06/11/2025
কঠিন চীবর দান ও বড়ুয়া বৌদ্ধদের উন্মাদনা
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
কঠিন চীবর দানকে দানশ্রেষ্ঠ, দানরাজা এবং দানোত্তম ইত্যাদি গালভরা বিশেষণে অভিষিক্ত করা হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমায় ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের যে বর্ষাবাস শুরু হয় তিনমাস পর আশ্বিনী পূর্ণিমায় তা সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে পরবর্তী একমাস অর্থাৎ কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত বিহারের বিহারে এ দান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছর ফ্রান্সে বড়ুয়া বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছয়টি বিহারে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়েছে। তথ্যে যতদূর জানা যায়, ফ্রান্সে নব্বইয়ের দশক হতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হতে বড়ুয়া বৌদ্ধ জনগুষ্ঠীর অভিবাসন শুরু হয়েছে এবং এ অভিবাসন বৃদ্ধির সংখ্যা বছরের পর বছর এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ফ্রান্সে বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ছয়-সাত হাজার হবে বলে মনে করা হয়। যদি তা হয়, তাহলে পাশ্চাত্যের যে কোনো দেশের তুলনায় ফ্রান্সে হবে সর্বাধিক। যা অতীব আনন্দের সমাচার।
প্রথম দিকে যাঁরা এসছিলেন তাঁরা ফ্রান্সে বিভিন্ন বিষয়ে সীমাহীন কষ্ট ভোগ ও পরিশ্রম করে বর্তমানের একটা অবস্থান তৈরী করেছিলেন। এরাই আবার দেশের ধাম্মিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চাকাকেও অনেকটা সচল করতে সহায়তা করেছেন। ফ্রান্সে বডুয়ারা আসার পর হতে চিন্তাশীল ব্যক্তিরা নিজেদের মত করে ধম্ম চর্চার জন্য একটা বিহার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন এবং সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিজেদের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু নিজেদের আর্থিক দৈন্যতা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনি জটিলতা, নিজেদের মধ্যে অনৈক্যতা ইত্যাদি কারণে বিহার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণে দীর্ঘ সূত্রিতা কাজ করছিল। নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ সময় পার করার পর যখন গুটিকয়েক উৎসাহী উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় একটি বিহার হল, এরপর দেখতে দেখতে এখন ছয়টি বিহার স্থাপিত হয়েছে এবং ছয়টি বিহারে এবছর কঠিন চীবর দান সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি আরও একটি বিহার আত্ম প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি বিহার স্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বিহার অধিক হওয়া ভাল। কিন্তু সে বিহার সমূহে যদি নিয়মিত ধ্যানাভ্যাস না হয়, ধম্ম শিক্ষা না হয় এবং বৌদ্ধ নীতিবোধের প্রশিক্ষণ না হয়ে কেবল দলাদলি, আঞ্চলিকতা, স্বজন প্রীতি ও আড্ডাখানার আখড়া হয় তাহলে তা উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশী।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যে বিহারগুলি যেখানে যেখানে স্থাপিত হয়েছে, সেগুলি সেখানে সেখানে স্থাপনের সরকারী কোনো অনুমোদনও নাই। ফ্রান্স যেহেতু একটি উদার ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, সেহেতু এখানে যত্রতত্র ধর্মস্থান করার জন্য সরকার অনুমোদন দেয়না। তাই বাসগৃহের মতো ঘর কিনে বা ভাড়া করে সেগুলিতে অল্প সংখ্যক লোক সমবেত হয়ে ধাম্মিক কার্যাবলী সীমিত পরিসরে সম্পন্ন করা হয়। কেননা অধিক লোক জমায়েত এবং উচ্চ শব্দাদি করে অন্য প্রতিবেশীদের শান্তিভঙ্গ করা ফরাসীরা পছন্দ করেননা। ঘরগুলির ভাড়াও মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয়। কঠিন চীবর দানের মত অধিক লোক সমাগম করে অনুষ্ঠান করতে গেলে অনেক দিন পূর্ব হতে পরিকল্পনা করে বিশাল সভাগৃহ ভাড়া করে করতে হয়। কেননা সব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন আর্থিক বাজেটের মধ্যে পাঁচ শতাধিক লোক ধারণ করার ক্ষমতা বিশিষ্ট এরকম সভাগৃহ পাওয়াও খুব দুষ্কর।
বডুয়া-সিংহ সব মিলিয়ে আনুমানিক সংখ্যা ছয়-সাত হাজার বঙ্গীয় বৌদ্ধ বললেও সক্রিয়ভাবে বিহার সমূহের বিভিন্ন ধাম্মিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে মাত্র হাতে গোণা কিছু লোক। অধিকাংশ লোক কিন্তু ধাম্মিক ও সামাজিক কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তায় অধরাই থাকে। ফ্রান্সে অধিক লোক সমাগমে বড় অনুষ্ঠান বলতে একমাত্র কঠিন চীবর দানই হয়ে হয়। যে ছয়টি বিহারে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে ছয়টি বিহারের সংশ্লিষ্ট ভিক্ষু ও সদস্যেরা উপাসক-উপাসিকাদের বাসায় বাসায় মাসাধিক পূর্ব হতে গিয়ে গিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে কঠিন চীবরের দানের চাঁদা সংগ্রহ করে থাকেন। কঠিন চীবর দানের জন্য বাসায় বাসায় গিয়ে যেভাবে টাকা সংগ্রহ করে থাকেন, তা দান সহগ্রহ করা না বলে চাঁদা সংগ্রহ করা বলাই উত্তম। কেননা দান কখনও গিয়ে চেয়ে নেওয়া হয়না। স্বত:স্ফুর্তভাবে শ্রদ্ধা সহকারে দেওয়াই হল দান। যেহেতু ভিক্ষু-দায়ক অযাচিতভাবে দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চেয়ে সংগ্রহ করে থাকেন এবং অনেক সময় লোকেরা লজ্জায় পড়ে বাধ্য হয়ে কিছু দিয়ে থাকেন, সেজন্য তাকে চাঁদা বলাই ভাল।
এভাবে কঠিন চীবর দানের নামে চাঁদা সংগ্রহ করে বডুয়ারা দানোত্তম, দানরাজা, দানশ্রেষ্ঠ ও আরও কতকিছু গালভরা মহিমা প্রচার করলেও আসল কার্য কিন্তু দেখা যায় খুবই লঘু। তা যেন ‘বহ্বারম্ভ লঘু ক্রিয়া।’
হিন্দুদের দুর্গা ও অন্যান্য পূজা সমূহে যেমন বাধ্য করে চাঁদা আদায় পূর্বক যতটা পূজার জন্য ব্যয় না হয়, তার চেয়েও বেশী ব্যয় হয় নানা রকমের বিনোদনে। যেমন রকমারী নৃত্য, গীত, বাদ্য-বাজনা, নেশা দ্রব্য সেবন ইত্যাদি নিজেদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিতে। ইহা তাদের জন্য মানায়। কেননা কল্পিত দেব-দেবীদের যে চরিত্র ও কাহিনীও হল সেরকম। তাই তদনুসারেই হয় তাদের রঙ্গ-তামাশাপূর্ণ উৎসব অনুষ্ঠান সমূহ। কিন্তু এগুলি বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইদানীং বড়ুয়ারা কঠিন চীবরের নাম দিয়ে চাঁদা আদায় করে বিবাহ অনুষ্ঠানের মত মাছ, মাংস (ছাগল-মুরগী), ডিম, বিরিয়ানী ইত্যাদি সহকারে উদরপূর্তির মহোৎসব করে থাকেন। অত:পর কিছুক্ষণ ভিক্ষুদের কাছ হতে পারম্পরিক ও গতানুগতিক চর্বিত-চর্বন কিছু বক্তব্য শুনে কোন রকমে দান কার্য সম্পন্ন করার সাথে সাথে যে আসনে ভিক্ষুরা বলে ধম্ম কথা বলেছেন, সে আসনে উঠে মদ্যপান করে দুর্গাপূজার মত উশৃঙ্খল-উন্মত্ত-উদ্দাম কামোত্তেজ্জক নৃত্য-গীত ও বাদ্য-বাজনা সহকারে বেপরোয়া বেয়াপনা শুরু করে দেয়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেগুলি চলতে থাকে। সব কঠিন চীবর দানে শুরু হয়েছে এরকম উন্মাদ বেহায়াপনা। যেভাবে গালভরা মহিমা কীর্তন করে কঠিন চীবর দানের কথা দেশনা শুনেছে, শীল-সমাধি ও প্রজ্ঞার কথা শুনেছে, সেগুলির মাধ্যমে লেশমাত্র আত্ম সংযমের শিক্ষা
বড়ুয়ারা গ্রহণ করেনি। দিন দিন উন্মত্ত-উশৃঙ্খলতা যেন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলি আয়োজন করছে বিহার ও অনুষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ধম্মকে আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা গভীরভাবে ভাববার বিষয়!
দান অনুষ্ঠানে ভিক্ষুদের দেশনা শুনে যারা ভক্তিতে গদগদ হয়ে ঘন ঘন সাধুবাদ ধ্বনিতে সভাস্থলকে মুখরিত করে তোলে, তাদেরকেই আবার অশ্লীল-অশালীন গান-বাদ্যের জন্য বিনোদন উপভোগে রত থাকতে দেখে হতবাক হয়ে যাই। তাই আমি মনে করি যে, শান্ত, দান্ত, শীল, সমাধিযুক্ত এবং সংযম শীলতাপূর্ণ বুদ্ধের এ নৈর্বাণিক ধম্ম বডুয়াদের চরিত্রের উপযোগী নয়। প্রায় বডুয়ারা ভিক্ষুদের প্রদত্ত কোনো শিক্ষাই আমলে নেয়না। যতক্ষণ শুনে ততক্ষণ মাত্র। ধম্ম অনুষ্ঠানে একটু বিনোদন মূলক ধম্ম সম্বন্ধিত এবং ধম্ম সংবেগ জাগানোর জন্য কিছু গীতি-নাট্য বা বুদ্ধ ভক্তিগীতের চর্চা ইচ্ছা করলে করা যায়। এর বাহিরে করা ধম্মের নামে অপসংস্কৃতির চর্চা করার সামিল। পূর্বে আমাদের গ্রামে-গঞ্জে কঠিন চীবরাদি উৎসবে সে ধরণের নাটক-কীর্তন-ভজন ইত্যাদিরই ব্যবস্থা হতো। বর্তমানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অপসংস্কৃতি গুলি আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমদানি করে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকেই কলঙ্কিত করছে। সুশীল ও বিবেকবান মানুষেরা যদি এ ব্যাপারে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর পরিণাম ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হবে সন্দেহ নাই।
নীচের ভিডিও ক্লিপটি আপনাদেরকে দেখার জন্য প্রদত্ত হল। ইহা ফ্রান্সে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া একটি কঠিন চীবর দানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দৃশ্য। কঠিন চীবর দান সম্বন্ধিত অনুষ্ঠানে এরকম অশ্লীল গানের সাথে উদ্দাম নৃত্যের আয়োজনই বুঝিয়ে দেয় আমাদের মন-মানসিকতা কত যে হীন ও নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তা আর অপেক্ষা রাখেনা। আমি মনে করি, কোনো ভদ্র, মার্জিত, সভ্য, শিক্ষিত ও আত্ম সম্মানবোধ সম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা কখনও এসব বেহায়াপনা করতে পারেনা। এদেশে শিখার মতো, অনুকরণের মতো ভাল অনেক কিছু রয়েছে। সেগুলি গ্রহণ করে জীবনকে উন্নত না করে যারা অসভ্যামিগুলি গ্রহণ করছে, তাতেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মাছিকে সুগন্ধ স্থানে রাখলেও কখনও সুগন্ধিত স্থানে থাকবেনা। দুর্গন্ধ ও দুর্গন্ধযুক্ত স্থানই খুঁজবে। স্বভাব বদলানো বড়ই কঠিন!