
15/07/2025
🔴 ১৯শে মহররম সিরিকোটি হুজুর কিবলা (র) এর মুরীদ ও খলীফা শায়খ নূর মুহাম্মদ আল কাদেরী রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা এর ওরস উপলক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
🔸জন্ম ও পরিচয়ঃ
ফানাফিশ শাইখ নুর মুহাম্মাদ আলক্বাদেরি (র) ছিলেন সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার একজন একনিষ্ঠ সেবক এবং যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ কুতুবুল আউলিয়া সৈয়দ আহমাদ শাহ সিরিকোটি (র)'র অত্যন্ত প্রিয় ভাজন ও স্নেহধন্য মুরিদ। এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ১৩৭৪ হিজরির ১১ই মুহররম চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার বাকলিয়াস্থ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হলো হাজী মুহাম্মাদ হোসেন।
🔸কর্মক্ষেত্রঃ
নুর মুহাম্মাদ আলকাদেরি (র) অতি সাধারণ পরিবেশে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর অবিচল কর্মক্ষেত্র তাঁকে একজন মহত্ত্বের রূপ লাবণ্যে সুদর্শন করেছিল। তিনি শৈশবে মক্তব শিক্ষা শেষ করে পার্থিব শিক্ষিত হয়ে উঠলেন এবং যৌবনে তিনি পৈত্রিক পেশা ব্যবসাতে নিজেকে নিয়োগ করেন। ব্যবসায়িক অঙ্গণ ছাড়াও ইসলামিক বিভিন্ন সংগঠন, সমাজ-দেশের প্রত্যেকটি অঙ্গনেই তাঁর পদচারণা দেখা যায়। নিম্নে তার আংশিক আলোচনা করা হলো-
♦️ধর্মীয় অঙ্গণেঃ
🔷তিনি আঞ্জুমান-এ রহমানিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আজীবন সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন।
🔷জামিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর।
🔷আঞ্জুমানে খাদেমুল হজ্ব ও বাংলাদেশ হজ্ব কমিটির তিনি একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন।
♦️পার্থিব অঙ্গণেঃ-
🔷চট্টগ্রাম রিলিফ কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
🔷চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
🔷১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি বক্সিরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাবেক চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার হিসেবে জনগণের সেবা করে গেছেন।
🔷চন্দনপুরা গুল-এজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চর চাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, লামাবাজার সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি ভূমিকা রাখেন।
🔷ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি গঠনে তিনি উল্লেখযােগ্য অবদান রাখেন।
🔷তিনি চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাস্টি বাের্ড সদস্য ছিলেন।
🔷এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সহ সভাপতি ও প্রাদেশিক কাউন্সিলর এর দায়িত্ব পালন করেন গভীর নিষ্ঠার সাথে।
🔸দেশপ্রেমঃ
রাজনৈতিকভাবেও তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নিরলস কর্মী ছিলেন। তিনি একজন তুখােড়, সংগ্রামী, আপােষহীন, সচেতন ও সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তৎকালীন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলােতে সফর ও করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর উপর সরকারী বিমাতাসূলভ আচরণকে বন্ধ করার লক্ষ্যে আলােচনার জন্যে তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এতে অনেকাংশে সফলতা লাভ করেন।
🔸বায়'আত গ্রহণঃ
ইহজাগতিক সকল স্তরে সফলকাম হলেও মনে স্বস্তি ছিল না তাঁর, কি এক অজানা অতৃপ্তের হাহাকার হৃদয়-চিত্তকে অবিরাম নাড়া দিত। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ও প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন যখন কোন বান্দার প্রতি সদয় হন, তখন সে বান্দার জন্য কোন না কোন নেক উসিলার ব্যবস্থা করে দেন এভাবেই পঞ্চাশ দশকের শেষভাগে তাঁর জীবনে এলাে এক সুবর্ণ সুযােগ। এ সময় চট্টগ্রামের কৃতিপুরুষ আলােকিত সন্তান কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস, কোহিনূর লাইব্রেরী ও দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, কুতুবুল আউলিয়া আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (র)-কে রেঙ্গুন হতে চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন অন্যান্য পীরভাইদের সহায়তায়। এই সুযোগেই তিনি কুতুবুল আউলিয়া হযরত সৈয়দ আহমাদ শাহ সিরিকোটি (র)'র পবিত্র দাস্ত মুবারকে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করে এক নতুন জীবন লাভ করেন। এতদিনের অতৃপ্ত আত্মা যেন কিসের স্নিগ্ধ পরশে প্রশান্তি লাভ করে। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। আপন পীরের প্রতি তিনি নিজের অজান্তেই আসক্ত হয়ে পড়েন। কোন মতেই চেহারা মুবারকটি ভুলতে পারছিলেন না। ভুলতে পারলেননা তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণীসমূহ। তাঁর কর্মকান্ড ও কথাবার্তা শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন। কিছুই তাঁর ভাল লাগছিল না। তাই সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি'র সাথে প্রায়ই দেখা ও সাক্ষাত করতে ছুটে যেতেন। তরীকতে দাখিল হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। সাথে সাথে তিনি চাটগাঁয় এক পা দুই পা করে এগিয়ে যাওয়ার সময় হযরত সিরিকোটী (র)কে অনুভব করলেন। আপন পীরকে স্মরণে রেখে খেদমতের নাযরানা পেশ করতে লাগলেন।
🔸ফানাফিশ শায়খঃ
মুর্শিদ-মুরিদের সম্পর্ক কি রকম হওয়া প্রয়ােজন, এ সম্পর্কে কোন রকম পূর্ব ধারণা না থাকলেও আপন পীরের অলৌকিক ক্ষমতা (তাওয়াজ্জুহ) তাঁর মনে গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অন্তরে অন্তরে বেজে উঠে বিনা তারের ঝংকার।আপন পীরের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মন-মেজাজ সম্পর্কে তিনি বিশেষভাবে অবগত ছিলেন। মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ'র কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল।
আল্লাহ রাসূল প্রেমের সুর মুৰ্ছনায় অবগাহন করে স্নিগ্ধতায় শুভ্রতায় পরিশুদ্ধ হয় দেহ-মন-আত্মা। এভাবেই অর্জিত হয় ফানাফিশ শায়খ, ফানাফির রাসূল হয়ে ফানাফিল্লাহর মাকাম। মুর্শিদের ইচ্ছাতে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করাই একজন মুরিদের প্রথম ও প্রধান কাজ। এ কথা সওদাগর ছাহেবের অবচেতন মনে গেঁথে যায়। মুরিদের আত্মার উন্নতির সােপান পীরের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এ কথা মনে রেখেই তিনি পীরের খেদমতে সমর্পিত হন।
🔸অন্যান্য খেদমতঃ
নিজের বাসভবনে মুর্শিদের খানকাহ্ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একটি সম্পূর্ণ তলা ওয়াকফ করে দেন। আওলাদে রাসূল (৩৯তম) হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি সফরসঙ্গী হয়ে তিনি পবিত্র হজ্ব সমাপন ও প্রাণপ্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন’র রওজা মুবারক যিয়ারত করেন। পাশাপাশি হুযুর কেবলা (র)'র সাথে বাগদাদ শরিফ, আজমীর শরিফ ও যিয়ারত করেন। ১৯৫৮ সালের পর হুজুরে আর বাংলাদেশে তাশরীফ রাখেননি। তাঁর ছাহেবজাদা ও প্রধান খলিফা আওলাদে রাসূল (৪০তম) হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র) দরবারে আলিয়া কাদেরিয়ার সাজ্জাদানশীন হয়ে এদেশে শুভাগমন করেন সিলসিলার মহান দায়িত্ব নিয়ে। আমৃত্যু আলহাজ্ব নুর মুহাম্মাদ আল-কাদেরি (র) কায়িক ও আর্থিকভাবে সিলসিলার খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। পীরের সাহেবজাদার প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল প্রশংসনীয়।
🔸জামেয়া নির্মাণে তাঁর অগ্রণী ভুমিকাঃ
১৯৫৪ সালে মুর্শিদে বরহক কুতবুল আউলিয়া হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি মসলক-এ আ'লা হযরত-এর নীতির উপর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে পীরভাইদের অনেকেই সেমিপাকা, কাঁচাবাশের দ্বারা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এতে হুজুর কিবলা মত দেননি। আলহাজ্ব নুর মােহাম্মদ সওদাগর এতক্ষণ কোন পরামর্শ না দেয়ায় হুজুর তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি (সওদাগর সাহেব) সরাসরি পাকা দালান করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন (হুজুর! মাদরাসা ভবন পাক্কা হোগা, ইনশাআল্লাহ।) হুজুর এ কথা শুনে আনন্দাপ্লুত হয়ে সওদাগর সাহেবের পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি এও বলেন যে, "জামেয়ামে যেতনী লোহেকা জরুরত হোগা হাম দেঙ্গে ইনশাআল্লাহ।"
সওদাগর সাহেবের এ প্রস্তাব শুনে হুজুর উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। মুর্শিদের মন-মেজাজ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন আলহাজ্ব নুর মােহাম্মদ আল-কাদেরী। এসবই তিনি মুর্শিদের অনুগ্রহে লাভ করেছিলেন।
🔸জশনে জুলুসে ঈদ-এ মিলাদুন্নাবি (ﷺ)-এ নেতৃত্ব দানঃ
কুতুবুল এরশাদ আওলাদে রাসুল হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (র)'র খেদমতে তিনি আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে হুজুরের জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালনের নির্দেশ প্রদান করলে তাঁরই নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে জুলুছ বের হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ময়দানে গিয়ে সমাপ্ত হয়।
🔸আলক্বাদেরি উপাধি লাভঃ
তিনি আপন পীরের কাছে নিজেকে পুরােপুরি সমর্পন করেছিলেন। তিনি যেদিন পীরের বায়'আত গ্রহণ করেন সে দিন থেকে নিজেকে পীরের কাছে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। নিজের বলতে কিছুই দাবী করতেননা। পীরের সাহেবজাদার প্রতিও তিনি যথেষ্ট নিবেদিত। তাই তো তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ হুজুর কেবলা (র)কে সন্তুষ্ট করে “আলক্বাদেরী” খেতাবে ভূষিত হন এবং ১৯৭৬ সালে হুযুর কেবলা (র)'র প্রধান খলীফা হিসেবে খেলাফত প্রাপ্ত হন। এটা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। ত্বরিকতের এ প্রাপ্তি মুক্তির সােপান। মুর্শিদ রাজী হলে আল্লাহ্ রাসুল সন্তুষ্ট হবেন এ কথা যেমন অবধারিত সত্য, তেমনি মুর্শিদের রেজামন্দি হাসিলের জন্য প্রয়ােজন নিঃস্বার্থ ও নিরহংকার মনের নিঃশর্ত আত্ম সমর্পণ।
🔸 সন্তান সন্ততিঃ
হযরত নূর মোহাম্মদ আল-কাদেরী (র)'র এক সুযোগ্য পুত্র আলহাজ্ব মোহাম্মদ মহসিন সাহেব আঞ্জুমান ট্রাস্টের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বে থেকে পিতার আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করে চলেছেন নিষ্ঠার সাথে। তাঁর অপর এক পুত্র সাবের আহমদ গাউসিয়া কমিটির সাথে ওতপ্রোতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তাঁর অপরাপর সন্তান সন্ততিগণও নিষ্ঠার সাথে এ দরবারের খেদমতে নিয়োজিত আছেন।
🔸ওফাতঃ
অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী তাঁর ইন্তিকালের মুহূর্ত। এ সময় তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে, “আমার মুর্শিদে বরহক্ব আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফুলেরমালা হাতে বরণ করে নিতে অপেক্ষা করছেন। এ বলে তিনি ১৯৭৯ সালে ১৪০০ হিজরীর ১৯শে মুহররম সােমবার প্রিয়নবী রসূলে, আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিতে দিতে জান্নাতের চির আতিথ্য গ্রহণ করলেন।
♦️তথ্যসূত্র:
তরজুমান-এ আহলে সুন্নত ওয়াল জাম'আত, মহররম সংখ্যা।
゚