07/10/2025
আমি শিবানী সাহা অনেক ভাগ্যবতি,আমার ছেলে আামাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়নি। তার সাথেই আমাকে রেখেছে। একটা মাত্র ছেলে আমার।ছোটবেলায় খুব নেওটা ছিলো । এখন বড় হয়েছে। মস্ত বড় ডাক্তার আমার ছেলে। কত নাম ডাক তার?সবাই এক নামে চিনে। আর বৌ ও পেয়েছি সোনায় সোহাগা। সেও বড় ডাক্তার। সারাদিন ব্যস্ততা, আমাকে কোথাও পাঠানোর সময়ও তাদের নাই।
নাতি নাতনি দুটো আমার কাছেই থাকে সারাদিন।স্কুলে নিয়ে যাওয়া সময়মতো স্কুল থেকে আনা, গোছল করানো রুটিন মাফিক খাওয়ানো সব দায়িত্ব আমার।
বৌমাও বেশ ভালো।সবার সাথে মিশে,খুব মিশুক।
বৌমা মাঝে মাঝেই বলে, "মা আপনি খুব লাকি, আমরা আপনাকে বাসায় রেখেছি।আমার বোনদের সবার শশুর শাশুড়ী বৃদ্ধাশ্রমে থাকে।অবশ্য তাদের শশুর শাশুড়ী সংসারের কোন কাজে আসেনা।একেবারেই বয়স্ক- অকেজো।"
আমি আমার ছেলের সংসারের কাজ দায়িত্ব নিয়েই করি,অবহেলা করিনা।হাটুর ব্যাথায় কষ্ট পেলেও অর্থোপেডিক ডাক্তার ছেলেকে কখনো বলিনা ব্যাথার কথা। ফার্মেসী থেকে প্যারাসিটামল এনে খেয়ে পরে থাকি। যদি বৌমা মনে করে আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবেনা। আমি তাই সবসময় নিজেকে সচল রাখি।নিজেকে অকেজো হতে দিইনা।
সেদিন সুমন মানে আমার ছেলে বলেছিল,"কত আরাম তোমার মা!!এসি গাড়ীতে করে স্কুলে যাও।
আমি ছেলে মেয়েদের আরামের জন্য গাড়ী কিনেছি।তুমি সেই গাড়ী দিয়ে ওদের স্কুলে দিয়ে আসো।"
আর আমি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি,তুমি কোন দিন একটা রিক্সাও নিতে দাওনি।।রোদেপুড়ে আমি কত কষ্ট পেতাম।তোমারতো কোন মায়া ছিলো না আমার জন্য।শুধু টাকা জমানোর ধান্দায় ছিলে।
ছেলের কথায় বৌমা যেন আরও মজা পায়,বলে আপনি এক ছেলের পিছনে সারা জীবন যা খরচ করেছেন,আমরা এক সপ্তাহে ছেলে মেয়ের পিছনে এর চেয়ে বেশি খরচ করি।আপনার ছেলেতো বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ালেখা করেছে।আপনারতো তেমন খরচ হয়নি।
কিছু বলিনা ,মনে হয় এইতো ভালোইতো আছি। অকালে স্কুল মাস্টার স্বামী গত হয়েছিলেন।ভাগ্যিস লেখাপড়া জানতাম, টিউশনি আর সেলাই করে একমাত্র ছেলেকে মানুষতো করেছি।কেউতো বলতে পারবেনা বাবাছাড়া ছেলে অমানুষ হয়েছে।আমাদের সমাজে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলেই লোকে তাকে মানুষ হওয়া বলে! সুমনের এক বছর বয়সেইতো হঠাৎ লোকটা সাপের কামড়ে চলে গেলো।
কতজন বলল, নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে,পারিনি লোকটার মায়াময় চোখদুটো সব সময় ভাসতো চোখে। আহারে! যখন তাকে কেউটে কামড় দিলো,সাথে সাথেই ক্ষতস্হান বেঁধে ওঝা ডাকা হলো,
ওঝা এসে বাঁধন খোলতে চাইলে, তিনি বাঁধনটা খুলতে চায়নি বলেছিলো, শিবানী বাঁধনটা খুললেই আমি মরে যাবো।ওঝা ওর কথা শুনেনি বাঁধনটা খুলে দিতে পীরাপীরি করতে লাগলো।সাথে যোগদিলো শশুড় বাড়ীর সবাই। লোকটা তখন আমাকে কাছে ডেকে সুস্হ মানুষের মতো বলল--
"শিবানী, আমার কিছু হলে ছেলেটাকে তুমি দেখো।তাকে ডাক্তার বানাবে।বড় ডাক্তার।"
আমি আমার স্বামীকে দেয়া কথা রেখেছি।দিনরাত পরিশ্রম করে ছেলে মানুষ করেছি।
হ্যাঁ আমি কৃপনের মতো করে টাকা জমিয়েছি,একটা জয়গা কেনা জরুরী ছিল,বাবা হারা ছেলে নিয়ে আমি অথৈ সাগরে পরেছিলাম।স্বামী মারা যাওয়ার পর সকল আপনজন পর হয়ে গেলো।
লোকটা টিউশনি করতো,অংকের মাষ্টার, খুব নামকরা অঙ্কের মাস্টার। তাই বেশ কিছু ছাত্র ছিল।সেসময় বুদ্ধি করে দুঃসময়ের জন্য ব্যাংকে কিছু টাকা জমিয়েছিলো।বিধবা হওয়ার পর এই টাকাগুলোই ছিলো আমার সম্বল।যক্ষের ধনের মত এই টাকাটা আমি রক্ষা করেছি। নিজে অনেক কষ্ট করেছি কিন্তু একটা টাকাও খরচ করিনি।সেই টাকার ভাগের জন্য কতো মানষিক নির্যাতন সহ্য করেছি, লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।
আস্তে আস্তে শ্বশুর বাড়ীতে থাকা যখন অসম্ভব হয়ে গেলো তখন,এই টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছি,থাকার জন্য ছোট একটা ঘর করেছি।
আজ সেই জায়গায় আমার ছেলে বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ী বানিয়েছে। বিশাল বড় বাড়ী।আমার ছেলের বাড়ী।
আজ আমি ছেলের সাথেই থাকি।আমার বানানো ছোট ঘর দুটো এখনো আছে।ভেঙে ফেলতে দিইনি।বৌমাও বলছিলো" থাকুক ঘরটা মা থাকবে।"একটাতে আমি থাকি, আরেকটাতে ড্রাইভার ছালাম তার মাকে নিয়ে থাকে।
সারাদিন নাতি নাতনির সেবা করি, রাতে ওরা চেম্বার থেকে আসলে নিজের ঘরে চলে আসি,আমার স্বামীর টাকায় বানানো ঘরে।
আমি শিবানী সাহা,অনেক ভাগ্যবতি,আমি ছেলের সাথে থাকি বৃদ্ধাশ্রমে থাকিনা।
ছোটগল্প
শিবানী সাহা নিজের ঘরেই থাকে।
সুস্মিতা মিলি
সংগৃহীত