27/08/2025
ঘুম থেকে উঠে মাকে ডাক দিলাম। দেখি মা ঘরে নেই। বড় আপার ঘরে যেয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করি। আপা বলে, মা বাড়িতে নেই সকালে উঠেই নানু বাড়িতে গেছে।
কাউকে কিছু না বলে মায়ের নানু বাড়ি চলে যাবার অবশ্য একটা কারণ আছে। বাবার সাথে গতরাতে মায়ের ঝগড়া হয়েছে। মা একসময় বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আপার কাছে ঘুমাতে যায়। ভোরে উঠেই নানাবাড়ি চলে গেছে।
মায়ের অভিমান করে চলে যাওয়া নিয়ে অবশ্য তেমন খারাপ লাগলো না। মা ভালোই আছেন নানুবাড়িতে। আমরা যে খারাপ আছি তেমন না। বড় আপা রান্না করছেন, খাবার খাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা হয় না। আমি পেয়ে গেলাম মুক্ত জীবন। সন্ধ্যা বেলা বাবা থাকেন বাইরে, আমি টিভির সামনে বসি। এখন সন্ধ্যা বেলা টিভি দেখা নিয়ে কেউ বকে না। দুপুরের খাবার খেয়ে এক দৌড়ে বল নিয়ে মাঠে চলে যাই।
মা নানু বাড়িতে গেছেন দুদিন হয়। যদিও আপা ঘরের কাজ সব করছেন, তবে দুদিন পরেই হুট করে বাইরে থেকে এসে মা বলে ডেকে বলি। খেয়াল ছিলো না, মায়ের বাড়িতে না থাকা। ডাক দেবার পরেই খেয়াল আসে মা বাড়িতে নেই। মনে হলো ঘর জুড়ে শূন্যতা, কোথাও কিছু নেই। টিভির সামনে বসতে ইচ্ছে হলো না।
আপার কাছে ছুটে গেলাম। আপা আমারে ত্রিশ টাকা দিবি? বাবার কাছ থেকে নিয়ে তোরে দিয়ে দিবো৷
আপা আমার হাত ত্রিশ টাকা দিলো। নানু বাড়ি যেতে বাস ভাড়া দশ টাকা। যাওয়া আসা মিলিয়ে বিশ টাকায় হয়ে যাবে৷
বাসা থেকে বের হয়ে বাস ধরলাম। মনে হলো এক দৌড়ে নানুদের বাসায় এসেছি। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মা বলে ডাক দিতেই মা সাড়া দেয়। আমি ঘরের ভিতরে আসি। মা বলেন তুই এইসময়? আমি বলি এমনি।
আমার কাছে মনে হয়েছে আমি মাকে ডাক দিবো আর মা সাড়া দিবে এইসবই একমাত্র শান্তি। তাই ছুটে চলে আসছি। গত কয়েকদিন মাকে ডাকা হয়নি। বই খুঁজে না পেলে মাকে ডাকি, ফ্রিজের কোন তাকে খাবার সেসব খুঁজে না পেলে ডাকি। টিশার্ট খুঁজে না পেলে মাকে ডাকি। সেই মাকে গত দুদিন ডাকিনি, ভাবতেই বুকের ভিতনে কেমন করে উঠে।
ঘন্টাখানেক মায়ের কাছে থেকে আবার বাস ধরে বাড়িতে চলে আসি। আজকে অবশ্য থাকা যেতো। তবে আগামীকাল আমার একটা পরীক্ষা আছে তাই চলে আসতে হয়েছে। মাকে বললাম, মা চলো। মা বললেন, যাবো না আমি তুই আজকের রাত থাক। আমিও আর থাকলাম না।
মা বাড়ির বাইরে চারদিন হয়৷ আপার সাথে প্রতিদিনই কলে কথা বলে, বাবার খোঁজ খবর নেয়। যদিও আমার ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আবার যখন মন খারাপ হবে ছুটে যাবো এক দৌড় ঠিক করে রাখি।
চারদিন পরে বাবা অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটায়। আমাদের বাড়িটা একতলা। বাবা বাড়িতে দুজন লোক নিয়ে আসেন, কিছুসময় পরেই ট্রাক ভর্তি করে কিছু মালামাল বাড়ির সামনে আসে।
আমি আর আপা জিজ্ঞেস করতেই বাবা বলেন উপরে একটা ঘর করা হবে। আপা বলেন, এখন উপরে ঘর করে কি হবে? মা বাড়ির বাইরে তাকে ফেরাতে হবে না?
বাবা আপার কথায় কোনো উত্তর দেয় না। আপা সাথে সাথে যেয়ে মাকে খবরটা জানায়। তবে কি বাবা আবার বিয়ে করবার চিন্তাভাবনা করছেন? উপরের ঘরে তার সেই নতুন বউ নিয়ে থাকবে।
বাবার এসব কর্মকাণ্ড দেখে বড় চাচা বিকালে বাড়িতে আসেন। কিভাবে যেনো ছড়িয়ে গেলো বাবা আবার বিয়ে করতে চাইছেন তাই ঘর তুলছেন উপরে। চাচা এসে বাবাকে বুঝিয়ে বলেন, এই বয়সে কি তোর বিয়ে করা সাজে বল? দুটো ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, ওদের পড়াশোনা করাবি, মানুষের মতো মানুষ করতে হবে না?
বাবা চাচার কথায় কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু চাচার কথা কেন কারো কথায় কোনো উত্তর দেয় না৷
এদিকে মা দিনে চার পাঁচবার কল দিয়ে আপার সাথে কাঁদছেন। ফোন দিয়েই কান্না শুরু করেন।
বাবা যে আসলে কি করতে চায় কেউ বুঝতে পারে না৷
উপরের ঘরের কাজ শেষ করতে পনেরো দিন চলে যায়। বাবা আজকাল এই ঘরটা নিয়েই আছেন, দেয়ালে কি রং করবেন, কোনপাশে জানালা দিলে বাতাস আসবে, এমন সব ভাবনা৷ আপার কাছে বেশ উৎসাহ নিয়ে ঘরের কাজের কথা বলেন, তবে তিনি বিরক্ত হয়।
ঘরের কাজ শেষ হবার পরে কিছু আসবাবপত্র কিনেন। একটা সোফা, দুটো ছোটো চেয়ার। দেয়ালের জন্যে কিছু ছবি। ছোটো একটা খাট। আর অনেকগুলো বই। পুরো ঘরের দুইপাশের দেয়াল জুড়ে বইয়ের তাক সাজানো।
বাবা আমাদের দুই ভাই বোনকে ডেকে নিয়ে ঘর দেখায়। আপা কোনো কথা বলে না। বাবা তার মতো করে কথা বলে যায়। একসময় বাবা বলেন, তোর মা আমার খুব রাগ করে আছে তাইনা? হয়তো আমাকে কল দিতে চেয়েও দেয়নি। চল এক কাজ করি কালা আমরা সবাই দুপুরে তোর নানাবাড়ি যাই তোর মাকে ফিরিয়ে আনতে।
আপা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। বাবাও মৃদু হাসেন।
সকালে বাজারের হাট থেকে বাবা বড় দেখে একটা বোয়াল মাছ কিনেন। সেই মাছ নিয়েই আমরা নানাবাড়িতে যাই।
বাবার আসবার কথা শুনে সেই যে মা ভিতরের ঘরে গেছেন এখন পর্যন্ত সামনের ঘরে আসেনি। বাবার সামনে তিনি আসতে চায়নি।
দুপুরবেলা বাড়িতে বেশ ভালো আয়োজন হয়। বাবাকে মামারা খুব সম্মান করেন, মামাবাড়িতে কোনো কিছু হলে বাবার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাবা আসছেন শুনে মামারা বেশ খুশি হয়েছে।মাকে সবাই মিলে খুব বুঝিয়েছে।
বিকালে নানাবাড়ি থেকে আমরা মাকে নিয়ে বাড়ির পথে রহনা দেই। পুরো পথে মা বাবার সাথে কথা বলেনি।
বাবা বাড়িতে ফিরেই সবাইকে নিয়ে উপরের ঘরে যায়। মাকে নিয়ে আসেন আপা। বাবা আপার দিকে তাকিয়ে বলেন, বুঝলি রাইসা তোর মা আর আমি এক ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম৷ বিয়ের পরে তার স্বপ্ন ছিলো একটা ঘর হবে, বই থাকবে ঘর ভর্তি। তবে স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করেছি, এক রুমে সংসার শুরু হয়। ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতাম, সেই ঘরের এক কোনায় ছিলো কিছু ছোটো হাড়ি পাতিল। টিউশনের টাকা পেলে নীলক্ষেত যেয়ে দুটো পুরোনো বই কিনে দিতাম। সেই বই তোর মা পড়তো।
সংসার ধর্মে দুজনে মন দিলাম, ছেলেমেয়ে হলো। আর বই ভর্তি তার নিজের মতো ঘর দিতে পারলাম না। তোর মা অবশ্য এখন তেমন বই পড়েও না। সংসার নিয়েই তো সময় চলে যায়, ছেলেমেয়েদের দেখতে হয়। অনেক দায়িত্ব।
এবার থেকে আমার সাথে ঝগড়া হলে যেনো আর তোর নানাবাড়িতে না যায়। এই ঘরটা আজকে থেকে তোর মায়ের। আর এই ঘরে তোরা কখনো আসবি না। আমার সাথে ঝগড়া হলে কিংবা দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে এখানে চলে আসবে।
বাবা মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে একটা তালা আর চাবি মায়ের হাতে দেয়।
মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কথা বলতে পারছে না। দুই চোখে পানি টলমল করছে। বাবার উপর হয়তো তার মনে এখন কোনো রাগ নেই। আপা যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মিটমিট করে হাসে, মা নিজেও হাসি দেয় যদিও চোখেভর্তি পানি। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমি কি এসব কখনো বলছি, এতো টাকা খরচ করে এসবের কি দরকার ছিলো?
বাবা বলেন দরকার ছিলো, খুব দরকার। অবশেষে তোমার ইচ্ছে তো পূর্ণ করতে পারলাম, আর রাগ করে বাবার বাড়িতে যেতে হবে না। যখন ইচ্ছে হবে এই ঘরের তালা খুলে এখানে এসে বসে থাকবে, বইপত্র পড়বে। এটা তোমার নিজের ঘর, এখানে তোমার অনুমতি ছাড়া কারো আসা নিষেধ। আপা বলেন, বাবা আমিও আসতে পারবো না? আমিও বলি, আমিও কি আসবো না? মা হেসে বলেন, সবাই আসবি তোরা।
মায়ের ঘর
-মুস্তাকিম বিল্লাহ
#ছোটগল্প #অনুগল্প