুলে একটি স্কুলের যাত্রা শুরু করেন বাবু সত্যপদ বড়ুয়া। অর্থের বিনিময়ে নয় তিনি মানুষের কাছে হাত পেতেছিলেন বছরে একবার ধানের জন্য। গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরে শিক্ষক সত্যপদ বড়ুয়া আর বাবু দোলন বড়ুয়া সেই সংগৃহীত ধানের টাকায় পরিচালিত হতো স্কুলের যাবতীয় খরচ। এটি ছিল টাকা চাওয়ার ঊধের্ব এক সম্মানের আরজি, যা গ্রামের মানুষকে এই মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছিল।
দক্ষিণ কদলপুর উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল প্রতিষ্ঠায় এই কঠিন যাত্রায় তিনি একা ছিলেন না। সাথে ছিলেন জয়নগর বড়ুয়াপাড়া তো বটেই, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পাহাড়তলী ইউনিয়নের শাহাদুল্লাহ কাজীর বাড়ি, কদলপুর ইউনিয়নের খলিফা পাড়া ও ভোমর পাড়ার মানুষ। এলাকার মুসলীম-বৌদ্ধদের সম্মিলিত সহযোগিতা আর সত্যপদ বড়ুয়ার দৃঢ নেতৃত্বে ধীরে ধীরে স্কুলটি প্রাণ পেতে শুরু করে।
একটা সময় ছিল যখন ক্লাস নিতে হতো স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দিরে সেখান থেকে সময়ের পরিক্রমায় স্কুলটি আজ একটি পূর্ণাঙ্গ পাকা ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। বাবু সত্যপদ বড়ুয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমের চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ২০২২-২৩ সালে, যখন বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। জীবনের শেষ সময়ে এসে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের এই সাফল্য দেখে তাঁর চোখেমুখে যে আন্দনের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ছিল অমূল্য।
তাঁর স্বপ্ন ছিল একটি শিক্ষিত সমাজ ও আলোকিত জাতি গঠন করা, আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে আজ অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
স্থানীয়রা জানান, বাবু সত্যপদ বড়ুয়া কেবল একজন শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। তরুণদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তাঁর সেই ত্যাগের সুফল আজ ভোগ করছে পুরো গ্রামের মানুষ।
বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাবু দোলন বড়ুয়া স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমরা বাবু সত্যপদ বড়ুয়ার সঙ্গে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি এই স্কুলের জন্য। এলাকাবাসীর সহযোগিতা আর স্যারের একক প্রচেষ্টায় দক্ষিণ কদলপুর উচ্চ বিদ্যালয় আজ এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাবু সত্যপদ বড়ুয়ার গল্পটি কেবল একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার গল্প নয়, এটি একজন দেশপ্রেমিক মানুষের ত্যাগের গল্প, যিনি একটি পিছিয়ে পড়া জনপদকে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করতে নিজের জীবন উ'ৎ'স'র্গ করেছেন। তাঁর দেখানো পথ আজও অনুপ্রেরণা জোগায় অগণিত মানুষকে।
আমির হামজা
লেখক ও সংবাদকর্মী।