
19/08/2025
বয়ঃসন্ধি শব্দটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ত্রিশের পরের জীবনটাকে আমরা কোনো নামই দিইনি। অথচ এই বয়সটাও একরকম নতুন জন্ম। বুড়ো না, আবার তরুণও না। সংসার, দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা-সবকিছু মিলে এটি এক অদ্ভুত বয়স।
ত্রিশ পেরোনো নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্তত ৬-৭ বছরের সংসারী। কারো এক-দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার পরও ভেতরের কিশোরী মনটা রয়ে যায় ঠিকই। সেই কিশোরী মনকে দমিয়ে রাখার ক্লান্তিকর চেষ্টার মধ্যেই কেটে যায় প্রতিদিন। সমাজ তাকে আর কিশোরী হতে দেয় না, অথচ মনের ভেতরে সেই চঞ্চলতা অটুট থাকে।
দিন শেষে যখন রান্নাঘর নিভে যায়, অফিসের ফাইল গুছিয়ে রাখা হয়, তখন মনের কোণে জমা হয় না পাওয়া গল্পগুলো। কে শোনে সেইসব? সংসারের লোকজন? তারা তো সবাই ব্যস্ত। বন্ধুত্ব নেই বললেই চলে। একসময় যে বন্ধুত্বগুলো প্রাণের সমান ছিল, ত্রিশ পেরোনো জীবনে সেগুলো কেবল স্মৃতির পাতায় আটকে থাকে।
ত্রিশের পর নারীরা এক অদ্ভুত রোগে ভোগে-নস্টালজিয়া। শৈশব, কৈশোর, কলেজজীবন, প্রথম প্রেম, বৃষ্টিভেজা দুপুর -সবকিছু অকারণেই মনে পড়ে যায়। একসময় যে মানুষ কষ্ট দিয়েছে বা যার কষ্ট সে দিয়েছে, তাকেও ভুলতে পারে না। রাতের অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে অচেনা লাগে। চুল পড়ে গেছে, মুখে বলিরেখা, শরীরে মেদ-সব মিলিয়ে একসময়কার মেদহীন সুন্দরী শরীরটা কেবল স্মৃতিতে রয়ে যায়।
হয়তো এ কারণেই অনেকে সাজগোজে, শাড়ি-গয়নায় নিজেকে লুকোতে চায়। এটা আত্মপ্রেম নয়, বরং বিষণ্ণতা ঢাকার উপায়।
ত্রিশ পেরোনো নারীরা হঠাৎ প্রেমে পড়তে চায় না। তারা আসলে চায় একজন শ্রোতা-যে কোনো জাজমেন্ট ছাড়াই সব কথা শুনবে। সংসারে থাকা মানুষটিকেই আবার নতুন করে পেতে চায়। চোখের তারা হয়ে থাকার সাধ আবার জাগে। কিন্তু বাস্তবতা কানে কানে বলে দেয়-সবকিছু আগের মতো আর হয় না।
এই বয়সে বাবা-মায়ের অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, তারাও চান না মেয়েটা অতিরিক্ত অধিকার খাটাক। অথচ ভেতরে ভেতরে মেয়ে হয়ে যতটুকু আদর পেতে ইচ্ছে করে, তা আর বলা হয়ে ওঠে না। নিজের সন্তানদের আঁকড়ে ধরে সে অন্যরকম সমাজের স্বপ্ন বুনে চলে।
ত্রিশ পেরোনো কোনো নারী যদি অবিবাহিতা হয়, সন্তান না থাকে, কিংবা ডিভোর্সি হয়, তবে সমাজ তাকে নিয়ে অযথা চিন্তিত হয়ে পড়ে। অথচ যে মেয়েটা সংসার করছে, বাচ্চা সামলাচ্ছে, তার মনের খবর কে রাখে? কে জিজ্ঞেস করে-কেমন আছো? আজ তোমাকে ক্লান্ত লাগছে কেন?
আজকাল মেয়ে মানেই ফাইন্যান্সিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার ডাক। কিন্তু ত্রিশ পেরোনো নারী বুঝে যায়-শুধু আর্থিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়। অর্থ থাকলে সময় থাকে না, সময় থাকলে অর্থ থাকে না। তাছাড়া সমাজ তো কখনোই পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয় না। মেয়েরা যতই উপার্জন করুক, মানসিকভাবে সমাজের শেকল ভাঙা কঠিন।
এ বয়সে প্রায়শই মন চায় একা থাকতে। নিজের মতো করে। কোনো দায়িত্ব ছাড়া। অথচ মুহূর্তের মধ্যেই সন্তানদের মুখ মনে পড়ে যায়। মায়ের সবচেয়ে বড় ভয় হলো মৃত্যু-কারণ সন্তানদের ছাড়া চলে যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না।
ত্রিশের কাছে এসে মেয়েদের সবুজ মন ধীরে ধীরে নীল হয়ে যায়। যে মেয়ে সামান্য আঘাতেই কেঁদে ফেলত, সে নিঃশব্দ কান্না করতে শিখে যায়। যে মেয়ে আগে স্বপ্নে ভরা ছিল, সে এখন ব্যালান্স করতে করতে নিজের স্বপ্নই ভুলে যায়।
এক,দুই বা তিনবার সন্তান জন্ম দেওয়ার ধকল শরীরের উপর যে কতটা প্রভাব ফেলে, তা সে-ই বোঝে। মেরুদণ্ডে ইনজেকশন, অস্ত্রোপচারের ব্যথা-সব সহ্য করেও রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে, সন্তান সামলে, সংসারের চাকায় সে ঘুরতেই থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরা অসুস্থ হলে তার কষ্টকে গৌণ মনে হয়। অথচ সে-ও চায়, কেউ একবার জিজ্ঞেস করুক-আজ তোমার শরীরটা কেমন আছে?
ত্রিশ পেরোনো নারীর মনের সবচেয়ে গভীর চাহিদা হলো যত্ন। তারা খুব সামান্য কিছুই চায়-কেউ যদি বলে "আজ তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে" বা "তুমি অনেক কষ্ট করো"- এটুকুই তার কাছে বিশাল প্রাপ্তি।
ত্রিশ পেরোনো নারীর জীবন হলো নীরব এক সংগ্রাম। সমাজ তাকে নানা নামে ডাকতে ভালোবাসে-মা, স্ত্রী, কর্মজীবী নারী। কিন্তু তার ভেতরের মানুষটিকে চেনে কয়জন? এই বয়সে নারীরা শুধু দায়িত্ব নয়, একটু যত্ন, একটু বোঝাপড়াও প্রাপ্য। আমরা যদি সেটা মনে রাখতে পারি, তবে ত্রিশ পেরোনো জীবনের নাম হয়তো একদিন পাওয়া যাবে-আর সেই নাম হবে আত্মিক পরিপূর্ণতার আরেক নাম।
゚viralシ ゚ ゚