04/11/2024
বিয়ের এক মাসের মাথায় প্রথম কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম স্বামীর জন্য।সে খেয়ে বলেছিলো,হইছে ভালোই।
ভালো শব্দটার সঙ্গে যখন ই-প্রত্যয় যুক্ত করা হয় তখন তার মানে আসলে ভালো না;এটুকু বুঝার জ্ঞান আমার আছে।বিয়ের আগে বাবা-মায়ের আদরের কন্যা ছিলাম।কুটোটিও নাড়তে হয়নি কখনো।তাই,রান্নাবান্নায় আমি খানিকটা আনাড়ি-ই বলা চলে।মা যখন শিখাতে চাইতো তখন একটুও শিখতাম না।ভাল্লাগতো না।কিন্তু,এখন মনে হয়,,শিখলেই পারতাম ভালো করে!খুব তারিফ শুনতে ইচ্ছা করে মানুষটার মুখে।মনে হয়,সে বলুক,,বাঃ নীতি তোমার রান্না তো অসাধারণ সুস্বাদু। এমনিতে,সাধারণ ভাত,ডাল,তরকারি,মাছ সবই রাঁধতে পারি।একটু বিশেষ আইটেম গুলোতে যেয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলি।অভ্যাস নেই তো তাই!
সেদিন ইউটিউব দেখে দেখে মোমো বানালাম।মিনহাজ যখন খাচ্ছিলো তখন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম।ইশ!ভালো হইছে যেন বলে।কিন্তু,ও বললো,কিসব বানাও নেট ফেট দেখে।মুখে দেওয়া যায়না।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম।কই আমার কাছে তো বেশ সুস্বাদুই লেগেছিলো।
ও প্রায়শই বলে,ওর মায়ের রান্নার হাত চমৎকার। জীবনে এতো সুস্বাদু রান্না অন্য কাউকে আর করতে দেখেনি সে।স্বাভাবিক! সবার কাছেই নিজের মায়ের হাতের রান্না অসাধারণ লাগে।আমার কাছেও আমার মায়ের রান্না অমৃত।ওর কাছেও তাই হবে...তবু কেন যেনো একটু বিষন্ন অনুভব করলাম।ইউটিউব ঘেটে ঘেটে কতো নিত্যনতুন রেসিপি-র মাস্টার আমি হয়ে গেছি।তবে,সবসময়ই ওর একই কথা।-হুম ভালোই হইছে।
কিছুদিন বাদে শ্বাশুড়ি বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়।বিয়ের পরপরই মিনহাজের সাথে ওর কর্মস্থলে চলে এসেছিলাম আমি।শ্বাশুড়ির সাথে এক ছাদের নিচে থাকা তাই হয়ে ওঠেনি।তাকে অনেক বার সাধা হলেও,গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে তিনি রাজি হননি।
কাজেই,শ্বাশুড়ির সাথে খুব একটা মেলামেশা আমার হয়নি।তবে,যতটুকু বুঝেছি উনি খুব গম্ভীর আর চুপচাপ ধরনের মহিলা।চেহারায় জেদী ভাব প্রবল।
মিনহাজ একদমই মা বলতে অজ্ঞান।মায়ের বাধ্য সন্তান সে বলা চলে।আমি নিজেও কেন যেন খুব সমীহ করার পাশাপাশি খানিকটা ভয়ও পাই শ্বাশুড়ি মাকে।
তিনি বেড়াতে আসায় খানিকটা কুঁকড়ে গেলাম।মিনহাজ বললো,মা এসেছে মায়ের কাছ থেকে রান্না বান্না ভালো মতো শিখে নিবা।কি যে তুমি রাঁধো!
এই কথা শুনে আরো কুঁকড়ে গেলাম।সংকুচিত হয়ে পরলাম মনে মনে।আমার শ্বাশুড়ি পুরোদস্তুর গ্রামের মহিলা।যদি শোনেন চব্বিশ বছর বয়সী পুত্রবধু রান্নায় তেমন পারদর্শী না তাহলে নিশ্চয়ই খুব ক্ষেপবেন।তার ছেলের মুখে আমার রান্না রুচে না, এই জিনিস গ্রামীণ কোনো মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না।হয়তো খোঁটা দিবেন,এতো বড় মেয়ে তবুও স্বামীর মনের মতো রান্না জানো না?আমার ছেলেটা তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।কিংবা হয়তো মা তুলে কথা বলবেন,তোমার মা কিছু না শিখিয়েই পাঠিয়ে দিলো?
এর থেকেও বাজে ভাষায় হয়তো বলবেন।মনটা খারাপ হয়ে গেলো।এতো খারাপও তো আমি রাধি না,মিনহাজ যেভাবে বললো!
আমার লজ্জা লজ্জা লাগছিলো।কিছুতেই আমি উনাকে বলতে পারলাম না,আপনি আমাকে একটু রান্না শিখান।তবে,উনিই সেদিন রাঁধলেন।ছোট মাছের চচ্চড়ি,মেটে আলু দিয়ে রুই মাছের তরকারি,লাউশাক দিয়ে চিংড়ি আর পাঁচমিশালি সবজি।সবশেষে, গ্রাম থেকে আনা আখের গুড় দিয়ে পায়েশও বানালেন।
আমি রান্নাঘরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলাম কিভাবে তিনি রাঁধলান।তার অভিজ্ঞ হাত,মশলার পরিমাণ তার মুখস্থ, আমার মতো হিসাব নিকাশ তাকে করতে হয়না,,খুব দ্রুতই সব রান্না শেষ হয়ে গেলো।আমি কেবল ডালটা রাঁধলাম শেষে।ডাল ছাড়া আমি খেতে পারিনা।
রাতে খেতে বসে মিনহাজ হৈহৈ করে উঠলো।বলতে লাগলো,আরে ঘ্রাণ পেয়েই বুঝছি,আজ মা রেঁধেছে।আজকে তো পুরো পাতিলের ভাত আমিই খেয়ে ফেলবো।মিনহাজকে এতো খুশি দেখে আমার ভাল্লাগলো।টেবিলে খাবার বাড়তে লাগলাম।তবে মনে মনে,চিনচিনে একটা কষ্টও হচ্ছিলো।
তিনজন একসাথেই টেবিলে খেতে বসেছি।
মিনহাজ বারবার তারিফ করছে,কতো দিন পর পেট ভরে,মন ভরে খেলাম!
একপর্যায়ে, শ্বাশুড়ি আম্মা জিজ্ঞেস করলেন,এমন হাভাতেদের মতো করছিস কেন?নীতি কি তোকে খাওয়াতো না এতোদিন?
মিনহাজ হাসতে হাসতে অকপটেই বলে ফেললো,আরে ধুরর নীতি এ যুগের মেয়ে।ও কি রাঁধতে জানে?কিসব যে রাঁধে ইউটিউব ঘেটে ঘেটে ও-ই জানে।তুমি একটু শিখিয়ে যেয়ো তো ওকে তোমার স্পেশাল কয়টা রান্না।
আমার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো।তবুও,জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম ঠোঁট বেঁকিয়ে।
আমার শ্বাশুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,দাও তো বউমা তোমার ডাল কয়েক চামচ খেয়ে দেখি।কতোটা বাজে রাঁধো তুমি।
আমি আরো একবার হাসিমুখে অপমানিত হওয়ার জন্য ডাল এগিয়ে দিলাম।
তিনি আমাকে অবাক করে সেদিন ডাল দিয়ে, লেবু চিপেই সবগুলো ভাত খেলেন।নিজের রাঁধা একটা তরকারিও পাতে তুললেন না।
আমি আর মিনহাজ অনেকবার বললাম একটা মাছের পিস নিন।
উনি নিলেন না।মিনহাজ হেসে বললো,মা তোমার কি এতোই ভাল্লাগলো ওর ডাল?
উনি কোনো কথাই বললেন না।খাওয়া শেষে আমাদের দুইজনের দিকেই তাকিয়ে বললো,আমার যখন বিয়ে হয় নতুন নতুন।তোর বাবাও একই কথা বলতো,আমি রাঁধতে জানিনা।বাড়ির সকলে বলতো আমার রান্না মজা হয়না,মাটির মতো বিষাদ লাগে।একবার আমার শ্বাশুড়ি তো ডালের হাড়ি ছুঁড়ে ফেলেছিলো, বেশি পাতলা করে ফেলেছিলাম নাকি ডালটা।তখন আমার বিয়ের বয়সও চারমাস।
নীতিরও বিয়ের বয়স চারমাস।তবে,ও আমার চেয়ে দশগুণ ভালো ডাল রেঁধেছে।
উনি মুচকি হাসলেন।
আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মিনহাজও অবাক।সে বললো,সিরিয়াসলি?তোমার রান্না বাজে বলতো সবাই ?উনাদের টেস্টবাডে সমস্যা ছিলো মেবি।
উনি আবারও হাসলেন।বললেন,মানসিকতায় নির্ঘাত সমস্যা ছিলো।নাহয় একবারো ভাবলো না, সদ্য নিজের ঘর-পরিবার সব ছেড়ে চলে আসা মেয়েটা কতো যত্ন করে, কতো কষ্ট করে রাঁধছে।সে তো এতোমানুষের রান্নাবান্নায় অভ্যস্ত না,তবুও সে করছে।অথচ,তার প্রতি কারো বিন্দু মাত্র সহানুভূতি নেই।সবাই ব্যস্ত তার রান্নায় খুঁত ধরতে।ভুল করলে কেউ শুধরে দেয় না উল্টা মা-বাবা ছেড়ে আসা মেয়েটাকে মা-বাবা তুলে খোঁটা দেয়।কতো রাত যে চোখের পানি ফেলেছি হিসাব নেই।এসব কথা সন্তানদের সামনে বলা উচিৎ না,তবুও না বলে পারছি না,কারণ,না বললে হয়তো আজ থেকে ৩০ বছর পর আমার ছেলের বিরুদ্ধেও তার বউয়ের একই অভিযোগ থাকবে.....আমি ৩৫ বছর ধরে নিয়মিত রান্না করে আসছি আর নীতি নিয়মিত রান্না করছে এখনো ৫ মাসও হয়নি।অবুঝের মতো তুই ওর সাথে আমার রান্নার তুলনা দিস কেন?আমি যেন আর কখনো এরকম না শুনি।
মিনহাজ চুপ করে আছে মাথা নিচু করে।তার মূলত উদ্দেশ্য ছিলো না আমাকে কষ্ট দেওয়ার।আসলে সে ভাবতেও পারেনি,আমি কষ্ট পাই এধরনের কিছু বললে।।সে তো হাসতে হাসতে মজা করেই বলে।
সে আস্তে আস্তে বললো,নীতি তুমি কি আসলেই কষ্ট পাইছো?
সে তখনো বিশ্বাস করতে পারছে না আমার মতো শিক্ষিত,শক্ত একটা সাবলম্বী মেয়ে কেবল মাত্র স্বামী তার রান্নার তারিফ করে না এই সামান্য কারণে কষ্ট পায়।আমার শ্বাশুড়ি হেসে বললেন,বাবারে!মেয়েরা দুনিয়ার সবার সাথে যুদ্ধ করতে পারে,সবার দেওয়া আঘাতে শক্ত থাকতে পারে কেবল স্বামীর থেকে অতি সামান্য একটু কষ্ট পেলেও আয়নার মতো ঝনঝন করে ভেঙে পরে।
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে দুফোঁটা জল পরলো।
মিনহাজ এবার সত্যিই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
পরদিন উনি আমাকে বললেন,বউমা আমি তোমাকে একটা পুরানে দিনের রান্না শিখাবো আর তুমি আমাকে নতুন দিনের একটা রান্না শিখাও।আমি শিখাবো,জামাইআদর পিঠা বানানো।এই পিঠা আগের যুগে মেয়ের জামাই বেড়াতে এলে শ্বাশুড়িরা বানাতেন তো খুব তাই এমন নাম হয়েছে।তুমি কি বানানো শিখাবে আমাকে?
আমি বললাম,মোমো।
উনি হাসলেন,বাহ নামটাই তো কেমন আদর আদর।মোমো।
আমি হাসলাম।উনি এমনিতেই আমাকে শিখাতে পারতেন।বলতে পারতেন,আসো তোমাকে পিঠা বানানো শিখাই।উনি তা বললেন না।উনি নিজেও আমার কাছে শিখতে চাইলেন,যেন আমার মনে কোনো হীনমন্যতা না থাকে।যেন আমার মনে না হয় আমি কিছুই পারিনা....!
মা ডাকটা অনেক পবিত্র আর ভালোবাসাময়।নিজের মা ছাড়া যাকে তাকে মন থেকে মা ডাকা যায় না।ডাকা উচিৎ-ও না।ভুল মানুষকে এমন পবিত্র নামে ডাকলে ডাকটার অসম্মান হয়।
তবে,আমি সেদিন মন থেকেই উনাকে ডাকলাম,মা!
পরবর্তী পর্ব গুলো পেতে আমাকে ফলো করুন
👉 The Smile Vloger
মা
(সমাপ্ত)
゚