03/12/2025
চট্টগ্রামে সাবেক নেভী অফিসারের কোটি টাকার প্রতারণা; চকবাজার 'দ্য রুফটপ পিজ্জা লাউঞ্জে'র পেছনের অন্ধকার গল্প!
চট্টগ্রামের রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি বরাবরই অনন্য। বন্দরনগরীর রাতের আকাশ, পাহাড়ি হাওয়া আর তরুণ প্রজন্মের উৎসবমুখর জীবন নতুন কোনো কফিশপ বা লাউঞ্জ খুললেই যেন শহর ধাওয়া করে সেখানে। ঠিক তেমনভাবেই ইম্পেরিয়াল কমপ্লেক্সের টপ ফ্লোরে গড়ে ওঠা "দ্য রুফটপ পিজ্জা লাউঞ্জ" একসময় ছিল শহরের আলোচনার কেন্দ্র। উন্মুক্ত আকাশ, নরম বাতাস, ছবি তোলার স্পট সব মিলিয়ে পরিবার-বান্ধব আড্ডার জায়গা হিসেবে দ্রুতই জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।
কিন্তু শহরের আলোচনার কেন্দ্র যে একদিন আতঙ্কের প্রতীকে পরিণত হবে—তা কেউ কল্পনাও করেনি। রেস্টুরেন্টটির মালিক মিথুন আহমেদ ও তার স্বামী মোহাম্মদ শোয়াইবকে কেন্দ্র করে যখন একের পর এক ভয়াবহ অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করল, তখন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ চট্টগ্রামবাসী।
ভুক্তভোগীদের বয়ান!
অত্যাচার সইতে না পারে বিগত কয়েকবছরে অনেক কর্মচারী রেস্টুরেন্ট থেকে পালিয়ে যান, কেও আবার চাকরি ছেড়ে দেন। তাদের মধ্যেই একজন সাবেক স্টাফ কাঁপা গলায় বললেন, “স্যার, রান্না ঠিক না হলেই আমাদের রোদে দাঁড় করায়। কখনও দেয়ালের দিকে হাত নিচে, পা ওপরে। আমরা মানুষ না?
আরেকজন চোখ মুছতে মুছতে বলেন “আমি যখন চাকরি ছেড়ে দেই তখন তিনি বেতন পরে দিবে বলে চলে যেতে বলেন। এখন বেতন চাইলে বলে—তোর নামেই মামলা দিব, জেলে দিবো। বেতনের জন্য ডিউস্লিপ চায়, অথচ আমাদের তো কোনো ডিউস্লিপ ই দেয় নাই। আমি এখন স্লিপ দেখাবো কই থেকে ”
আরেকজন সাবেক স্টাফ বলেন, আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা ফুড কার্ট শুরু করি। আমারো অনেক টাকা পাওনা ছিলো। আমি যখন সেই টাকা চাই শোয়াইব বলে আমার রেস্টুরেন্ট থেকে টাকা চুরি করে ফুড কার্ট দিয়েছো। অথচ আমি আমার কষ্টের টাকায় ব্যাবসা শুরু করি। এখন উনি আমাকে চুরির মামলার ভয় দেখায়। মেয়র ডা: শাহাদাতের ঘনিষ্ঠ বলে কিছু বলতেও ভয় লাগে।
একজন সাবেক নারী কর্মচারী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, “আমি যখন চাকরী ছাড়তে চাই, তখন আমার বেতন বাড়ানোর কথা বলে আমাকে যেতে দেয় না। এরপর তিনি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। আমি ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি। ৫ই আগস্টের পর যখন বিশেষ বাহিনী উনাকে তুলে নিয়ে যাই, আমি তখন নেভাল হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করি, আমারো ৫০ হাজারের মত পাওনা ছিলো। নেভাল হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হয় আমাকে আইনী পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু ভয়ে থাকি, আমি তো মেয়ে মানুষ। মেয়রের সাথে ওঠা বসা শোয়াইবের, আমাকে কিছু করলে?
পিজ্জা লাউঞ্জের সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার বলেন,
“শোয়াইব একটা বাটপার, ও যে চাকরি ছেড়ে দেওয়া স্টাফদের বেতনের বাকী টাকা পরিশোধের জন্য ডিউস্লিপ চায়, আমার সেই স্লিপ বানানোর কথা, অথচ আমি নিজেই তো কোনো ডিউস্লিপ বানাই নাই এবং কোনো স্টাফকে ডিউস্লিপ দিতেও দেখি নাই। তাইলে উনি এখন টাকা পরিশোধের সময় ডিউস্লিপ কিভাবে খোঁজে! আমি নিজেও তো ১২ হাজার টাকা পাই, আমার স্লিপ কই? আমি গ্রাফিক্স ডিজাইনার হলেও পুরো রেস্টুরেন্টের সব কাগজ আমি হ্যান্ডেল করতাম। ব্যাংক থেকে থেকে শুরু করে ভিসা প্রসেসিং, সব তো আমি করতাম। রেস্টুরেন্টের প্রত্যেকটা কাগজ আমার হাত দিয়েই যেতো। ডিউস্লিপ নামে কিছু আমি থাকাকালীন অবস্থায় দেখি নাই।”
ইনভেস্টরদের সাথে প্রতারণা!
শুরুর দিকের একজন ইনভেস্টর কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন “নেভী অফিসার পরিচয় দিয়ে কথা বলত। ভেবেছিলাম বিশ্বাসযোগ্য লোক। কিন্তু লভ্যাংশের নামে ভুয়া চেক ধরিয়ে দিল! তাও একবার না বারবার। লভ্যাংশ না-হয় বাদ দিলাম। আমার ইনভেস্টমেন্ট ফেরতের চুক্তি শেষ হয় দুই মাস আগে, এর মাঝে টাকা চাইতে গেলে আমাদের তিনি রেস্টুরেন্টে সবার সামনে অপমান করেন, অনেক বাক বিতন্ডা হয়। বারবার মেয়রের পরিচয় দিতে থাকেন। পরে তিনি আমাদের মেয়র অফিসে ডাকান, সেখানে মেয়রের সচিব জিয়া ভাই এর সামনে তিনি বলেন নভেম্বরে তিনি পুরো টাকা ফেরত দিবেন। ৩ টা চেকও দেন। টাকা দেওয়ার সময় হলে তিনি আবার আমাকে একটা ম্যাসেজ দেন। এই সপ্তাহে দেওয়া সম্ভব না, আমি যেনো চেক এখন না ভাঙ্গাই। পরের সপ্তাহ (৬/১১/২৫) তিনি যেতে বলেন এবং এই বিষয়ে তিনি নাকি মেয়র ডা শাহাদাতের একান্ত পিএস জিয়া ভাই কে জানিয়েছেন উনার আরো এক সপ্তাহ লাগবে আমার ১৫ লাখ টাকার প্রথম ইন্সটলমেন্ট দিতে। নভেম্বর এখন শেষের দিকে। শোইয়াব কিংবা সচিব জিয়া ভাই কেওই এখন আমার ফোন ধরে না। এর আগেও লভ্যাংশ দেওয়া নিয়ে তিনি এক বছর আমার সাথে একি ঘটনা করেন। আজকে কালকে এভাবে এক বছর চলে গেলো, শুরুতে দুই তিনবার লভ্যাংশ দিয়ে এরপর আর খোঁজ নাই। এখন আমি আমার ১৫ লাখ টাকা কিভাবে ফেরত পাবো ”
অন্য আরেকজন ইনভেস্টর হতাশ হয়ে বলেন,
“কি আর বলবো শোয়াইবকে নিয়ে, ও একটা ক্রিমিনাল। আমি তো জানতাম না এতকিছু। পরিচয় দিতো নেভী অফিসার, তাই বিশ্বাস ছিলো অগাধ। পরে আমার ইনভেস্ট আর লভ্যাংশ নিয়েও যখন কথা ঠিক রাখতে পারে না আমি একটু খোঁজ খবর নেই ওর ব্যাপারে। জানতে পারি এর আগেও ও রাঙ্গামাটি তে জায়গা জমি নিয়ে প্রতারণা করে এসে চট্টগ্রামে এসে নতুন করে চকবাজারে রেস্টুরেন্টটি দেয়। টাকার আশা তো ছেড়েই দিয়েছি। আইনী পদক্ষেপ নিবো তাও ভয় করে, মেয়রের ঘনিষ্ঠ কখন কি করে! এর আগেও অনেকবার আমাকে বলেছে এখন টাকা নাই পরে দিবো, ব্যাবসা ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসা ভালো না গেলে নতুন আরেকটা রেস্টুরেন্ট “পাচঁফোড়ন” কিভাবে দিলো?
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, “ওয়াকি-টকি হাতে নিয়ে যখন চলত, মনে হত রেস্টুরেন্ট না,কোনো ক্যাম্প! শুনেছিলাম নেভী অফিসার ছিলো, সম্মান করতাম। পরে যখন ৫ই আগস্টের পর কারা যেনো ওকে আটক করে তখন আমরা জানতে পারি ও একটা প্রতারক। অনেকেই তখন ওর ব্যাপারে আমাদের কাছে খোজ নিতে আসে, তখন জানতে পারি উনি দশ জায়গা থেকে টাকা নিয়ে দুইজন কে খুশি রাখেন, পরে আবার দশ জায়গা থেকে নেভী অফিসার এবং রেস্টুরেন্টের পরিচয় দিয়ে আবার ইনভেস্ট নেন, এরপর বাকি যারা ছিলো কাওকে ইচ্ছা হলে টাকা ফেরত দেন, মন না চাইলে ঝুলিয়ে রাখেন। গাড়ীটাও কিনেছে শুনলাম ব্যাংক লোন করে। ”
আরেকজন ব্যাবসায়ী ক্ষোভে বলেন, “বিল্ডিংয়ের সামনের সরকারি রাস্তাও নিজের এলাকা বলে দখল করেছে! গাড়ি পার্ক করে রাখে। মেয়রের নাম বলে ভয় দেখায় মানুষকে।”
মোহাম্মদ শোয়াইব দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে বাংলাদেশ নেভীর সাবেক অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিল। এই পরিচয়ের আড়ালেই চলত কর্মচারী নির্যাতন, নারী হেনস্তা, বেতন আটকে রাখা, ভুয়া চেক দিয়ে প্রতারণা, ইনভেস্টরদের টাকা আত্মসাৎ, রাস্তা দখল, ভয়ভীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে;
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, “ভুয়া পরিচয়, প্রতারণা, নারী কর্মী হেনস্তা, কর্মচারী নির্যাতন এবং আর্থিক জালিয়াতি—সব অভিযোগ নিয়ে মামলা হলেই তদন্ত শুরু হয়ে যাবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এর আগেও ৫ আগস্ট এর পর বিশেষ বাহিনী কর্তৃক শোয়াইবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছিল।
একটি রেস্টুরেন্ট, যা এখন প্রতারণা ও আতঙ্কের প্রতীক। একসময় যার ছাদের নিচে হাসির শব্দ ভেসে আসত, আজ সেই দ্য রুফটপ পিজ্জা লাউঞ্জ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে নির্যাতন, প্রতারণা আর ভয় দেখানোর আরেক অন্ধকার গল্প।
ভুক্তভোগীরা আজও আতঙ্কে কথা বলেন, ইনভেস্টররা দিশাহারা, ব্যবসায়ীরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ।
একটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের আড়ালে যে ভয়াবহতার গল্প লুকিয়ে ছিল এই তদন্ত এগোলে হয়তো সামনে আসবে আরও বহু অজানা অধ্যায়।