18/12/2024
#প্রিয়_প্রাক্তন
্ব
বিয়ের আগে কান্তা কখনো সন্ধ্যা বেলা ছাদে উঠতো না। কারণ - মা তাঁকে বলতো,
'তিন সন্ধ্যা বেলা ছাদে যেতে হয় না। ভর সন্ধ্যায় তাঁরা (ভূত-প্রেত) ঘুরে বেড়ায় ছাদে। ভুলেও কখনো চুল খুলে ছাদে যাবে না, তাহলে পেত্নী চুলের মুঠি ধরে ছাদ থেকে ফেলে দিবে।'
আজ কান্তার অসম্ভব মন খারাপ। সে ভর সন্ধ্যাবেলা ছাদে গিয়ে কামিনী গাছটির পাশে চুপ করে বসে আছে, ভাবছে, আচ্ছা, এখন কি মায়ের বলা সেই কথা ফলে যেতে পারে না?
আসুক অশরীরী কোন আত্মা,- তাঁকে ফেলে দিক ছাদ থেকে। কি হবে? না হয় মরেই যাবে। বেঁচে থেকে কি এমন হাতি-ঘোড়া হচ্ছে?
টানা তিনবছর প্রেম করে বিয়ে করেছিলো। জীবনে একটাই চাওয়া ছিলো, তা হলো-
তমাল, তাকে দেখেই বুঝতে পারবে, তার মন ভালো- না খারাপ,একটু আহ্লাদী কন্ঠ শুনে-ই বুঝতে পারবে, সে এখন প্রিয় মানুষটার একটু সান্নিধ্য চাচ্ছে। তারমানে বিশেষ কিছু না, একটু জড়িয়ে ধরা, ছোট্ট করে একটা চুমু ব্যস এটুকুই।'
মানুষ যা চায়, তা পায় না। প্রেম করে বিয়ে করলে বোঝাপড়া ভালো থাকবে, একজন আরেক জনের ভালো লাগা মন্দ লাগা সম্পর্কে জ্ঞত থাকবে।
হাসবেন্ড হয়ে গেলে ছেলেরা মনে হয় ছোট-ছোট আদর গুলো ভুলে যায়। বউ একটু গায়ে গা ঘেঁষলেই মনে করে, এখনই বিছানায় শুয়ে পরতে হবে।
ইদানীং তমালের সাথে ছোট-খাটো বিষয়ে এত বেশি কথা কাটাকাটি হয় যে, বিরক্ত ধরে গেছে সংসারে প্রতি।আজ মনটা ফুরফুরে ছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিল তমালকে বলবে,
অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে। তারা রিক্সা করে ঘুরবে। আজ আকাশে ছিলো আধখানা চাঁদ। আধখানা চাঁদ মানে আধো আলো-আধো ছায়া। আকাশ পরিস্কার, কিন্তু জোছনার আলোতে সব ভেসে যাচ্ছে না।
তমালকে কল দিয়েছিলো কান্তা।
তমাল কল রিসিভ করেই প্রথমে যে কথাটা বলেছিলো তা হলো,
- কল দিয়েছো কেন? কিছু লাগলে ম্যাসেজ পাঠাও, আমি বিজি।
এইটুকু বলেই কান্তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দেয়। কান্তা হতভম্ব হ'য়ে যায়! তখন থেকেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।
তমাল অফিস থেকে বের হওয়ার আগে, কল দিয়ে জানতে চায়েছিলো
- কিছু আনতে হলে বলো?
কান্তা তখন ঠান্ডা গলায় বলেছিলো,
-কিছু আনতে হবে না।
তমাল, কান্তার ঠান্ডা গলা শুনে বলেছিলো,
-কিছু আনতে হলে এখনই বলো। বাসায় এসে আর বের হতে পারবো না। কথায়-কথায় রাগ করো কেন? অফিসে কাজের সময় কল দিলে, আমার পক্ষে তো, প্রেমালাপ করা সন্ভব না।
এইটুকু শোনার সঙ্গে-সঙ্গে কান্তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। তমালের সাথে কথা বলার মতো রুচি হচ্ছে না। আজ তমাল বাসায় আসলে কঠিন ঝগড়া হবে। প্রেম করার সময় ছেলেদের এক রুপ, আর বিয়ের পরে আরেক।
আগে তমাল কারণে-অকারণে তাঁকে একটু ছুঁতে চাইতো, আর এখন সব প্রেম মধ্যে রাতের বিছানায়। তাও শুধু মাত্র যে দিন তার চাহিদা থাকে সেদিন, অন্য দিন ঘুম।
কান্তা ভেবে পায় না,ছেলেরা মেয়েদের মনের খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না কেন? কেন একজন স্ত্রীকে তার হাসবেন্ডের ইচ্ছায় সব সময় সাড়া দিতে হবে? দাম্পত্য জীবনের নারীর চাহিদা বলতে শাড়ি, গয়না, পোশাককে কেন বোঝে সবাই? এই কথাটা কান্তার মাথায় আসে না। এমনকি সিনেমা, নাটক, গল্প উপন্যাসে নারীর মানসিক, শারীরিক চাহিদা তুলে ধরা হয় না।
একজন মানুষ, সে নারী-পুরুষ যে কেউ হতে পারে। সারাদিনে বাসা, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে, রাস্তা-ঘাট, সন্তানের স্কুল-কলেজ নিয়ে কত ঝামেলা যে পোহায়। দুইজন মানুষের সারাদিনের ক্লান্তি ভুলার জন্য দরকার সহমর্মিতা। আমাদের সমাজে কয়জন হাসবেন্ড- ওয়াইফ, তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে আধ ঘন্টা সময় একজন আরেকজনকে দেয়?
কয়জন নারী-পুরুষ বলতে পারবে? সপ্তাহে দুই দিন তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে পাঁচ মিনিটের জন্য। এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে যৌনতা থাকে না, এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে থাকে মমতা। এই মমতা টুকু দেখানোর জন্য অফিসের ঝামেলা, বাচ্চার স্কুল, ঘরের কাজ দেখানোর প্রয়োজন হয় না। দরকার হয় ইচ্ছের।
আমাদের সমাজে মেয়েরা, প্রেম-বিয়ে, সংসার সব জায়গায় তাদের রাগ, সংসারের জন্য সীমাহীন মমতা তুলে ধরতে পারে খুব সহজেই, শুধু তাদের একান্ত কিছু চাওয়া তুলে ধরতে পারে না। এভাবেই আমাদের সমাজে নারীরা তৈরি হয়েছে। নারীরা হাসবেন্ডের কাছেও লজ্জা পায় তাদের চাওয়া প্রকাশ করতে।
কারণ -আমাদের সমাজের অধিকাংশ পুরুষ মনে করে, দাম্পত্য জীবনের বিশেষ সময়গুলোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকতে হবে। কারণ-তারা পুরুষ।
কান্তার ইদানীং কিছুই ভালো লাগে না। শুধু মনে হয় মানুষ বাঁচে কয়দিন? কেন সব সময় নিজের ইচ্ছে গুলোকে ইগনোর করতে হবে? ছোটো-খাটো ইচ্ছে গুলোর মূল্য দিত হবে, আনন্দ নিজেকে খুঁজে নিতে হবে। সব কিছুর জন্য তমালের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে কেন ?
একসময় তমালের চাইতে ঢাকা শহরের অলিগলি কান্তা ভালো চিনতো।এমনকি পুরান ঢাকার সব রাস্তা চিনতো। কতদিন সে একা-একা বের হয় না।
আজ তার ইচ্ছে হচ্ছে, এই সংসার ছেড়ে কোথাও চলে যেতে, কোথায় যাবে? তমালের সাথে যখনই তার কোন এলোমেলো ভাবনা, ইচ্ছের কথা শেয়ার করতে চায় তখন-ই তমাল মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, এমন কিছু বলে বসে, যাতে কান্তা রীতি মতো অপমানিত বোধ করে।
যেমন সেদিন তমালের পাশে শুয়ে সে বলছিলো,
-জানো আমার না একা-একা ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়। দূরে কোথাও চলে যেতে মন চায়। হঠাৎ-হঠাৎ ইচ্ছে হয় দুপুর বেলা একা-একা লালবাগের কেল্লায় চলে যাবো। তারপর, কেল্লার দেয়ালের ছায়ায় বসে থাকবো। আমার পুরাতন স্থাপত্যের গন্ধ ভালো লাগে। মনে হয় নির্জন দুপুরে কান পাতলেই বাতাসে শুনতে পাবো, সেই সময়ের মানুষের কথা। তাদের নিশ্বাস আমি অনুভব করতে পারি।
এইটুকু বলার সাথে সাথেই তমাল এত বাজে ভাবে বলে উঠলো,
- কান্তা তোমার বয়স কত?এখনও কি মনে হয় তুমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী? যা খুশি তা-ই করে বেড়াবে। সংসারে মন দাও,তোমার মুখে এইসব শুনলে মানুষ কি বলবে?এমন চিন্তা-ভাবনা করা করে জানো? যাদের ঘর সংসার নাই লাফাঙ্গা, ফালতু মহিলারা।
কান্তা তমালের এই ধরনের কথা শুনলে কি বলবে বুঝতে পারে না। মনে হয়, এটা কিসের জীবন? একটা মনের কথা বলা যাবে না? তাতে মানুষ তাকে ফালতু ভাববে কেন? আর সংসারে মন দাও বলতে কি বুঝাতে চায় তমাল, সারাদিন সংসার নিয়ে কথা বলা। সংসার নিয়ে সে কি বলবে?
তাদের একমাত্র ছেলেকে ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করার জন্য ক্যাডেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যাডেটে চান্স পাওয়ার জন্য, কঠিন নিয়মে রেখে কোচিং, বাসায় পড়া সব তো কান্তাকে-ই দেখতে হয়েছে।
ছেলে হওয়ার পরে ছেলের জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল কান্তা। অথচ তমাল এখন ভাব করে তার বাহিরের দুনিয়া সম্পর্কে কোন ধারণা নাই। অফিস কত শত ঝামেলা, দায়িত্ব তা সে জানে না। কারণ সে গৃহিণী।
হঠাৎ করে কান্তার কি যে হলো, ছয়তলার ছাদ থেকে চিলেকোঠার লোহার সিড়ি বেয়ে সাত তলার ছাদে চলে এলো। বাড়ির ছাদের রেলিঙের সাথে যে কার্নিশটা আছে সেখানে উঠে বসলো। কান্তা কিন্তু অনেক ভিতু, কোন উঁচু জায়গা থেকে নীচে তাকাতে পারে না। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হলো, সে মনে-মনে বললো,
- গোল্লায় যাক, তমাল আর তার সংসার। এমনকি সে বাচ্চাকে নিয়েও আর ভাববে না। প্রতিদিন আস্তে- আস্তে মরার চাইতে এখনই সব শেষ করে দিবো।
ঠিক তখনই কান্তার মোবাইলে একটা কল এলো,
-দ্যাত, এই সময়ে কে কল দিলো!বলে কলটা রিসিভ করার জন্য, কার্নিশ থেকে নেমে দাঁড়ালো।
- হ্যালো কে?
- জি,আমি কি কান্তার সাথে কথা বলছি?
- জি,কান্তা বলছি
- ম্যাডাম, আমি আপনার বাসার কাছে, আপনি কি একটু নীচে আসবেন, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
#লেখাঃসুরাইয়া_শারমিন