18/02/2025
ড. আজহারীর 'এক নজরে কুরআন' কি আসলেই হুবহু কপি বা অনুবাদ?
-----------------------------------------
সমালোচনা কাঙ্ক্ষিত যখন তা হয় গঠণমূলক ও সংস্কারমূলক । ড. মিজানুর রহমান আজহারীকে নিয়ে এ যাবত যত সমালোচনা হয়েছে তার সিংহভাগই বিদ্বেষমূলক, অপ্রাসঙ্গিক, অতিরঞ্জন ও অমূলক । এবার তার দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল 'এক নজরে কুরআন' গ্রন্থ নিয়েও একদল মানুষ সমালোচনায় আনন্দ খোঁজে বেড়াচ্ছে । অথচ আজহারী সাহেবের 'এক নজরে কুরআন' এর মত কোরআনের ইনফোগ্রাফিক খিদমাহ অন্যান্য ভাষায় হলেও বাংলা ভাষায় এটাই প্রথম বলে মনে হয় ।
শায়খ ড. আজহারী যা লিখেছেন তার সবটুকু পড়ার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি । মক্কায় অবস্থানের কারণে শায়খের বইটি এখনো হাতে পাইনি । তবে যে অংশ নিয়ে সমালোচকেরা নিজেদের ব্যাস্ত রেখেছে তা পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে । সমালোচকদের দাবি হচ্ছে শায়খ আজহারী তার 'এক নজরে কুরআন' বইটি বিজ্ঞ লেখক শায়খ ফাইজ আস সারীহ এর (معالم السور) 'মায়া'লিমুস সুয়ার' গ্রন্থের কপি করেছেন বা হুবহু অনুবাদ করেছেন । (! ) ( والله المستعان على ما تصفون )
এই অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর । এই ধরণের কাজ ইলমি খিয়ানতের অন্তর্ভুক্ত । একাডেমিক ভাষায় plagiarism বা লেখা চুরি । যেকোন লেখকের ব্যাপারে এত বড় অভিযোগ উত্থাপনের আগে শতভাগ নিশ্চিত না হলে তা নি:সন্দেহে মিথ্যা অপবাদ । কারো সম্মানহানি করাকে তাকে হত্যা করার মত অপরাধের মতই হারাম বলেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম । এই ধরণের অপবাদ ইসলামি শরিয়তে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।
শায়খ ড. আজহারীর ব্যাপারে আনা অভিযোগ কতটা বাস্তব? সংক্ষিপ্ত এই আলোচনায় আশা রাখি পাঠক বুজতে পারবেন অভিযোগের সত্যতা আসলে কতটুকু । নাকি তা হিংসার বশবর্তী হয়ে কেবলই নির্জলা মিথ্যাচার!
আমি এখানে কেবল সুরা ফাতিহার উপর ড. আজহারীর লেখা ও শায়খ ফাইজ আস সারীহ -এর 'মায়ালিমুস সুয়ার' (معالم السور) বইয়ের মিল ও অমিল তুলে ধরবো । ইন শা আল্লাহ । এতে করে সম্পূর্ণ কিতাবের উপর একটি ধারণা তৈরি হবে । তাছাড়া যেহেতু সমালোচনা সুরা ফাতিহার আলোচনা নিয়ে উত্থাপিত হয়েছে তাই এই সুরা নিয়ে কথা বলাই বাঞ্চনীয় ।
শায়খ ফাইজ আস সারীহ -এর 'মায়ালিমুস সুয়ার' (معالم السور) সম্পূর্ণ গ্রন্থটিতে চোখ বুলানোর সুযোগ হয়েছে । সেখানে তিনি প্রতিটি সুরাকে ৯/১০ টি শিরোনামে তুলে ধরেছেন । প্রায় সকল সুরায় তার আলোকপাতের ধরণ এমনই রেখেছেন ।
এবার আসুন দেখি লেখক তার কিতাবে কী কী শিরোনামে আলোচনা সাজিয়েছেন এবং সেগুলোতে কী উল্লেখ করেছেন । লেখক সুরা ফাতিহার আলোচনায় সর্বমোট ৯ টি শিরোনামে সম্পূর্ণ সুরাটির সামারী তুলে ধরেছেন । সেগুলো হলো :
১। সুরার নাম সমূহ
২। নামকরণের কারণ
৩। এক নজরে সুরা ফাতিহা
৪। সুরা ফাতিহার উদ্দেশ্য
৫। সুরা ফাতিহার বিষয়বস্তু
৬। মূল আলোচ্য বিষয়সমূহ
৭। গুরুত্বপূর্ণ শব্দাবলীর ভাবার্থ
৮। সুরার আয়াত সমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক বা মিল
৯। অহীর বার্তার নির্জাস বা আয়াত ভিত্তিক ফায়দা সমূহ
(মায়ালিমুস সুয়ার , শায়খ ফাইজ ইবনু সাইয়াফ আস সারীহ । পৃষ্ঠা : ১০,১১,১২ )
সুরা ফাতিহার আলোচনায় ড. আজহারীর 'এক নজরে কুরআন' গ্রন্থে উল্লেখিত শিরোনামের সংখ্যা ১৫টি ।সেগুলো হলো:
১। সুরা ফাতিহা নাজিলের ধরণ
২। এক নজরে ফাতিহা
৩। নামের রহস্য
৪। মেজর থিম
৫। সুরার শুরু শেষ সম্পর্ক ও অন্য সুরার সংগে সম্পর্ক
৬। শানে নুযূল
৭। সেগমেন্ট
৮। ফজিলত
৯। কজ এন্ড ইফেক্ট
১০। গতিপথ
১১। সেন্ট্রাল থিম
১২। কেইস স্টাডি
১৩। ওভারভিউ
১৪। রিফ্লেকশন্স / তাদাব্বুর
১৫। কিছু শব্দ জানতেই হয়
(এক নজরে কুরআন, ড. মিজানুর রহমান আজহারী । পৃষ্ঠা : ২৫, ২৬, ২৭, ২৮,২৯, ৩০ )
এবার আসুন 'মায়ালিমুস সুয়ার' (معالم السور) গ্রন্থের সাথে 'এক নজরে কুরআন' এর সুরা ফাতিহা অংশে কতটা মিল আছে তা বুজতে চেষ্টা করি । 'মায়ালিমুস সুয়ার' (معالم السور) গ্রন্থে উল্লেখিত ৯ টি শিরোনামের সাথে 'এক নজরে কুরআন' গ্রন্থের কয়েকটি শিরোনামে মিল রয়েছে । যেমন, সুরার অন্যান্য নাম, নামকরণের কারণ, এক নজরে সুরা ফাতিহা, বিষয়বস্তু , সুরার আয়াতসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ।
এই ৫ টি শিরোনামের বাইরে আরো ১০ টি অতিরিক্ত এবং ভিন্ন শিরোনাম ড. আজহারী তার 'এক নজরে কুরআন' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । যেগুলোর আলোচনার সাথে শায়খ ফাইজ সারীহের গ্রন্থের কোন মিল নেই । সেই ১০ টি শিরোনামে ড. আজহারী গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য উপস্থাপন করেছেন যা তার গ্রন্থকে অন্যান্য গ্রন্থ থেকে আলাদা করেছে । তার সাবলীল ভাষা চয়ন, আয়াতে কারীমার অনন্য শিক্ষা, প্রায়োগিক নানান দিক, গুরুত্বপূর্ণ নসিহা ও তাদাব্বুরের সংযোজন প্রশংসার দাবি রাখে । মজার ব্যাপার হলো, যে শিরোনামগুলোতে মিল রয়েছে সেগুলোর ভেতরকার আলোচনায় দুটি গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে ।
এ ধরণের মিল কেন রাখতে হলো?
আপনি যেকোন মুফাসসির এর তাফসীর খুলে দেখুন কোরআনের সুরার ব্যাপারে আলোকপাত করতে গিয়ে তাদের সবাইকেই এই কয়েকটি বিষয়ে প্রায় একই আলোচনা টানতে হয়েছে । হয়তো কেউ বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন কেউবা সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন । তবে তাদের সবাই এই তথ্যসমূহের মূল উৎসগ্রন্থের তথ্য বইয়ের শেষে লিখে দিয়েছেন । যেমন ধরুন, সুরা ফাতিহার নামকরণ , ফাতিহার অন্যান্য নাম, মূল আলোচ্যে বিষয় , এক নজরে ফাতিহা - এ সকল শিরোনামে প্রায় একই কথা সবাইকেই লিখতে হয়েছে ।
এর একটি নমুনা :
শায়খ ফাইজ এক নজরে সুরা ফাতিহা এই শিরোনামে উল্লেখ করেছেন, সুরার আয়াত সংখ্যা: ৭ টি, সুরাটি মাক্কী সুরা, মুসহাফের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রথম সুরা , নাযিলের ধারাবাহিকতায় পঞ্চম সুরা ।
শায়খ ড. আজহারী শায়খ ফাইজ এক নজরে সুরা ফাতিহা এই শিরোনামে উল্লেখ করেছেন, সুরার আয়াত সংখ্যা : ৭ টি, এটি মাক্কী সুরা, মুসহাফের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রথম সুরা ।
এক নজরে সুরা ফাতিহা নিয়ে কথা বলা প্রায় সকল মুফাসসির বা লেখক কে অবশ্যই এই কয়েকটি বিষয় তুলে ধরার বাইরে তেমন কিছু উল্লেখের সুযোগ নাই । জানতে চাই, এখানে একজন মাক্কী সুরা লিখলে অন্যজন মাদানী লিখতে পারবেন? ফাতিহার আয়াত সংখ্যা একজন ৭ টি লিখলে অন্যজনকে কপি হবার ভয়ে ৮ টি লিখতে হবে? আফসোস এই জাতির সমালোচকদের জন্য ! তবে তারা একটি জায়গায় সাধারণ মানুষদের ভুল মেসেজ দিতে সক্ষম হয়েছেন । তা হলো এই তথ্যসমূহের ইনফোগ্রাফিক স্টাইল । শায়খ ফাইজ আস সারীহের কিতাবে যে ইনফোগ্রাফিক স্টাইলের ব্যাবহার হয়েছে ড. আজহারীও একই স্টাইলে তার কিতাবে এই তথ্যসমূহে উপস্থাপন করেছেন । আর এতেই সমালোচকরা দুটি বইয়ের এই একটি পৃষ্ঠা কে সামনে এনে তুলকালাম কান্ড বাধিয়েছে । বলে বেড়াচ্ছে ড. আজহারীর 'এক নজরে কোরআন' গ্রন্থটি একটি আরবি গ্রন্থের কপি বা অনুবাদ!
( والله المستعان على ما تصفون )
এই মিল কতটা দোষের?
শায়খ ফাইজ আস সারীহের 'মায়ালিমুস সুয়ার' গ্রন্থের সাথে শায়খ ড. আজহারীর 'এক নজরে কুরআন' গ্রন্থের ইনফোগ্রাফিক স্টাইলের ক্ষেত্রে কাছাকাছি ডিজাইন হওয়া মানেই কপি বা অনুবাদ নয়, তা হতেও পারে না । ইনফোগ্রাফিক স্টাইলে এই ধরণের কিতাব যারাই লিখেছে সবার মাঝেই এই জায়গায় কিছুটা মিল খোঁজে পাওয়া স্বাভাবিক । সত্যায়ন প্রকাশন -এর বরাতে জানতে পেরেছি শায়খ ড.আজহারী চেয়েছিলেন একটা লিটারেচার রিভিউ লিখে দিবেন । অতটা জরুরী নয় ভেবে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান তা আমলে নেয়নি। পরবর্তী সংস্করণে সেটির উল্লেখ করার কথাও জানিয়েছেন ।
সুপ্রিয় পাঠক, ড. মিজানুর রহমান আজহারীর এক নজরে কোরআন গ্রন্থের ব্যাপারে উত্থিত সমালোচনার বাস্তবতা আপনাদের চোখের সামনে । জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত! দিন-রাত এক করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আমাদের কল্যাণে কাজ করে আর আমরা সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যাই । এ লজ্জা আমাদের সবার!
©Salauddin Makki