17/10/2025
(১)
ব্যারিস্টার আরমানের গুম নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি - যে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করতে পারার মতো না।
আমি পারি নাই।
সংবেদনশীল মানুষ হওয়ার দরকার নাই। জাস্ট খুব সাধারণ 'মানুষ' হলেও, আরমানের গুমের বীভৎস এই বর্ণনা - আপনাকে শেষ করে ফেলবে।
(২)
হাসিনার গুম সিন্ডিকেটের - সম্ভবত, সবচেয়ে নির্মম এবং নৃশংসতম অত্যাচারের ভিকটিম হচ্ছেনঃ ব্যারিস্টার আরমান।
ওনাকে "আট বছর" র্যাবের Task Force for Interrogation cell (TFI) - এই জায়গাতে গুম করে রাখা হয়েছিলো।
সবচেয়ে নির্মম - কেন বলছি এইটাকে? কারণ, গুমের শিকার অন্যান্য মানুষকেঃ হয় মেরে ফেলা হয়েছে। না হয় টর্চার করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু, আরমানকে আট বছর, এমন একটা পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছিলো, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে। বন্দী আরমান নিজে বহুবার অনুরোধ করেছে, এতো যন্ত্রণা দেয়ার চেয়ে - তাকে বরং মেরে ফেলতে।
আহারে। আরমানকে মেরেও ফেলা হয়নি।
(৩)
আট বছর - লোকটার টয়লেটে যাওয়ার স্বাধীনতা ছিলোনা। দেয়ালে হ্যান্ডকাফ দিয়ে শব্দ করে টয়লেটে যাওয়ার আবেদন জানাতে হতো। বহুবার কেউ আসেনি তাকে টয়লেটে নিতে।
কাপড় নষ্ট হয়েছে। সেই ময়লা আবার তাকেই পরিষ্কার করতে দেয়া হয়েছে। বন্ধ রুমের গরমে, ঘাম প্রস্রাব ঝড়ে ঝড়ে - তার মেঝেতে পানি জমে যেতো। তার মধ্যে ঘুমিয়েছে আরমান।
হাতকড়া পরে থাকতে থাকতে, আরমানের কবজিতে ফোসকা পড়ে গেছিলো। তখন সেই হাতকড়া খুলে তার পায়ে পরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরবানির গরুকেও এই নৃশংস যন্ত্রণা দেয়না মানুষ।
(৪)
জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। ৩২ বছর বয়সী ইয়াং আরমানকে বাসা থেকে গুম করা হয়। যখন ফিরলো, তখন তার বয়স চল্লিশ। চোখে দেখেনা। হাঁটতে পারেনা। ভয় পায়।
ছোট ছোট দুইটা মেয়ে সন্তান। বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো খালি পায়ে, ছোট মেয়েটা বাবার দুইটা জুতা হাতে তুলে পিছে পিছে যাচ্ছিলোঃ বাবা তোমার জুতা।
সহ্য করার মতো নারে ভাই।
(৫)
মেয়েগুলো এখন বড় হয়ে গেছে। বাবা বেঁচেই ছিলো, কিন্তু নিজের চোখে বাচ্চাগুলোর বড় হওয়ার দৃশ্য দেখতে পায়নি।
বাচ্চাদের সাথে বাবার ইমোশনাল বন্ডিং তৈরি হওয়ার সময়টাতেই - বাবা ছিলোনা। বাচ্চাদের টেক কেয়ার করার জন্য বাবার চোখ ছিলোনা।
আরমানের স্ত্রী জানতো না, তার স্বামী বেঁচে আছে নাকি নাই। সে সধবা না বিধবা। এ কোন আঁধার, রাতের চেয়েও অন্ধকার...
আহারে আমার ভাই। আহারে।
(৬)
অন্ধকারে চোখ বাঁধা থাকতে থাকতে, আরমানের চোখে ছানি পড়ে গেছে। সবকিছু ঝাপসা দেখে।
লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে আসা লোকটার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার - সম্পূর্ণ শেষ। ফ্যামিলিটা ফাইন্যান্সিয়ালি ধ্বংস হয়ে গেছে।
অপুষ্টিতে ভুগে স্বাস্থ্যবান লোকটা শুকিয়ে জীর্ণ হয়ে গেছে। লোকটার কথা বলার কেউ ছিলোনা জন্যঃ এক পর্যায়ে সে রুমের টিকটিকির সাথে, পিঁপড়ার সাথে কথা বলা শুরু করে।
টিকটিকির নাম ছিলো টুকটুকি। এই টুকটুকি, তোর কয়টা বাচ্চা? আমার দুইটা মেয়ে আছে ছোট....
(৭)
দাঁতে দাঁত চাপ দিয়ে - আরমানের গুমের এই ডকুমেন্টারি দেখেন।
১৫০০+ মানুষের ওপর এই মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালিয়েছে - হাসিনা আর তার লোকজন।
ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে এই গুমের কাহিনী লেখা হোক। এই জাতিকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে আওয়ামী রেজিমের জুলুমের ইতিহাস। আয়নাঘরগুলোকে মিউজিয়াম বানিয়ে, সেখানে বাচ্চাদের শিক্ষা সফরে নিয়ে আসা হোক।
আমরা যেন ভুলে না যাই, আওয়ামী জাহেলিয়াত কী জিনিস ছিলো। আমরা যেন মনে রাখি।
(৭)
ডকুমেন্টারির সবচেয়ে ভয়াবহ ক্লিপ হচ্ছেঃ আরমানের মুক্তি পাওয়ার দৃশ্যটা।
আট বছর পরঃ অচেনা রাস্তায় একটা পশুকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সে জানেনা, এটা কোন জায়গা। কতো সাল। সে জানেনা, সে কতো বছর বন্দী ছিলো। সে জানেনা, হাসিনা পালিয়ে গেছে। সে রাস্তাঘাট কিচ্ছু চিনতে পারছেনা।
সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছেঃ লুঙ্গি পরা একটা জীর্ণকায় লোক। দুই পায়ে টলতে টলতে, ইবনে সিনা হাসপাতালে ঢুকছে। আট বছর পরে কেউ তাকে চিনতে পারছে না। ময়লা কাপড়ের জন্য কেউ তাকে বিশ্বাস করছে না।
(৮)
লোকটা ভয়ে গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। যদি তাকে চিনতে পেরে আবারও কেউ ধরে নিয়ে যায়। পরাধীন থাকতে থাকতে, লোকটা ভুলেই গেছে যে - স্বাধীনতা এসে গেছে। হি ইজ ফ্রি।
আহারে লোকটা। বাকী জীবন কীভাবে কাটাবে এই ট্রমা নিয়ে?
একজনের কাছ থেকে একটা মোবাইল ধার করে আরমান নিজের নাম লিখে গুগল করেন। গুগলে তার পুরাতন চেহারার ছবি বের হয়ে আসে। নিজের চেহারার পাশে সেই মোবাইলের ছবি ধরেঃ ইবনে সিনার কর্মকর্তাদের তিনি বলেন, এইবার চেনা যায়?
(৯)
ওই প্রথমবার, আট বছর পর মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়ঃ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে (সম্ভবত) সর্বোচ্চ নির্যাতনের শিকার, মীর আহমাদ বিন কাশেম, আরমান। আমাদের ভাই।
কী অসম্ভব প্রাণশক্তি থাকলে, লোকটা এখনও মানসিকভাবে সুস্থ আছে, পাগল হয়ে যায়নি - ভাবতে অবাক লাগে। নিঃস্ব হয়ে গেছে লোকটা। এই ডকুমেন্টারি হচ্ছে আরমানের সেই জীবনের গল্প, যে জীবনের চেয়ে মৃত্যুই হয়তো ভালো ছিলো।
(১০)
আপনারা দয়া করে ডকুমেন্টারিটা দেখেন। বোঝেন। উপলব্ধি করেন। আরমানের সাথে আরমানের আটটা বছর - বিশ মিনিটে কাটিয়ে আসেন।
এই মহাপাপ, এই মহা অন্যায়ের বিচার দাবি করেন। চোখের জলে বুক ভাসান, যেভাবে আরমান ভাসিয়েছিলো তার শুয়ে থাকার মেঝেটা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র যাতে আরমান সহ গুমের প্রত্যেক ভিকটিমের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয় - সেই দাবিটা করেন রাষ্ট্রের কাছে।
(১১)
আমাদের দুর্ভাগ্য, এতো সবকিছুর পরেও কিছু অমানুষের বাচ্চা, আওয়ামী দলদাস মাদারচোদ - গুমের জলজ্যান্ত প্রমাণকে নাটক হিসাবে দাবি করে। দেড় হাজার মানুষের লাশ অস্বীকার করে।
মানুষ হিসাবে আপনার নিজের ওপর ঘেন্না জন্মাবে, যেঃ এইসব অমানুষের সাথে আপনাকে একই বাতাসে অক্সিজেন শেয়ার করতে হয়। একই মাটির স্পর্শ শেয়ার করতে হয়। একই সূর্যের আলো শেয়ার করতে হয়।
এইসব অমানুষের জাত, আওয়ামী শুয়ারের বাচ্চার সাথে আপনাকে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। কিছুই করার নাই।
(১২)
লজ্জা যদি এইটা না হয়, তো লজ্জা কী?
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম স্বৈরাচারঃ শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্যতম পিশাচের নামঃ শেখ হাসিনা।
আর কেউ না জানুক, আরমান জানে। ভাই আমার, আপনার বাকী জীবনটা সহজ হোক। সুন্দর হোক। দুনিয়াতে এখনও সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে যায়নি।
দুনিয়াতে এখনও কিছু "মানুষ" আছে।
- শুভজিৎ ভৌমিক