01/07/2025
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি, যিনি বখতিয়ার খলজি নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন ঘুরি সাম্রাজ্যের একজন তুর্কি-আফগান সেনাপতি এবং প্রাথমিক দিল্লি সালতানাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ও বিহারের কিছু অংশ জয় করে প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং বাংলার খলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যা ১২০৩ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অল্প সময়ের জন্য বাংলা শাসন করে।
জীবন ও পটভূমি:
জন্ম ও উৎস: বখতিয়ার খলজি আফগানিস্তানের গরমশির (বর্তমানে দস্ত-ই-মার্গ) অঞ্চলের তুর্কি খলজি উপজাতির সদস্য ছিলেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশদ তথ্য জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় দারিদ্র্যের কারণে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বের হন।
কর্মজীবনের শুরু: তিনি প্রথমে গজনির সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার খর্বাকৃতি, অস্বাভাবিক লম্বা হাত ও চেহারার কারণে প্রত্যাখ্যাত হন। পরে দিল্লিতে কুতুবুদ্দিন আইবেকের দরবারেও তিনি চাকরি পাননি। অবশেষে বদাউনে মালিক হিজবরউদ্দিন তাকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেন, কিন্তু উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এতে সন্তুষ্ট হননি। পরে অযোধ্যায় মালিক হুসামউদ্দিনের অধীনে তিনি ভাগবৎ ও ভিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গির পান এবং নিজের সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন।
বাংলা ও বিহার জয়:
বিহার জয়: ১১৯৭-১২০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বখতিয়ার বিহারে একটি প্রাচীরবেষ্টিত স্থান আক্রমণ করেন, যা পরে জানা যায় ওদন্তপুরী বৌদ্ধ বিহার ছিল। তিনি এটিকে দুর্গ মনে করে আক্রমণ করেন এবং সেখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এই ঘটনা বিহার নামের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলা জয়: ১২০৪-১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেন রাজা লক্ষ্মণসেনের অস্থায়ী রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন শিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী অনুসারে, তিনি মাত্র ১৭-১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নদীয়ায় প্রবেশ করেন, যারা ঘোড়া ব্যবসায়ী হিসেবে ছদ্মবেশে ছিলেন। অতর্কিত আক্রমণে তিনি নদীয়া দখল করেন, যা বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করে।
শাসনকাল ও প্রশাসন:
বখতিয়ার খলজি একজন সুশাসক ছিলেন। তিনি লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করেন, মুহাম্মদ ঘুরির নামে মুদ্রা প্রচলন করেন এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটান। তিনি রাজ্যকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় মনোযোগ দেন।
তার শাসনামলে ভারতের অনেক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, যা পূর্ব ভারতে ইসলামি পণ্ডিতদের দাওয়াতের ফল।
নালন্দা ও বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস নিয়ে বিতর্ক:
কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয়, বখতিয়ার খলজি নালন্দা, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেন, যা উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের অন্যতম কারণ। তবে কিছু ঐতিহাসিক এই দাবির বিরোধিতা করেন, বলেন যে এই বিহারগুলো তার আক্রমণের আগেই পরিত্যক্ত বা দুর্বল অবস্থায় ছিল।
শরৎচন্দ্র দাশের তথ্য অনুযায়ী, ১২০২ সালে বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী ধ্বংস হয়, কিন্তু নালন্দার নাম উল্লেখ নেই। ১২৩৪-৩৬ সালে তিব্বতী সাধু ধর্মস্বামী নালন্দাকে চালু অবস্থায় দেখেছিলেন।
তিব্বত অভিযান ও মৃত্যু:
১২০৬ সালে বখতিয়ার তিব্বত আক্রমণের উদ্দেশ্যে একটি অভিযান শুরু করেন, যা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়, এবং তিনি ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন। দেবকোটে ফিরে এসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আলী মর্দান খলজি কর্তৃক ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
উত্তরাধিকার:
বখতিয়ার খলজির বাংলা জয় ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। তার শাসন বাংলায় মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে।
বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ তার “বখতিয়ারের ঘোড়া” কাব্যগ্রন্থে তাকে একজন বীর হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তবে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ধ্বংসাত্মক আক্রমণকারী হিসেবে বিবেচিত।
তার শাসনকালে ইসলামের প্রসার এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।