দিশারী দ্যা ডায়নামিক রিডার্স

দিশারী দ্যা ডায়নামিক রিডার্স ' কোনকিছুকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জ্ঞান ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত! '

বই পড়ে অন্যকে পড়ার সুযোগ দিন। নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করুন ও অন্যকে ও জ্ঞান অর্জনে সহযোগিতা করুন।

17/10/2025

(১)

ব্যারিস্টার আরমানের গুম নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি - যে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করতে পারার মতো না।

আমি পারি নাই।

সংবেদনশীল মানুষ হওয়ার দরকার নাই। জাস্ট খুব সাধারণ 'মানুষ' হলেও, আরমানের গুমের বীভৎস এই বর্ণনা - আপনাকে শেষ করে ফেলবে।

(২)

হাসিনার গুম সিন্ডিকেটের - সম্ভবত, সবচেয়ে নির্মম এবং নৃশংসতম অত্যাচারের ভিকটিম হচ্ছেনঃ ব্যারিস্টার আরমান।

ওনাকে "আট বছর" র‍্যাবের Task Force for Interrogation cell (TFI) - এই জায়গাতে গুম করে রাখা হয়েছিলো।

সবচেয়ে নির্মম - কেন বলছি এইটাকে? কারণ, গুমের শিকার অন্যান্য মানুষকেঃ হয় মেরে ফেলা হয়েছে। না হয় টর্চার করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু, আরমানকে আট বছর, এমন একটা পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছিলো, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে। বন্দী আরমান নিজে বহুবার অনুরোধ করেছে, এতো যন্ত্রণা দেয়ার চেয়ে - তাকে বরং মেরে ফেলতে।

আহারে। আরমানকে মেরেও ফেলা হয়নি।

(৩)

আট বছর - লোকটার টয়লেটে যাওয়ার স্বাধীনতা ছিলোনা। দেয়ালে হ্যান্ডকাফ দিয়ে শব্দ করে টয়লেটে যাওয়ার আবেদন জানাতে হতো। বহুবার কেউ আসেনি তাকে টয়লেটে নিতে।

কাপড় নষ্ট হয়েছে। সেই ময়লা আবার তাকেই পরিষ্কার করতে দেয়া হয়েছে। বন্ধ রুমের গরমে, ঘাম প্রস্রাব ঝড়ে ঝড়ে - তার মেঝেতে পানি জমে যেতো। তার মধ্যে ঘুমিয়েছে আরমান।

হাতকড়া পরে থাকতে থাকতে, আরমানের কবজিতে ফোসকা পড়ে গেছিলো। তখন সেই হাতকড়া খুলে তার পায়ে পরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরবানির গরুকেও এই নৃশংস যন্ত্রণা দেয়না মানুষ।

(৪)

জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। ৩২ বছর বয়সী ইয়াং আরমানকে বাসা থেকে গুম করা হয়। যখন ফিরলো, তখন তার বয়স চল্লিশ। চোখে দেখেনা। হাঁটতে পারেনা। ভয় পায়।

ছোট ছোট দুইটা মেয়ে সন্তান। বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো খালি পায়ে, ছোট মেয়েটা বাবার দুইটা জুতা হাতে তুলে পিছে পিছে যাচ্ছিলোঃ বাবা তোমার জুতা।

সহ্য করার মতো নারে ভাই।

(৫)

মেয়েগুলো এখন বড় হয়ে গেছে। বাবা বেঁচেই ছিলো, কিন্তু নিজের চোখে বাচ্চাগুলোর বড় হওয়ার দৃশ্য দেখতে পায়নি।

বাচ্চাদের সাথে বাবার ইমোশনাল বন্ডিং তৈরি হওয়ার সময়টাতেই - বাবা ছিলোনা। বাচ্চাদের টেক কেয়ার করার জন্য বাবার চোখ ছিলোনা।

আরমানের স্ত্রী জানতো না, তার স্বামী বেঁচে আছে নাকি নাই। সে সধবা না বিধবা। এ কোন আঁধার, রাতের চেয়েও অন্ধকার...

আহারে আমার ভাই। আহারে।

(৬)

অন্ধকারে চোখ বাঁধা থাকতে থাকতে, আরমানের চোখে ছানি পড়ে গেছে। সবকিছু ঝাপসা দেখে।

লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে আসা লোকটার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার - সম্পূর্ণ শেষ। ফ্যামিলিটা ফাইন্যান্সিয়ালি ধ্বংস হয়ে গেছে।

অপুষ্টিতে ভুগে স্বাস্থ্যবান লোকটা শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে। লোকটার কথা বলার কেউ ছিলোনা জন্যঃ এক পর্যায়ে সে রুমের টিকটিকির সাথে, পিঁপড়ার সাথে কথা বলা শুরু করে।

টিকটিকির নাম ছিলো টুকটুকি। এই টুকটুকি, তোর কয়টা বাচ্চা? আমার দুইটা মেয়ে আছে ছোট....

(৭)

দাঁতে দাঁত চাপ দিয়ে - আরমানের গুমের এই ডকুমেন্টারি দেখেন।

১৫০০+ মানুষের ওপর এই মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালিয়েছে - হাসিনা আর তার লোকজন।

ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে এই গুমের কাহিনী লেখা হোক। এই জাতিকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে আওয়ামী রেজিমের জুলুমের ইতিহাস। আয়নাঘরগুলোকে মিউজিয়াম বানিয়ে, সেখানে বাচ্চাদের শিক্ষা সফরে নিয়ে আসা হোক।

আমরা যেন ভুলে না যাই, আওয়ামী জাহেলিয়াত কী জিনিস ছিলো। আমরা যেন মনে রাখি।

(৭)

ডকুমেন্টারির সবচেয়ে ভয়াবহ ক্লিপ হচ্ছেঃ আরমানের মুক্তি পাওয়ার দৃশ্যটা।

আট বছর পরঃ অচেনা রাস্তায় একটা পশুকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সে জানেনা, এটা কোন জায়গা। কতো সাল। সে জানেনা, সে কতো বছর বন্দী ছিলো। সে জানেনা, হাসিনা পালিয়ে গেছে। সে রাস্তাঘাট কিচ্ছু চিনতে পারছেনা।

সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছেঃ লুঙ্গি পরা একটা জীর্ণকায় লোক। দুই পায়ে টলতে টলতে, ইবনে সিনা হাসপাতালে ঢুকছে। আট বছর পরে কেউ তাকে চিনতে পারছে না। ময়লা কাপড়ের জন্য কেউ তাকে বিশ্বাস করছে না।

(৮)

লোকটা ভয়ে গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। যদি তাকে চিনতে পেরে আবারও কেউ ধরে নিয়ে যায়। পরাধীন থাকতে থাকতে, লোকটা ভুলেই গেছে যে - স্বাধীনতা এসে গেছে। হি ইজ ফ্রি।

আহারে লোকটা। বাকী জীবন কীভাবে কাটাবে এই ট্রমা নিয়ে?

একজনের কাছ থেকে একটা মোবাইল ধার করে আরমান নিজের নাম লিখে গুগল করেন। গুগলে তার পুরাতন চেহারার ছবি বের হয়ে আসে। নিজের চেহারার পাশে সেই মোবাইলের ছবি ধরেঃ ইবনে সিনার কর্মকর্তাদের তিনি বলেন, এইবার চেনা যায়?

(৯)

ওই প্রথমবার, আট বছর পর মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়ঃ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে (সম্ভবত) সর্বোচ্চ নির্যাতনের শিকার, মীর আহমাদ বিন কাশেম, আরমান। আমাদের ভাই।

কী অসম্ভব প্রাণশক্তি থাকলে, লোকটা এখনও মানসিকভাবে সুস্থ আছে, পাগল হয়ে যায়নি - ভাবতে অবাক লাগে। নিঃস্ব হয়ে গেছে লোকটা। এই ডকুমেন্টারি হচ্ছে আরমানের সেই জীবনের গল্প, যে জীবনের চেয়ে মৃত্যুই হয়তো ভালো ছিলো।

(১০)

আপনারা দয়া করে ডকুমেন্টারিটা দেখেন। বোঝেন। উপলব্ধি করেন। আরমানের সাথে আরমানের আটটা বছর - বিশ মিনিটে কাটিয়ে আসেন।

এই মহাপাপ, এই মহা অন্যায়ের বিচার দাবি করেন। চোখের জলে বুক ভাসান, যেভাবে আরমান ভাসিয়েছিলো তার শুয়ে থাকার মেঝেটা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাতে আরমান সহ গুমের প্রত্যেক ভিকটিমের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয় - সেই দাবিটা করেন রাষ্ট্রের কাছে।

(১১)

আমাদের দুর্ভাগ্য, এতো সবকিছুর পরেও কিছু অমানুষের বাচ্চা, আওয়ামী দলদাস মাদারচোদ - গুমের জলজ্যান্ত প্রমাণকে নাটক হিসাবে দাবি করে। দেড় হাজার মানুষের লাশ অস্বীকার করে।

মানুষ হিসাবে আপনার নিজের ওপর ঘেন্না জন্মাবে, যেঃ এইসব অমানুষের সাথে আপনাকে একই বাতাসে অক্সিজেন শেয়ার করতে হয়। একই মাটির স্পর্শ শেয়ার করতে হয়। একই সূর্যের আলো শেয়ার করতে হয়।

এইসব অমানুষের জাত, আওয়ামী শুয়ারের বাচ্চার সাথে আপনাকে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। কিছুই করার নাই।

(১২)

লজ্জা যদি এইটা না হয়, তো লজ্জা কী?

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম স্বৈরাচারঃ শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্যতম পিশাচের নামঃ শেখ হাসিনা।

আর কেউ না জানুক, আরমান জানে। ভাই আমার, আপনার বাকী জীবনটা সহজ হোক। সুন্দর হোক। দুনিয়াতে এখনও সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে যায়নি।

দুনিয়াতে এখনও কিছু "মানুষ" আছে।

- শুভজিৎ ভৌমিক

"আমি ঢাকায় বড় হওয়া মানুষ। ঢাকা নিয়ে, বড় বঙ্গ নিয়ে, আমার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি হয় নি কোনোদিন। অস্ট্রেলিয়ায় যেখানে...
17/10/2025

"আমি ঢাকায় বড় হওয়া মানুষ। ঢাকা নিয়ে, বড় বঙ্গ নিয়ে, আমার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি হয় নি কোনোদিন। অস্ট্রেলিয়ায় যেখানেই আমি সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকান পাই, ঢুকে পড়ি। কোথায় যেন একটা আশা আমাকে খোচা দেয় বারবার। যদি কোনো বই পাওয়া যায়। এরকম ঘোরাঘুরিতেই একদিন ক্যানবেরায় পেয়েছিলাম শায়িস্তা ইকরামুল্লার ফ্রম পার্দা টু পার্লামেন্ট। ANU'র লাইব্রেরীর বাংলা বইয়ের কালেকশন নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যাবে, সেখানেই আমি প্রথম দেখতে পাই ভাই গিরিশচন্দ্রের কোরানের বঙ্গানুবাদ (কারো কাছে যদি বইটার ফার্স্ট এডিশান থেকে থাকে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন প্লীজ। আমি কিনতে চাই)।

হুট করে একটা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল দু সপ্তা আগে।

Erudite এর কোনো যুৎসই বাংলা নেই। আমাদের বয়েসী একজন লোককে আমি নির্দ্বিধায় erudite বলি: শিবলী আজাদ। ফেসবুকেই পরিচয়। এমন পাঠকের পরামর্শ ফেলে দেয়ার মতো না। পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহার পড়ে সত্যিই আশ্চর্য হলাম। আমার শহর ঢাকা নিয়ে এই বই।

আর্টিস্ট হিসেবে পরিতোষ সেনের পরিচয় জানা ছিলো কিন্তু তিনি যে লেখকও ছিলেন সেটা আমার জানা ছিলো না। শুধু লেখক বললে কম বলা হবে, তিনি যে একেবারে মুজতবা আলী, তপন রায় লীগের লেখক ছিলেন সেটা না জানাটা একরকম লজ্জার বিষয়।

তিনি ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে থেকেছেন ৩০ এর দশকে। সেই সময়ের ঢাকায় তার কিশোর বেলার চোখে দেখা সাধারণ কিছু মানুষকে নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সেই গল্পের ব্যাকড্রপ হোলো এই শহর। পুরোনো ঢাকার এই মানুষগুলোর একটা ক্যারেক্টার ছিলো, এমনি তাদের উপস্থিতি যে ডেন্টিস্ট আখতার মিঞার কথা আমি ভুলতেই পারছি না। আমার খুবই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে সত্যিকার জীবনে মানুষটা কেমন ছিলেন। জানতে ইচ্ছা হয় দর্জি হাফিজ মিয়া, নিয় মার্কেটের বশির টেইলরের যে দর্জি আমার পাঞ্জাবি বানিয়েছিলো তার বাবাকে দর্জিগিরি শিখিয়েছিলো কি না (এই ভদ্রলোক ৫০ এর দশকে নিউ মার্কেটে ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছিলেন। সেই দোকানে আজো ঢাকার একমাত্র সঠিক চুড়িদার বানানো হয় ছেলেদের। আর বানানো হয় সবচেয়ে ভালো শেরওয়ানী। এখন থার্ড জেনারেশন ব্যবসা করছেন। স্যাভিল রো'র যে বংশানুক্রমিক টেইলরিং বাংলাদেশে তার একমাত্র তুলনা হতে পারে এই বশির টেইলর)

এমন ঘটনা আগেও একবার হয়েছিলো। ঝুম্পা লাহিড়ির ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিজ এর একটা গল্পের নাম ছিলো When Mr. Pirzada Came to Dine . প্রথম পুরুষে লেখা গল্পের বিষয় বস্তু হোলো ১৯৭২ সালের দিকে লাহিড়ির বাসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক পীরজাদা এক রাতে তাদের আমেরিকার বাসায় যে এসেছিলেন সে রাতের গল্প। বেশ কয়েক বছর আগে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ইত্তেফাকে লাহিড়ির বইটার রিভিউ করতে গিয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে লাহিড়ি যদি ফোন ডিরেক্টরীটাও একটু ঘাটাঘাটি করতেন তাহলে এর চেয়ে ভালো একটা বাঙালি নাম কল্পনা করতে পারতেন। আসলে সৈয়দ সাহেব যদি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোন ডিরেক্টরিটা একটু কষ্ট করে ঘাটাঘাটি করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন ঝুম্পা বানিয়ে লেখেন নি কিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে আসলেই পীরজাদা নামের একজন শিক্ষক ছিলেন, তিনি অবাঙালি ছিলেন, তিনি পীরের ছেলেই ছিলেন, এবং তিনি আসলেই পিএইচডি করছিলেন ৭২ এর দিকে আমেরিকায়। আমি ছাত্রাবস্থায় বোটানী ডিপার্টমেন্ট এর প্রবীণতম শিক্ষকের সাথে দেখা করে নিশ্চিত হয়েছিলাম।

কোথায় যেন এই মানুষগুলোর সাথে আমার একটা যোগসূত্র খুঁজে বেড়াই আমি। ছোট্টবেলায় পুরোনো ঢাকার পাতলা খান লেনে নানার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময়ে যে রহস্য আমার মাথায় ঢুকে পড়েছিলো কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে, তার থেকে নিস্তার নাই।

আমার নেক্সট টার্গেট হোলো জিন্দাবাহার লেনের পরিতোষ সেনের সেই বিখ্যাত ডেন্টিস্ট আখতার মিয়ার সন্ধান বের করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ায় অংশ নেয়া এই মজার মানুষটার বিয়ে হয় ১৯৩২-৩৫ এর দিকে। আমার হিসেবে তার নাতি আমাদের বয়েসী কিংবা আমাদের চেয়ে একটু বড় হওয়ার কথা। কেউ তাকে চিনে থাকলে দয়া করে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি তার ছবি দেখে নিশ্চিত হতে চাই যে গরু তার গায়ের লোমকে ঘাস ভেবে চিবিয়ে খেয়েছিলো কি না, আর তার স্ত্রীর চেহারা দেখে নিশ্চিত হয়ে নেবো যে ফুল ছুড়ে মারার মতো হিম্মতওয়ালী সে ছিলো বিলক্ষণ।

হ্যারল্ড পিন্টার ১৯৭১ এ দা গো-বিটউইন নামের একটা চমৎকার সিনেমার ফিল্ম এডাপটেশন করেছিলেন। সিনেমাটা শুরু হয় একটা অসাধারণ ডায়ালগ দিয়ে: The past is a foreign country: they do things differently there. আমাদের দেশে তিরিশ বছর আগে আমরা কী করতাম সেটাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে - কোথাও রেফারেন্স নাই কোনো।

আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে কতোটা মাহরুম সেটা বোঝার একটা চমৎকার এক্সারসাইজ হোলো এই জিন্দাবাহার। আপনার মনে হবে যে আপনি অন্য কোনো দেশের গল্প পড়ছেন। এই ঢাকা শহরটা তিরিশের দশকে কেমন ছিলো তার ফার্স্ট হ্যান্ড বর্ণনা খুবই কম। মুসলমানের বর্ণনা যাও বা আসে কেমন যেন আগন্তুকের মতোন। জিন্দাবাহারের গুরুত্ব ঠিক এখানেই। কিশোর বয়েসে সেনের দেখায় যে রোম্যান্টিসিজম সেটাও অনবদ্য, দারুণ টানে (কারণ আমি ওল্ড ওয়ার্ল্ড এর মানুষ, টাইম মেশিনে ভুল চাপাচাপি করে চলে এসেছিলাম ভবিষ্যতে)।

কখনোই ঢাকার নবাবদের সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা খুঁজে পাই নি কোথাও। সেনের বাবা নবাবের চিকিৎসক ছিলেন বলে গিয়েছিলেন একদিন নবাববাড়িতে বাবার সাথে। তার ছোট্টবেলার চোখে ঢাকার নবাবের সেই আজিজী, সেই আন্দাজ, সেই ওল্ড স্কুল চার্ম এড়ায় নি মোটেও। আমার ছোট্টবেলার চোখেও ধরা পড়েছিলো সেই ওল্ড ওয়ার্ল্ড এর চার্ম। আমি বুঝেছিলাম শরীফ মুসলমান বলতে বেগম শায়িস্তা ইকরামুল্লাহ কী বলেছিলেন। সেই চার্ম আমি দেখেছিলাম DOHS এ কর্নেল ফারুকের মা, পাড়ার আমার বয়েসী অনেক কিশোরের সেই রহমান দাদীর মাঝে, উইংকমান্ডার আবুল মির্জার মাঝে, তার স্ত্রীর মাঝে, শাহীন স্কুলে ক্লাস সিক্সে ইংরেজির শিক্ষিকা জাকিয়া ইসলাম ম্যাডামের মাঝে।

কী যে আমরা হারিয়েছি তার কোনো ধারণাই অবশিষ্ট নাই আর।। অথেনটিক বাঙালি হতে গিয়ে মুসলমানের যে কালচারাল সফিস্টিকেশন সেটাকে বিসর্জন দিয়েছি সবার আগে। আর আমার সময়ে সেক্সি হতে গিয়ে যা কিছু ইনট্রীগ তার পুরোটাই জলাঞ্জলি দিয়ে অথেন্টিক ফকিন্নী। যাক সে কথা, সেই আলাপ আমি জমিয়ে রেখেছি বুড়ো বয়সে যে আত্মজীবনী লিখবো সেটার জন্য।

জেনানার অবোরোধবাসিনীর জীবন যে পুরোটাই অপচয় হয় নি এই সত্য উপলব্ধি করতে আরো কিছু কাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। দয়া করে এর তর্জমা এভাবে করবেন না যে আমি মেয়েদের অবরোধের বিজ্ঞাপন করছি। বিজ্ঞাপন যদি করে থাকি সেটা সেই সে সময়ের ইনট্রীগ এর, জেনানার না।

জিন্দাবাহার অবশ্য পাঠ্য। আমার পূর্বপুরুষ তাদের জীবনটা অপচয় করেন নি পুরোটা, তারা আদিম ছিলেন না, অপাঙতেও ছিলেন না, তারা ফালতু ছিলেন না - এই ধারণাগুলো বদ্ধমূল হলে ক্ষতি হয় না মোটেও। সেজন্য জিন্দাবাহারের প্রয়োজন আছে। আর ওরকম বর্ণনা আমাদের কালে লেখার মতোন ক'জন লেখকই বা অবশিষ্ট আছেন। পড়ে দেখবেন - বিফলে মূল্য ফেরৎ।"

- ফাহাম আব্দুস সালাম
৯ই আগষ্ট, ২০১৫

প্রিয় জোহানিস, তুমি যখন এ চিঠি পড়বে তখন আমি মৃত্যুর সমুদ্র পার হয়ে যাবো। পৌঁছব পরপারে। আজ আমার কাছে সব কিছুই এমন অদ্ভূত ...
14/10/2025

প্রিয় জোহানিস,

তুমি যখন এ চিঠি পড়বে তখন আমি মৃত্যুর সমুদ্র পার হয়ে যাবো। পৌঁছব পরপারে। আজ আমার কাছে সব কিছুই এমন অদ্ভূত যে তোমাকে সবকিছু লিখতে সংকোচ লাগছে না। মনে হচ্ছে, দ্বিধা করার কোন কারণই কোনদিন ঘটে নি। তোমাদের মতো যখন সুস্থ ছিলাম, তখন অসহ্য বেদনা চুপ করে সয়েছি, তবু তোমাকে একটা লাইন লিখে মনের কথা ব্যক্ত করিনি। কিন্তু এখন আমার মন সকল সংকোচের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে গেলেন ফুসফুসের অতি সামান্য অবশেষের উপরে আমার বাকি দিন কটা দাঁড়িয়ে আছে। এখন সংকোচ আর ভদ্রতার কি মূল্য, বল?

‘আজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোমার সঙ্গে শেষ আলাপের কথাগুলো রোমস্থন করছি। সেই বনের মধ্যে আমাদের শেষ সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে তোমার? তখন জানতাম না, সে-ই আমাদের শেষ দেখা। যদি জানতাম, তাহলে তোমার কাছ থেকে ভালো করে বিদায় নিয়ে আসতাম। এ জীবনে তোমার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না। অনুশোচনায় আমার বুক ভরে উঠছে। কেন সেদিন তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়িনি, কেন তোমার চলার পথের ধুলো মাথায় নিয়ে তোমাকে জানতে দিইনি কি গভীর ভাবে তোমাকে ভালোবাসতাম! কাল থেকে শুয়ে শুয়ে কেবলই ভাবছি- যদি অন্তত একবার অল্প সময়ের জন্যও সুস্থ হয়ে উঠতে পারতাম! জীবনের কোন আনন্দ উপভোগ করার জন্য ভালো হতে চাই না; শুধু একবার, আর-একটিবার, বাড়ি গিয়ে তোমার সহস্র স্মৃতি বিজড়িত বনের পথে বেড়াতে চাই। যে-গাছটির নিচে তুমি আমার হাত ধরে বসেছিলে, সেখানে আর-একবার গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে। তাহলে হয়ত আবার তোমার উপস্থিতিটা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারব। কিন্তু আমি তো বাড়ি যেতে পারব না। যদি না- মা যেমন আশা করেন- একটু ভালো হয়ে উঠতে পারি।

‘প্রিয় জোহানিস, মৃত্যুর ছায়ায় ভালোবাসার হিসাব-নিকাশ করতে বড় অদ্ভুত লাগছে! মনে হচ্ছে, শুধু তোমাকে ভালোবাসার জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলাম; জীবনের সেই একটিমাত্র কর্তব্য সমাপ্ত করেই সংসার থেকে বিদায় নিচ্ছি। বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে আশ্চর্য লাগছে। জীবন আর জীবনের কলরব পিছনে ফেলে পায়ে-পায়ে মৃত্যুর অভিমুখে এগিয়ে যাওয়াই কি প্রেম। পৃথিবীতে আবার বসন্ত আসবে, কিন্তু আমি দেখব না। শহরের এই পথ, দুপাশের বাড়ি- সবকিছূ চিরদিনের জন্য রেখে যেতে হবে। আজ আমাকে অল্প সময়ের জন্য বিছানায় উঠে বসার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। জানালা দিয়ে পৃথিবীকে শেষবার দুচোখ ভরে দেখে নিলাম। পথের মোড়টায় দুই ভদ্রলোক পরস্পরকে অভিবাদন জানালেন, কি যেন বলে দুজনেই হেসে উঠলেন। এই রোগশয্যা থেকে আমি আজ তাদের লক্ষ্য করছি, কিন্তু শীগগির তাদেরও যে মৃত্যু হবে- একথা জানিলে তারা বিশ্বাস করবেন না! আমি যে মুত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছি, ঐ ভদ্রলোকেরা তা জানেন না। জানলেও তাদের ভদ্রতা-বিনিময় এমনি করেই চলত। আমার মৃত্যু পৃথিবীর জীবনধারায় বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটাতে পারবে না। গতকাল সন্ধ্যায় পর অন্ধকার যখন গাঢ় হয়ে উঠতে লাগল, তখন মনে হল শেষ মুর্হূত ঘনিয়ে এসেছে। শ্বাস নিতে পারছি না, হৃৎপিন্ড বন্ধ হয়ে যায় বুঝি! যেন অচেনা সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। পর মুহূর্তেই ফিরে এলাম পৃথিবীতে; যেন বহুদূরের কোন অনাবিস্কৃত দেশের আভাস দেখে ফিরে এলাম। হৃৎপিন্ড আবার চলতে শুরু করল। জীবন-মৃত্যুর সেই অনুভুতি আমি বর্ণনা করতে পারব না। মা বলেন, ও কিছু না। আমার দুর্বল মস্তিষ্কে শুধু গ্রামের ঝর্ণা আর ছোট নদীটা খল্খল্ শব্দে খেলা করে যায়।

জোহানিস, তুমি যদি জানতে তোমাকে কত ভালোবাসতাম! কখনো তা প্রমাণ করার সুযোগ পাইনি। নানারকম অন্তরায় ছিল, সবচেয়ে বড় বাধা ছিল আমার স্বভাব। এ স্বভাব আমি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি বুক ভেঙ্গে গেলেও মুখ বুজে থাকতেন। আমি তো তারই মেয়ে! কিন্তু আজ মৃত্যুর স্পর্শে আমি নতুন মানুষ হয়ে উঠছি। আমার সেই মনের শক্তি, স্বভাবের একগুয়েমি দূর হয়ে গেছে। তাছাড়া অনেক দেরি হয়ে গেল যে! তাই কোন স্বীকৃতি বা সঙ্কোচ এখন দ্বিধার সৃষ্টি করে না। পৃথিবীর কাছ থেকে বিদায় নিতে পিছন ফিরে জানিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু এই স্বীকৃতির আজ কি মূল্য? নিজের মনেই এ প্রশ্ন অনেকবার জেগেছে। বিশেষ করে তোমার কাছে এর কোন মূল্য নেই। কারণ মৃত্যু আমাকে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে। তবু সব কথা লিখে আমার মনের সত্যিকারের ছবিটা তোমার কাছে রেখে গেলাম। এমনি করে মন উন্মুক্ত করে দেবার মধ্যে তৃপ্তি আছে। নি:সঙ্গ মৃত্যুশয্যায় শুয়েও নিজেকে এখন একা মনে হচ্ছে না। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকবে সেই আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠছি।

‘আমার এই চিঠি যখন তুমি পড়বে তখন তোমার মুখের রেখায় কোন্ ভাষা ফুটে উঠবে তাই মনে মনে কল্পনা করছি। তুমি যখন চোখের সামনে চিঠিটা খুলে নতুন আবিষ্কারের আনন্দে-বেদনায় শিহরিত হয়ে উঠবে, তখন অদৃশ্যলোক থেকে আমি তোমার ভাবান্তরটা দেখতে চাই। আমাদের দুজনের মধ্যে এতদিন ধরে যে-ব্যবধান চলে এসেছে সেটা এই চিঠি দূর করে দেবে। আমার তো মনে হয়, আমাদের মধ্যে মিলনের সেতুটা ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। তোমাকে এখানে ডেকে পাঠাবার অধিকার আমার নেই। মা দুদিন আগেই তোমাকে খবর পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি নিষেধ করেছি। আমার মনে হয়, দেখা হওয়ার চেয়ে চিঠি লেখাই এখন ভালো। আমার অসুখের আগের রূপটাই তোমার মনে বেঁচে থাক, এই আকাংখা আমাকে পরাজিত করেছে। তোমার স্মৃতির পটে চিরদিনের জন্য পান্ডুর চেহারাটা দেখিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।.......যদি সময় থাকে, তবু তুমি আমাকে মৃত্যুর পর দেখতে এসো না, এই আমার অনুরোধ। হয়ত আমার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি; একটু জীর্ণ শুকনো হয়েছি, মুখ হয়েছে মলিন। তবু আমি নিশ্চিত আমার আজকের চেহারা তোমাকে দু:খ দেবে। তুমি এসো না, প্লিজ।
‘সারাদিন ধরে থেমে থেমে এ চিঠি লিখছি। তবু যা বলতে চাই তার কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না। মৃত্যুটা এত ভয়ংকর লাগছে। আমি মরতে চাই না, জোহানিস, আমি বাঁচতে চাই। আমার শিয়রে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে, তবু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন অন্তত বসন্তকাল পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন। তখন দিনগুলি হাল্কা হবে, গাছগুলি সবুজ রঙিন পোষাক পরবে।

জোহানিস, আবার যদি ভালো হয়ে উঠতে পারি- তোমাকে কখনো দু:খ দেব না। একদিন তোমাকে যে-আঘাত দিয়েছি, তার জন্য কেঁদে কাটিয়েছি কত বিনিদ্র রজনী। শুধু তোমাকে নয়, বাঁচার অধিকার পেলে কাউকে আমি কোনো দু:খ দেব না। পথের পাথরকুচিগুলি মাড়িয়ে চলার জন্য তাদের কাছেও ক্ষমা চাইব। আমি বাঁচতে চাই, পৃথিবীর দরিদ্রতম লোক হয়েও বাঁচতে চাই। সংসারের সহস্র অভাবের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও করব না। আমাকে যারা আঘাত করবে, তাদের অর্ভ্যথনা করব হাসি দিয়ে। হে ঈশ্বর, আমাকে শুধু বাঁচতে দাও।

‘জীবনটা বৃথাই শেষ হয়ে গেল। কারো জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এ জীবন কারো কোন উপকারেই এল না। যদি জানতে, বাঁচার কি উদগ্র কামনা নিয়ে মরতে বসেছি, তাহলে আমাকে ধরে রাখার জন্য হয়ত তুমি অসম্ভব চেষ্টা করতে। জানি, তোমার আন্তরিক চেষ্টাও কিছু করতে পারতো না, তবু শুয়ে শুয়ে কল্পনা করতে বেশ ভালো লাগে যে তুমি এবং তোমার বন্ধুরা ঈশ্বরের কাছে আমর জীবন ভিক্ষা করছ; আর তিনি তোমাদের কথা শুনছেন। যদি জীবন ভিক্ষা পাই- আমি তোমাদের সকলের ক্রীতদাস হয়ে থাকব; ভাগ্যদেবতার নিষ্ঠুর আঘাতগুলিও হাসিমুখে সহ্য করে যাব। তোমরা শুধু আমাকে বাঁচতে দাও।

‘মা আমার বিছানায় বসে কাঁদছেন। কাল সারাটা রাত কেঁদে কাটিয়েছেন। তার এই কান্না দেখে একটু তৃপ্তি পাচ্ছি। রিক্ততার ব্যর্থ বেদনা তার অশ্রুজলে অনেক লঘু হয়েছে। আজ শুয়ে শুয়ে ভাবছি- যদি আগের মতো সুস্থ দেহে, সুন্দর সেজেগুঁজে পথ চলতে চলতে হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তোমাকে এড়িয়ে যাব না; দ্বিধা না করে সোজা তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। তোমাকে আঘাত না করে, একটি গোলাপ উপহার দেব। আমার এই অপ্রত্যাশিত ভাবান্তরে তোমার চোখেমুখে কি বিস্ময় ফুটে উঠবে, মনে মনে তারই কল্পনা করছি। কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল- এ তো হবার নয়; আর কোনদিন পথে বের হতে পারব না। তোমার সঙ্গে আমার দেখাও হবে না।
‘দিনের মধ্যে অনেকবার আমি কাঁদি, শান্ত বিছানায় শুয়ে অশ্রান্তভাবে কেঁদে চলি। কান্না থামাবার মতো সান্তনা খুঁজে পাই না। কান্না আমার ক্ষতি করে না। বরং বুকটা হালকা হয়ে যায়। জোহানিস, প্রিয় সংসারে আমার সবচেয়ে প্রিয়তম, সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে তুমি একবার আমার শিয়রে এসে দাঁড়াও। আমি আর কাঁদব না। তোমার উপস্থিতির আনন্দে যতটা সুন্দর করে সম্ভব- রোগশীর্ণ মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তুলব!

‘হায়, আজ আমার গর্ব আর তেজ কোথায় গেল! পিতৃ-নামে পরিচিত হবার যোগ্যতাও আমি হারিয়েছি। সে হয়ত শারীরিক দুর্বলতার জন্য। জোহানিস, রোগশয্যা গ্রহণের অনেকদিন আগে থেকেই আমি যন্ত্রণা ভোগ করছি। তুমি যখন দেশ ছেড়ে কোথায় চলে গেলে, তখন কি-যে বেদনায় পুড়ে মরেছি, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। এরপর এলাম এই শহরে। এখানকার দিনগুলি নিরবচ্ছিন্ন বেদনার রক্তাক্ত ইতিহাস। দীর্ঘায়িত রাতগুলিকে প্রেতের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার ঘর থেকে দুবার তোমায় রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছি। মুখ তুলে চাইলে হয়ত আমাকেও দেখতে পেতে। কিন্তু তুমি তাকাওনি। তোমার দেখা পাব বলে অনেক আশা করে ক্যামিলাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এলে না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইনি, তোমার খুব কাছেও যেতে স্বপ্ন দেখিনি- শুধু দূর থেকে একবার দেখার ভারি লোভ হয়েছিল। কিন্তু তুমি আসো নি! হঠাৎ মনে হল, আমি যাব জেনেই বোধহয় তুমি পার্টি বর্জন করেছ। হতাশা ভোলার জন্য রাত এগারোটায় নাচতে আরম্ভ করলাম।... জোহানিস, আমি তোমাকে ভালোবাসি, এ জীবনে একমাত্র তোমাকেই ভালোবেসেছি। হ্যাঁ, এ অসম্ভব স্বীকারোক্তি সেদিনের সেই ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে লিখে যাচ্ছে। মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ স্বীকৃতির সাক্ষ্য রয়েছেন স্বয়ং বিধাতা!

‘এবার বিদায় নিতে হচ্ছে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে, ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। জোহানিস, বিদায়! তোমার ভালাবাসায়, তোমার স্বপ্নে, আমার জীবনের যে-দিনগুলি গোপনে মধুর হয়ে উঠেছিল- সে-দিনগুলির জন্য তোমায় ধন্যবাদ! তোমার নাম জপ করতে করতে আমি এই পৃথিবী থেকে যাত্রা করছি। তোমার জীবন সুখের হোক। যত দু:খ তোমাকে দিয়েছি- তার জন্য ক্রটি নিও না। মনে মনে আবারও তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করছি। জোহানিস, চিরদিনের জন্য বিদায়! এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। তোমার ভিক্টোরিয়া।...’

‘আলো জ্বেলেছি। ঘর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তন্দ্রা এসেছিল। তন্দ্রার মধ্যে যেন বহু দূর চলে গিয়েছিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এবার আগের মতো অত ভয় লাগেনি। বরং গান শুনতে পেয়েছি। তাছাড়া অন্ধকারও কেটে গেছে। বিদায়, প্রিয়তম, বিদায়...।’

ভিক্টোরিয়া \\ ন্যূট হামসুন
অনুবাদ : বুলবুল সরওয়ার

14/10/2025

"We don't read and write poetry because it's cute. We read and write poetry because we are members of the human race. And the human race is filled with passion. And medicine, law, business, engineering : these are noble pursuits and necessary to sustain life.
But poetry, beauty, romance, love: these are what we stay alive for."

🎬 : Dead Poets Society
Director : Peter Weir

এক.জামে মসজিদের পাশে প্রায়ই এক বুড়ো ফকিরকে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। উস্কো খুস্কো চুল, লম্বা দাড়ি, ময়লা পাগড়ী পরা বুড...
10/10/2025

এক.

জামে মসজিদের পাশে প্রায়ই এক বুড়ো ফকিরকে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। উস্কো খুস্কো চুল, লম্বা দাড়ি, ময়লা পাগড়ী পরা বুড়োর বয়স ষাটের ওপরে।
তার চোখ প্রায়ই লাল হয়ে থাকে।
বুড়ো প্রায় সারাদিনই রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, দেখলে মনে হয় তিনি কি যেন খুজছেন।
এমনিতে শান্ত হলেও কেউ কথা বলতে আসলেই বুড়ো একেবারে খেকিয়ে ওঠেন, এজন্য কেউ তাকে দেখতে পারে না।
অদ্ভুত এই বুড়ো কারো কাছে ভিক্ষা করে না, কিছু চায়ও না, আবার কিছু করেও না, কিন্তু তাকে প্রায়ই তাজা ফলমূল খেতে দেখা যায়, এমন সব ফল যা শহরের বাজারগুলোতে পাওয়া যায় না।
বুড়োকে একই সময় দুই বা তিন জায়গায় দেখা যায় মাঝে মাঝে, এটা নিয়ে শহরের লোকেরা অবাক হয়। এমনকি মাঝে মাঝে তাকে একই দিনে আঙ্কারা আর কোনইয়াতেও দেখার কথা শোনা গেছে মুসাফির আর বণিকদের মুখে।

বুড়ো পথে পথে ঘোরেন, আর একজনকে খোজেন। তাকে তিনি প্রায় কুড়ি বছর ধরে খুজছেন।
প্রতিরাতে তিনি স্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনা করে ঘুমাতে যান, জীবদ্দশায় যেন তিনি সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষকে খুজে পান, যাকে নিজের যাবতীয় বিদ্যা তিনি শিখিয়ে যেতে পারবেন। যে তার আগুনে মেজাজ সহ্য করতে পারবে।

এই বুড়োর নাম শামস। তিনি তাবরিজ থেকে এসেছেন।

কোনইয়ার চিনি ব্যবসায়ীদের সরাইখানায় একদিন তিনি এক যুবককে দেখলেন।

তার কেন যেন মনে হল, তিনি যাকে খুজছেন, তাকে এবার তিনি পেয়ে গেছেন।

সেদিন রাতে শামস এক রহস্যময় কণ্ঠকে বলতে শুনলেন, "তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেতে পারো বটে, কিন্তু সেজন্য তোমাকে তোমার জীবন দিতে হতে পারে।"

দুই.

১৫ই নভেম্বর,১২৪৪।
মধ্যবয়সী সুদর্শন এক উলামা ঘোড়ায় চড়ে মাদ্রাসা থেকে বাজারে যাচ্ছেন।
তার পেছন পেছন আসছে ছাত্রদের এক ছোটখাট মিছিল। তিনি যেখানেই যান, ছাত্ররা তার সাথে আঠার মত লেগে থাকে।

এই উলামা বেশ বিখ্যাত, আনাতোলিয়া তো বটেই,সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকেও তার নাম-ডাক আছে। বালখ থেকে আসা এই উলামার নাম জালাল উদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ।

রাজপথে হঠাৎ তার ঘোড়ার লাগাম ধরলেন বুড়ো ফকির। দু চোখ লাল, মুখ ধুলায় ধূসর।
শামস ই তাবরিজী।

শামস জালালকে প্রশ্ন করলেন, "এই উলামা,আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও, তারপর এখান থেকে তোমাকে আমি যেতে দেবো।"
জালাল বললেন, "বলুন শুনি কি আপনার প্রশ্ন।"
শামস বললেন,"বায়েজীদ বোস্তামী আর মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মধ্যে কে বড় সুফী??"
উলামা জবাব দিলেন, "এটা তো সহজ প্রশ্ন।"

শামস বললেন,বায়েজীদ তো একবার বলেছিলেন, সমস্ত গৌরব আমার হোক। কি চমৎকারই না আমার এই গৌরব!!

আর মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন, "আমার আরও ভালোভাবে অনুভব করা উচিত ছিল,আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা উচিত ছিল।"

জালাল এবার জবাব দিলেন, "বায়েজীদ আল্লাহকে খুব সীমিতভাবে অনুভব করেছিলেন, তাই তিনি এক মুহুর্তের জন্য বলে উঠেছিলেন, সমস্ত গৌরব আমার হোক।

আর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি মুহুর্তেই তার রবের আরো নিকটবর্তী হতে থাকতেন, যতই নিকটবর্তী হতেন, ততই তিনি তার আগেকার অবস্থা নিয়ে আফসোস করতেন।

তাই নবীয়ে কারীম মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ই সর্বশ্রেষ্ঠ সুফী।

আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা পরা শামস ই তাবরিজির মনে হল, তিনি তার আকাঙ্ক্ষিত ছাত্রকে পেয়ে গেছেন। তিনি সরাসরি জালাল উদ্দীনের চোখের ভেতরে তাকালেন।
জালাল উদ্দীনের মনে হল,তার মাথার তালু থেকে আকাশের দিকে ধোয়া উঠছে, ধোয়া উঠতে উঠতে তা যেন জান্নাতকে স্পর্শ করছে।
তিনি জ্ঞান হারিয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন।

জ্ঞান ফেরার পর জালাল উদ্দীন শামস ই তাবরিজীকে নিজের শায়খ হিসেবে গ্রহন করলেন। তারা প্রায় সব সময়েই একসাথে থাকতেন, দিনরাত তাদের ভেতর অত্যন্ত রহস্যময় ভাষায় কথাবার্তা হত।

শামস ই তাবরিজীর সাথে জালাল উদ্দীন চল্লিশ দিন ধরে নির্জনে সাধনা করেছিলেন। এই চল্লিশ দিন সাধনার পর থেকে জালাল উদ্দীন হয়ে গেলেন পুরোপুরি অন্য মানুষ।
প্রায় আড়াই বছর তাকে বিভিন্ন বিদ্যা শেখানোর পর একদিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলেন শামস ই তাবরিজী। তাকে আর কখনো খুজে পাওয়া যায় নি।

শামস ই তাবরিজীর এই হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট উলামা জালাল উদ্দীন মুহাম্মাদকে পরিণত করলো এক বিরহকাতর কবিতে।
ইনিই জালাল উদ্দীন মুহাম্মাদ রুমী আল বালখী।
মানুষ তাকে মাওলানা বলে ডাকে।

তিন.

মাওলানা রুমী তার প্রিয়তম বন্ধু শামসকে হারিয়ে তাকে খুজতে পথে নামলেন। দামিশকের দিকে যাবার সময় তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল,

Why should I seek? I am the same as
He.
His essence speaks through me.
I have been looking for myself!

তারপর তিনি থেমে গেলেন,ফিরে চললেন কোনইয়ার দিকে।
কোনইয়াতে যাবার পর থেকে তার মুখ থেকে একের পর এক কবিতার লাইন বেরিয়ে আসতে লাগলো।

এসব কবিতার বেশিরভাগ তার ছাত্ররা লিখে রাখতেন,অনেকেই মুখস্ত করে রাখতেন।
তার কাব্যের প্রথম সংকলন দিউয়ান ই শামস ই তাবরিজী।
এতে আছে প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার লাইন কবিতা।

রুমীর জীবনের সেরা কাজ বলা হয় মসনবী ই মানাউইকে।
শিষ্য হুসামউদ্দীন চেলেবীর অনুরোধে তিনি মসনবী ই মানাউই লেখার অনুমতি দেন।
মসনবীর ভুমিকায় মাওলানা বলেছেন,
"This is the book of the Masnavi, and it is the roots of the roots of the roots of the (Islamic) Religion and it is the Explainer of the Qur'ân."

তার মুখ থেকে একের পর এক ঝরে পড়া পঞ্চাশ হাজার লাইনের একটিও বাদ পড়ে নি তার ছাত্রদের কলমের গ্রাস থেকে, মসনবী সম্পর্কে প্রবাদ আছে, কুরআন যদি ফারসি ভাষায় নাযিল হত,তবে মসনবীকে কুরআন বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
প্রকৃতপক্ষে মসনবীর ভাব ও গড়ন,বর্ননারীতি নেয়া হয়েছে কুরআন আর হাদীস থেকে।

রুমী বলেন,
I am the servant of the Qur'an as long as I have life.
I am the dust on the path of Muhammad, the Chosen one.
If anyone quotes anything except this from my sayings,
I am quit of him and outraged by these words.

ইরানী গবেষক হাদি আল হারিরি দেখিয়েছেন, মসনবীর প্রায় ছয় হাজার লাইন আসলে কুরআনের আয়াতের প্রায় সরাসরি অনুবাদ।
এজন্যেই ইরানে চালু আছে আরেকটি প্রবাদ বাক্য,তিনি রাসুল নন, তবে তারও একটা কিতাব আছে।

চার.

রুমীকে বলা হয় ভালোবাসার কবি।তার একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি হচ্ছে,
There are many ways to find Allah.
Amongst them,I have chosen love.

ইসলামের ভয়কেন্দ্রিক প্রচারের চাইতে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকে।
মাওলানার মতে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন সমগ্র মাখলুকাতের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ হয়ে, তাই তার শিক্ষাকে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া সংকীর্ণ চিন্তার পরিচায়ক, এই শিক্ষা সবার জন্য।
"The Light of Muhammad does not abandon a Zoroastrian or Jew in the world. May the shade of his good fortune shine upon everyone! He brings all of those who are led astray into the Way out of the desert."

মাওলানা শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসতে, সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে যেতে।
তাই তিনি লিখেছেন,
On the seeker’s path, wise men and fools are one.
In His love, brothers and strangers are one.
Go on! Drink the wine of the Beloved!
In that faith, Muslims and pagans are one.

রুমী দেখিয়ে গেছেন, ইসলামকে অনুসরন করেই কিভাবে শত মত, ধর্ম, ভাষা ও গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারে।

তুরস্ক, আফগানিস্তান আর ইরান, এই তিনটি দেশের তিনি জাতীয় কবি। তুর্কীরা তাকে ডাকে মেভলানা, আফগানরা মাওলানা আর ইরানীরা মৌলভী।
পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মাওলানা রুমীর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

রুমীর ভালোবাসার কবিতা ছাড়িয়ে গেছে ধর্ম, দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির সীমানা।
আজ,আটশো বছর পরেও রুমীর কবিতা পড়া হয় ফারসি, তুর্কী, আরবী, উর্দু, স্প্যানিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজী, রুশ সহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জনপ্রিয় ভাষায়।
যেমনটা তিনি ভাবতেন,
Love, however, has its own many other dialects.

একজন মুসলিম হবার পরেও তার লেখা গজল শোনা যায় হিন্দুর মন্দির থেকে শিখের গুরুদুয়ারা,জৈন আশ্রম থেকে বৌদ্ধ মঠ, খ্রিস্টানের গীর্জা থেকে ইহুদীর সিনাগগ সর্বত্র।

ভালোবাসা থেকে রুমী কাউকে বঞ্চিত করতে চান নি, তিনি বলেছেন,
Come, come, whoever you are,
Wanderer, idolater, worshiper of fire,
Come even though you have broken your vows a thousand times,
Come, and come yet again.
Ours is not a caravan of despair.

তাই হয়তো আজ তার ভালোবাসার আহবান আজ ছড়িয়ে গেছে সবার ভেতর।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য,ইউএস বিলবোর্ড টপচার্টের অল টাইম টপ টোয়েন্টিতে আছেন রুমী, তার লেখা গজল আর কবিতায় তিনি উড়ছেন আটলান্টিকের ওপারের মার্কিন মুলুকেও, আটশো বছর পর।

গত কুড়ি বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক পঠিত কবির নাম রুমী,মাওলানা জালাল উদ্দীন মুহাম্মাদ রুমী।
তার প্রভাব পশ্চিমা শোবিজ তারকাদের মধ্যেও উপস্থিত, ম্যাডোনা, ডেমি মুর, হিউ গ্র‍্যান্ট, কেট উইন্সলেটের মুখে শোনা যায় তার কবিতা, বেয়ন্স নোয়েলস নিজের সন্তানের নাম রেখেছেন রুমী।

রুমীর শক্তি আসলে ভালবাসার শক্তি,এই শক্তিকে অন্য কিছুই স্পর্শ করতে পারে না।

১২০৬ সালের শরতের আজকের দিনে মাওলানা রুমীর জন্ম, ইন্তেকাল ১২৭৩ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর। ইন্তেকালের কিছুদিন আগেই তিনি বুঝতে পারেন,তার মৃত্যুর সময় এসে গেছে।
তিনি তার সন্তান ও ছাত্রদের জানিয়ে দেন তার মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে।
এসময়েও তার কাব্য রচনা থেমে থাকে নি।
If your thought is a rose, you are a rose garden.
If your thought is a thorn, you are fuel for the fire.
ডিসেম্বর মাসের সতের তারিখ তার ইন্তেকাল ঘটে।
মাওলানার কবরের এপিটাফে লেখা,

When we are dead, seek not our tomb in the earth, but find it in the hearts of men.

সানজাক ই উসমান \\ প্রিন্স মোহাম্মদ সজল

"আমার লেখা"- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমি কেমন করে লেখক হলাম, এ আমার জীবনের, আমার নিজের কাছেই একটা অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য ...
09/10/2025

"আমার লেখা"
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি কেমন করে লেখক হলাম, এ আমার জীবনের, আমার নিজের কাছেই একটা অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য হয়তো একথা ঠিক, নিজের জীবনের অতি তুচ্ছতম অভিজ্ঞতাও নিজের কাছে অতি অপূর্ব। তা যদি না হত, তবে জগতে লেখক জাতটারই সৃষ্টি হত না। নিজের অভিজ্ঞতাতে এরা মুগ্ধ হয়ে যায়-আকাশ প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে কত কল্পলোক রচনা করছে যুগে যুগে-তারই তলে কত শত শতাব্দী ধরে মানুষ নানা তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজের দিন কাটিয়ে চলেছে, মানুষের জন্ম-মৃত্যু, আশা-নৈরাশ্য, হর্ষ-বিষাদ, ঋতুর পরিবর্তন, বনপুষ্পের আবির্ভাব ও তিরোভাব-কত ছোট বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে -কে এসব দেখে, এসব দেখে মুগ্ধ হয়?

এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের চোখে কল্পনা সব সময়েই মোহ-অঞ্জন মাখিয়ে দিয়ে রেখেছে। অতি সাধারণ পাখীর অতি সাধারণ সুরও তাদের মনে আনন্দের ঢেউ তোলে, অস্তদিগন্তের রক্তমেঘস্তূপ স্বপ্ন জাগায়, আবার হয়তো তারা অতি সাধারণ দুঃখে ভেঙে পড়ে। এরাই হয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক। এরা জীবনের সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। এক যুগের দুঃখবেদনা আশা আনন্দ অন্য যুগে পৌঁছে দিয়ে যায়।

আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতা তাই চিরদিনই আমার কাছে অভিনব, অমূল্য, দুর্লভ হয়ে রইল। যে ঘটনা আমার জীবনের স্রোতকে সম্পূর্ণ অন্য দিকে বাঁক ফিরিয়ে দিয়েছে-আমার জীবনে তার মূল্য অনেকখানি।

১৯২২ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি নিয়ে ডায়মণ্ডহারবার লাইনে একটা পল্লীগ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি চাকুরি নিয়ে গেলাম আষাঢ় মাসে।

বর্ষাকাল, নতুন জায়গায় গিয়েছি। অপরিচিতের মহলে নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছি। বৈঠকখানা ঘরের সামনে ছোট্ট একটু ঢাকা বারান্দাতে একলা বসে সামনে সদর রাস্তার দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় একটি ষোল সতের বছর বয়সের ছেলেকে একখানা বই হাতে যেতে দেখে তাকে ডাকলাম কাছে। আমার উদ্দেশ্য, তার হাতে কি বই দেখব এবং যদি সম্ভব হয় পড়বার জন্যে চেয়ে নেব একদিনের জন্যে।

বইখানা দেখেছিলাম, একখানা উপন্যাস। এ লাইব্রেরির বই, আজ ফেরত দেওয়ার দিন। তবে লাইব্রেরি থেকে বই বদলে এনে দেব এখন। তার কাছে চাইতে সে বললে, আপনাকে তো দিতে পারছি নে,

-লাইব্রেরি আছে এখানে?

-বেশ ভাল আইব্রেরি, অনেক বই। দু আনা চাঁদা।

-আচ্ছা চাঁদা দেব, আমায় বই এনে দিও।

ছোকরা চলে গেল এবং ফেরবার পথে আমাকে একখানা বই দিয়েও গেল।

আমি তাকে বললাম তোমার নামটি কি হে? সে বললে-আমার নাম পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী, কিন্তু এ গ্রামে আমাকে সবাই বালক-কবি বলে জানে।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম-বালক-কবি বলে কেন? কবিতা-টবিতা লেখ নাকি?

ছেলেটি উৎসাহের সঙ্গে বললে-লিখি বই কি। না লিখলে কি আমাকে বালক-কবি নাম দিয়েচে? আচ্ছা কাল এনে দেখাব আপনাকে।

পরদিন সে সকাল বেলাতেই এসে হাজির হল। সঙ্গে একখানা ছাপানো গ্রাম্য মাসিক পত্রিকা গোছের। আমাকে দেখিয়ে বললে-এই দেখুন, এই কাগজখানা আমাদের গাঁ থেকে বেরোয়। এর নাম 'বিশ্ব'। এই দেখুন প্রথমেই 'মানুষ' বলে কবিতাটি আমার। এই আমার নাম ছাপার অক্ষরে লেখা আছে কবিতার ওপরে-বলেই ছোকরা সগর্বে কাগজখানা আমার নাকের কাছে ধরে নিজের নামটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে। হ্যা সত্যিই-লেখা আছে বটে, কবি পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী। তাহলে তো নিতান্ত মিথ্যা বলে নি দেখছি।

কবিতাটি সেই আমায় পড়ে শোনালে। বিশ্বের মধ্যে মানুষের স্থান খুব বড় -ইত্যাদি কথা নানা ছাঁদে তার মধ্যে বলা হয়েছে।

অবশ্য কাগজখানা দেখে আমার খুব ভক্তি হল না। স্টেশনের কাছে একটা ছোট প্রেস আছে এখানে, সেই প্রেসেই ছাপানো-অতি পাতলা জিল-জিলে কাগজ। পত্রিকাখানিকে 'মাসিক' 'পাক্ষিক' ইত্যাদি না বলে 'ঐকিক' বললেই এর স্বরূপ ঠিক বোঝানো হয়। অর্থাৎ যে শ্রেণীর পত্রিকা গ্রামের উৎসাহী লেখা-বাতিক-গ্রস্ত ছেলে-ছোকরার দল চাঁদা তুলে একটিবার মাত্র বার করে, কিন্তু পরের বারে উৎসাহ মন্দীভূত হওয়ার দরুন আশানুরূপ চাঁদা না ওঠাতে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়-এ সেই শ্রেণী পত্রিকা।

তবু আমার ঈর্ষা না হয়ে পারল না। আমি, তখন লিখি না বা লেখার কথা কখনও চিন্তাও করি না। অথচ এতটুকু ছেলে-এর নাম দিব্যি ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে গেল! এর ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হল, মনে ভাবলাম, বেশ ছোকরা তো। অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে কেমন কবিতা লিখেছে! সাহিত্যের সমঝদারিত্ব তার মধ্যে ছিল তা আমি জানি। তখনকার আমলের একজন বিশেস লেখকের বই না থাকলে পল্লীগ্রামের কোন লাইব্রেরি চলত না। সেই লেখকের এক একখানা বইএর তিন চার কপি পর্যন্ত রাখতে হত কোন কোন বড় লাইব্রেরিতে।

ছেলেটি বলত-ওসব ট্র্যাশ, ট্র্যাশ! দেখবেন ওসব টিকবে না।

এক এক দিন পাঁচুগোপাল আমাকে নিয়ে গ্রামের বাইরের মাঠে বেড়াতে যেত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখও তার বেশ ছিল-মাঝে মাঝে মুখে মুখে কবিতা তৈরি করে আমাকে শোনাত। অনেকগুলো কবিতা হলে পর একটা কবিতার বই ছাপবে এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করত। সেই সময় কলকাতার কোনও 'পাবলিশিং হাউস' ছয়-আনা গ্রন্থাবলী প্রকাশ শুরু করে দিল-তার প্রথম বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বইখানি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে পাঁচুগোপাল আমায় এনে দিয়ে বললে-"এ বই নিতে ভিড় নেই। নতুন এসেছে, এক আধ জন নিয়েছিল, কালই ফেরত দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু দেখুন গে যান অমুকের বইএর জন্যে কি যে মারামারি। ডিটেকটিভ উপন্যাস না রাখলে লাইব্রেরি উঠে যাবে। কেউ চাঁদা দেবে না।” পরের মাসে আর একখানি বই বেরুল। সেখানা আমার কাছে নিয়ে এসে সে বললে-"আমি একটা কথা ভাবছি, আসুন আপনাতে আমাতে এই রকম উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক। খুব বিক্রি হবে, আর একটা নামও থেকে যাবে। আপনি যদি ভরসা দেন, আমি উঠে পড়ে লাগি।” আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম-"তুমি আর আমি দুজনে মিলে বইএর কারবার করব, এ কখনও সম্ভব? এ ব্যবসার আমরা কিই বা জানি? তা ছাড়া, বই লিখবেই বা কে? এতে লেখকদের পারিশ্রমিক দিতে হবে, সে পয়সাই বা দেবে কে?” সে হেসে বললে -"বাঃ তা কেন, বই লিখবেন আপনি, আমিও দুএকখানা লিখব। পরকে টাকা দিতে যাব কেন।"

বাংলা সাহিত্যকে ভালবাসতাম বটে, কিন্তু নিজে কলম ধরে বই লিখব এ ছিল সম্পূর্ণ দুরাশা আমার কাছে। অবিশ্যি পাঠ্যাবস্থায় অন্য অনেক ছাত্রের মত কলেজ ম্যাগাজিনে দু একটা প্রবন্ধ, এক আধটা কবিতা যে না লিখেছি তা নয়, বা প্রতিবেশীর অনুরোধে বিবাহের প্রীতি-উপহারের কবিতা যে দু পাঁচটা না লিখে-ছিলাম তাও নয়-কিন্তু সে কে না লিখে থাকে?

সুতরাং আমি তাকে বললাম-"লেখা কি ছেলেখেলা হে যে কলম নিয়ে বসলেই হল? ওসব খামখেয়ালি ছাড়। আমি কখনও লিখি নি, লিখতে পারবও না। তুমি হয়তো পারবে-আমার দ্বারা ওসব হবে না।”

সে বললে-"খুব হবে। আপনি যখন বি এ পাশ, তখন আপনার কাছে এমন কিছু কঠিন হবে না। একটু চেষ্টা করুন তাহলেই হয়ে যাবে।” তখন বয়স অল্প, বুদ্ধিসুদ্ধি পাকে নি, তবুও আমার মনে হল, বি এ পাশ তো অনেকেই করে, তাদের মধ্যে সকলেই লেখক হয় না কেন? অথচ বি এ পাশ করা লোকদের ওপর পাঁচুগোপালের এই অহেতুক শ্রদ্ধা ভেঙে দিতেও মন চাইল না। এ নিয়ে কোনও তর্ক আমি আর তার সঙ্গে করি নি।

কিন্তু করলেই ভাল হত, কারণ এর ফল হয়ে দাঁড়াল বিপরীত। দিন দশেক পরে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সেখানে নোটিস-বোর্ডে, দেওয়ালের গায়ে, নারকেল গাছের গুঁড়িতে সর্বত্র ছাপানো কাগজ টাঙানো-তাতে লেখা আছে,-বাহির হইল! বাহির হইল!! বাহির হইল !!! এক টাকা মূল্যের গ্রন্থমালার প্রথম উপন্যাস!

লেখকের নামের স্থানে আমার নাম দেখলাম।

আমার তো চক্ষুস্থির। এ নিশ্চয় সেই পাঁচুগোপালের কীর্তি। এমন ছেলেমানুষি সে করে বসবে জানলে কি তার সঙ্গে মিশি! বিপদের ওপর বিপদ, স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষক ছাত্রবৃন্দ সবাই জিজ্ঞেস করে,- "আপনি লেখক তা তো এতদিন জানতাম না মশাই? বেশ বেশ! তা বইখানা কি বেরিয়েছে নাকি? আমাদের একবার দেখিয়ে যাবেন।” হেডমাস্টার ডেকে বললেন, তাঁর স্কুল লাইব্রেরিতে একখানা বই দিতে হবে। সকলের নানারূপ সকৌতূহল প্রশ্ন এড়িয়ে চলি সারাদিন-কবে থেকে আমি লিখছি, আর আর কি বই আছে, ইত্যাদি। স্কুলের ছুটির পরে বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। এমন বিপদেও মানুষ পড়ে!

তাকে খুঁজে বার করলাম বাসায় এসে। দস্তুরমত তিরস্কার করলাম তাকে, এ তার কি কাণ্ড! কথার কথা একবার একটা হয়েছিল বলে একেবারে নাম ছাপিয়ে এ রকম ভাবে বার করে, লোকে কি ভাবে।

সে নির্বাক হয়ে দাঁত বার' করে হাসতে হাসতে বললে-"তাতে কি হয়েছে? আপনি তো এক রকম রাজিই হয়েছেন লিখতে। লিখুন না কেন!” আমি বললাম-"বেশ ছেলে বটে তুমি! কোথায় কি তার ঠিক নেই, তুমি নাম ছাপিয়ে দিলে কি বলে, আর দিলে দিলে একেবারে স্কুলের দেওয়ালে, নোটিস-বোর্ডে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছ, এ কেমন কাণ্ড? নামই বা পেলে কোথায়? কে তোমাকে বলেছিল ও নামে আমি কিছু লিখেছি বা লিখব?”

যাক-পাঁচুগোপাল তো চলে গেল হাসতে হাসতে। এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে সকলের প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হল-বই বেরুচ্ছে কবে? কৃত দেরি 'আছে আর বই বেরুবার?-মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। সে যা ছেলেমানুবি করে ফেলেছে তার আর চারা নেই। আমি এখন নিজের মান বজায় রাখি কেমন করে? লোকের অত্যাচারের চোটে তো অস্থির হয়ে পড়তে হয়েছে।

সাতপাঁচ ভেবে একদিন স্থির করলাম-এক কাজ করা যাক। সে এক-টাকা সিরিজের বই কোনদিনই বের করতে পারবে না। ওর টাকা কোথায় যে বই ছাপবে? বরং আমি একখানা খাতায় যা হয় একটা কিছু লিখে রাখি -লোকে যদি দেখতে চায়, খাতাখানা দেখিয়ে বলা যাবে, আমার তো লেখাই রয়েছে, ছাপা না হলে আমি কি করব। কিন্তু লিখি কি? জীবনে কখনও গল্প লিখি নি, কি করে লিখতে হয় তাও জানা নেই। কি ভাবে প্লট জোগাড় করে, কি কৌশলে তা থেকে গল্প ফাঁদে-কে বলে দেবে? প্লটই বা পাই কোথায়? আকাশপাতাল ভাবি প্রতিদিন, কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নে। গল্প লেখার চেষ্টা কোনদিন করি নি। পাঠ্যাবস্থায় সুরেন বাঁড়ুজ্যে ও বিপিন পালের বক্তৃতা শুনে সাধ হত, লেখক হতে পারি আর না পারি, একজন বড় বক্তা হতে হবেই।

কিন্তু লেখক হবার কোন আগ্রহই কোনদিন ছিল না, সে চেষ্টাও করি নি। কাজেই প্রথমে মুশকিলে পড়ে গেলাম। সাতপাঁচ ভেবে প্লট সংগ্রহ আর করতে পারি না কিছুতেই। মন তখন বিশ্লেষণমুখী অভিব্যক্তির পথ খুঁজে পায় নি। সব কিছুতেই সন্দেহ, সব কিছুতেই ভয়।

অবশেষে একদিন এক ঘটনা থেকে মনে একটা ছোট গল্পের উপাদান দানা বাঁধল। সেই পল্লীগ্রায়ের একটি ছায়াবহুল নিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্র বিহঙ্গ স্থাকলীর মধ্যে প্রতিদিন স্কুলে যাই, আর একটি গ্রাম্য বধূকে দেখি পথিপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে কলসী কক্ষে প্রতিদিন স্নান করে ফেরেন। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়-কিন্তু দেখা ওই পর্যন্ত। তাঁর পরিচয় আমার অজ্ঞাত এবং বোধ হয় অজ্ঞাত বলেই একটি রহস্যময়ী মূর্তিতে তিনি আমার মানসপটে একটা সাময়িক রেখা অঙ্কিত করেছিলেন। মনে মনে ভাবলাম এই প্রতিদিনের দেখা অথচ সম্পূর্ণ অপরিচিত বধূটিকে কেন্দ্র করে একটি গল্প আরম্ভ করা যাক ত, কি হয় দেখি! গল্প শেষ করে সেই গ্রামের দু-এক জনকে পড়ে শোনালাম-পাঁচুকেও। কেউ বলে ভাল হয়েছে, কেউ বলে মন্দ হয় নি। আমার একটি বন্ধুকে কলকাতা থেকে নিমন্ত্রণ করে গল্পটি শুনিয়ে দিলাম। সেও বললে ভাল হয়েছে। আমি তখন একেবারে কাঁচা লেখক; নিজের ক্ষমতার ওপর কোন বিশ্বাস আদৌ জন্মায় নি। যে আত্ম-প্রত্যয় লেখকের একটি বড় পুঁজি, আমি তখন তা থেকে বহু দূরে, সুতরাং অপরের মতামতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি। আমার কলকাতার বন্ধুটির সমঝদারিত্বের ওপর আমার শ্রদ্ধা ছিল-তার মত শুনে খুশি হলাম।

পাড়াগাঁয়ে স্কুলমাস্টারি করি। কলকাতার কোন সাহিত্যিক বা পত্রিকা-সম্পাদককেই চিনি না-সুতরাং লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমায় একপ্রকার হতাশ হতে হল। এইভাবে পূজার অবকাশ এসে গেল, ছুটিতে দেশে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম। পুনরায় ফিরে এসে কাগজপত্রের মধ্যে থেকে আমার সেই লেখাটি একদিন বার করে ভাবলাম, আজ এটি কলকাতা নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।

ঘুরতে ঘুরতে একটা পত্রিকা আপিসের সামনে এসে পড়া গেল। আমার মত অজ্ঞাত অখ্যাত নতুন লেখকের রচনা তারা ছাপবে এ দুরাশা আমার ছিল না, তবুও সাহস করে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। দেখা যাক না কি হয়, কেউ খেয়ে তো ফেলবে না, না হয় লেখা না-ই ছাপবে। ঘরে ঢুকেই একটি ছোট টেবিলের সামনে যাঁকে কর্মরত দেখলাম, তাঁকে নমস্কার করে ভয়ে ভয়ে বলি-"একটা লেখা নিয়ে এসেছিলাম-"; ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "আর কোথাও আপনার লেখা কি বেরিয়েছিল? আচ্ছা, রেখে যান, মনোনীত না হলে ফেরত যাবে। ঠিকানাটা রেখে যাবেন।"

লেখা দিয়ে এসে স্কুলের সহকর্মী ও গ্রামের আলাপী বন্ধুদের বলি-"লেখাটা নিয়ে বলেছে শীগগির ছাপবে।” চুপি চুপি ডাকঘরে গিয়ে বলে এলাম, আমার নামে যদি বুকখোস্ট গোছের কিছু আসে, তবে আমাকে স্কুলে বিলি যেন না করা হয়। কারণ লেখা ফেরৎ এসেছে এটা তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে।

দিন গুনি, একদিন সত্যিই ডাকপিওন স্কুলে আমায় বললে-আপনার নামে একটা বুকপোস্ট এসেছে, কিন্তু গিয়ে নিয়ে আসবেন। আমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। নবজাত রচনার প্রতি অপরিসীম দরদ যাঁরা অনুভব করেছেন তাঁরা বুঝবেন আমার দুঃখ। এতদিনের আকাশকুসুম চয়ন তবে ব্যর্থ হল, লেখা ফেরত দিয়েছে!

কিন্তু পরদিন ডাকঘর থেকে বুকপোস্ট নিয়ে খুলে দেখি যে, আমার রচনাই বটে, কিন্তু তার সঙ্গে পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের একটি চিঠি। তাতে লেখা আছে, রচনাটি তাঁরা মনোনীত করেছেন, তবে সামান্য একটু-আধটু অদল-বদলের জন্য ফেরত পাঠানো হল, সেটুকু করে আমি যেন লেখাটি তাঁদের ফেরত পাঠাই, সামনের মাসেই ওটা ছাপা হবে।

অপূর্ব আনন্দ আর দিগ্বিজয়ীর গর্ব নিয়ে ডাকঘর থেকে ফিরি। সগর্বে নিয়ে গিয়ে চিঠিখানা দেখাতেই সবাই বললেন- “কারু সঙ্গে আপনার আলাপ আছে বুঝি ওখানে?-আজকাল আলাপ না থাকলে কিছু হবার জো-টি নেই। সব খোশামোদ, জানেনই তো।" তাঁকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, যাঁর হাতে লেখা দিয়ে এসেছিলাম তাঁর নাম পর্যন্ত আমার জানা নেই। তার পর সে গ্রামের এমন কোনও লোক রইল না, যে আমার চিঠিখানা না একবার দেখলে। কারও সঙ্গে দেখা হলে পথে তাকে আটকাই এবং সম্পূর্ণ অকারণে চিঠিখানা আমার পকেট থেকে বেরিয়ে আসে, এবং বিপন্ন মুখে তাকে বলি-তাই তো, ওরা আবার একখানা চিঠি দিয়েছে, একটা লেখা চায়-সময়ই বা তেমন কই! হায়! সে-সব লেখকজীবনের প্রথম দিনগুলি! সে আনন্দ, সে উৎসাহ, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সে বিস্ময় আজও স্মরণে আছে, ভুলি নি। নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে গৌরব এবং আত্মপ্রসাদ নিহিত, লেখকজীবনের বড় পুরস্কার সবচেয়ে তা-ই। স্বচ্ছ সরল ভাবানুভূতির যে বাণীরূপ কবি ও কথাশিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে যান-তা সার্থক হয় তখনই, যখন পাঠক সেই ভাব নিজের মধ্যে অনুভব করেন। এইজন্য লেখক ও পাঠকের সহানুভূতি ভিন্ন কখনও কোন রচনাই সার্থকতা লাভ করতে পারে না।

বালক-কবির নিকট আমি কৃতজ্ঞ। সে-ই একরকম জোর করে আমাকে সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে নামিয়েছিল।

পাঁচুগোপালের সঙ্গে মাঝে দেখা হয়েছিল। সে এখন চব্বিশ পরগনার কাছে কি একটা গ্রামের উচ্চ প্রাথমিক পাঠশালার হেডমাস্টার। এখনও সে কবিতা লেখে।

(লেখক তাঁহার প্রথম রচনার এই ইতিহাসটি কলিকাতা বেতার-কেন্দ্রে প্রথম পাঠ করেন।)

Address

Chittagong
4217

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when দিশারী দ্যা ডায়নামিক রিডার্স posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share